যুধিষ্ঠিরের শিশুপাল সান্ত্বনা
বৈশম্পায়ন কহিলেন, অনন্তর রাজা যুধিষ্ঠির সত্বর শিশুপালের নিকট গমন করিয়া তাঁহাকে সাত্মনাপূর্ব্বক মধুরবাক্যে কহিতে লাগিলেন, “হে মহীপাল! তুমি যাহা কহিলে, তাহা তোমার উপযুক্ত বাক্য হয় নাই, উহা নিতান্ত অধর্ম্মযুক্ত, পুরুষ এবং নিরর্থক! নিশ্চয়ই বোধ হইতেছে, ধর্ম্ম কাহাকে বলে, তুমি নিজেই তাহা জান না; ধর্ম্মজ্ঞান থাকিলে ভীষ্মের অপমান করিতে না। দেখ, যে সকল রাজারা তোমা অপেক্ষা বয়োবৃদ্ধ, কৃষ্ণের পূজা তাহাদিগের অভিলষণীয়, অতএব এ বিষয়ে তোমার ক্ষান্ত হওয়াই উচিত। হে চেদিপতে! কৃষ্ণ এবং ভীষ্মকে যথাযথারূপ পরিজ্ঞাত হও; কৌরবকুল ইহাকে যেমন চিনিতে পারিয়াছেন, তুমি সেরূপ জানিতে পার নাই।”
শিশুপালের অনুনয়ে ভীষ্মের নিষেধ
ভীষ্ম কহিলেন, “হে যুধিষ্ঠির! লোকবৃদ্ধ কৃষ্ণের অৰ্চনা যাহার অনভিমত, এমন ব্যক্তিকে অনুনয় বা সান্তুনা করা অনুচিত। যিনি ক্ষত্ৰিয়সমরে ক্ষত্রিয়ান্তরকে পরাজয় ও আপনার বশীভূত করিয়া তাহাকে পরিত্যাগ করেন, তিনি সেই নির্জিত ক্ষত্ৰিয়ের গুরু হয়েন। এই মহতী নৃপসভায় একজন মহীপালও দৃষ্ট হয়েন না, যাঁহাকে কৃষ্ণ তেজোবলে পরাভব করেন নাই; আচ্যুত কেবল আমাদিগের অর্চনীয়, এমন নহেন, সেই মহাভুজ ত্ৰিলোকীর পূজনীয়। তিনি যুদ্ধে অসংখ্য ক্ষত্রিয়বর্গের পরাজয় করিয়াছেন এবং অখণ্ড ব্ৰহ্মাণ্ড তাহাতেই প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে, এই নিমিত্ত অন্যান্য বর্ষিষ্ঠ ব্যক্তি থাকিতেও আমরা কৃষ্ণকে অর্ঘ্য প্রদান করিয়াছি, তাহাতে তোমার এরূপ গর্ব্ব প্রকাশ করা নিতান্ত অযোগ্য। অতঃপর আর যেন তোমার বুদ্ধির এরূপ ব্যতিক্রম না ঘটে! আমি অনেকানেক জ্ঞানবৃদ্ধ সাধু পুরুষদিগের সহবাস করিয়াছি এবং তাহাদিগের নিকট সর্ব্বগুণাধর কৃষ্ণের অশেষ প্রকার গুণরাশি শ্রবণ করিয়াছি। কৃষ্ণ জন্মিয়া অবধি যে সকল কাৰ্য্য করিয়াছেন, লোকে মৎসন্নিধানে পুনঃ পুনঃ তৎসমুদয় কীর্তন করিয়াছে। তিনি অত্যন্ত বালক হইলেও আমরা তাহার পরীক্ষা করিয়া থাকি। কৃষ্ণের শৌৰ্য্য, বীৰ্য্য, কীর্তি ও বিজয় প্রভৃতি সমস্ত পরিজ্ঞাত হইয়া সেই ভূতসুখাবহ জগদর্চ্চিত আচ্যুতের পূজাবিধান করিয়াছি, নতুবা কোন প্রকার সম্বন্ধের অনুরোধ অথবা উপকারপ্রত্যাশায় তদীয় সৎকার করি নাই। গুণবাহুল্যপ্রযুক্ত বৃদ্ধ ব্যক্তিদিগকে অতিক্রম করিয়াও