প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

৩৮. সহজিয়া ও অন্যান্য সম্প্রদায় প্রসঙ্গে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী

সহজিয়া ও অন্যান্য সম্প্রদায় প্রসঙ্গে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী

আমরা শুরুতেই দেখেছি, মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলছেন যে, নামান্তরের আড়ালে লোকায়তিক সম্প্রদায় আজো আমাদের দেশে টিকে রয়েছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি সহজিয়া-সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ করছেন। অতএব, লোকায়তর আলোচনায় আমাদের পক্ষে এই সহজিয়া সম্প্রদায়ের স্বরূপকে বোঝবার চেষ্টা করা দরকার।

সহজিয়া বলতে ঠিক কী বোঝায়? সহজিয়া সম্প্রদায় এলো কোথা থেকে? মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও বলছেন, এই সহজিয়া সম্প্রদায় বা সহজযান আসলে হলো বৌদ্ধধর্মের অধঃপাতের ফল :

যে পঞ্চকামোপভোগ নিবারণের জন্য বুদ্ধদেব প্রাণপণে চেষ্টা করিয়াছিলেন, যে চরিত্র-বিশুদ্ধি বৌদ্ধধর্মের প্রাণ, যে চরিত্রবিশুদ্ধির জন্য হীনযান হইতেও মহাযানের মহত্ব, যে চরিত্র বিশুদ্ধির জন্য আর্যদেব ‘চরিত্র বিশুদ্ধি প্রকরণ’ নামে গ্রন্থই রচনা করিয়া গিয়াছেন, সহজযান সেই চরিত্রবিশুদ্ধি একেবারেই পরিত্যাগ করিয়া দিল। বৌদ্ধধর্ম সহজ করিতে গিয়া, সহজযানীরা যে মত প্রচার করিলেন তাহাতে ব্যভিচারের স্রোত ভয়ানক বাড়িয়া উঠিল। ক্রমে বৌদ্ধধর্ম নেড়ানেড়ীর দলে গিয়া দাঁড়াইল। সহজযানীরা সন্ধ্যাভাষায় গান লিখিতে আরম্ভ করিলেন। সন্ধ্যাভাষার অর্থ আলো-আঁধারী ভাষা। কানে শুনিবামাত্র একরকম অর্থ বোধ হয়, কিন্তু একটু ভাবিয়া দেখিলে তাহার গূঢ় অর্থ অতি ভয়ানক। তাঁহারা দেহতত্ত্বের গান লিখিতে আরম্ভ করিলেন।…যে বোধিচিত্ত মহাযানমতে নির্বাণ পাইবার আশায় ক্রমেই আপনার উন্নতি করিতেছিলেন, দেহতত্বের মধ্যে আসিয়া তাহার যে কী দশা হইল তাহা আর লিখিয়া জানাইব না। জানাইতে গেলে সভ্যতার সীমা অতিক্রম করিয়া যাইতে হয়।

দেহতত্ত্বের আলোচনায় আমরা পরে প্রত্যাবর্তন করবো। আপাতত দেখা যাক, মহামহোপাধ্যায় বৌদ্ধধর্মের এই ভয়াবহ অধঃপতনের কী ব্যাখ্যা দিচ্ছেন(৬৩৮) :

বৌদ্ধধর্মে অনেকদিন হইতেই ঘূণ ধরিয়াছিল। বুদ্ধদেব নিজে যেদিন স্ত্রীলোকদিগকে দীক্ষা দিয়া ভিক্ষুণী করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন—সেইদিন হইতেই তাঁহাকে সঙ্ঘের বিশুদ্ধি রক্ষার জন্য অনেক কঠোর নিয়ম করিতে হইয়াছিল। তিনি ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীদের এক বিহারে থাকিতে দিতেন না। কিন্তু তাহার মৃত্যুর পাঁচ ছয় শত বৎসর পর হইতে ভিক্ষু্রা ক্রমে বিবাহ করিতে লাগিল—ক্রমে একদল গৃহস্থ ভিক্ষু হইল। এইখান হইতেই ঘূণ ধরা আরম্ভ হইল। ভিক্ষুর ছেলে—সে একেবারেই ভিক্ষু হইত।…আমাদের দেশে যেমন ‘জাত বৈষ্ণব’ বলিয়া একটা জাতি হইয়াছে—সেকালেও তেমনি ‘জাত ভিক্ষু’ বলিয়া একটা জাতির মত হইয়াছিল। উহাদের যত দলপুষ্ট হইতে লাগিল, আসল ভিক্ষুদের অবস্থা তত হীন হইতে লাগিল। গৃহস্থ ভিক্ষুরা কারিগরি করিয়া জীবন নির্বাহ করিত–ভিক্ষাও করিত—কেহ বা রাজমজুর হইত, কেহ বা রাজমিস্ত্রী হইত, কেহ বা চিত্রকর হইত, কেহ বা ভাস্কর হইত, কেহ বা স্যাকরা হইত, কেহ বা ছুতার হইত—অথচ ভিক্ষাও করিত, ধর্মও করিত, পূজাপাঠও করিত। বৌদ্ধধর্মের পৌরহিত্যটা ক্রমে নামিয়া আসিয়া কারিগরদের হাতে পড়িল।…লেখাপড়, বিদ্যাবুদ্ধির নামগন্ধ পর্যন্ত বৌদ্ধদের মধ্যে লোপ পাইল।

