তন্ত্রের অর্থ, প্রাচীনত্ব ও সম্প্রদায়-ভেদ
তন্ত্র মানে কী? তন্ত্র কতো প্রাচীন? হিন্দুতন্ত্রের সঙ্গে বৌদ্ধতন্ত্রের সম্পর্ক কী রকম?
এবার এই প্রশ্নগুলির আলোচনা করা দরকার।
ইতিপূর্বে অনেকেই তন্ত্রের অর্থ-নির্ণয় করবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সেই প্রসঙ্গে কথাটির সবচেয়ে সরল শব্দার্থের প্রতি উপযুক্ত মনোযোগ দেবার ইচ্ছা সবসময় চোখে পড়ে না। তার কারণ, তন্ত্রকে কোনো গূঢ় অধ্যাত্মবিদ্যা বলে ধরে নিয়ে অগ্রসর হলে ওই সরল শব্দার্থটির দিক থেকে তার উপর আলোকপাত হবার সম্ভাবনা থাকে না। অথচ, আমরা তন্ত্রের আদিরূপকে যে-অর্থে গ্রহণ করতে চাই তার সঙ্গে এই সরল শব্দার্থের সঙ্গতি অস্পষ্ট নয়।
তন্ ধাতুর উপর ষ্ট্রন্ প্রত্যয় করে তন্ত্র। তনোতি তন্যতে বা তন্ ষ্ট্রন্। তন্ ধাতুর অর্থ বিস্তৃত করা। বংশ-বিস্তার এর একটি মুখ্য অর্থ : তন্+আয়ট্=তনয়; সম্+তন্+ঘঞ=সন্তান। মনিয়ার উইলিয়ম্স্ দেখাচ্ছেন, পুরোনো পুঁথিপত্রে তন্ত্রের প্রজননার্থক ব্যবহার বিরল নয়। মহাভারতের অনুশাসন পর্বে ‘কুলস্য তন্ত্র’ শব্দ পাওয়া যায়; মনিয়ার উইলিয়ম্স্-এর মতে তার অর্থ হলো the principal action in keeping up a family, i.e., propagation। কাত্যায়নের শ্রৌতসূত্রে, আপস্তম্বর ধর্মসূত্রে ও তৈত্তিরীয় উপনিষদে নিম্নোক্ত অর্থে তন্ত্র শব্দের ব্যবহার হয়েছে : any one propagating his family in regular succession। মহাভারতে কুলতন্তুর অর্থ হলো propagating the succession of a family, ঐতরেয় ব্রাহ্মণে তন্তুকর্ত্রীর অর্থ line of descendants(৬২০)।
কিন্তু শুধু প্রজননই নয়। তন্ত্রের আক্ষরিক অর্থের মধ্যে খাদ্যাদি-উৎপাদনের ইঙ্গিতও খুঁজে পাওয়া যায়। তন্ত্রি কুটুম্বধারণে ঘঞ্। কুটুম্বকৃত্য=কুটুম্বদিগের ভরণাদি কার্য(৬২১)। স্বভাবতই, খাদ্যাদি-উৎপাদনই এই কার্যের মধ্যে অন্যতম। তাহলে, তন্ ধাতুর অর্থ যে বিস্তৃত করা তা শস্য-উৎপাদনবৃদ্ধিও বোঝাতে পারে। গৌণ (?) অর্থ হিসেবে তন্ত্র বলতে তাঁত বোঝায় : কৃষিবিদ্যার পাশাপাশি এই বয়নকর্মও মেয়েদেরই আবিষ্কার এবং তা কৃষিরই আনুষঙ্গিক আবিষ্কার(৬২২)।
তন্ত্রের আভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করে আমরা দেখাবার চেষ্টা করেছি যে, কৃষিকেন্দ্রিক জাদুঅনুষ্ঠানের মধ্যেই তন্ত্রের উৎস সে-অনুষ্ঠানের পিছনে মূল বিশ্বাস হলো মানবীয় প্রজননের সাহায্যে প্রকৃতির ফলপ্রসূতা-বৃদ্ধি। অতএব, তন্ত্রের এই জাতীয় শব্দার্থের সঙ্গে আমাদের উক্ত বিশ্লেষণের সঙ্গতি পাওয়া যায়।
তন্ত্র কতোদিনের পুরোনো? তান্ত্রিক পুঁথিপত্রগুলির সনতারিখ অনুসন্ধান করে অনেকে এই প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করেছেন। এবং এইদিক থেকে অগ্রসর হয়ে অনেকে সিদ্ধান্তে আসতে চাইছেন যে, ষষ্ঠ বা সপ্তম খৃষ্টাব্দে তন্ত্রের জন্ম(৬২৩)। আমরা বলতে চাই, এ-জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রথমত, তান্ত্রিক গ্রন্থগুলি অবশ্য প্রায়ই অর্বাচীন। এই অর্বাচীনতা যে কতোখানি চূড়ান্ত হতে পারে তার দৃষ্টান্ত(৬২৪) উদ্ধৃত করা যায় :
