রাবণের রম্ভাবতী হরণ ও নলকুবের কর্ত্তৃক রাবণের প্রতি অভিশাপ প্রদান
কৈলাস পর্ব্বতে গেল বেলা অবসানে।
বাসা করি রাবণ রহিল সেই স্থানে।।
দ্বিতীয় প্রহর রাত্রে জাগে দশানন।
চন্দ্রের উদয় হেতু নির্ম্মল গগন।।
সুশীতল রাত্রি বহে বায়ু মনোহর।
ধবল রজনী শোভা করে সুধাকর।।
রাবণ মদনে মত্ত নারী নাহি পাশে।
হেনকালে রম্ভা যায় উপর আকাশে।।
রম্ভা নামে অপ্সরা সে পরমা সুন্দরী।
কপালে তিলক তার শোভে সারি সারি।।
রুপেতে করিল আলো যেন চন্দ্রকলা।
দেখিয়া রাবণ রাজা কামে হৈলা ভোলা।।
রম্ভা রম্ভা বলিয়া রাবণ ধরে হাতে।
তুষিতে কাহার প্রাণ যাহ এত রাতে।।
কোন্ নাগরের প্রতি যাহ রসবতী।
তাহারে এড়িয়া মোরে ভজ লো যুবতী।।
রতিশাস্ত্র অষ্টাদশবিধ আমি জানি।
তুমি আমি কেলি করি দিবস যামিনী।।
লাজে হেঁটমাথা রম্ভা বলে যোড়হাত।
আমার শ্বশুর তুমি রাক্ষসের নাথ।।
শ্বশুর হইয়া তুমি না ধরিহ হাতে।
কেন বা আইনু আমি হেন ছার পথে।।
রাবণ বলিল তুমি কাহার সুন্দরী।
কি সম্বন্ধে তুমি সে আমার বহুয়ারী।।
রম্ভা বলে যদি কর সম্বন্ধ বিচার।
আমাকে ছাড়িয়া দেহ করি পরিহার।।
শ্রীনলকূবর নামে কুবের-কুমার।
পতিব্রতা হই আমি রমণী তাঁহার।।
কুবের তোমার জ্যেষ্ঠ ধন-অধিকারী।
তাঁর পুত্রবধূ যে তোমার বহুয়ারী।।
শ্বশুর হইয়া কর বধূরে ধারণ।
আমাকে অপেক্ষি আছে কুবের-নন্দন।।
ধর্ম্মে মতি দেহ রাজা ছাড় পরিহাস।
হাত ছাড়ি দেহ যাই নায়কের পাশ।।
ছাড়ি দেহ লঙ্কেশ্বর আজিকার রাতি।
কল্য আসি তব সঙ্গে করিব পিরীতি।।
শুনিয়া রম্ভার কথা হাসিল রাবণ।
এ সময়ে পেলে নারী ছাড়ে কোন্ জন।।
পুরুষ হইয়া যদি পায় সে রমণী।
প্রাণান্তে নাহিক ছাড়ে শুন সুবদনি।।
মনেতে ভাবিয়ে রম্ভা দেখহ আপনি।
ইন্দ্ররাজা হরিলেন গুরুর রমণী।।
এতেক কহিল যদি রাজা লঙ্কেশ্বর।
মনে মনে ভাবে রম্ভা যা করে ঈশ্বর।।
দশানন বলে তুমি কি ভাবিছ আর।
কালি হইতে ভ্রাতৃবধূ হইও আমার।।
রম্ভা বলে মহারাজ কর পরিহার।
কালি আমি তব সঙ্গে করিব বিহার।।
রম্ভার বচন শুনি দশানন হাসে।
আজি বহুয়ারী কালি ঘুচিবেক কিসে।।
রম্ভা বলে আমার নিয়ম বলি শুন।
যে দিন যাহার পাশে করিব গমন।।
সেই দিন পতি সেই জানিহ নিশ্চয়।
একথা অন্যথা নাহি কদাচিৎ হয়।।
বিধির নির্ব্বন্ধ শুন রাক্ষসের পতি।
চিরদিন ধর্ম্ম রাখি এইরূপে সতী।।
নলকূবরের লাগি করিয়াছি যাত্রা।
আজি ছাড়ি দেহ রাজা রাখ এই বার্ত্তা।।
ধর্ম্ম রাখ নলকূবরের অনুরোধ।
বিলম্ব দেখিলে তিনি করিবেন ক্রোধ।।
আজি রাজা ছাড়ি দেহ তুমি মোর আশ।
দশ দিন থাকিব আসিয়া তব পাশ।।
বিশ্বশ্রবার পুত্র তুমি সুবুদ্ধি সুধীর।
পণ্ডিত হইয়া কেন এতেক অস্থির।।
রাবণ বলেও কথা আমারে নাহি লাগে।
আর দিন তব কাছে কেবা রতি মাগে।।
দৈবের ঘটনে আজি হাতে গেছ পড়ে।
হেন জন কেবা আছে স্ত্রী পাইলে ছাড়ে।।
পৃথিবীর নারী যদি হয়ত ঘটনা।
পাইলে না ছাড়ি আমি তার একজনা।।
এত যদি কহিলেক রাজা দশানন।
নাকে হাত দিয়া রম্ভা ভাবে মনে মন।।
বুঝি রাবণের হাতে পরিত্রাণ নাই।
মৌন হয়ে থাকি তবে যা করে গোঁসাই।।
এত ভাবি কহিলেক রাজা দশানন।
নাকে হাত দিয়া রম্ভা ভাবে মনে মন।।