প্রশ্ন হচ্ছে, মহামহোপাধ্যায়ের এই অনুমান যদি নির্ভুল হয় তাহলে এ-থেকে ঠিক কী সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব? এই প্রশ্নের জবাব পেতে হলে ওই তথাকথিত অধঃপতনের স্বরূপটিকে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

ওই ‘অধঃপতিত’ বৌদ্ধধর্মের রূপটিকে বিশ্লেষণ করে কি তার মধ্যে শুধুমাত্র স্থূলবুদ্ধি, নিবুদ্ধি এবং নিরক্ষরতার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে? না, এমন কিছু কিছু নির্দিষ্ট আচার-অনুষ্ঠান এবং বিশ্বাসের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে যার সঙ্গে ইতিপূর্বেই আমাদের পরিচয় ঘটেছে?

যদি প্রথম সম্ভাবনাটি ঠিক হয় তাহলে মানতে হবে, প্রাকৃতজনের সংস্পর্শে এসে বৌদ্ধধর্মের মহত্তর ও বৃহত্তর আদর্শগুলির স্থূল-ব্যাখ্যা শুরু হয়েছিলো। কিন্তু যদি দ্বিতীয় সম্ভাবনাটি ঠিক হয়—যদি দেখা যায় বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে সম্পর্কহীন এবং জাত-আলাদা কিন্তু সুনির্দিষ্ট কতকগুলি আদিম বিশ্বাস ও অনুষ্ঠান তথাকথিত অধঃপাতে-যাওয়া বৌদ্ধধর্মের প্রাণবন্তু হয়ে দাঁড়ালো—তাহলে স্বীকার করতে হবে, সমাজের নিচের মহলের মানুষদের উপর বৌদ্ধধর্মের প্রভাব এসে পড়া সত্ত্বেও তাদের চিন্তাচেতনায় এই বৌদ্ধধর্ম কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। অর্থাৎ, সমাজের নিচের মহলের ওই মানুষদের বিশ্বাসাদির উপর যদিও কৃত্রিমভাবে বৌদ্ধধর্মের প্রলেপ এসে পড়লো তবুও তারা আসলে তাদের আদিম বিশ্বাস এবং আচার-অনুষ্ঠান নিয়েই মেতে রইলো। এই সম্ভাবনা অনুসারে সহজিয়া-সম্প্রদায়কে অধঃপতিত বৌদ্ধধর্মের পরিচায়ক বলে মনে না করে কৃত্রিম বৌদ্ধপ্রভাবের পরিচায়ক মনে করাই সঙ্গত হবে।

শোনা যায়, আধুনিক যুগে খৃস্টান পাত্রীরা সাঁওতালদের খৃস্টধর্মভূক্ত করবার পরও তারা নিজেদের পুরোনো পুজো-পার্বণ পরিত্যাগ করে না। পুরোনো-পূজাপার্বণ-রত ওই আধুনিক যুগের খৃস্টান-সাঁওতালদের দৃষ্টান্ত কি খৃস্টধর্মের অধঃপতনের পরিচায়ক হবে? না, পুরোনো ধ্যানধারণাকে অনেকাংশে অক্ষুন্ন রেখে তারই উপর খৃস্টধর্মের কৃত্রিম প্রলেপের পরিচায়ক হবে?

