৩৮. দুর্নিমিত্তদর্শন—অশুভসূচনা

৩৮তম অধ্যায়

দুর্নিমিত্তদর্শন—অশুভসূচনা

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! ঐ সময় কৌরবগণ মহাধনুর্দ্ধর কর্ণকে যুদ্ধাৰ্থ প্রস্তুত অবলোকন করিয়া হাষ্টচিত্তে চারিদিক্‌ হইতে চীৎকার করিতে লাগিলেন। দুন্দুভি, ভেরী প্রভৃতি বিবিধ বাদ্যধ্বনি, নানাপ্রকার বাণশব্দ এবং অশ্ব, হস্তী প্রভৃতির ভীষণ গর্জন হইতে আরম্ভ হইল। কৌরবসৈন্যগণ জীবিতনিরপেক্ষ হইয়া যুদ্ধে গমন করিল। মহাবীর কর্ণ সংগ্রামে যাত্রা করিলে যোধগণের আহ্লাদের পরিসীমা রহিল না। ঐ সময় বসুন্ধরা কম্পিত হইয়া বিকৃত শব্দ করিতে লাগিল। সূৰ্য্য হইতে সাত মহাগ্রহকে নির্গত হইতে লক্ষিত হইল। উল্কাপাত, দিগ্‌দাহ, বিনা মেঘে বজ্রাঘাত ও প্রচণ্ডবেগে বায়ুবহন হইতে লাগিল। দুর্নিমিত্তদ্যোতক [অশুভসূচক] অসংখ্য মৃগ ও পক্ষিগণ সৈন্যগণের বামভাগে অবস্থান করিল। কর্ণের অশ্বগণ গমনকালে বারংবার স্খলিতপদ হইতে লাগিল। অন্তরীক্ষ হইতে ভয়ানক অস্থি বর্ষণ আরম্ভ হইল। অস্ত্রসকল প্রজ্বলিত, ধ্বজনিচয় কম্পিত এবং বাহনগণের অশ্রুধারা অনবরত বিগলিত হইতে লাগিল। হে মহারাজ! কৌরবসৈন্যগণের বিনাশের নিমিত্ত এবংবিধ ও অন্যান্য নানাপ্রকার ভয়াবহ উৎপাতসকল উপস্থিত হইল। তৎকালে দৈবদুর্ব্বিপাকবশতঃ মুগ্ধ হইয়া কেহই সেই দুর্নিমিত্তসকল লক্ষ্য করিল না। নরপতিগণ যুদ্ধাৰ্থ প্ৰস্থিত সূতপুত্রকে ‘জয় হউক’ বলিয়া উৎসাহিত করিতে লাগিলেন এবং কৌরবগণ মনে মনে পাণ্ডবগণকে পরাজিত বলিয়া স্থির করিলেন।

