‘অ্যালবাট্রস, সমুদ্রের বিশাল বিহঙ্গ, যেন অলস
ভ্রমণ-সঙ্গী, জাহাজের পিছু
পিছু ওড়ে
গভীর থেকে গভীরে যায় জাহাজ,
তারাও সঙ্গে সঙ্গে
যায়
নাকিবেরা এক একসময় তাদের বন্দি করে
খেলাচ্ছলে।
ডেকের ওপর তাদের নামিয়ে আনার প্রায় সঙ্গে
সঙ্গে
নীল আকাশের রাজা, এই পাখিরা
বিভ্রান্ত, এবং
লজ্জা মাখা মুখে
তাদের মস্ত বড় দুটি শাদা ডানা ছড়িয়ে দেয় দু’পাশে
যেন করুণভাবে ঝুলতে থাকা দুটি দাঁড়
কিছুক্ষণ আগেই যে ছিল দুর্দান্ত সুন্দর, এখন সে
কেমন
দুর্বল আর জোবড়া-জোবড়া,
সেই উড়ন্ত পর্যটককে
এখন দেখাচ্ছে কী কুৎসিত আর কিম্ভুত
একজন খোঁচাচ্ছে তার চঞ্চু, অন্য কেউ খুঁড়িয়ে
খুঁড়িয়ে নকল করছে তাকে।
কবিও ঠিক যেন এই মেঘের যুবরাজের মতন
ঝড়ের সঙ্গে অনবরত ঘোরে, তিরন্দাজদের উপহাস
করে
নির্বাসিত হয়ে আসে পৃথিবীতে,
চতুর্দিকে
ধিক্কার-বিদ্রুপ
প্রকাণ্ড দুটি ছড়ানো ডানার জন্য সে হাঁটতে পারে না।’
–শার্ল বোদলেয়ার
আড্ডা আমাদের বাঙালি জীবনের একটা অঙ্গ, ফরাসিরাও কম আড্ডা মারে না। আমাদের আড্ডা যেখানে-সেখানে জমতে পারে। ওদের আড্ডা বসে কাফে রেস্তোরাঁয় এবং ওদের অধিকাংশ কাফে-রেস্তোরাঁ পানশালাও বটে। কোনও কোনও আড্ডা পরে ঐতিহাসিক মর্যাদা পেয়ে যায়।
সেই রকমই একটা আড্ডা ছিল প্যারিসের কাফে গেরবোয়া-তে, গত শতাব্দীতে। আভিনু দ্য ক্লিশি’র ওপরে এই কাফেটি বেশ প্রশস্ত। এখানকার আচ্ছাটির বিশেষত্ব এই যে এখানে প্রথম শিল্পীদের সঙ্গে কবি ও লেখকদের মিলন ঘটে। এই কাফের আডধারীদের মধ্যে দুজন, ফরাসি দেশে তো বটেই, এমনকি বিশ্বেরও আধুনিক শিল্প ও কাব্যের প্রধান পথিকৃৎ। এদুরার মানে এবং শার্ল বোদলেয়ার। দুজনেই সমকালে দারুণ নিন্দিত।
এদুরার মানে এই আড্ডার মধ্যমণি। অন্যান্য সমসাময়িক শিল্পীদের সঙ্গে মানের একটা বিরাট তফাত এই যে, তাঁকে কখনও দারিদ্রের কষ্ট সহ্য করতে হয়নি। উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, স্বভাবে বুর্জোয়া, ভালো পোশাক পরতে ভালোবাসতেন, ভালো খাবার ও পানীয়, ভালো রেস্তোরাঁ, নারীদের সঙ্গ, নাচ-গান পছন্দ করতেন। গোড়ার দিকে ছবি আঁকার ব্যাপারে বাবার আপত্তি থাকলেও মায়ের প্রশ্রয়ে পরে আর কোনও অসুবিধে হয়নি। নিজস্ব স্টুডিওতে নিশ্চিন্তে ছবি আঁকতে পারতেন। শিল্পের জগতে কোনও বিপ্লব ঘটাতেও চাননি মানে, ভেবেছিলেন ভদ্দরলোকদের মতন প্রথাসম্মত ছবি আঁকবেন, ভালো জায়গায় প্রদর্শনী হবে, লোকে প্রশংসা করবে, কিনবে, তিনি স্বাভাবিকভাবে খ্যাতি অর্জন করবেন। কিন্তু বাস্তবে হয়েছিল এর ঠিক বিপরীত! বাহ্যত যিনি বুর্জোয়া এবং বিলাসী তাঁর ভেতরের এক সাংঘাতিক প্রতিভা যেন জোর করে তাঁকে দিয়ে যুগান্তকারী সব ছবি আঁকাচ্ছিল কোনও কোনও সমালোচক বলেছেন, মানে যেন একই অঙ্গে ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড!