এদেশে মহানির্বাণতন্ত্র সর্বত্র বিশেষ আদৃত। কিন্তু অনেক স্থলে প্রবাদ প্রচলিত যে, মহাত্মা রামমোহন রায়ের গুরু এই তন্ত্রখানি রচনা করেন। শক্তিরত্নাকরে বৃহন্নির্বাণতন্ত্রের উল্লেখ আছে, কিন্তু নিতান্ত আধুনিক প্রাণতোষিণী ব্যতীত কোন প্রাচীন বা আধুনিক তন্ত্রসংগ্রহে মহানির্বাণতন্ত্রের উল্লেখ না থাকায়, ইহার আধুনিকত্বই প্রতিপন্ন হয়। আবার মেরুতন্ত্ৰে লণ্ড্রজ, ইঙ্গ্রেজ ইত্যাদি শব্দদ্বারা ভারতে ইংরেজাগমনের পর যে ওই তন্ত্র রচিত হইয়াছে তাহাই প্রতিপন্ন হইতেছে।
অতএব, তন্ত্রের লিখিত গ্রন্থগুলি কতো পুরোনো তার হিসেবের উপর নির্ভর করেই তন্ত্রের প্রাচীনত্ব নিরূপণ করা চলে না। অপরপক্ষে, আধুনিক গবেষকদের মধ্যে অনেকেই স্বীকার করছেন যে, এই তান্ত্রিক গ্রন্থাবলীর সনতারিখ যাই হোক না কেন, তান্ত্রিক ধ্যানধারণা ও আচার-অনুষ্ঠান সেই সনতারিখের তুলনায় অনেক প্রাচীন। এখানে, সে-জাতীয় কয়েকটি মন্তব্য উদ্ধৃত করা যায়।
Their date, however, it is impossible to determine with any precision. The existing treatises are probably for the most part at least reproductions with additions and variations of older works which are no longer extant. In their present form they are usually ascribed to the 6th. or 7th. cen. of our era, but they may be considerably later. Tantrik usages and popular formulas were current and practised in a much earlier age; they belong to a type of thought that is primitive and among primitive peoples varies little in course of the centuries(৬২৫).
এগুলির তারিখ সুনিশ্চিতভাবে নির্ণয় করা অসম্ভব। আজকাল যে-রচনাগুলি পাওয়া যায় সেগুলি খুব সম্ভব বিলুপ্ত ও প্রাচীনতর গ্রন্থেরই পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ। বর্তমানে এগুলিকে যে-রূপে পাওয়া যায় সাধারণত তার তারিখ ধরা হয় ৬ষ্ঠ বা ৭ম খৃস্টাব্দ; এগুলি আরো পরের যুগের হতে পারে। কিন্তু ঢের পুরোনো যুগ থেকেই তান্ত্রিক অনুষ্টান ও মন্ত্রাদি প্রচলিত ছিলো; এগুলি আদিম চিন্তাধারার পরিচায়ক এবং আদিম মা্নুষদের মধ্যে শতাব্দীর পর শতাব্দী উত্তীর্ণ হয়েও এ-জাতীয় চিন্তাধারায় পরিবর্তন সামান্যই ঘটে থাকে।
শ্রীযুক্ত পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়(৬২৩) বলছেন,
দুই চারিজন বিশেষজ্ঞ প্রত্নতত্ত্ববিদ বলিয়া থাকেন যে, তন্ত্রধর্ম বৈদিক ধর্মের মতন পুরাতন এবং সনাতন।
অবশ্যই এই কথার ব্যাখ্যা হিসেবে উক্ত প্রত্নতত্ত্ববিদেরা যা অনুমান করছেন তা স্বীকারযোগ্য কিনা সে-বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে :
এই সকল প্রত্নতত্ত্ববিদ্দিগের বিশ্বাস যে, শ্বেতাঙ্গ আর্যদিগের উদ্ভবের সময়ে অপেক্ষাকৃত কৃষ্ণাঙ্গ আর্যও একদল ছিল। বেদে কৃষ্ণাঙ্গ আর্যদিগের উল্লেখ পাওয়া যায়। ইহারা ইরান বা পারস্য দেশ হইতে বাহির হইয়া বর্তমান কাবুলের উত্তর উপত্যকা বাহিয়া, তাগ্লা-মাকান অধিত্যকা হইতে কাশ্মীরে নামিয়া ভারতবর্ষে আসিয়াছিল; পরে কাশ্মীর হইতে পার্বত্য প্রদেশ বাহিয়া বঙ্গদেশ পর্যন্ত ছড়াইয়া পড়িয়াছিল। অন্যদিকে গান্ধার সুবান্তু হইয়া লাট ও মহারাষ্ট্র প্রদেশ পর্য্নত ইহাদের বিস্তার ঘটিয়াছিল। ইহারাই নাকি ভারতবর্ষে তন্ত্রধর্ম আনয়ন করে…(৬২৭)
