৩৬তম অধ্যায়
সারথ্যগ্রহণে দ্ৰৌপদীর প্রতি অর্জ্জুনের গুপ্ত ইঙ্গিত
উত্তর কহিলেন, “যদি আমি একজন তুরঙ্গনিয়োগবিশারদ সারথি প্রাপ্ত হই, তাহা হইলে অবিলম্বেই সুদৃঢ় শরাসন ধারণপূর্ব্বক সংগ্রামে গমন করি; কিন্তু আমার সারথ্যপদে অভিষিক্ত হইতে পারে, এমত লোক দৃষ্টিগোচর হয় না। অতএব অবিলম্বে একজন উপযুক্ত সারথির অন্বেষণ কর। অষ্টবিংশতি রাত্রি কি একমাস ব্যাপিয়া যে মহাযুদ্ধ হইয়াছিল, তাহাতেই আমার সারথি গতজীবিত হইয়াছে। এক্ষণে যদি হয়যানবেত্তা কোন এক ব্যক্তিকে প্রাপ্ত হই, তাহা হইলে অচিরাৎ মহাধ্বজসমুচ্ছ্রিত [উচ্চে উত্থিত] গজবাজিরথসন্ধুল পরবলে প্রবেশপূর্ব্বক দুৰ্য্যোধন, ভীষ্ম, কৰ্ণ, দ্রোণ, অশ্বত্থামা প্রভৃতি সমাগত মহাধনুৰ্দ্ধরগণকে পরাজিত করিয়া পশুযূথ প্রত্যানয়ন করিতে পারি। কৌরবগণ শূন্যদেশ [অরক্ষিত স্থান] পাইয়া সমস্ত গোধন অপহরণপূর্ব্বক প্রস্থান করিতেছে। আমি তথায় বিদ্যমান থাকিলে তাহারা কি এই ব্যাপারে কৃতকৃত্য হইতে সমর্থ হইত? যাহা হউক, এক্ষণে সমাগত কৌরবগণ অদ্য আমার বলবীৰ্য্য প্রত্যক্ষ করুক। স্বয়ং ধনঞ্জয় কি আমাদিগের প্রতিপক্ষে আগমন করিয়াছেন?”
ধনঞ্জয় রাজপুত্রের বাক্য শ্রবণ করিয়া নির্জনে দ্রৌপদীকে কহিলেন, “কল্যাণি! তুমি আমার বাক্যানুসারে শীঘ্র রাজপুত্ৰ উত্তরকে বল যে, বৃহন্নলা পাণ্ডবগণের সারথ্যভার গ্রহণ করিয়া মহাযুদ্ধে কৃতকাৰ্য্য হইয়াছেন, অতএব উনিই আপনার সারথি হইবেন।”
বিরাটপুত্ৰ অর্জ্জুনের নামকীর্ত্তনপূর্ব্বক স্ত্রীগণমধ্যে বারংবার আত্মশ্লাঘা করিতেছেন শ্রবণ করিয়া দ্রুপদতনায়া সহ্য করিতে পারিলেন না। তিনি উত্তরের সমীপবর্ত্তিনী হইয়া সলজভাবে ধীরে ধীরে কহিলেন, “রাজপুত্র! ঐ প্রিয়দর্শন বৃহদ্বারাণসন্নিভঙ্গ [বৃহৎ হস্তিতুল্য] বৃহন্নলা পূর্ব্বে অর্জ্জুনের সারথি ছিলেন। উনি সেই মহাত্মারই শিষ্য, ধনুর্বিদ্যায় তাহা অপেক্ষা ন্যূন নহেন। আমি পাণ্ডবগৃহে বাসকালে উঁহার সমুদয় বৃত্তান্ত অবগত হইয়াছি। যখন হুতাশন খাণ্ডববন দাহ করেন, তৎকালে উনিই ধনঞ্জয়ের সারথি হইয়াছিলেন। ধনঞ্জয় খাণ্ডবপ্রস্থে উহারই সারথ্য সহকারে সর্ব্বভূত পরাজয় করিয়াছিলেন। ফলতঃ উহার সমান সারথি আর কেহই নাই।”
উত্তর কহিলেন, “সৈরিন্ধ্রি!! ঐ নপুংসক যুবা যে প্রকার লোক, তাহা তুমি সবিশেষ অবগত আছ, যথাৰ্থ বটে, কিন্তু আমি স্বয়ং বৃহন্নলাকে আমার সারথকাৰ্য্য সম্পাদনে অনুরোধ করিতে পারি না।”
দ্ৰৌপদী কহিলেন, “রাজপুত্র! বৃহন্নলা আপনার যবীয়সী [কনিষ্ঠা] ভগিনীর বাক্য অবশ্যই রক্ষা করিবেন। যদ্যপি তিনি আপনার সারথ্যপদ পরিগ্রহ করেন, তাহা হইলে নিশ্চয়ই আপনি কৌরবগণকে পরাভব ও গোধনসমূদয় প্রত্যাহরণপূর্ব্বক পুনরাগমন করিবেন।”
উত্তর দ্রৌপদীর বাক্য শ্রবণ করিয়া ভগিনীকে কহিলেন, “উত্তরে! যাও, শীঘ্ৰ বৃহন্নলাকে আনয়ন কর।” উত্তরা ভ্রাতার আদেশক্ৰমে দ্রুতপদসঞ্চারে নর্ত্তনগৃহে ছদ্মবেশী অর্জ্জুনের সমীপে গমন করিলেন।