যুধিষ্ঠিরাদির বিলাপ
বৈশম্পায়ন বলিলেন, অনন্তর সেই পুরবাসী ও অন্যান্য লোকসমুদয়ের রোদনধ্বনি উপরত [নিবৃত্ত] হইলে, ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির শোকাবেগ সংবরণ করিয়া দেবর্ষি নারদকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “ভগবন্! আমরা জীবিত থাকিতেও যে তপানুষ্ঠাননিরত মহাত্মা অন্ধরাজ অনাথের ন্যায় অরণ্যমধ্যে কলেবর পরিত্যাগ করিলেন, ইহার পর আক্ষেপের বিষয় আর কি আছে? যখন প্রবলপ্রতাপশালী অন্ধরাজকেও দাবানলে দগ্ধ হইতে হইল, তখন নিশ্চয়ই বুঝিলাম, পুরুষদিগের গতি নিতান্ত দুর্জ্ঞেয়। হায়! যে মহাত্মার মহাবলপরাক্রান্ত একশত পুত্র ছিল, যিনি অযুত নাগতুল্য পরাক্রান্ত ছিলেন, তাঁহাকেও এক্ষণে দাবানলে দগ্ধ হইতে হইল। পূর্ব্বে পরমসুন্দরী রমণীগণ পার্শ্বে উপবিষ্ট হইয়া যাঁহাকে তালবৃন্ত বীজন করিত [৬], আজ তিনি দাবানলে দগ্ধ হওয়াতে গৃধ্রগণ তাঁহাকে পুচ্ছদ্বারা বীজিত করিতেছে। যিনি সূত ও মাগধগণের স্তুতিবাদ শ্রবণ করিয়া গাত্রোখান করিতেন, আজ এই নরাধমের কাৰ্য্যদোষে তাঁহাকে ধরাশয্যা আশ্রয় করিতে হইয়াছে।
“আমি পুত্রবিহীনা জননী গান্ধারীর নিমিত্ত অনুতাপ করি না। তিনি পতির অনুগামিনী হইয়া ভর্ত্তৃলোক লাভ করিয়াছেন। এক্ষণে কেবল যিনি পুত্রগণের এই সুসমৃদ্ধ রাজ্যসম্পদ পরিত্যাগ করিয়া বনগামিনী হইয়াছিলেন, সেই জননী কুন্তীকে স্মরণ করিয়া আমার হৃদয় শোকানলে দগ্ধ হইতেছে। আমাদিগের রাজ্য, বল, পরাক্রম ও ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্মে ধিক! আমরা জীবন্মৃত। হায়! কালের গতি ত’ অতিশয় সুক্ষ্ম। দেখুন, মনস্বিনী কুন্তী যুধিষ্ঠির, ভীমসেন ও অর্জ্জুনের জননী হইয়াও রাজ্যসম্পদ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক বনে গমন করিয়া অনাথার ন্যায় দাবানলে দগ্ধ হইলেন। আমি তাঁহাকে স্মরণ করিয়া নিতান্ত ব্যাকুল হইয়াছি। অর্জ্জুন অনর্থক খাণ্ডববন প্রদান করিয়া, অনলের তৃপ্তিসাধন করিয়াছিল। এক্ষণে আমি নিশ্চয় বুঝিলাম, হুতাশনের তুল্য অকৃতজ্ঞ ও কৃতঘ্ন আর কেহই নাই। পূৰ্ব্বে ব্রাহ্মণবেশে অর্জ্জুনের নিকট ভিক্ষা প্রার্থনা করিয়া এক্ষণে তিনি কিরূপে তাহার জননীকে দগ্ধ করিলেন?
“হুতাশনকে ও অর্জ্জুনের সত্যপ্রতিজ্ঞায় ধিক! অন্ধরাজ বৃথানলে কলেবর পরিত্যাগ করিয়াছেন, শ্রবণ করিয়া আমার চিত্ত নিতান্ত ব্যাকুল হইয়াছে। হায়! সেই মহাবনে তপানুষ্ঠাননিরত মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের মন্ত্রপূত পবিত্র অগ্নি বিদ্যমান থাকিতে তাঁহার বৃথানলে মৃত্যু হইল কেন? বোধ করি, যখন দাবানল আমার জননীর চতুর্দ্দিক বেষ্টন করিয়াছিল, তখন তিনি নিতান্ত ভীত হইয়া ‘হা ধৰ্ম্মরাজ! হা ভীমসেন! তোমরা শীঘ্র আমার নিকট আগমন কর’ বলিয়া উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিয়াছেন। তিনি সমুদয় পুত্র অপেক্ষা সহদেবের প্রতি সমধিক স্নেহ করিতেন, কিন্তু সেও এক্ষণে তাঁহাকে অনল হইতে রক্ষা করিল না।”
ধৰ্ম্মরাজ এই বলিয়া করুণস্বরে রোদন করিতে আরম্ভ করিলে, তাঁহার ভ্রাতৃগণ নিতান্ত শোকাকুল হইয়া যুগান্তকালীন প্রাণীগণের ন্যায় পরস্পরকে আলিঙ্গনপূৰ্ব্বক ক্রন্দন করিতে লাগিলেন। তাঁহাদিগের সেই ক্রন্দনকোলাহলে প্রাসাদসমুদয় প্রতিধ্বনিত ও আকাশমণ্ডল পরিব্যাপ্ত হইল।