শল্যপ্রমুখ কৌরবগণের প্রতি কর্ণের আশ্বাস

“হে মহারাজ! অনন্তর প্রদীপ্ত পাবকতুল্য সূৰ্য্যসদৃশ শত্রুতাপন কর্ণ মহাবীর ভীষ্ম ও দ্রোণাচাৰ্য্যকে বিগতবীৰ্য্য সন্দর্শন করিয়া অর্জ্জুনের কার্য্যাতিশয় চিন্তা করিয়া একেবারে অভিমান, দর্প ও ক্রোধে প্রজ্বলিত হইয়া নিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক শল্যকে কহিলেন, ‘হে মদ্ররাজ! আমি রথারোহণ ও আয়ুধ ধারণ করিলে ক্রোধাবিষ্ট বজ্ৰপাণি পুরন্দরকে নিরীক্ষণ করিয়াও ভীত হই না। এক্ষণে ভীষ্ম প্রমুখ মহারথগণকে রণশয্যায় শয়ান দেখিয়া আমি কিছুমাত্র অস্থির হইতেছি না। মহেন্দ্র ও বিষ্ণুর সদৃশ অমিতপরাক্রম, অনিন্দিত, রথ, অশ্ব ও করিগণের নিহন্তা, অবধ্যকল্প [প্রায়-অবধ্য অনেকাংশে বধের অযোগ্য], মহাবীর ভীষ্ম ও দ্রোণকে অরাতিশরে নিহত দেখিয়াও আমার অন্তঃকরণে কিছুমাত্র ভয়সঞ্চার হইতেছে না। দিব্যাস্ত্রবেত্তা দ্বিজবর দ্রোণাচাৰ্য্য অসাধারণ বলবীৰ্য্যসম্পন্ন অসংখ্য মহীপাল এবং সারথি, রথী কুঞ্জরদিগকে অরাতিগণকর্ত্তৃক নিহত নিরীক্ষণ করিয়া কি নিমিত্ত তিনি তাহাদিগকে সংহার করিলেন না? হে কৌরবগণ! আমি অর্জ্জুনকে সংগ্রামে দ্রোণেরও সম্মানভাজন অবগত হইয়া সত্য কহিতেছি যে, আমা ভিন্ন অন্য কোন বীরই করালকৃতান্তের ন্যায় সমাগত ধনঞ্জয়ের ভুজবীৰ্য্য সহ্য করিতে সমর্থ হইবে না। মহাবীর দ্রোণ অস্ত্রাভ্যাস, অবধানতা, বাহুবল, ধৈৰ্য্য ও নীতিসম্পন্ন ছিলেন, যখন সেই মহাত্মা মৃত্যুমুখে নিপতিত হইয়াছেন, তখন আজ আমি সকলকেই আসন্নমৃত্যু বলিয়া বিবেচনা করিতেছি। কর্ম্মসমুদয় দৈবায়ত্ত; তন্নিবন্ধন আমি অনেক অনুসন্ধান করিয়াও এই পৃথিবীর কোন বস্তুরই স্থিরতা দেখিতেছি না। যখন আচাৰ্য্য নিহত হইয়াছেন, তখন অদ্য সূর্য্যোদয়ে আমি জীবিত থাকিব, এ কথা নিঃসন্দেহরূপে কে বলিতে পারে? হে শল্য! অরাতিহস্তে আচার্য্যের নিধন নিরীক্ষণ করিয়া আমার স্পষ্টই বোধ হইতেছে। যে, নীতি, দিব্য-আয়ুধ, বলবীৰ্য্য ও কাৰ্য্যকলাপ—এই সমস্ত মনুষ্যের সুখোৎপাদনে সমর্থ নহে। দেখ, যিনি বিক্রমে ত্রিবিক্রম ও ইন্দ্রের তুল্য, নীতিবিষয়ে বৃহস্পতি ও শুক্রের সদৃশ এবং ভেজে হুতাশন ও আদিত্যের সদৃশ, সেই নিতান্ত দুঃসহবীৰ্য্য দ্রোণাচাৰ্য্য দ্বিব্যাস্ত্র প্রভৃতি কোন উপায়দ্বারা রক্ষা পাইলেন না। হে মদ্ররাজ! এক্ষণে আমাদিগের