আমাদের মন্তব্য হলো, সহজিয়া সম্প্রদায়ের উপর বৌদ্ধতত্ত্বের ওই প্রলেপটাই কৃত্রিম এবং অর্বাচীন। তাই একে বৌদ্ধধর্মের অধঃপাতের পরিচায়ক না বলে বরং আদিম জাদুবিশ্বাসের কৃত্রিম বৌদ্ধসংস্করণ মনে করাই স্বায়সঙ্গত। এবং আমাদের কাছে এই প্রভেদটি তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, বৌদ্ধধর্মের অধঃপতনের পরিচায়ক হিসেবে গ্রহণ করলে এ-সম্প্রদায়ের মূল কথাগুলিকে বোঝবার সময় বৌদ্ধধর্মের মৌলিক তত্ত্বের উপরই দৃষ্টি আবদ্ধ রাখতে হবে এবং দেখতে হবে একদা-মহৎ কতকগুলি ধ্যানধারণা কীভাবে অশিক্ষিত ও মুর্থ মানুষদের চেতনায় স্থল ও বিকৃত অর্থে প্রতিভাত হয়েছে। কিন্তু বৌদ্ধ-পরিভাষায় কৃত্রিমভাবে সজ্জিত এক আদিম বিশ্বাসের পরিচায়ক বলে গ্রহণ করলে এই সম্প্রদায়ের আলোচনা প্রসঙ্গে ওই বৌদ্ধ-পরিভাষাগুলিই অপ্রাসঙ্গিক বলে স্বীকৃত হবে এবং সে-ক্ষেত্রে এই সম্প্রদায়ের স্বরূপ উপলব্ধির উদ্দেশ্যে স্বতন্ত্র পদ্ধতি গ্রহণ করবার প্রয়োজন হবে।

আমরা ইতিপূর্বে কৃষিকেন্দ্রিক আদিম বিশ্বাস ও অনুষ্ঠানের আলোচনা করবার চেষ্টা করেছি। সহজিয়া-সম্প্রদায়ের মূল তত্ত্বগুলির বিচার করেও সেই নির্দিষ্ট বিশ্বাস ও অনুষ্ঠানের পরিচয় পাওয়া যায় কি না তা একটু পরেই দেখবো। কিন্তু তার আগে আমরা এটুকু বলে নিতে চাই, মহামহোপাধ্যায়ের নিজের রচনাতেই এমন ইঙ্গিত খুঁজে পাওয়া যায় যে-ইঙ্গিত অনুসারে সমাজবিকাশের পিছনদিককার পর্যায়ে আটকে পড়ে থাকা মানুষদের মধ্যেই এই বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানের স্পষ্টতর স্বাক্ষর খুঁজে পাওয়া সম্ভবপর।

মহামহোপাধ্যায়(৬৩৯) প্রশ্ন তুলছেন, বৌদ্ধধর্ম কোথায় গেল? উত্তরে তিনি করছেন, প্রধানত মুসলমান আক্রমণের দরুনই বাংলাদেশ থেকে বৌদ্ধধর্ম বিলুপ্ত হয়। কিন্তু তা সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়নি। উড়িষ্যার জঙ্গলে, চট্টগ্রামের রাঙামাটিতে আজো ওই বৌদ্ধধর্মের (অর্থাৎ মহামহোপাধ্যায় যাকে অধঃপতিত বৌদ্ধধর্ম বলছেন তার) জীবন্ত নিদর্শন পাওয়া যায়। এই অঞ্চলগুলি যে প্রধানতই দেশের পিছিয়ে-পড়া মানুষদের অঞ্চল সে-কথা প্রমাণ করবার প্রয়োজন নেই। কেবল প্রশ্ন হলো, মহামহোপাধ্যায় যে-সব ধ্যানধারণাকে অধঃপতিত বৌদ্ধধর্মের পরিচায়ক বলে অনুমান করছেন সেগুলি টিকে থাকবার মতো স্বাভাবিক জমি কেন এই পিছিয়ে-পড়া পর্যায়ের মানুষদের মধ্যেই পেলে? এইদিক থেকেও, ওই পিছিয়ে-পড়া পর্যায়ের সঙ্গে এ-জাতীয় ধ্যানধারণার একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক অনুমান করা সঙ্গত নয় কি?