উত্তরকালের উন্নততর ঐতিহাসিক গবেষণার ফলে ওই শ্বেতাঙ্গ আর্যদের কপালেই অনেক বিপর্যয় ঘটে গিয়েছে; তথাকথিত কৃষ্ণাঙ্গ আর্যগুলির ভারতবর্ষে আগমন-কাহিনীর পক্ষে ঐতিহাসিক সত্যের সম্ভাবনা অবশ্যই আরো সংকীর্ণ। তাছাড়া, দেশান্তরে শাক্ত ধ্যানধারণার বা তান্ত্রিক আচার-অনুষ্ঠানের কোনো নিদর্শন পেলেই তা কোন পথে এ-দেশে এসেছিলো সে-কথা কল্পনা করবার প্রয়োজনও সত্যিই নেই। তার মানে এই নয় যে, প্রাচীন পৃথিবীতে দেশ থেকে দেশান্তরে ধর্মবিশ্বাস বা আচার-অনুষ্ঠানের আমদানি-রপ্তানিটা একান্তই অসম্ভব ব্যাপার। অনেক ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই তা ঘটেছিলো। আমাদের মন্তব্য শুধু এই যে, তাছাড়াও বিভিন্ন দেশে সমান্তরালভাবে, এবং অতএব পরম্পরের উপর প্রভাব-নিরপেক্ষভাবেই, একই বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানের উদ্ভব হওয়া অসম্ভব নয়। কেননা, মানববিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানের বাস্তব ভিত্তি আছে; সে-ভিত্তি শেষ পর্যন্ত মানুষের উৎপাটন-কৌশল : সমতুল্য পরিবেশে এবং সমতুল্য হাতিয়ারের উপর নির্ভর করে প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে বিভিন্ন দেশের মানুষ পরস্পরের উপর প্রত্যক্ষ-প্রভাব নিরপেক্ষভাবে প্রকৃতির রহস্যকে মোটের উপর একইভাবে বোঝবার আয়োজন করতে পারে।
আমাদের এই মন্তব্যের পক্ষে জীবন্ত প্রমাণ হলো পৃথিবীর পিছিয়ে-পড়ে-থাকা মানুষগুলি। এদের মধ্যে যারা আজো কৃষিবিদ্যার প্রাথমিক পর্যায়ে আটকে রয়েছে তাদের ধ্যানধারণা আর আচার-অনুষ্ঠান অন্তত কাঠামোর দিক থেকে একই রকম। এ-বিষয়ে আমরা ইতিপূর্বেই প্রাসঙ্গিক তথ্য উদ্ধৃত করেছি। এবং আমরা আরো দেখেছি যে, প্রাচীন মানুষদের মধ্যে যারা কৃষিবিদ্যার প্রাথমিক পর্যায়ে ছিলো তাদের প্রত্নতত্ত্বমূলক ও অন্যান্য কীর্তিগুলি থেকেও একই বিশ্বাস, একই ধ্যানধারণা অনুমান করা অসঙ্গত নয়। অথচ, আজকের পৃথিবীতে নানান জায়গায় যে-সব মানবদল ওই রকমের পিছিয়ে-পড়া পর্যায়ে আটকে রয়েছে তাদের ধ্যানধারণার উপর পরস্পরের প্রত্যক্ষ প্রভাব অনুমান করা যে-রকম অসঙ্গত, সেই রকমই অসঙ্গত হলো তাদের উপর বিলুপ্ত পৃথিবীর মানুষদের ধ্যানধারণার প্রত্যক্ষ প্রভাব অনুমান করবার প্রচেষ্টা।
অতএব, কোনো সুদূর অতীতে পারস্যে বা মধ্য এসিয়ার কোথাও যদি তান্ত্রিকাদি ধ্যানধারণার নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায় তাহলেই এ-কথা অনুমান করবার তাগিদ নেই যে, বাংলার তান্ত্রিক বিশ্বাসও সেখান থেকেই আসতে বাধ্য(৬২৮)। একই পরিবেশে উভয় দেশের মানুষই প্রকৃতির সঙ্গে একইভাবে বুঝতে গিয়ে একই কথা চিন্তা করতে পারে। যে-কারণে, আজকের পৃথিবীর পিছিয়ে-পড়া মানুষদের মধ্যেও আমরা এই তান্ত্রিক ধ্যানধারণ আর আচার-অনুষ্ঠানের নিদর্শন পেয়ে থাকি।
পৃথিবীর পিছিয়ে-পড়া মানুষদের কথা উঠলো বলেই এখানে কাল-নির্ণয় প্রসঙ্গে একটি মন্তব্য অবান্তর হবে না। তন্ত্রের কাল-নির্ণয় শুধুমাত্র সনতারিখের ব্যাপার হতে পারে না। কিংবা, সনতারিখের সাহায্যে তন্ত্রের কাল-নির্ণয় প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত অনেকাংশেই ভ্রান্ত হবার ভয়। তার কারণ, বিভিন্ন মানবদলের অসমান উন্নতি। এই অসমান উন্নতির ফলে পৃথিবীর নানান মানবদল উন্নতির নানান পর্যায়ে আটকে পড়ে আছে; যার আজো কৃষিবিদ্যার প্রাথমিক পর্যায় পেরিয়ে আসতে পারেনি তাদের দিক থেকে বিচার করলে তন্ত্র কোনো আদিম কালের ব্যাপার নয়, সাম্প্রতিক— এমনকি সমসাময়িক—বিশ্বাস ও সাধনপদ্ধতি। আবার যারা সহস্ৰ বছর আগে কৃষিবিদ্যার ওই প্রাথমিক পর্যায়টিকে পিছনে ফেলে এসেছে তাদের দিক থেকে বিচার করলে তন্ত্র সহস্র বছরের পুরোনো বিশ্বাস ও অনুষ্ঠান।