বোদলেয়ার শুধু কবি নন, তিনি তাঁর কালের শ্রেষ্ঠ শিল্প সমালোচক এবং এখনও সমালোচকদের কাছে আদর্শস্বরূপ। যখন আধুনিক শিল্পীগোষ্ঠীকে বড় বড় সমালোচকরা তুলোধনা করছেন, গালাগালির চোটে ভূত ভাগাচ্ছেন, পত্র-পত্রিকায় তাঁদের নিয়ে শুধু ঠাট্টাবিদ্রূপ চলছে, সেই সময় বোদলেয়ার জোরালোভাবে সমর্থন করছেন এই নতুন শিল্প আন্দোলনকে। মানের সঙ্গে বন্ধুত্বের ফলে বোদলেয়ারের নিজেরও খানিকটা উপকার হয়েছিল, মায়ের সঙ্গে ঝগড়া, অর্থকষ্ট, কাব্যগ্রন্থ নিয়ে মামলায় হেরে যাওয়া, ফরাসি আকাদেমির সদস্য হওয়ার চেষ্টাও করেও ব্যর্থ হওয়া, এই সব মিলিয়ে বোদলেয়ার নৈরাশ্যে ভুগছিলেন, আত্মহত্যার ইচ্ছে জাগত মাঝে মাঝে। কিন্তু তীব্র জীবনবোধসম্পন্ন মানের সঙ্গে মিশে তিনি কিছুদিনের জন্য সঞ্জীবিত হয়েছেন, মানে যখন ক্যানভাস-তুলি নিয়ে আঁকতে যেতেন মাঝে মাঝে, তখন বোদলেয়ারও তাঁর সঙ্গে যেতেন। ‘তুইলারির বাগানে কনসার্ট’ নামে মানের যে একখানা বড় ছবি আছে, সেই ছবিতে অনেক মানুষের মধ্যে বোদলেয়ারকেও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এ ছাড়া বোদলেয়ারের একটা চমৎকার এচিং করেছিলেন মানে।
এমিল জোলা তখনও বড় উপন্যাসগুলি লিখতে শুরু করেননি, খবরের কাগজে ফিচার লিখে জীবিকা অর্জন করতেন। তিনি ওই আড়ার নিয়মিত সদস্য। সুযোগ পেলেই তিনি পত্র-পত্রিকায় শিল্পী বন্ধুদের পক্ষে সমর্থন করে লিখতেন। লেখকদের মধ্যে আরও আসতেন এডমনদ দুরান্তি, পরে তাঁর খুব খ্যাতি হয়েছিল, সে সময় তিনি ছিলেন বিষণ্ণতার প্রতিমূর্তি, অধিকাংশ সময়েই বসে থাকতেন চুপ করে। ঠোঁটে পাইপ কিন্তু জ্বালাবার কথা মনে থাকত না। তা হলেও তিনি এই শিল্পী গোষ্ঠী নিয়ে প্রথম একটি পুস্তিকা রচনা করেন, ‘নতুন শিল্পী’ নামে। জাকারি আসক নামে আর একজন মাঝারি কবি একদিন মানের ‘অলিমপিয়া’ ছবিটি দেখে হঠাৎ স্বতঃস্ফূর্ত কবিতা বানিয়ে ফেলেছিলেন।
এই আড্ডার একেবারে শেষের দিকে কয়েকবার এসেছেন আর এক প্রখ্যাত কবি, স্তেপান মালার্মে।
শিল্পীদের মধ্যে আসতেন পিসাররা, রেনোয়া, ক্লদ মোনে। মানে আর মোনে, প্রায় একইরকম নাম, গোড়ার দিকে অনেকে গুলিয়ে ফেলত। পরে দুজনেই আলাদা ধরনের শিল্পী হিসেবে বিখ্যাত হন, এবং দু’জনের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল।
মোনেকে অসম্ভব দারিদ্র্যের কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে একসময়। খেতে-না-পাওয়ার স্তরেও নেমে আসতে হয়েছিল। মোনের মিস্ট্রেস (পরে স্ত্রী) কামিল যখন একটি সন্তানের জন্ম দেয়, মোনে তখন বাধ্য হয়ে একা মফস্বলে পিসির বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, খবর পেয়ে পুত্রমুখ দর্শন করার জন্য প্যারিসে আসার ট্রেনভাড়াও তাঁর জোটেনি। এই দারিদ্র্যের কথা উল্লেখ করতে হল এই জন্যে যে, এখন মোনের একটি ছবি পঞ্চাশ লাখ টাকায় বিক্রি হলেও বেশ সস্তা বলতে হবে। মোনে অবশ্য দীর্ঘজীবী হয়েছিলেন, ছিয়াশি বছরের জীবনে তিনি তিন হাজারেরও বেশি ক্যানভাসে ছবি রেখে গেছেন। মোনে সম্পর্কে সেজান বলেছিলেন, ‘ওর তো শুধু চোখ–কিন্তু কী অসাধারণ চোখ!’