শুধু তাই নয়, ওই সহজিয়া সম্প্রদায়ের আলোচনা প্রসঙ্গে অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয়(৬৪০) বলছেন, এ-জাতীয় সম্প্রদায় একটি নয়, বহু। পূর্ববঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে নানান নামের অন্তরালে মূলত এই একই সম্প্রদায়কে টিকে থাকতে দেখা যায় : কর্তাভজা, বাউল, বৈষ্ণব এবং আরো অনেক নাম। এবং শ্ৰীযুক্ত পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়(৬৪১) এই জাতীয় সম্প্রদায়গুলির মধ্যে তত্ত্বগত সাদৃশ্যের প্রতিও আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন : “সহজিয়া, বৈষ্ণব, শৈব, কিশোরীভজা, কর্তাভজা, পরকীয়া সাধনা—সবই রিরংসার উপর প্রতিষ্ঠাপিত।” এবং আমাদের যুক্তি অনুসারে এই জাতীয় পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়াই স্বাভাবিক। কেননা, উক্ত ধ্যানধারণার উৎসে যদি কৃষিকেন্দ্রিক জাদুঅনুষ্ঠানই বর্তমান থাকে এবং যদি বাংলা দেশের কৃষকদের উৎপাদন-পদ্ধতিতে খুব বড়ো রকমের মৌলিক উন্নতি দেখা না দিয়ে থাকে, তাহলে তাদের নানান দলের চেতনায় উক্ত ধ্যানধারণাগুলির প্রভাব নানান নামে প্রতিভাত হওয়াই সম্ভব এবং স্বাভাবিক।

অবশ্যই অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সেন নিজেও এই সহজিয়া সম্প্রদায়কে বৌদ্ধধর্মেরই স্মারক বলে গ্রহণ করতে চান। তবুও তাকে স্বীকার(৬৪২) করতে

হচ্ছে যে, আধুনিক বিদ্বানদের এই সিদ্ধান্তটি সহজিয়াদের নিজেদের কাছে অজ্ঞাত :

The Sahajias would by no means confess that they were Buddhists, nor refer to any Buddhist texts which would make it far easier to trace the doctrines to their genuine origin…… It is the duty of a historian and scholar to thrash out grains from the chaff and find out the true Buddhist elements in their views and practices.
অর্থাৎ, সহজিয়ারা কিছুতেই স্বীকার করবে না যে তারা আসলে বৌদ্ধ। তার কোনো বৌদ্ধ গ্রন্থেরও উল্লেখ করবে না—তাহলে তাদের মতের প্রকৃত উৎস খুঁজে পাওয়া সহজ হতো।…ঐতিহাসিক ও বিজ্ঞানের কর্তব্য হলো, ধানকুটে চাল বের করবার মতো করেই সহজিয়াদের মতবাদ ও আচার-অনুষ্ঠান থেকে প্রকৃত বৌদ্ধধর্মের অঙ্গগুলিকে খুঁজে বের করা।

ধান কুটে চাল বের করা। আমাদের যুক্তিও ঠিক তাই। কেবল কোন্‌টে চাল আর কোন্‌টে তুষ—এই নিয়ে তফাত। আমরা বলতে চাইছি, ওই বৌদ্ধধর্মের অঙ্গগুলিই তুষের মতো—সহজিয়ার স্বরূপ নির্ণয় করতে হলে এই তুষই বাদ দিতে হবে।

বাদ দিলে কী পড়ে থাকে? কৃষিকেন্দ্রিক জাদুঅনুষ্ঠান।

অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সেন সহজিয়া সম্প্রদায়ের মতবাদ ও আচারঅনুষ্ঠানকে ভালো করে বিশ্লেষণ করবার কথা বলছেন। তাঁর এই নির্দেশ মেনেই অগ্রসর হওয়া যাক।

প্রথম প্রশ্ন হলো, এই প্রসঙ্গে সহজ শব্দটির মানে কী? ডক্টর শশীভূষণ দাসগুপ্ত(৬৪৩) বলছেন :

The word Sahaja’ literally means that which is born or which originates with the birth or origination of any entity.
সহজ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো, যা জন্মেছে বা যা একটা কিছুর জন্মের সঙ্গে উৎপন্ন হয়।

অবশ্যই অধ্যাপক দাসগুপ্ত বৌদ্ধধর্মের আলোয় এই অর্থটিরও একটা আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আমরা আগেই দেখেছি, তন্ত্র কথাটির শব্দার্থের পিছনেও এই জাতীয় একটা ইঙ্গিতই খুঁজে পাওয়া যায়। ইঙ্গিতটা হলো, প্রজনন ও উৎপাদন পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত—কিংবা প্রজননের অনুকরণেই উৎপাদনকে আয়ত্তে আনবার পরিকল্পনা। ‘সহ-জ’ কথাটির মধ্যেও ওই একই ইঙ্গিত দেখতে পাওয়া যায় না কি? এবং এই ইঙ্গিত থেকে কৃষিকেন্দ্রিক আদিম জাদুবিশ্বাসই অনুমান করা সম্ভব নয় কি?