অবশ্যই, সামগ্রিকভাবে এই কৃষিকাজই ভারতীয় অর্থনীতির প্রধানতম অঙ্গ এবং আমরা আগেই দেখেছি, এ-দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিলো বলেই কৃষিবিজ্ঞার প্রাথমিক পর্যায়ের নানান অঙ্গ উত্তরযুগেও আমাদের দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়নি। অতএব, আধুনিক যুগেও আমাদের দেশে ওই প্রাচীন পর্যায়ের ধ্যানধারণাগুলির এমন ব্যাপক ও গভীর প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়।
কিন্তু সেই সঙ্গেই মনে রাখা দরকার যে, উত্তরকালে—বিশেষত লিখিত পুঁথিপত্রের মাধ্যমে,—তান্ত্রিক বিশ্বাস ও অনুষ্ঠান হিসেবে যার পরিচয় পাওয়া যায় তাকেই তন্ত্রের আদি ও অকৃত্রিম রূপ মনে করলে ভুল হবে। শ্ৰীযুক্ত পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়(৬২৯) বলছেন, “এখন যে ভাবে যে-সকল তন্ত্রগ্রন্থ এদেশে প্রচলিত আছে, তাহা হইতে তত্ত্বকথা খুঁজিয়া বাহির করা বড়ই কঠিন।” কিন্তু প্রশ্ন হলো, তার কারণ কী?
প্রথমত, আমরা আগেই বলেছি, যে-মূর্ত পরিস্থিতিতে এ-জাতীয় বিশ্বাস ও অনুষ্ঠানের উদ্ভব, সেই পরিস্থিতি থেকে উৎপাটিত হয়ে উত্তরকালের পরিস্থিতিতেও টিকে থাকবার সময় এই বিশ্বাস ও অনুষ্ঠানগুলির আদি-তাৎপর্য অনিবার্যভাবেই বিপরীতে পর্যবসিত হয়েছে; যতোই কাল্পনিক আর অসম্ভব হোক না কেন, মানসিক উদ্দীপনার উৎস হিসেবে অতীতে (বা, পিছিয়ে-পড়ে থাকা মানুষদের জীবনে, বর্তমানেও) এই তন্ত্রই ছিলো জীবন-সংগ্রামের অঙ্গ, উৎপাদন কৌশলের সহায়ক। অথচ, উত্তরকালের ধর্মবিশ্বাস আর ধর্মানুষ্ঠান ছিসেবে টিকে থাকবার সময় এই তন্ত্রই আজ অর্থহীনতায় ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দ্বিতীয়ত, উত্তরপর্যায়ে রচিত হয়েছে বলেই তান্ত্রিক পুঁথিপত্রগুলির মধ্যে উত্তরকালের অজস্র ধ্যানধারণা অনিবাৰ্যভাবেই প্রবেশলাভ করেছে। শ্ৰীযুক্ত পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়(৬৩০) যেমন বলছেন, “বাঙ্গালীকে ব্রাহ্মণ-শাসনাধীন করিতে পূৰ্ব্বকালের ব্রাহ্মণগণকে তান্ত্রিক এবং বৌদ্ধ ধর্মের সহিত অনেকটা আপোস করিতে হইয়াছিল।…আধুনিক তন্ত্রগ্রন্থে যে এই আপোসের নিদর্শন অতি সুস্পষ্ট, তাহা তন্ত্রের পাঠকমাত্রেই জানেন।” আপোসজনিত ধ্যানধারণাগুলি শুধুই যে বিজাতীয় তাই নয়; বহুলাংশে পরস্পর-বিরোধীও—কেননা, তা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ধ্যানধারণা। বিজাতীয়, কেননা এই সব তান্ত্রিক পুঁথিপত্রে পূজা, উপাসনা, মোক্ষ, এমন কি ব্ৰহ্মজ্ঞানের কথাও এসে জুটেছে; অথচ, তান্ত্রিক দেহতত্ত্বের আলোচনা প্রসঙ্গে আমরা একটু পরেই দেখতে পাবো যে, তন্ত্রের আদি-রূপটির সঙ্গে আধ্যাত্মিক ধ্যানধারণার সঙ্গতি যে থাকতে পারে না, তা অনুমান করবার প্রভূত কারণ রয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র বিজাতীয় ধ্যানধারণাই নয়, পরস্পরবিরোধী ধ্যানধারণাও। আর, তার সবচেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো হিন্দুতন্ত্র ও বৌদ্ধতন্ত্র উভয়ের চেয়েও অনেক প্রাচীন এবং উত্তরকালে হিন্দুধৰ্মমূলক ধারণা এবং বৌদ্ধধৰ্মমূলক ধারণ তন্ত্রের উপর প্রক্ষিপ্ত হয়েই যে তথাকথিত হিন্দুতন্ত্র এবং বৌদ্ধতন্ত্রের জন্ম দিয়েছে,—একথা ইতিপূর্বে যোগ্য বিদ্বানেরা স্বীকার করেছেন। শ্রীযুক্ত পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়(৬৩১) বলছেন,