কৃষ্ণের অৰ্চনা করা বিধেয়। ব্রাহ্মণদিগের মধ্যে যিনি জ্ঞানবৃদ্ধ, তিনিই অৰ্চনীয়; ক্ষত্ৰিয়দিগের মধ্যে অধিক বলশালী ব্যক্তি পূজনীয়; বৈশ্যকুলে ধনধান্যসম্পন্ন ব্যক্তি সম্মানভাজন এবং শূদ্ৰবংশজাত বয়ােবৃদ্ধ ব্যক্তি সৎকারাহ হয়েন। কিন্তু কৃষ্ণের পূজ্যতাবিষয়ে দুইটি হেতু আছে; তিনি নিখিল বেদ-বেদাঙ্গপারদর্শী ও সমধিকবলশালী। ফলতঃ মনুষ্যলোকে তাদৃশ বলবান এবং বেদবেদাঙ্গসম্পন্ন দ্বিতীয় ব্যক্তি প্রত্যক্ষ হওয়া সুকঠিন। দান, দাক্ষ্য [দক্ষতা], শ্রুত, শৌচ, লজ্জা, কীর্তি, বুদ্ধি, বিনয়, অনুপম শ্ৰী, ধৈৰ্য্য ও সন্তোষ প্রভৃতি সমুদয় গুণাবলী কৃষ্ণে নিয়ত বিরাজিত রহিয়াছে। অতএব সেই সর্ব্বগুণসম্পন্ন, আচাৰ্য্য, পিতা ও গুরুস্বরূপ পূজার্হ কৃষ্ণের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করা তোমাদিগের সর্ব্বতোভাবে কর্তব্য। তিনি একাধারে ঋত্বিক, গুরু, সম্বন্ধী, স্নাতক, রাজা এবং প্রিয় পাত্ৰ, এই নিমিত্ত আচ্যুত অৰ্চিত হইয়াছেন। কৃষ্ণই এই চরাচর বিশ্বের সৃষ্টিস্থিতিপ্ৰলয়কর্তা, তিনিই অব্যক্ত প্রকৃতি, সনাতন কর্তা এবং সর্ব্বভূতের অধীশ্বর; সুতরাং পরমপূজনীয়, তাহাতে আর সন্দেহ কি? বুদ্ধি, মন, মহত্তত্ত্ব পৃথিব্যাদি পঞ্চ ভূতসমুদয়ই একমাত্র কৃষ্ণে প্রতিষ্ঠিত আছে। চন্দ্ৰ, সূর্য্য, গ্রহ, নক্ষত্র, দিক্, বিদিক্, সমুদয়ই একমাত্র কৃষ্ণ প্রতিষ্ঠিত আছে। যাদৃশ বেদচতুষ্টয়ের অগ্নিহোত্ৰ, ছন্দের গায়ত্রী, মনুষ্যের রাজা, নদীর সাগর, নক্ষত্ৰমণ্ডলীর চন্দ্ৰ, তেজঃপদার্থের আদিত্য, সমস্ত পর্ব্বতের সুমেরু এবং বিহঙ্গজাতির গরুড় মুখস্বরূপ হইয়াছেন, সেইরূপ ত্ৰিলোকমধ্যে উৰ্দ্ধ, তিৰ্য্যক ও অধঃপ্রদেশে জগতের যাবতী গতি নিরূপিত রহিয়াছে, ভগবান কেশবই তাহার মুখস্বরূপ হয়েন। এই বালক শিশুপাল সর্ব্বদা সর্ব্বস্থলে কৃষ্ণকে বুঝিতে পারেন না, এই কারণে ইনি এইরূপ কহিতেছেন। যে বুদ্ধিমান ব্যক্তি অত্যুৎকৃষ্ট ধর্ম্ম অনুসন্ধান করিয়া থাকেন, তিনি যেমন ধর্মের মর্ম্ম বুঝিতে পারেন, চেদিরাজ শিশুপাল তদ্বিষয়ে কদাচি সমর্থ হইবেন না; বালক, বৃদ্ধ ও ভূপালগণমধ্যে কোন ব্যক্তি আচ্যুতকে অৰ্চনীয় বলিয়া বোধ না করেন? কোন ব্যক্তিই বা কৃষ্ণের সৎকার-বিষয়ে অনাদর করিয়া থাকেন? যদ্যপি কৃষ্ণের পূজা শিশুপালের নিতান্ত অসহ্য বোধ হইয়া থাকে, তবে তাহার যেরূপ অভিরুচি হয় করুন।”