যদি কৃষিকেন্দ্রিক জাদুঅনুষ্ঠানই এই সাধনপদ্ধতির উৎস হয় তাহলে সহজিয়াদের ধ্যানধারণা ও আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে নারীপ্রাধান্যের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া উচিত। এবং তা পাওয়া যায়।

সহজিয়াদের সাধন-পদ্ধতির মধ্যেও এই নারী-প্রাধান্যমূলক চিন্তার কী রকম পরিচয় পাওয়া যায় তাই দেখা যাক। অধ্যাপক মণীন্দ্রমোহন বসু(৬৪৪) বলছেন :

The Sahajiao also believe that at a certain stage of spiritual culture the man should transform himself into a woman and remember that he cannot have experience of true love so long as he cannot realise the nature of a woman in him.
অর্থাৎ, সহজিয়াদের বিশ্বাস অনুসারে সাধনার একটা পর্যায়ে পুরুষের পক্ষে নারীভাবে পর্যবসিত হওয়া প্রয়োজন এবং এ-কথাও মনে রাখা প্রয়োজন যে, নারীত্বের অনুভূতি ছাড়া প্রকৃত প্রেমের অভিজ্ঞতা হয় না।

এই উক্তির সমর্থনে অধ্যাপক মণীন্দ্রমোহন বসু – – সহজিয়াদের গান উদ্ধৃত করছেন :

পুরুষ ছাড়িয়া প্রকৃতি হবে।
একদেহ হয়ে নিত্যতে যাবে।

কিংবা,

স্বভাব প্রকৃতি হইলে তবে রাগ রতি।

কিংবা,

প্রকৃতি আচার পুরুষ বেভার
যে জনা জানিতে পারে।

কিংবা,

আপনি পুরুষ প্রকৃতি হইবে।

ইত্যাদি। ইত্যাদি।

আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি, তন্ত্রেরও এই একই উপদেশ : বামা ভূত্বা যজেং পরাম্‌। এবং আমরা দেখেছি, এ-থেকে অনুমান করা যায়, তন্ত্রসাধনা এককালে মেয়েদেরই সাধন-পদ্ধতি ছিলো। সহজিয়া-প্রসঙ্গেও একই সিদ্ধান্ত স্বাভাবিক হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আধুনিক মনোবিজ্ঞানের নজির দেখিয়ে অধ্যাপক মণীন্দ্রমোহন বসু এই তত্ত্বের যে-আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছেন তা প্রায় হাস্যকর হয়ে দাঁড়িয়েছে; পাদটীকায়(৬৪৬) আমরা তার সিদ্ধান্ত উল্লেখ করবো এবং সে-সিদ্ধান্ত কেন আমাদের কাছে প্রায় হাস্যকর মনে হয়েছে তারও আলোচনা তুলবো। আপাতত, সহজ-সাধনায় নারীপ্রাধান্যের দিকটিকে আরো ভালো করে দেখা যাক :

অধ্যাপক শশীভূষণ দাসগুপ্ত(৬৪৭) বলছেন :

Another thing that deserves special attention in connection with the yogic practice of the Sahajia Buddhists is the conception of the female force. In the Carya-songs we find frequent reference to this female force variously called as the Chandi, Dombi, Savari, Yogini, Nairamani, Sahaja-sundari, etc., and we find frequent mention of the union of the yogin with this personified female deity.
সহজিয়াদের যোগসাধনা প্রসঙ্গে স্ত্রী-শক্তি সম্বন্ধে তাদের ধারণার কথা বিশেষ করে উল্লেখ করা প্রয়োজন। চর্যা-পদে নানান নামে এই স্ত্রী-শক্তির উল্লেখ বারবার পাওয়া যায় : চণ্ডী, ডোম্বী, শবরী, যোগিনী, নৈরামণি, সহজস্বনারী ইত্যাদি। এবং মানবীরূপে কল্পিত এই দেবীর সঙ্গে যোগসাধকের মিলনের উল্লেখও বারবার পাওয়া যায়।