স্ত্রীপুত্রেরা মুক্তকণ্ঠে রোদন করিতেছে এবং ধার্ত্তরাষ্ট্রগণের পৌরুষও ব্যর্থ হইয়া গিয়াছে; এ সময় যুদ্ধ করা কেবল আমারই কার্য্য, অতএব তুমি অবিলম্বে বিপক্ষসৈন্যমধ্যে আমাকে লইয়া যাও। আমা ভিন্ন আর কোন্ ব্যক্তি সত্যপ্রতিজ্ঞ রাজা যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জ্জুন, নকুল, সহদেব, সাত্যকি ও সৃঞ্জয়গণের বলবীৰ্য্য সহ্য করিতে সমর্থ হইবে? অতএব হে মদ্ররাজ! যে স্থানে পাঞ্চাল, পাণ্ডব ও সৃঞ্জয়গণ অবস্থান করিতেছে, তুমি অবিলম্বে তথায় রথ লইয়া গমন কর। আজ আমি হয় তাহাদিগকে সংহার, না হয় স্বয়ং দ্রোণপ্রদর্শিত পদবী অবলম্বনপূর্ব্বক যমলোকে প্রস্থান করিব। হে শল্য! আমাকেও সেই ভীষ্মপ্রমুখ বীরগণের ন্যায় মৃত্যুমুখে পতিত হইতে হইবে, তদ্বিষয়ে আর কোন সন্দেহই নাই; কিন্তু আমি রণস্থল হইতে পলায়ন করিয়া কোনক্রমেই মিত্রদ্রোহ করিতে সমর্থ হইব না। দেখ, বিদ্বানই হউক বা মূর্খই হউক, আয়ুঃক্ষয় হইলে মৃত্যুর হস্তে, কাহারও পরিত্রাণ নাই; আর অদৃষ্টে যাহা আছে তাহা অতিক্রম করা কাহারও সাধ্যায়ত্ত নহে। অতএব আমি অবশ্যই সংগ্রামার্থ পাণ্ডবগণসন্নিধানে গমন করিব। ধৃতরাষ্ট্রতনয় মহারাজ দুৰ্য্যোধন নিরন্তর আমার শুভচিন্তা করিয়া থাকেন, তন্নিবন্ধন তাঁহার কাৰ্য্যসংসাধনার্থ প্রীতিকর ভোগ ও দুস্ত্যজ জীবন বিসর্জন করা আমার অবশ্যই কর্ত্তব্য। হে শল্য! ভগবান্ রাম আমাকে এই ব্যাঘ্রচর্ম্মপরিবৃত, শব্দহীন, চক্ৰযুক্ত, সুবর্ণময় আসনসম্পন্ন, রজতময় ত্রিবেণুসমলঙ্কৃত, উৎকৃষ্ট তুরগসংযোজিত রথ প্রদান করিয়াছেন। আর এই আমার বিচিত্র শরাসন, ধ্বজ, গদা, ভয়ঙ্কর সায়কনিকর, সমুজ্জ্বল অসি এবং ভীষণনিঃস্বনসম্পন্ন শুভ্র শঙ্খ বিদ্যমান রহিয়াছে। আমি এই বিচিত্রপতাকা-সমলঙ্কৃত অশনিসমনিঃস্বন, শ্বেতাশ্বযুক্ত, তূণীরপরিশোভিত রথে আরোহণ করিয়া বলপ্রকাশপূর্ব্বক ধনঞ্জয়কে সংহার করিব। যদি সর্ব্বক্ষয়কর মৃত্যু স্বয়ং অপ্রমত্ত হইয়া ধনঞ্জয়কে রক্ষা করেন, তথাপি আমি তাঁহার সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়া হয় তাঁহাকে সংহার না হয় স্বয়ংই ভীষ্মের ন্যায় যমলোকে গমন করিব। অধিক কি, যদি অদ্য যম, বরুণ, কুবের এবং ইন্দ্রও স্বগণসমভিব্যাহারে ধনঞ্জয়কে রক্ষা করিতে অভিলাষ করেন, তথাপি আমি তাঁহাদিগের সহিত তাহাকে পরাজিত করিব।