এঁদের তুলনায় বয়েসে কিছুটা ছোট হলেও সেজান আসতেন এই আড্ডায়। আসতেন সিসলে, এদগার দেগা, আমেরিকান শিল্পী হুইশলার। এবং নাদার। নাদার ঠিক লেখকও নন, শিল্পীও নন, এক আধুনিক রূপকথার নায়ক। তাঁর উপস্থিতি একটা ঝড়ের মতন, অসাধারণ তাঁর প্রাণশক্তি। শিল্পী, লেখক সবারই তিনি প্রিয়। বোদলেয়ার এই নাদার সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, সাধারণ মানুষের চেয়ে দ্বিগুণ হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, পাকস্থলি ইত্যাদি রয়েছে এই মানুষটার। বোদলেয়ার এঁকে একটি কবিতা উৎসর্গ করেছেন, মানে উৎসর্গ করেছেন ছবি। জুল ভার্ন তাঁর ‘পৃথিবী থেকে চাঁদে’ নামে বইতে একটি চরিত্র গড়েছেন নাদার-এর আদলে, তার নাম আরদাঁ (Nadar ওলটালে অনেকটা Ardan হয়ে যায়)। নাদার কার্টুনিস্ট, সাংবাদিক, আবিষ্কারক। দু-একটা উপন্যাসও লিখেছেন। কিন্তু এসবের চেয়েও বড় পরিচয় তাঁর দুঃসাহসিক অভিযানস্পৃহা, প্রায়ই বেলুনে চেপে আকাশে উড়তেন। এবং তিনি সেকালের সবচেয়ে বিখ্যাত ফোটোগ্রাফার।
আড্ডাধারীদের বিচিত্র পোশাক, বিভিন্ন ধরনের মেজাজ। কামিল পিসারোকেও প্রচণ্ড দারিদ্র্যের মধ্যে বহু বছর কাটাতে হয়েছে, তবু বরাবরই তিনি শান্ত, ধীরস্থির। সমসাময়িক শিল্পীদের নিয়ে একসঙ্গে চলার চেষ্টা তিনি করে গেছেন সারাজীবন। ভাইয়ের মতন, বন্ধুর মতন অন্যদের পরামর্শ দিয়েছেন, নিজের দুঃসময়েও অন্য বিপদাপন্ন শিল্পীদের আশ্রয় দিয়েছেন। পরবর্তীকালে যিনি হয়ে ওঠেন আর এক শিল্প আন্দোলনের নেতা, সেই পল সেজানকে একসময় পিসাররা নিজের পাশে বসিয়ে আঁকায় সাহায্য করেছেন। যদিও দুজনের চরিত্রের একটুও মিল ছিল না। তরুণ বয়েসে সেজান ছিলেন অতিশয় দুর্মুখ, যেমন ছিলেন দেগা। নিষ্ঠুর ঠাট্টা-বিদ্রূপ করায় এঁদের জুড়ি ছিল না। দেগা একবার এক সমালোচক সম্পর্কে বলেছিলেন, সেই সমালোচকটি জাতে ফরাসি হলেও জন্ম হয়েছিল জার্মানিতে) ‘ওই লোকটা জার্মানি থেকে গাছে গাছে লাফিয়ে এখানে এসে পৌঁছেছে।’ পল সেজান অন্যদের সঙ্গে কটু-কাটব্য করলেও সমীহ করতেন এদুয়ার মানে কে। নোংরা, ঘেঁড়া ঝুলিঝুলি পোশাক, চুল আঁচড়ানো নেই। সেই অবস্থায় কাফেতে এসে অন্যদের সঙ্গে হাত ঝাঁকুনি দিতে-দিতে এগোলেও তিনি শৌখিনবাবু এদুয়ার মানের সামনে থমকে দাঁড়াতেন। তারপর বলতেন, ‘মসিউ মানে, আমি আপনার সঙ্গে করমর্দন করব না। কারণ আমি সাতদিন স্নান করিনি।
এই আড্ডায় কোনও মহিলা শিল্পী ছিল না। কারণ, তখনও ভদ্রঘরের মেয়েদের কাফে-রেস্তোরাঁয় আড্ডায় যোগ দেওয়াটা চালু হয়নি। নচেৎ, এঁদের অনেকের বান্ধবী অতীব রূপসী বার্থ মরিসো, যাঁকে মডেল করে মানে বেশ কয়েকটি ছবি এঁকেছেন, এবং যিনি নিজেও ছিলেন প্রতিভাময়ী শিল্পী, তিনি নিজের যোগ্যতাতেই এখানে স্থান করে নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি থাকতেন আড়ালে। এই নারীবর্জিত আড্ডায় নিশ্চিত সবচেয়ে বেশি অস্বস্তি বোধ করতেন অগুস্ত রেনোয়া। নারী-চিন্তায় বিভোর এই শিল্পী প্রকৃতির মধ্যেও নারীকে দেখতে পেতেন। রেনোয়া একবার বলেছিলেন, ‘‘ঈশ্বর যদি নারীদের সৃষ্টি না করতেন, তা হলে বোধহয় আমি শিল্পীই হতাম না।’
কাফে গেরবোয়ার টেবিলগুলো শ্বেত পাথরের, তার ওপর সবসময় ওয়াইন ও বিয়ারের ফেনা। সবাই গুটি গুটি এখানে এসে জমায়েত হতেন বিকেল পাঁচটায়, এঁরা অনেকেই উন্মুক্ত স্থানে ছবি আঁকতেন বলে রোদ পড়ে গেলে ক্যানভাস গুটিয়ে ফেলতেন, অন্যান্য দু-একটা দিন কারুর বাদ পড়েও গেলেও বেস্পতিবার দিনটায় সবার আসা চাই ই, আড্ডা চলত অনেক রাত পর্যন্ত। পয়সা ফুরিয়ে গেলে কাফে ছেড়ে সবাই চলে যেত কাছেই এদুয়ার মানের স্টুডিয়োতে। বন্ধুদের খাদ্য ও সুরা দিয়ে আপ্যায়ন করতে মানের কখনও কার্পণ্য ছিল না।
আর কোনও নির্দিষ্ট বিষয় থাকে না, শিল্পী এবং লেখকরা যে সবসময় শিল্প কিংবা সাহিত্য নিয়েই কথা বলবেন তার কোনও মানে নেই, পরচর্চা, কেচ্ছা-কাহিনি থেকে রাজনীতি, অনেক কিছুই চলে আসতে পারে। ফরাসি দেশের রাজনীতিও তখন বেশ সরগরম। ফরাসি বিপ্লব ব্যর্থ হয়ে গেলেও গণতন্ত্রের ধারণা অনেকের মনে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়ে গেছে, এদিকে তখন তৃতীয় নেপোলিয়ান সিংহাসনে বসে রাজতন্ত্র চাপিয়ে দিয়েছেন, তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক লেগেই থাকে।
কিন্তু একটা বিষয় আড্ডার মধ্যে প্রায়ই ঘুরে ফিরে আসে। রিয়েলিজম বা বাস্তববাদ। এই শব্দটিই তখন সদ্য তৈরি হয়েছে, এই ধারণাটি বেশ কিছুদিন ধরে শিল্পী সাহিত্যিকদের পীড়িত করছে। রনেশাঁসের সময় সকলের দৃষ্টি ফিরে গিয়েছিল ক্লাসিকাল যুগের দিকে। তারপরেও তো আবার কয়েকশো বছর কেটে গেল। এখন শিল্পীদের মনে হচ্ছে, সমসাময়িক কালকে বাদ দিলে শিল্প হয় না। চোখের সামনে যা দেখছি, তার থেকে চোখ ফিরিয়ে অতীত ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে থাকাটা একঘেয়েমির পর্যায়ে এসে গেছে। সৌন্দর্যনির্মাণই শিল্পের শেষ কথা, কিন্তু আধুনিক জীবন, বাস্তব জীবনে কি সৌন্দর্য নেই?