লেখক স্বীকার করছেন, সহজিয়াদের এই স্ত্রী-শক্তিটি তন্ত্রের শক্তি ছাড়া য়ার কিছু নয় :

This conception of Sakti of the Buddhist Sahajias is an adoption of the general Tantric conception of the Sakti.
বৌদ্ধ সহজিয়াদের শক্তির এই ধারণ তন্ত্রের শক্তির ধারণাকেই গ্রহণ করবার ফল…

তন্ত্রসাধনার শক্তির আলোচনা আমরা ইতিপূর্বেই করেছি এবং আমরা দেখাবার চেষ্টা করেছি যে, কৃষি-আবিষ্কারের পটভূমিতেই তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব।

অবশ্যই, সহজ-সাধনার আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করছেন বলেই ডক্টর শশীভূষণ দাসগুপ্ত(৬৪৯) বলছেন, ওই শক্তির সঙ্গে সাধকের যে-সঙ্গমের উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে তাকে দৈহিক বা শারীরিক অর্থে গ্রহণ করলে ভুল করা হবে। কিন্তু স্ত্রী-পুরুষের দৈহিক মিলনই যে সহজ-সাধনার একটি প্রধানতম অঙ্গ এ-কথা শুধু ডক্টর শশীভূষণ দাসগুপ্ত নন, মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সেন প্রমুখ আধুনিক বিদ্বানেরা সকলেই স্বীকার করেছেন। আমাদের যুক্তি অনুসারে ওই সহজসাধনাও যদি কৃষিকেন্দ্রিক জাদুঅনুষ্ঠান থেকেই জন্মলাভ করে থাকে তাহলে এ-রকমটা না-হয়ে উপায় নেই। তার মানে অবশ্যই এই নয় যে, কৃষিকেন্দ্রিক জাদুঅনুষ্ঠানের সেই আদি-অকৃত্রিম রূপটিই সহজ-সাধনার মধ্যে আজো অবিকৃতভাবে দেখতে পাওয়া সম্ভব। বিশেষত, সহজিয়া-সাহিত্যে ওই বৌদ্ধ-প্রলেপের দরুন এই সঙ্গম-সাধনার উপর নানা রকম বৌদ্ধ পরিভাষা প্রক্ষিপ্ত হওয়াই স্বাভাবিক। তাই সহজিয়া-সাহিত্যে এই মৈথুনকে প্রভাস্বর ও নিরাত্মাদেবীর মৈথুন, শূন্যতা ও করুণার মৈথুন, প্রজ্ঞা ও উপায়ের মৈথুন—প্রভৃতি নানান পরিভাষায় ব্যক্ত করা হয়। কিন্তু পরিভাষাটা যাই হোক না কেন, তার মূলে ঠিক কী আছে তা মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর(৬৫০) নিম্নোক্ত উক্তি থেকেই অনুমান করা সম্ভবপর :

যোগাচারমতে যেমন কিছুই থাকে না বিজ্ঞানমাত্র থাকে, সহজমতে, তেমনি কিছুই থাকে না আনন্দমাত্র থাকে। এই আনন্দকে তাঁহারা মুখ বলেন, কখনো বা মহামুখ বলেন। সে সুখ স্ত্রী-পুরুষ-সংযোগজনিত মুখ।

