৩৭তম অধ্যায়
সারথ্যগ্রহণে অর্জ্জুনের প্রতি উত্তরার অনুরোধ
সর্ব্বাঙ্গসুন্দরী বিরাটকুমারী কুন্তীকুমারের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া জলন্ধরসংলগ্না সৌদামিনীর ন্যায়, নগররাজ-সমীপবর্ত্তিনী করিণীর ন্যায় শো’র চাইতে লাগিলেন। অর্জ্জুন উত্তরাকে নয়নগোচর করিয়া সদস্য দিনে কহিলেন, “রাজপুত্র! এমন দ্রুত পদসঞ্চারে আগমন করিবার কারণ কি? আজি তোমার মুখমণ্ডল অপ্ৰসন্ন দেখিতেছি কেন?”
উত্তরা সখীগণসমক্ষে প্রণয়সম্ভাষণপূর্ব্বক কহিলেন, “বৃহন্নলে! কৌরবগণ আমাদিগের রাজ্যের সমুদয় গোধন অপহরণ করিয়াছে, আমার ভ্রাতা তাহাদিগের পরাজয় করিতে গমন করিবেন। কিছুদিন হইল, তাহার সারথি সংগ্রামে নিহত হইয়াছে, এক্ষণে উপযুক্ত সারথি আর কেহই নাই; তিনি সারথি অন্বেষণ করিতেছেন দেখিয়া সৈরিন্ধ্রী তাঁহাকে তোমার হয়জ্ঞাতার পরিচয় প্রদান করিলেন। হে বৃহন্নলে! তুমি পূর্ব্বে অর্জ্জুনের প্রিয়তম সারথি ছিলে; তিনি তোমারই সাহায্যে ধারামণ্ডল পরাজয় করিয়াছিলেন। এক্ষণে তুমি আমার ভ্রাতার সারথ্যিকর্ম্ম সম্পাদন কর। কৌরবগণ এতক্ষণ গোধন লইয়া বহু দূরে পলায়ন করিয়াছে! হে কল্যাণি! যদ্যপি তুমি আমার এই প্রণয়সহকৃত অনুরোধ রক্ষা না কর, তাহা হইলে আমি নিশ্চয়ই প্ৰাণ পরিত্যাগ করিব।”
মহাবীর অর্জ্জুন রাজপুত্রীর বাক্যশ্রবণানন্তর অমিততেজাঃ রাজকুমারের সমীপে গমন করিলেন। যেমন রাবণবধু মদমত্ত করভের অনুসরণ করে, সেইরূপ বিশালনয়না উত্তরা ত্বরিতগামী অর্জ্জুনের অনুগামিনী হইলেন। রাজপুত্ৰ অর্জ্জুনকে দূর হইতে দৃষ্টিগোচর করিয়াই কহিতে লাগিলেন, “বৃহন্নলে! সৈরিন্ধ্রীর মুখে শুনিলাম, পূর্ব্বে তুমি কুন্তীকুমার ধনঞ্জয়ের প্রিয় সারথি ছিলে। তিনি তোমার সাহায্যেই খাণ্ডবারণ্যে হুতাশনকে পরিতৃপ্ত ও সমস্ত ধরামণ্ডল পরাভূত করিয়াছিলে। এক্ষণে তুমি সেই প্রকার মদীয় সারথ্যভার গ্রহণ কর। আমি অপহৃত পশুযূথ প্রত্যাহরণ করিবার নিমিত্ত কৌরবগণের সহিত সংগ্রাম করিব।”
অর্জ্জুন উত্তর করিলেন, “রাজপুত্র! সংগ্ৰামমুখে সারথী-কর্ম্ম সম্পাদন করা কি আমার সাধ্য? যদি গান, বাদ্য বা নৃত্য করিতে বলেন, তাহা অনায়াসেই করিতে পারি; আমার সারথ্য-শক্তি কোথা?”
উত্তর কহিলেন, “বৃহন্নলে! তুমি পুনর্ব্বার গায়ক বা নর্ত্তক-পদে অধিষ্ঠিত হইবে; এক্ষণে আমার রথে আরোহণপূর্ব্বক অশ্বচালনা কর।’
ধনঞ্জয় রাজকুমারীর মুখে সমুদয় বৃত্তান্ত অবগত হইয়াছিলেন; তথাপি রাজকুমারের সহিত পুনঃ পুনঃ পরিহাস করিতে লাগিলেন। তিনি পরিহাস-মানসে স্বীয় কবচ বিপৰ্য্যস্ত করিয়া অঙ্গে ধারণ করিলেন; তদর্শনে কুমারীগণ হাস্য করিয়া উঠিল। তখন রাজপুত্ৰ তাঁহাকে সন্নদ্ধ [যুদ্ধোপযোগী সজ্জিত] ও সারথিপদে প্রতিষ্ঠিত করিয়া স্বয়ং দিব্য কবচ পরিধান, রুচির ধনুর্ব্বাণ ধারণ ও সিংহধ্বজ উন্নমনপূর্ব্বক যুদ্ধে যাত্ৰা করিলেন।
উত্তরা প্রভৃতি রাজকন্যাগণ অর্জ্জুনকে কহিলেন, “বৃহন্নলে! ভীষ্ম, দ্রোণ প্রভৃতি যোদ্ধৃগণ পরাজিত হইলে তুমি তাঁহাদিগের রুচির সূক্ষ্ম ও বিচিত্র বসনসকল আনয়ন করিও! আমরা তদ্বারা পুত্তলিকা সুসজ্জিত করিব।”
ধনঞ্জয় সহাস্যবদনে উত্তর করিলেন, “যদি রাজপুত্ৰ সংগ্রামে সেই মহারথগণকে পরাভব করেন তাহা হইলে তাহাদিগের দিব্যবসান-সকল আনয়ন করিব।”
এই কথা বলিয়া অর্জ্জুন কৌরবসৈন্যাভিমুখে অশ্বচালনা করিলেন। তখন ব্ৰতপরায়ণ ব্রাহ্মণগণ মহাভুজ উত্তরকে বৃহন্নলাসমভিব্যাহারে রথারূঢ় নিরীক্ষণ করিয়া রথ প্ৰদক্ষিণ করিতে লাগিলেন; রমণীগণও মঙ্গলাচরণপূর্ব্বক কহিলেন, “হে বৃহন্নলে! পূর্ব্বে যেমন খাণ্ডবদাহসময়ে মহাবল অর্জ্জুনের মঙ্গললাভ হইয়াছিল, আদ্য তোমরাও কৌরবসমরে সেইরূপ মঙ্গললাভ কর।’