কিন্তু কোন পদ্ধতিতে ফুটিয়ে তোলা হবে সেই বাস্তব? সেটা খুঁজে পাওয়াই তো শক্ত। বাস্তব মানে কি হুবহু বাস্তব? আমরা চোখের সামনে যা দেখি, সবসময় কি তার সামগ্রিক গভীরতা দেখতে পাই? সাহিত্য, শিল্প কি শুধ আয়না? কিংবা সেই আয়নার প্রতিফলনের ওপর একটা বক্তব্য চাপিয়ে দেওয়াই কি বাস্তবতা? অনেকেই তখন বলতে লাগলেন, চাক্ষুষ দৃশ্যই আসল সত্য, তার বাইরে আর কিছু শিল্প হতে পারে না। পরিদের আর আঁকা যাবে না। কারণ, পরিদের কেউ দেখতে পায় না। কুরবে নামে একজন শিল্পী যেমন জোর দিয়ে ঘোষণা করেছিলেন, ‘শিল্প হচ্ছে একটা বস্তুগত ভাষা, যার শব্দগুলি দৃশ্যমান জিনিস।’ অনেকে সেইভাবেই আঁকতে লাগলেন। কবিতা থেকে রোমান্টিক যুগের অবসান হয়ে গেল, গদ্যও হয়ে উঠল সামসাময়িক।
বোদলেয়ার এবং মানে এই দুজনেই শিল্পে সমসাময়িকতার প্রভাব থাকা উচিত এটা স্বীকার করেছিলেন, কিন্তু শিল্প মানেই বাস্তবের প্রতিচ্ছবি, এটা মেনে নিতে পারেননি। নতুন শিল্পরীতি ঠিক কী হবে, সে বিষয়েও নিঃসংশয় হওয়া সেই সময় সহজ ছিল না। বোদলেয়ার বলেছিলেন, ‘পুরোনো ধারা বাতিল হয়ে গেছে, নতুন ধারার এখনও সৃষ্টি হয়নি।’
সত্যিকারের অভিযাত্রীরা আগামী বছরেই আমাদের সেই দুর্লভ আনন্দের স্বাদ দিক, যাতে আমরা নবীনকে স্বাগত জানাতে পারি।
হুবহু বাস্তবতার সমর্থকরা যখন দলে বেশ ভারী, সেই সময়েই আর একটা যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে গিয়েছিল।
১৮৩৯ সালে এল জে এম ডাগের নামে এক ভদ্রলোক হঠাৎ এক গোপন খবর জানিয়ে দিলেন। সিলভার নাইট্রেট মাখানো তামার পাতের ওপর সূর্যের আলো নিয়ে পরীক্ষা করতে-করতে তিনি যে কোনও জিনিসের ছবি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। কালি, কলম, রং দিয়ে আঁকা নয়, তবু ছবি! এ যেন ম্যাজিক। তামার পাতের ওপর যে কোনও জিনিস, যে-কোনও মানুষের প্রতিচ্ছায়া স্থায়ী হয়ে যাচ্ছে। এই জিনিসটার নাম প্রথম দিক ছিল ডাগেরোটাইপ, কিছুদিনের মধ্যেই তা ফোটোগ্রাফি নামে পরিচিত হয়। এই আবিষ্কার শুধু বিজ্ঞানের জগতে নয়, মানুষের সভ্যতার ইতিহাসেও একটা বিস্ফোরণের মতন। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের বিস্ময়ের মধ্যে ফোটোগ্রাফি যে অন্যতম প্রধান তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
শিল্পের ইতিহাসেও এর গুরুত্ব অসাধারণ। যারা বাস্তবতার দাবি তুলেছিল তাদের তখন অনায়াসে বলা যেতে পারত, এবার নাও, কত হুবহু বাস্তব চাও! ফোটোগ্রাফ মিথ্যে বলে না। চোখের সামনে যা দেখছ, তা সবই ফুটে উঠছে। তা হলে রং-তুলি নিয়ে আঁকবেটা কী? যাঁরা শুধু পোট্রেট এঁকে দুচার পয়সা রোজগার করত তাদের ভাত মারা যাওয়ার উপক্রম হল। সাধারণ মানুষ ফোটোগ্রাফির অভিনবত্বই লুফে নিল।
প্রথম যুগে কেউ কেউ অবশ্য ফোটোগ্রাফিকে ‘প্রকৃতির ওপর জোচ্চুরি’ বলে আখ্যা দিয়েছে। আবার অনেক শিল্পীও ফোটোগ্রাফির দিকে আকৃষ্ট হয়েছে। কাফে গেরবোয়ার অন্যতম আড্ডাধারী যে নাদার, সে যেমন সাহসী অ্যাডভেঞ্চারার, তেমনই ভালো ফোটোগ্রাফার, বেলুনে চড়ে সে আকাশ থেকে প্যারিস শহরের ছবি তুলেছে, এরকম দৃশ্য কেউ আগে দেখেনি, তাই নাদারের অত খাতির ছিল। এই নতুন জিনিসটার প্রতি কৌতূহল রইল বটে, কিন্তু অনেক শিল্পী ও কবি নিছক বাস্তবতার দায়িত্ব ফোটোগ্রাফির কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে অন্যদিকে মুখ ফেরাল। বর্ণনার বদলে এল প্রতীক ও রূপকল্প, দর্পণের ছবির বদলে এল বিমূর্ত রূপ। সাহিত্য-শিল্পে ধারাবাহিকতা ছিন্ন হয়ে গেল বলা যায়।