আমাদের যুক্তি অনুসারে, তন্ত্রের মতোই ওই সহজিয়া প্রভৃতি সম্প্রদায়গুলিও আদিম কৃষিকেন্দ্রিক জাদুবিশ্বাস থেকেই জন্মলাভ করেছে। বস্তুত, তন্ত্রসাধনার আদি-অকৃত্রিম রূপটির সঙ্গে সহজিয়া প্রভৃতি এই সাধনসম্প্রদায়গুলির কোনো মৌলিক পার্থক্য অন্বেষণ করা অনেকাংশেই অনর্থক। ওই আদিম তন্ত্রসাধনার উপর যেমন কৃত্রিমভাবে কখনো বৈদান্তিক আবার কখনো বৌদ্ধ চিন্তাধারা অধ্যস্ত হয়েছে তেমনি কৃত্রিমভাবেই সহজসাধনার উপরও আরোপিত হয়েছে প্রধানত বৌদ্ধ ধ্যানধারণা। ফলে, সহজিয়া সাহিত্য বৌদ্ধ-ধ্যানধারণায় যেন ভরপুর। তবুও এই বৌদ্ধধ্যানধারণা সহজ-সাধনার পক্ষেও বাহিক ও কৃত্রিম। এর একটা প্রমাণ হলো, ওই বৌদ্ধ-ধ্যানধারণা যেমন অনায়াসে সহজ-সাধনার উপর অধ্যস্ত হয়েছে তেমনি অনায়াসেই অ-বৌদ্ধ ধ্যানধারণাও এর উপর অধ্যস্ত হতে পারে। উদাহরণ হিসাবে অধ্যাপক শশীভূষণ দাসগুপ্ত সহজিয়া সম্প্রদায়ের বৈষ্ণব সংস্করণের কথা বলেছেন। কিংবা ডক্টর শশীভূষণ দাসগুপ্তের বই থেকেই এ-বিষয়ে একটি আরো চিত্তাকর্ষক দৃষ্টান্ত উদ্ধত করা যায়। তিনি বলছেন(৬৫১), বৌদ্ধ-সহজিয়াদের কোনো কোনো পুঁথির মতোই বৈষ্ণব-সহজিয়াদের কোনো কোনো পুঁথিতে দেখা যায় রচনাভঙ্গিটা শিবোক্ত শাস্ত্রের মতোই—অর্থাৎ, শাক্ত ও শৈবদের তন্ত্র যে-রকম শিব ও শক্তির কথোপকথনরূপে রচিত, বৈষ্ণব সহজিয়াদের কোনো কোনো পুঁথিও সেই রকমই শিব ও শক্তির কথোপকথন হিসেবেই রচিত। তাছাড়া, আনন্দ-ভৈরবে(৬৫২) লেখা আছে, শিব বা হর তার বিভিন্ন শক্তিদের সঙ্গে কুচনীদের দেশে (অর্থাৎ, নারীপ্রধান কোচ্‌-ট্রাইবের দেশে) এই সহজিয়া পদ্ধতিতে সাধনা করেছিলেন :

এক এক গুণে কৈল এক এক প্রকৃতি।
হরকে ভজয়ে সবে ভাবে উপপতি।
শক্তি জানে রসতত্ত্ব আর জানে শঙ্করে।
সহজ বস্তু আস্বাদিল কুচনি নগরে।

আধুনিক বিদ্বানদের মধ্যে অধ্যাপক শশীভূষণ দাসগুপ্ত অত্যন্ত স্পষ্টভাবে অনুমান করতে পেরেছেন যে, সহজিয়া-সম্প্রদায়ের ধ্যানধারণার উপর যদিও পরবর্তী কালে—এবং অতএব কৃত্রিমভাবেই—বৌদ্ধ ও বৈষ্ণব ধ্যানধারণা প্রক্ষিপ্ত হয়েছিলো, তবুও এ-সম্প্রদায়ের আদি-অকৃত্রিম রূপটির সঙ্গে বৌদ্ধ বা বৈষ্ণব কোনো ধ্যানধারণার মৌলিক এবং আভ্যন্তরীণ সম্পর্ক নেই। তিনি বলছেন, আমাদের দেশে বহুদিনের পুরোনো একটি সাধন-পদ্ধতি প্রচলিত ছিলো এবং তারই উপর উত্তরকালের রকমারি ধ্যানধারণা প্রক্ষিপ্ত হওয়ার ফলে পরবর্তী যুগে রকমারি সহজিয়া সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। অধ্যাপক শশীভূষণ দাসগুপ্তের মতে যে-প্রাচীন সাধনপদ্ধতিটি আগে থাকতেই দেশে প্রচলিত ছিলো এবং যার সঙ্গে পরে বৌদ্ধধর্ম, হিন্দুধর্ম ও বৈষ্ণবধর্মের নানান ধ্যানধারণা মিশেছে, তা হলো একরকম গুহ্য যোগসাধনা ৷