শল্যকর্ত্তৃক কর্ণসমীপে অর্জ্জুনের শৌৰ্য্যপ্রশংসা

“হে মহারাজ! মদ্ররাজ শল্য সংগ্রামার্থ একান্ত হৃষ্ট সূতপুত্রের এইরূপ আত্মশ্লাঘা শ্রবণগোচর করিয়া তাঁহার বাক্যে উপহাস ও অশ্রদ্ধা প্রদর্শনপূর্ব্বক তাঁহাকে প্রতিষেধ করিয়া কহিতে লাগিলেন, ‘হে সূতপুত্র! তুমি আর আত্মশ্লাঘা করিও না। তুমি যথার্থ মহাবলপরাক্রান্ত বটে; কিন্তু এক্ষণে স্বীয় সামর্থ্য অপেক্ষা অতিরিক্ত বাক্যব্যয় করিতেছ। ধনঞ্জয় পুরুষপ্রধান, আর তুমি পুরুষাধম। তাঁহার সহিত তোমার কোনরূপেই তুলনা হইতে পারে না। দেখ, দেবরাজের ন্যায় বলবীৰ্য্যসম্পন্ন মহাবীর অর্জ্জুন ব্যতিরেকে আর কোন ব্যক্তি সুররাজরক্ষিত দেবলোকের ন্যায় বাসুদেব প্রতিপালিত দ্বারকাপুরী আলোড়িত করিয়া কৃষ্ণের কনিষ্ঠা ভগিনী সুভদ্রাকে হরণ এবং ত্রিভুবনবিভু ভূতভাবন ভগবান্ ভূতনাথকে মৃগবধকলহযুদ্ধে আহ্বান করিতে পারে? ঐ মহাবীর অগ্নির প্রতি বহুমান প্রদর্শনপূর্ব্বক সুর, অসুর, উরগ, নর, গরুড়, পিশাচ, যক্ষ ও রাক্ষসগণকে পরাজিত করিয়া তাঁহাকে অভিলষিত হবিঃ প্রদান করিয়াছিল। হে কর্ণ! গন্ধর্ব্বগণ কৌরবগণসমক্ষে কলহপ্রিয় ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদিগকে হরণ করিলে তুমি সর্ব্বাগ্রে পলায়ন করিলে মহাবীর অর্জ্জুন যে সুৰ্য্যের করজালসদৃশ শরজালদ্বারা গন্ধর্ব্বদিগকে পরাজিত করিয়া তাহাদের হস্ত হইতে দুৰ্য্যোধনপ্রমুখ বীরবর্গকে মুক্ত করিয়াছিল, ইহা কি এক্ষণে তোমার স্মৃতিপথে উদিত হয়? ঐ মহাবীর গোগ্রহ [বিরাটের গোহরণ] যুদ্ধে বলবাহনসম্পন্ন দ্রোণ, অশ্বত্থামা, ভীষ্মপ্রমুখ বীরগণকে পরাজিত করিয়াছিল; তৎকালে তুমি কি তাহাকে জয় করিতে সমর্থ হইয়াছিলে? হে সূতপুত্র! এক্ষণে তোমার বধসাধনের নিমিত্ত এই একটি যুদ্ধ উপস্থিত হইয়াছে। যদি তুমি অদ্য শত্রুভয়ে পলায়ন না করিয়া সমরে গমন কর, তাহা হইলে নিঃসন্দেহ বিনষ্ট হইবে।’

“মদ্ররাজ শল্য একাগ্রচিত্তে কর্ণের প্রতি অর্জ্জুনের স্তুতিবাদসহকৃত অতি কঠোর বাক্য প্রয়োগ করিলে কৌরবসেনাপতি সূতপুত্র সাতিশয় রোষাবিষ্ট হইয়া কহিলেন, ‘হে শল্য! তুমি কি নিমিত্ত অর্জ্জুনের শ্লাঘা করিতেছ? অদ্য অর্জ্জুনের সহিত আমার যুদ্ধ উপস্থিত হইয়াছে। যদি সে আমাকে পরাজিত করিতে পারে, তাহা হইলে তোমার এই শ্লাঘা সফল হইবে। মহাত্মা শল্য কর্ণের বাক্য শ্রবণ করিয়া ‘তাহাই হউক’ বলিয়া নিরস্ত হইলেন। তখন মহাবীর কর্ণ যুদ্ধার্থ শল্যকে অশ্বচালন করিতে কহিলেন। হে মহারাজ! অনন্তর কর্ণের সেই শ্বেতাশ্বসংযোজিত রথ শল্যকর্ত্তৃক পরিচালিত হইয়া দিবাকর যেমন অন্ধকার বিনাশ করিয়া সমুদিত হয়েন, তদ্রূপ শত্ৰুসংহার করিতে. ধাবমান হইল।”