তন্ত্রসাহিত্য পড়িয়া যতদূর বুঝা যায়, তাহাতে ইহা মনে দৃঢ় বিশ্বাস হয় যে, তন্ত্রধর্মই বাংলার আদিম ধর্ম। …এখন কথা এই যে, বৌদ্ধতন্ত্রধর্ম অতি পুরাতন কোন মূল তান্ত্রিক ধর্মের বৌদ্ধ সমন্বয়, কি একেবারেই একটা নতুন ধর্ম, তাহা এখনও স্থির হয় নাই। আমার মনে হয়, একটা অতি পুরাতন তন্ত্রধর্ম এদেশে খুব প্রচলিত ছিল; বৌদ্ধধর্ম সেই ধর্মের সহিত মিশিয়া প্রবলতর আকার ধারণ করিয়াছিল। তন্ত্রের অধিকতর আলোচনা হইলে এ-প্রশ্নের মীমাংসা পরে হইবে।
পরে, তন্ত্রের অধিকতর আলোচনা করেই অধ্যাপক শশীভূষণ দাসগুপ্ত(৬৩২) পাঁচকড়িবাবুর ওই সিদ্ধাস্তকেই সমর্থন করতে চাইলেন :
Tantrism is neither Buddhist nor Hindu in origin. : it seems to be a religious undercurrent, originally independent of any abstruse metaphysical speculation, flowing on from an obscure point of time in the religious history of India. With these practices and yogic processes, which characterise Tantrism as a whole, different philosophical, or rather theological, systems got closely associated in different times…
কিংবা(৬৩৩),
Side by side with the commonly known theological speculations and religious practices, there has been flowing in India, an important religious undercurrent of esoteric yogic practices from a pretty old time; these esoteric practices, when associated with the theological speculations of the Saivas and the Saktas, have given rise to Saiva and Sakta Tantrism; when associated with the Buddhistic speculations, have given rise to the composite religious system of Buddhist Tantrism; and again, when associated with the speculations of Bengal Vaisnavism, the same esoteric practices have been responsible for the growth of the esoteric Vaisnavite cult, known as the Vaisnava Sahajia movement,
অতএব(৬৩৪)
The real origin of the cult lies more outside Buddhism than inside it.
অর্থাৎ সংক্ষেপে, উৎসের দিক থেকে তন্ত্র বৌদ্ধও নয়, হিন্দুও নয়। অতি প্রাচীন কাল থেকে তন্ত্র-সাধনার স্রোত এ-দেশে প্রবাহিত ছিলো। আদিতে তার সঙ্গে কোনো রকম জটিল দার্শনিক তত্ত্বের সম্পর্ক ছিলো না। সেই আচরণ ও যোগসাধনাই হলো সামগ্রিকভাবে তন্ত্রের প্রধান লক্ষণ। উত্তরযুগে তার সঙ্গে বিভিন্ন দার্শনিক কিংবা ধৰ্মমূলক মতবাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। কিংবা,
দেশে সাধারণভাবে যে-সব ধর্মবিশ্বাস ও সাধনপদ্ধতির পরিচয় পাওয়া যায় তার পাশাপাশি অনেক পুরোনো যুগ থেকে আর একরকম গুহ্য সাধনার ফল্গুস্রোত বয়ে চলেছে। এই গুহ্য সাধনার সঙ্গে শৈব ও শাক্ত মতবাদের সম্পর্ক ঘটে জন্ম হয়েছে শৈব বা শাক্ত তন্ত্রের; বৌদ্ধ চিন্তাধারার সম্পর্ক ঘটে জন্ম হয়েছে বৌদ্ধ তন্ত্রের; বাংলার বৈষ্ণবধর্মের সম্পর্ক ঘটে জন্ম হয়েছে বৈষ্ণব সহজিয়া আন্দোলনের।
অতএব, এই তন্ত্রের উৎস সন্ধানে বৌদ্ধধর্মের ভিতরের চেয়েও বৌদ্ধধর্মের বাইরের দিকেই দৃষ্টি আবদ্ধ রাখা দরকার।