সাধারণ মানুষ প্রথমেই এই সম্পূর্ণ দিক বদল মেনে নিতে পারবে না, এ তো স্বাভাবিক, কিন্তু যাঁরা পণ্ডিত, যাঁরা বিশেষজ্ঞ, যাঁরা সমাজের হর্তাকর্তা, ওঁরাও দারুণ খেপে উঠলেন, তাঁদের মনে হল, এ যেন শিল্প-সাহিত্যের ব্যভিচার। যে ছবি সুন্দর, নিখুঁত করে আঁকা নয়, তা কী করে শিল্প হবে? যে কবিতা পড়া মাত্র বোঝা যায় না, তা আবার কী কবিতা? মানে এবং বোদলেয়ারকে এই নব্য রীতির ধ্বজাধারী হিসেবে প্রচুর লাঞ্ছনা, গঞ্জনা ও অপমান সহ্য করতে হয়েছে।
মানের থেকে বয়েসে বেশ কিছু বড় ছিলেন বোদলেয়ার, ওঁদের বন্ধুত্ব দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি। মাত্র ছেচল্লিশ বছর বয়েসে সিফিলিস রোগে, অর্ধ উন্মাদ অবস্থায় বোদলেয়ার মারা যান।
প্রথাসিদ্ধ ধারায়, নিশ্চিন্তে ভালোমানুষের মতন ছবি আঁকবেন ভেবেছিলেন মানে। কিন্তু ভেতরের কোনও রহস্যময় তাড়নায় তিনি একত্রিশ বছর বয়েসে এঁকে ফেললেন, ‘ঘাসের ওপর দুপুরের খাওয়া-দাওয়া’র মতন ছবি। সে ছবি তুমুল আলোড়নের সৃষ্টি করল, অজস্র নিন্দা-মন্দ গালাগাল বর্ষিত হল তাঁর ওপর। কিন্তু শিল্পকলার নতুন ইতিহাসও যে শুরু হল সেই সময় থেকে, তা অনেকেই বুঝতে পারেনি। বোদলেয়ারের কাব্যগ্রন্থ ‘অশিব পুষ্প’ এবং মানের পূর্বোক্ত ছবি এবং ‘অলিমপিয়া’ তুল্যমূল্য বলা যায়। মানে বেঁচেছিলেন একান্ন বছর, ততদিনে তাঁর অনুজ ও অনুগামী শিল্পীরা ইমপ্রেশানিস্ট ছবির আন্দোলন অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন, জীবদ্দশায় কিছুটা সমাদর পেয়ে গেছেন এদুয়ার মানে। কিন্তু বোদলেয়ার যে কবিতায় একটা লণ্ডভণ্ড কাণ্ড ঘটিয়ে গেলেন, তাঁকে দিয়েই আধুনিক কবিতার শুরু, সেটা বোদলেয়ার জেনে বা বুঝে যেতে পারলেন না।
কাফে গেরবোয়া’র আড্ডা ভেঙে যায় ১৮৭০ সালের যুদ্ধের সময়। বিসমার্কের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেন সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ান। আসল নেপোলিয়ানের ভাইয়ের এই ছেলেটির যুদ্ধ-কৃতিত্বের তেমন কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কিছুদিনের মধ্যেই এক লক্ষ সৈন্যসমেত তৃতীয় নেপোলিয়ান বন্দি হলেন। প্রাশিয়ান সৈন্য ফ্রান্সের একটার পর একটা জেলা দখল করে ঘিরে রাখল প্যারিস। হোটেল-রেস্তোরাঁ সব তো বন্ধ হয়ে গেল বটেই, সাধারণ মানুষের খাদ্য জোটে না। শিল্পী-সাহিত্যিকরা কেউ কেউ রেজিটান্স বাহিনীতে যোগ দিল। কেউ কেউ প্যারিস ছেড়ে পালাল। মানে জাতীয় রক্ষী বাহিনীর লেফটেনান্ট হলেন, মা ও স্ত্রীকে পাঠিয়ে দিলেন বাইরে। নাদারের বেলুনে চিঠি পাঠাতেন। একটা চিঠিতে মাকে লিখলেন, ‘এখন আমরা ঘোড়ার মাংস খাচ্ছি। গাধার মাংস তো রাজপুত্রদের খাদ্য।’ ভিক্টর হুগো তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন, ‘এখন আমরা যা খাচ্ছি, তা বোধহয় ঘোড়ার মাংসও নয়। হয়তো কুকুরের মাংস। কিংবা ইঁদুরের মাংস নাকি? মাঝে মাঝে আমার পেট ব্যথা হচ্ছে। আমরা কী খাচ্ছি না নিজেরাই জানি না।…চিড়িয়াখানার একটা হাতিকে মারা হয়েছে। সে কাঁদছিল। ওকেও খাওয়া হবে!’