তিনি(৬৫৩) বলছেন, ‘আমাদের দেশে এক গুহ্য সাধনপদ্ধতি প্রচলিত ছিলো। তাকেই ঘিরে বিভিন্ন সহজিয়া সম্প্রদায়ের শাখা-প্রশাখা গজিয়েছিলো। কিন্তু এই গুহ্য সাধনপদ্ধতি হিন্দু বা বৌদ্ধ কোনো ধর্মেরই অন্তর্গত নয়। এ হলো যোগসাধনী—তারই সঙ্গে বৌদ্ধ ও হিন্দু বিভিন্ন ধর্মমতের সংস্রব ঘটবার ফলে বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছে। এই গুহাসাধনার প্রধানতম অঙ্গ হলো যৌন-মুখকে যোগপদ্ধতিতে আয়ত্তে এনে তাকে অতীন্দ্রিয় আনন্দে পরিণত করা। তার ফলে দেহ ও মন উভয়েরই বলবৃদ্ধি হয়। এই যোগসাধনা ও তার অঙ্গগুলির সঙ্গে শিব-শক্তিমূলক দর্শনের যোগাযোগ হয়ে হিন্দু-তন্ত্রের কেন্দ্র হয়েছে; তারই সঙ্গে উত্তরযুগের বৌদ্ধধর্মের প্রজ্ঞা-উপায়মূলক চিন্তার যোগাযোগ হয়ে বিভিন্ন তান্ত্রিক বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছে—সহজিয়া সম্প্রদায় তারই অন্তর্গত; আবার, গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের রস ও রতিরূপে কল্পিত রাধা ও কৃষ্ণের ধারণার সঙ্গে যুক্ত হয়ে ওই একই যোগসাধন পদ্ধতি বাংলা দেশে বৈষ্ণব-সহজিয়া আন্দোলনে পরিণত হয়েছে’ (স্বাধীন তর্জমা)।

_____________
৬৩৭. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী : বৌদ্ধধর্ম ৭৮।
৬৩৮. ঐ ৮৫।
৬৩৯. ঐ ১০৬ ইত্যাদি।
৬.৪০. D. Sen CHA 351. “There are hundreds of these sects silently
working in Bengal”…
৬৪১. পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় : রচনাবলী ২,৩২৫ ।
৬৪২. D. Sen CHA 337.
৬৪৩. S. Dasgupta ORC90.
৬৪৪. M. M. Bose PCSCB 42.
৬৪৫. Ibid. 42.
৬৪৬. Ibid, 42-3. অধ্যাপক মণীন্দ্রমোহন বসুর মতে ৮০ বছরের বৃদ্ধ যদিও পুরুষ হয়েই থাকে তবুও তার কামনাবাসনার উপসম হয় ; কিন্তু এ-উপসম ক্ষয়জনিত। অপরপক্ষে যুবক যদি সযত্ন-সাধনার ফলে নিরপেক্ষ-দশায় পৌঁছুতে পারে তাহলে তার ইন্দ্রিয়াদি সক্রিয় থাকবে এবং তবুও বহিঃপ্রকৃতির সংবেদনে সে বিচলিত হবে না। অধ্যাপক বসুর এই ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয় : সহজিয়ারা স্ত্রী-পুরুষ-নিরপেক্ষ অবস্থায় পৌঁছুবার সাধনা করে না—স্পষ্টই স্ত্রীভাবে সাধনা করতে চায় এবং স্ত্রীলোক কামনা-বাসনা রহিত নয়। তাছাড়া যে-শান্ত সমাহিত অবস্থাকে অধ্যাপক বসু সহজিয়া-সাধনার লক্ষ্য বলছেন তা সম্প্রদায়ান্তরের পক্ষে প্রাসঙ্গিক হলেও অন্তত সহজিয়াদের বেলায় অপ্রাসঙ্গিক, কেননা সহজ-সাধনা রিরংসার উপরই প্রতিষ্ঠিত। cf. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী : (বৌদ্ধধর্ম ৭১) “এই সকল সহজপন্থীর শাস্ত্র স্পষ্ট করিয়া বলিয়া দিতেছে যে, যদি তোমার বোধিলাভের ইচ্ছা থাকে, তবে পঞ্চকাম উপভোগ কর”।
৬৪৭. S. Dasgupta op. cit. 115-6.
৬৪৮. Ibid. 120.
৬৪৯. Ibid. 121ff.
৬৫০. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী : বৌদ্ধধর্ম ৬৯ ৷
৬৫১. S. Dasgupta op. cit. 136.
৬৫২. Ibid,
৬৫৩. Ibid. 134.