আমাদের যুক্তিও ঠিক তাই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বৌদ্ধধর্মের বাইরের ঠিক কোন ক্ষেত্রটিকে অনুসন্ধান করে আমরা এই তন্ত্রের আদি-রূপকে উদ্ধার করতে পারবো? দুঃখের বিষয়, ডক্টর শশীভূষণ দাসগুপ্ত এই মৌলিক প্রশ্নটির প্রতি তেমন গভীর মনোযোগ দেননি। তার বদলে তিনি বরং ওই বৌদ্ধাদি ধ্যানধারণাগুলিকে তন্ত্রের উপর প্রক্ষিপ্ত বলে স্বীকার করা সত্ত্বেও, আপেক্ষিকভাবে এগুলিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। অবশ্যই, দেশে প্রচলিত ওই অতি-প্রাচীন তন্ত্রসাধন বৌদ্ধ, শৈব, বৈষ্ণব প্রভৃতি সম্প্রদায়ের সংস্পর্শে এসে কী রূপ নিয়েছে তার আলোচনা অবান্তর নয়; ডক্টর শশীভূষণ দাসগুপ্ত প্রধানতই লে-আলোচনা করেছেন এবং তাতে মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের উপর আলোকপাত হয়েছে। কিন্তু এই সম্প্রদায়গুলিকে বোঝবার ব্যাপারে তার চেয়ে মৌলিক কাজ হলে, ওই যে সুপ্রাচীন সাধনপদ্ধতি এ-দেশে প্রবাহিত ছিলো বলে স্বীকার করা হয়েছে তারই উৎস নির্ণয় করা।
আমাদের যুক্তি অনুসারে, সে-সমস্যা সমাধান করবার পদ্ধতি হবে, প্রাচীন পর্যায়ে আটকে-পড়ে-থাকা দেশবিদেশের মানুষগুলির বাস্তব বিশ্বাস ও ধ্যানধারণ সম্যকভাবে বিশ্লেষণ করা। এবং এই পদ্ধতি অনুসারে অগ্রসর হয়েই আমরা দেখেছি যে, কৃষিবিদ্যার প্রাথমিক পর্যায়ে আটকে-থাকা নানা জাতীয় মানবদলের দৃষ্টান্তে যে-বিশ্বাস ও আচরণ চোখে পড়ে তার মধ্যেই তন্ত্রসাধনার আদি-রূপটিকে আজো জীবন্তভাবেই আবিষ্কার করা সম্ভব।
বৌদ্ধ-তন্ত্র এবং হিন্দু-তন্ত্রের সমস্যাকে আরো একটু খুঁটিয়ে দেখবার চেষ্টা করা যায়। বিশ্বকোষের লেখক(৬৩৫) বলছেন :
হিন্দুতন্ত্রের বিষয় পুর্বে যে-রূপ লিখিত হইল, বৌদ্ধতন্ত্রগুলিতে ঐরূপ বিবরণ বর্ণিত হইতে দেখা যায়। হিন্দুতন্ত্রোক্ত শিব দুর্গ প্রভৃতি নামগুলিই যেন বজ্রসত্ব, বজ্ৰডাকিনী প্রভৃতি নামে রূপান্তরিত হইয়াছে। বৌদ্ধতন্ত্রেও চণ্ডী, তারা, বারাহী প্রভৃতির উপাসনা প্রচলিত আছে। শিবোক্ত তন্ত্রে যে-রূপ অদ্ভূৎ অদ্ভূত দেবমূর্তি কল্পিত হইয়াছে, বৌদ্ধতন্ত্রেও হেরুকাদি দেবদেবীর মূর্তিও তদ্রুপ বর্ণিত আছে।…
বৌদ্ধতান্ত্রিকগণও মালামন্ত্র, মাতৃকা, কবচ, হৃদয়াদি অতি গুহ্য বলিয়া জানেন। বৌদ্ধতন্ত্রেও ওই সকল গুহ্য বিষয় অধিকারী ভিন্ন অপর কাহারও নিকট প্রকাশ করিবার নিষেধ আছে।…
বুদ্ধমত-প্রতিপাদ্য বৌদ্ধশাস্ত্রে পঞ্চমকারের নিন্দ ও গ্রহণে নিষেধ আছে। কিন্তু বৌদ্ধতান্ত্রিকগণ তাহার অন্যথা করিয়া থাকেন। পঞ্চমকারের সেবা বৌদ্ধতন্ত্রের একটি প্রধান অঙ্গ। যে মদ্যমাংস গ্রহণ বৌদ্ধশাস্ত্রে বিশেষরূপে নিষিদ্ধ হইয়াছে, বৌদ্ধতন্ত্রে তাহার সুখ্যাতি দৃষ্ট হয়।…
…যিনি প্রকৃত সিদ্ধতান্ত্রিক বৌদ্ধতন্ত্রে তিনিই বীরনায়ক বলিয়া অভিহিত। বৌদ্ধ তান্ত্রিকগণও এই জগৎ বামোদ্ভব বলিয়া স্বীকার করেন। বৌদ্ধতন্ত্রে চক্ৰপুজা, বীরযাগ, ভগপুজা প্রভৃতির বিষয়ও বর্ণিত আছে।
বৌদ্ধ তান্ত্রিকদের মধ্যেও দক্ষিণাচারী এবং বামাচারীর মধ্যে প্রভেদ দেখা
যায় (৬৩৬) :
…the two Tantrik schools maintain that all beings are vajrasattvas, are the unique Vajrasattva; they also maintain that the nature of vajra is immanent in all beings and can be actualized by appropriate meditations and rites.