যুদ্ধ, আত্মসমর্পণ, আবার গৃহযুদ্ধ, প্রচুর রক্তপাতের পর প্যারিস অনেকটা শান্ত হল প্রায় দু’বছর পর। শিল্পী-সাহিত্যিকরা সকলেই ফিরে এল বটে, কিন্তু সেই আড্ডা আর জোড়া লাগল না।
শিল্পী কবি লেখকদের এরকম এক জায়গায় খোলামেলা মেলামেশার, পরস্পর ভাব বিনিময়, তর্কাতর্কি ও সমমর্মিতায় শিল্প ও সাহিত্য একই সঙ্গে সমৃদ্ধ হয়েছে। শিল্প ও সাহিত্য পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে চলে, একটা পেছনে পড়ে থাকলে অন্যটাও বেশি দূর এগোতে পারে না।
এই রকম আচ্ছার কথা অবশ্য আর বিশেষ শোনা যায় না।
ফোটোগ্রাফি জনপ্রিয় হতে লাগল দিন দিন। বাস্তবতা ও বিমূর্ততার লড়াই চলতেই থাকল। একদল ধরে রইল যে বাস্তবের প্রতিচ্ছবিকে শিল্প-সাহিত্যে কিছুতেই অস্বীকার করা যাবে না। আর একদল লেখক-শিল্পী বাস্তবের কোনো রকম অনুকরণকেই শিল্প বলতে রাজি নয়। চাক্ষুষ দৃশ্যের চেয়ে অবচেতনের অনুভূতিই তাঁদের কাছে মুখ্য।
গত শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে শিল্প-সাহিত্য আধুনিকতার এই যে আধুনিক রূপচিন্তা তারও অনেক বিবর্তন ঘটে যায়। নিখুঁত শিল্প সুন্দর শিল্প এবং ফোটোগ্রাফির বাস্তবতা থেকে সরতে-সরতে শিল্পসৃষ্টি এত বেশি বিমূর্ততায় চলে যায় যে তা চূড়ান্ত দুর্বোধ্যতায় পৌঁছে যায়। ছবির মধ্যে কোনও কাহিনি থাকবে না, চরিত্র থাকবে না, এই নীতি মানতে মানতে ছবি হয়ে যায় একটা আয়তনের মধ্যে কিছু রঙের ছোপ। বিশেষ এক শ্রেণির শিল্পবোদ্ধা ছাড়া সেসব ছবির রস গ্রহণ করা সাধারণ মানুষের সাধ্যের অতীত হয়ে গেল। ছবিটা উলটো না সোজা করে টাঙানো, সেটাই হয়ে গেল একটা ধাঁধা।
ফ্রান্সের যাঁরা সমাজতান্ত্রিক, যাঁরা বাস্তবতার দর্শনে বিশ্বাসী, তাঁরা এক সময় উচ্চ গলায় বলেছিলেন, এত কাল ছবি আঁকা হত দেবতা এবং রাজা-রাজড়ার জন্য। কিন্তু এখন সময় এসেছে, শিল্প হবে সাধারণ মানুষের জন্য। কিন্তু এই সম্পূর্ণ বিমূর্ত চিত্রকলার সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগ কোথায়, এসব ছবিকে কিছু মুষ্টিমেয় শিল্পবোদ্ধা সার্টিফিকেট দেয় আর রাজা-রাজড়াদের বদলে বর্তমানের ধনী ব্যবসায়ী শ্রেণি সেগুলি কিনে জমা করে রাখে। অন্যদিকে বাস্তববাদীতের মতবাদ আঁকড়ে রইলেন সমাজতান্ত্রিক দেশের নীতি নির্ধারকেরা। সেখানে এর নাম হল সোসালিস্ট রিয়েলিজম, যার মধ্যে আবার বিমূর্ততার কোনও স্থানই নেই, কল্পনার খেলা নিষিদ্ধ। সেখানেও বাস্তবতার নামে যেসব রাশি রাশি ছবি আঁকা হতে লাগল, তা গতানুগতিকতারই নামান্তর। তার দু-চারখানা দেখার পরেই মনে হয়, এর বদলে রঙিন ফটোগ্রাফই বা মন্দ কী!
সাহিত্যেও আধুনিকতার বিবর্তন এল অন্যভাবে।
বহু শতাব্দী ধরে ধর্ম, দর্শন, সমাজতত্ব, বিজ্ঞান এই সব কিছুর ওপরেই আধিপত্য করেছে সাহিত্য। হঠাৎ বিজ্ঞান অনেক কদম এগিয়ে এল। তাত্বিক আলোচনা ছেড়ে বিজ্ঞান যেই হাতে-কলমে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রবৃত্ত হল, অমনি সে ফুলে ফেঁপে বিশাল আকার ধারণ করল। তখন আর তার সাহিত্যকে তোয়াক্কা করার দরকার নেই। এই সময় ভলতেয়ার একটা দারুণ উক্তি করেছিলেন, যা আজও প্রণিধানযোগ্য। ‘I love Physics so long it did not try to take precedence over poetry, now that it is crushing all the arts, I no longer wish to regard it as anything but a tyrant.’