Now the left-hand school conceives the nature of vajra according to the Saivite pattern; the right-hand school is nearer the Vedantist or Yoga tradition…
In the Tantras of the Saivite type we have to deal with a Buddhist adaptation of Saivism and Saktism. The three traditional bodies of a Buddha are preserved, but the true nature of vajrasattva is his fourth body,…the body of vajra; it is with that body that the eternal tathagata or bhagavat eternally embraces his sakti, Tara or Bhagavati. From this erotic conception of the nature of being or the divine being it follows that, in order to actualize his real divine nature, the ascetic must perform the rites of union with a woman (yogini, mudra) who is the personification of Bhagavati, who is Bhagavati herself; as it is said, buddhatvam yosidyonisamasritam, ‘Buddhahood abides in the female organ’……The most conspicuous topic of this literature is what is called the stripuja, ‘worship of women’ : disgusting practices, both obscene and criminal, including incest, are a part of this puja, which is looked upon as the true, heroic behaviour, (dushkaracharya) of a bodhisattva, as the fulfilment of the perfect virtues. Buddhist mythology and mysticism are freely mixed with saktas: the semen is the five Buddhas, etc…
বামাচার ও দক্ষিণাচারের তর্জমা হিসেবে left-hand school এবং right-hand school শব্দ ব্যবহারের মতোই আধুনিক রুচিবোধ ও নীতিবোধের নিক্তিতে লেখক ওই আদিম বিশ্বাসের যেভাবে মূল্য নির্ণয় করবার চেষ্টা করছেন তা অবশ্যই ভ্রান্ত। কিন্তু আমাদের যুক্তির বর্তমান পর্যায়ে আলোচ্য বিষয় হলো, তথাকথিত বৌদ্ধ ও হিন্দুতন্ত্রের মধ্যে প্রভেদটা যে শেষ পর্যন্ত কতো কৃত্রিম তাই বিচার করা। উদ্ধত উক্তির মধ্যে সে-স্বীকৃতির স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। এবং ওই বৌদ্ধতন্ত্রের স্ত্রীপূজা বা ‘বুদ্ধত্বম্ যোষিদ্যোনি-সমাশ্ৰিতম্’ জাতীয় বাক্যের মধ্যে এ-ইঙ্গিত থেকে গিয়েছে যে, উক্ত ধ্যানধারণা শুধুমাত্র মাতৃপ্রধান সমাজের পরিচায়ক নয়, সেই আদিম জাদুবিশ্বাসেরও পরিচায়ক— যে-জাদুবিশ্বাস অনুসারে নারী-জননাঙ্গই সৃষ্টির আদি-কারণ : এ-জগৎ বামোদ্ভূত।
আমাদের যুক্তি অনুসারে, কৃষিবিদ্যা মেয়েদের আবিষ্কার। ফলে প্রাথমিক পর্যায়ের কৃষিকেন্দ্রিক সমাজ নারীপ্রধান। এই পর্যায়ের কৃষিবিদ্যার অপরিহার্য অঙ্গ যে-জাদুঅনুষ্ঠান তার মূল কথা হলো, নারীর প্রজননশক্তির সাহায্যে প্রকৃতির ফলপ্রসূতাকে আয়ত্তে আনবার প্রচেষ্টা। এই জাদুঅনুষ্ঠানের মধ্যেই তন্ত্রসাধনার উৎস খুঁজে পাওয়া যায়। উত্তরকালেও আমাদের দেশে উৎপাদন-কৌশলের বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়ে থেকেছে। ফলে দেশের আচার-অনুষ্ঠান ও ধ্যানধারণার ক্ষেত্র থেকে কৃষিবিদ্যার ওই প্রাথমিক পর্যায়ের স্মারকগুলি বিলুপ্ত হয়নি—যদিও এই স্মারকগুলির মধ্যে উক্ত আচার-অনুষ্ঠান ও ধ্যানধারণার আদি-তাৎপর্য অনিবাৰ্যভাবেই বিপরীতে পর্যবসিত হয়েছে। এই কারণেই আমাদের দেশে এতোদিন ধরে তন্ত্রসাধনার এমন ব্যাপক ও গভীর প্রভাব। অবশ্যই, উত্তরকালে এই তন্ত্রসাধনার উপর হিন্দু-ধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের নানা বিষয় প্রক্ষিপ্ত হয়েছে। ফলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, তন্ত্রসাধনা দ্বিবিধ, হিন্দু