এখন মানুষের জীবনে বিজ্ঞানের যা ভূমিকা, সেই তুলনায় সাহিত্য-শিল্প কিছুই না। তবে এখনও বিজ্ঞানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষকে আটকে রাখার ক্ষমতা রাখে ধর্ম কিংবা ধর্মীয় অন্ধ বিশ্বাস। পৃথিবীর অনেক জায়গাতেই যে সে চেষ্টা প্রবলভাবে চলছে, তা বলাই বাহুল্য।
পৃথিবীর লেখকসমাজ ধর্মকে পরিহার করেছে মোটামুটি একশো বছর আগে থেকে। অনেকের ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস থাকতে পারে কিন্তু ধর্মকে অবলম্বন করে এখন আর সাহিত্য রচিত হয় না। পাঠকসমাজকে আকৃষ্ট করার অন্য কোনও অস্ত্রও হাতে না পেয়ে সাহিত্য খানিকটা অসহায় হয়ে পড়ল। ছাপাখানার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যের যতখানি সাম্রাজ্য বিস্তারের কথা ছিল, তা হয়নি। শিক্ষিতের হার অনেক বেড়ে গেল বটে, তারা ছাপার অক্ষর পড়ে, কিন্তু অনেকেই সাহিত্য পড়ে না।
শ’দুয়েক বছর আগেও কবিতার স্থান ছিল সাহিত্যের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত। হঠাৎ গদ্য হুড়মুড়িয়ে শাখাপ্রশাখা বিস্তৃত করতে থাকে। সাহিত্যে স্পষ্ট দুটি ভাগ এসে যায়। আধুনিক মননে কবিতা হয়ে ওঠে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর, বেশি লোক পড়বে না জেনে গিয়ে অল্প সংখ্যক রসিকদের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে লাগল কবিরা। বিমূর্ত চিত্রকলার মতনই, কবিতাও হয়ে উঠল ধ্বনিসর্বস্ব, আকারে ছোট হতে লাগল। পৌঁছে গেল দুর্বোধ্যতার চরম সীমায়, মোটামুটি শিক্ষিত পাঠকও কবিতার প্রতি বিমুখ হল। গদ্য এতটা ঝুঁকি নিল না। পাঠকের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার দায় মেনে নিলেন গদ্য লেখকরা, গল্প উপন্যাস নিল অনেকটাই মনোরঞ্জনের ভূমিকা। দু-চারজন ব্যতিক্রম অবশ্যই আছেন, যাঁরা গদ্যভাষা নিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন কবিতারই মতন। কিন্তু অধিকাংশ গদ্য লেখকই বাস্তবধর্মী বর্ণনা, ন্যারেটিভ স্টাইলের সঙ্গে কখনও-সখনও পরাবাস্তব ও কল্পনার উদ্দামতা মিলিয়ে পাঠকদের নিজেদের জীবন ও আকাক্ষার ছবিই দেখাতে চাইলেন। কবিতার এরকম কোণঠাসা অবস্থা দেখে টি এস এলিয়ট যদিও বললেন, কবিতাও এক ধরনের এন্টারটেইনমেন্ট, সুপিরিয়র এন্টারটেইনমেন্ট, কিন্তু সে কথায় অনেকেই কান দেয়নি। অতিশয় ব্যক্তিগত কবিতা, পাঠকরা বুঝুক বা না বুঝুক তাতে কিছু যায় আসে, এরকম মনোভাব নিয়ে লিখে যেতে লাগলেন কবিরা। এই শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে পুরোপুরি বিমূর্ত চিত্রকলা দেখে লোকে যেমন বলতে শুরু করল, উলটো-সোজা বোঝা যায় না, তেমনি কবিতা সম্পর্কেও অনেকে বলাবলি শুরু করল, ডান দিক থেকে বা বাঁ দিকে থেকে পড়লেও তো একই রকম অবোধ্য। তবে ধনী শ্রেণির মধ্যে যেহেতু ছবি সংগ্রহ করা ফ্যাশানের অন্তর্গত হয়ে গেছে বা ইদানীং গুপ্ত সম্পদ হিসেবে গণ্য, তাই বিমূর্ত শিল্পেরও গ্রাহকদের অভাব হল না। তিন ফুট বাই দু ফুট একটা ক্যানভাসের ওপর একজন শিল্পী না খেয়ে না দেয়ে কিছু রং দিয়ে যে একখানা ছবি এঁকেছেন, শিল্পবোদ্ধাদের সার্টিফিকেট থাকলে সেই ছবির দাম এখনও হেসে-খেলে কয়েক কোটি টাকা। সেই তুলনায় কবিরা কারুর পৃষ্ঠপোষকতাও পায়নি, জনপ্রিয়তাও হারিয়েছে।
এখন অবশ্য আবার একটা পরিবর্তনের পালা এসেছে। ছবি এবং কবিতা দুটোই দুর্বোধ্যতা থেকে সরে আসছে আস্তে আস্তে। সে আলোচনায় আর আমি যেতে চাই না।