ও বৌদ্ধ। স্বভাবতই, হিন্দুধৰ্মমূলক ও বৌদ্ধধৰ্মমূলক ওই অধ্যস্ত বিষয়গুলির উপর দৃষ্টি আবদ্ধ রাখলে তন্ত্রসাধনার স্বরূপকে চেনা যাবে না। আমাদের দেশের বৈদান্তিকেরা সাধারণত একটি উপমা ব্যবহার করে থাকেন। তারই উপর নির্ভর করে আমরাও এখানে আমাদের বক্তব্য উপস্থিত করতে পারি। জবাফুলের সংস্পর্শে এসে স্ফটিক যদিও রক্তবর্ণ বলে প্রতিভাত হয় তবুও স্ফটিকের স্বরূপ উপলব্ধি করতে হলে এই রক্তবর্ণের উপর দৃষ্টি আবদ্ধ রাখা ভুল হবে। তেমনিই, হিন্দুধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের সংস্পর্শে এসে তন্ত্রসাধনার উপর যে-সব ধ্যানধারণা অধ্যস্ত হয়েছে তারই উপর দৃষ্টি আবদ্ধ রাখলে এ-সাধনার স্বরূপ উপলব্ধি সম্ভবপর হবে না।
আধুনিক বিদ্বানদের মধ্যে অনেকেই স্বীকার করছেন যে, অতি আদিম যুগ থেকে আমাদের দেশে তন্ত্রসাধনার একটি স্রোত বয়ে চলেছে। তারই সঙ্গে হিন্দুধর্মের মিশেল হয়ে হিন্দুতন্ত্রের এবং বৌদ্ধধর্মের মিশেল হয়ে বৌদ্ধতন্ত্রের জন্ম হয়েছিলো। যদি তাই হয় তাহলে মানা দরকার, তান্ত্রিক পুঁথিপত্রগুলির মধ্যে থেকে হিন্দুতন্ত্রের হিন্দুত্ব এবং বৌদ্ধতন্ত্রের বৌদ্ধত্ব সচেতনভাবে সরিয়ে রেখেই আমরা তন্ত্রসাধনার আকৃত্রিম রূপটির পরিচয় পেতে পারি।
হিন্দুতন্ত্রের পুঁথিপত্রে নানান কথা পাওয়া যায় : পূজা, মোক্ষ, স্বর্গপ্রাপ্তি, ব্ৰহ্মজ্ঞান। তাছাড়া নানান দেবদেবীর কথা তো আছেই। এমন কি বেদান্তদর্শনের অনেক ধ্যানধারণাও এই গ্রন্থগুলির মধ্যে খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। তন্ত্রসাধনার আলোচনায় স্বভাবতই এগুলির কথা অপ্রাসঙ্গিক হওয়া উচিত।
বৌদ্ধতন্ত্রের পুঁথিপত্রে নির্বাণ, বজ্রসত্ব, প্রজ্ঞাপারমিতা, বোধিসত্ত্ব প্রভৃতি বিবিধ বিষয়ের উল্লেখ প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। তাছাড়াও, যোগাচার মাধ্যমিক প্রভৃতি দার্শনিক সম্প্রদায়ের তত্ত্বকথাও বৌদ্ধতন্ত্রের পুঁথিতে বিরল নয়। গবেষকের দৃষ্টি এগুলির প্রতি আবদ্ধ হলে তন্ত্রসাধনার মৌলিক রূপটি তার চোখে ধরা পড়বে না।
পুঁথিপত্রে পাওয়া তন্ত্রসাধনার রূপ থেকে এইভাবে হিন্দুধর্ম ও হিন্দুদর্শন এবং বৌদ্ধধর্ম ও বৌদ্ধদৰ্শনের প্রসঙ্গ সচেতনভাবে বাদ দিলে কী বাকি থাকে? কৃষিকেন্দ্রিক জাদুঅনুষ্টান এবং তার অন্তর্নিহিত আদিম বিশ্বাস। পৃথিবীতে যে-সব মানবদল আজো ওই আদিম পর্যায়ের কাছাকাছি আটকে পড়ে আছে তাদের দিকে চেয়ে দেখলে এই বিশ্বাস ও অনুষ্ঠানের রূপটি আরো প্রকটভাবে আমাদের চোখে ধরা পড়বে। তাই আমাদের পদ্ধতি অনুসারে, তন্ত্রকে বোঝবার জন্যে ওই পিছিয়ে-পড়ে-থাকা মানুষদের দিকে চেয়ে দেখা দরকার : তন্ত্রের লিখিত পুঁথিপত্রের মধ্যে যেসব কথা উত্তরকালের ধ্যানধারণার জটিলতায় অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে সেগুলির জীবন্ত—অতএব স্পষ্টতর—রুপ পৃথিবীর পিছিয়ে-পড়া মানুষদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়।
————————–
৬২০. M. Monier-Williams SED—তন্ত্রI cf. শঙ্কর ব্রহ্মসূত্র-ভাষ্য ২.১.৩ “কপিলস্য তন্ত্রস্য” ইত্যাদি।
৬২১. বিশ্বকোষ ৭:৫০৪।
৬২.২. R. Briffault op cit. 1:46lsq.
৬২৩. ERE 12:192.
৬২৪. বিশ্বকোষ ৭:৫০৮ ।
৬২৫. ERE 12:192.
৬২৬. পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় : রচনাবলী ২:২৫৯ ৷
৬২৭. ঐ ২:২৫৯-৬০।
৬২৮. cf. G. Thomson SAGS 239.
৬২৯. পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় : রচনাবলী ২:২৭৪ ।
৬৩০. ঐ ২:২৮০-১।
৬৩১. ঐ ২:২২০।
৬৩২. S. Dasgupta ORC 27.
৬৩৩. Ibid. xxxiv.
৬৩৪. Ibid.
৬৩৫. বিশ্বকোষ ৭:৫৪৭।
৬৩৬. ERE 12.194.