আমার মতে, গত শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে এই শতাব্দীর প্রথম কয়েকটি দশক পর্যন্ত ফরাসি দেশে যেসব ছবি আঁকা হয়েছে, সেসব কবিতা রচিত হয়েছে, তা এখনও বিশ্বসেরা। আমি সেই সব শিল্পীদেরই কিছু কিছু পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করেছি, সেই সময়কার কবিদের রচনার অংশবিশেষ অনুবাদ করে দিয়েছি। খুব সাম্প্রতিক কালের শিল্প সাহিত্যের কথা বলতে পারিনি। কারণ, বিশেষ কিছু জানি না।
এক সময় বিশ্বের শিল্পের কেন্দ্রভূমি ছিল ফ্রান্স, নানা দেশ থেকে শিল্পীরা গিয়ে সেখানে জড়ো হত, এখন সেই কেন্দ্রটা সরে গেছে। এখন নিউ ইয়র্কে শত শত আর্ট গ্যালারি, সেখানে কারুর প্রদর্শনীর ব্যবস্থা হলে ভাগ্য খুলে যায়। তরুণ, গরিব শিল্পীরাও কোনওক্রমে নিউ ইয়র্কে পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করে। সেখানে জীবনযাত্রার খরচও প্যারিসের চেয়ে অনেক কম। ফরাসি কবিতাও আর তেমন মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি, ইভ বনফোরার পর কোনও বড় কবির সন্ধান আমি পাইনি। বিজ্ঞানের দাপটে পশ্চিমি দেশগুলিতে কবিতা এখন ম্রিয়মাণ। যত ধনী দেশ, তত কবিতার প্রতি অনীহা। ও সব দেশে কবিতা পাঠের আসরে দুশো আড়াইশো এলেই মনে করা হত যথেষ্ট। ডেনমার্কের একজন প্রধান কবি আমাকে বলেছিলেন, তাঁর কবিতার বই দুশো কপি বিক্রি হওয়া মানে বিরাট সার্থকতা, যদিও সে দেশে শতকরা একশোজনই শিক্ষিত। কবিতা বুঝি এখন শুধু গরিবদের খাদ্য। ভারত ও বাংলাদেশে কবিতা নিয়ে আজও মাতামাতি দেখে সাহেবরা অবাক হয়।
অতি আকস্মিকভাবে আমার প্রথমবার বিদেশযাত্রা ঘটে গিয়েছিল। প্রায় সেইরকমই আকস্মিকভাবে মার্গারিট ম্যাতিউ নামে একটি শিল্পসাহিত্য পাগলিনী ফরাসি যুবতীর সঙ্গে আমার পরিচয় ও হৃদ্যতা হয়। তার সঙ্গেই আমি প্রথম ফরাসি দেশে যাই। সে আমাকে ইমপ্রেশানিস্ট ও এক্সপ্রেশানিস্ট শিল্পীদের ছবিগুলি চিনিয়েছিল, সে তার প্রিয় কবিদের কবিতা ও অনর্গল মুখস্থ বলত। সেই সব ছবি, সেই সব কবিতা আজও আমার মনে গেঁথে আছে। সেগুলিই আজও আমার সবচেয়ে প্রিয়।
তারপরেও আমি বেশ কয়েকবার ফরাসি দেশে গেছি, কোনওবারই কোনও সরকারি বা বেসরকারি আমন্ত্রণে নয়, কোনও পূর্ব নির্ধারিত কারণেও নয়। হঠাৎ হঠাৎ। অন্য কোনও দেশে আচমকা নেমন্তন্ন পেয়ে গেছি, তখনই মনে হয়েছে ফরাসি দেশ ছুঁয়ে যাব কেন? সেখানে অসীম রায় রয়েছে, একবার কোনওক্রমে পৌঁছে গেলে আর কোনও চিন্তা নেই।
মার্গারিট বেঁচে থাকলে এতদিনে তার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক হত, তা জানি না। তবে ফরাসি দেশের মাটিতে পা দিলেই আমি যেন শুনতে পাই তার যৌবনময় কণ্ঠস্বর। তার উচ্ছলিত হাসির শব্দ, তার চোখ দিয়েই এখনও অনেক কিছু দেখি।
অসীম আমাদের বিদায় দিতে আসে এয়ারপোর্টে। ভাস্কর চলে যায় লন্ডনে। আমি আর বাদল ভারতমুখী বিমানের দিকে এগোই। প্রত্যেকবারই আমার মনে হয়, এবারই শেষ, আর কি আসা হবে এদেশে? তবু মনে মনে বলি, আবার দেখা হবে! আবার দেখা হবে!
কয়েক মাস পরেই অসীম চিঠি লেখে, আবার কবে আসছ এদিকে? ভাস্কর লেখে, কী রে, আবার একটা বেড়াবার প্ল্যান করে ফ্যাল। প্রতি বছর পুজোর আগে বাদল তল্পিতল্পা গুছিয়ে চলে যায় ফ্রাংকফুর্টের বিশ্ব বইমেলায়। আমার যাওয়া হয় না, আমি যাই তখন সাঁওতাল পরগনায় কিংবা ওড়িশার জঙ্গলে। আবার পরের বছরই হয়তো আচমকা একটা ডাক আসে সুইডেনে যাওয়ার। অমনি রক্ত চলকে ওঠে। হ্যাঁ, সুইডেন অদেখা দেশ, সেখানে যেতে ভালো লাগবে তো নিশ্চয়ই, কিন্তু তা বলে আকাশপথ কিছুটা বাঁকিয়ে ফরাসি দেশে কি থাকব না কয়েকটা দিন?
সেখানে গেলেই পাই বন্ধুদের সাহচর্যের উত্তাপ, জেগে ওঠে প্রথম যৌবনের স্মৃতি, চারপাশে টের পাই এককালের মহান শিল্পী-কবিদের পরিমণ্ডল। তাই তৃপ্তি হয় না, বারবার ফিরে আসতে ইচ্ছে করে।