বুঝি রাবণের হাতে পরিত্রাণ নাই।
মৌণ হয়ে থাকি তবে যা করে গোঁসাই।।
এত ভাবি মৌনভাবে থাকে রম্ভাবতী।
রাবণ বুঝিল রম্ভার হইল সম্মতি।।
কিছুই না বলে রম্ভা মৌনেতে থাকিল।
রম্ভারে চাহিয়া তবে রাবণ বলিল।।
হেঁটমুখে রহে রম্ভা রাবণ গোচর।
ভাল মন্দ রম্ভা কিছু না দিল উত্তর।।
অনুমানে বুঝিল রাবণ তার মন।
ধরিয়া শৃঙ্গার করে রাজা দশানন।।
একেত রাবণ তাহে রম্ভার ইঙ্গিত।
ইঙ্গিতে শৃঙ্গার রাজা করে বিপরীত।।
একে দশানন তাহে শৃঙ্গারে প্রবীণ।
একাসনে শৃঙ্গার করয়ে সপ্তদিন।।
রাবণের শৃঙ্গার না সহে কোন নারী।
সবে মাত্র সহে রম্ভা আর মন্দোদরী।।
হাত পা আছাড়ে রম্ভা রাবণের কোলে।
রাবণ শৃঙ্গার করে ধরি তার চুলে।।
রহ রহ বলি রম্ভা বলে রাবণেরে।
মুখেতে তর্জ্জন করে হরিষ অন্তরে।।
পুরুষের অষ্টগুণ স্ত্রীলোকের কাম।
তাহার বৃত্তান্ত কহি শুনহ শ্রীরাম।।
স্বভাবে পুরুষ হতে কামে মত্তা নারী।
তবু স্ত্রীলোকের মন বুঝিতে না পারি।।
হৃদয়ে আনন্দ মুখে করয়ে তর্জ্জন।
তিন লোকে নারীর বুঝিতে নারে মন।।
প্রকাশ না করে মুখে মনে পুড়ে মরে।
প্রকাশিয়া নাহি কয় পুরুষ-গোচরে।।
কঠিন রমণী-জাতি সৃজিলেন ধাতা।
অন্তরে পুড়িয়া মরে নাহি কয় কথা।।
পুরুষ অধিক নারী কামেতে পাগল।
তথাচ পুরুষ মন্দ স্বভাবে চঞ্চল।।
রমণী চঞ্চলা হয় কদাচ না শুনি।
রমণী এমন জাতি ভুলে যায় মুনি।।
লোভ মোহ কাম ক্রোধ ছাড়িয়া সকল।
হেন মুনি স্ত্রী দেখিলে হয়েন পাগল।।
কেহ না বুঝিতে পারে স্ত্রীলোকের ছল।
পুরুষ ভুলাতে নারী ফাঁদে নানা কল।।
শাস্ত্রমুখে জানি রাম সর্ব্ব বিবরণ।
নারীতে মজিলে যম গৌরব নিধন।।
রাম বলে যত বল সকলি স্বরূপ।
বিশেষ পুরুষ নাহি নারী অন্যরূপ।।
মুনি বলিলেন যার বড় ভাগ্যোদয়।
লোভ সম্বরণ করি তার নারী রয়।।
শৃঙ্গারেতে রমণী বাড়ায় অভিলাষ।
জনম অবধি তার নাহি পূরে আশ।।
দিনে দিনে বাড়ে লোভ নহে সম্বরণ।
সম্বরিতে পারে যদি নারী করে মন।।
যে রমণী পাপকর্ম্মে নাহি করে মতি।
উত্তমা রমণী জান সেই গুণবতী।।
সতীর অনেক গুণ শুন রঘুপতি।
অনেক খুঁজিলে নাহি মিলে এক সতী।।
এক গুণ নহে সতীর অনেক লক্ষণ।
সর্ব্ব গুণ ধরে দেহে সতী যেই জন।।
সতীর দেহেতে মহালক্ষ্মী মূর্ত্তিমান।
পূজা কৈলে পাপ খণ্ডে লক্ষ্মী অধিষ্ঠান।।
শত সহস্রেতে নারী মিলয়ে একটি।
সতী পাওয়া দুর্ল্লভ অসতী কোটি কোটি।।
আপনা উদ্ধার করে কুলের প্রতীকার।
অসতী হইলে কভু নাহিক নিস্তার।।
সতীর প্রশংসা রাম সকল পুরাণে।
অসতীর অপমান দেখ ত্রিভুবনে।।
অসতী অসত্যবাদী শুনহ লক্ষ্মণ।
প্রধান এক দোষ তার অধিক ভোজন।।
যাহা দেখে তাহা খাইতে করে সাধ।
রাত্রিদিন খায় তবু করয়ে বিষাদ।।
যত খায় ক্রমে ক্রমে তত বাড়ে আশ।
যার ঘরে হেন নারী তার সর্ব্বনাশ।।
তাহারে উদরে যত সন্তান-সন্ততি।
মাতৃদোষে তারা সবে হয়তো কুমতি।।
যে কর্ম্মে প্রবৃত্ত হয়ে করে অনাচার।
অনাচারে ব্রহ্মশাপে বংশের সংহার।।
বিপরীত ব্রহ্মশাপ হয় তার কুলে।
ব্রহ্মশাপে সবংশেতে পড়ে ডালে মূলে।।
পাপমতি স্ত্রী-পুরুষ যেই কুলে থাকে।
পাপে মজি তার বংশ যায় ত নরকে।।
অপকীর্ত্তি গায় তার সকল সংসার।
মরিলে নরকে যায় নাহিক নিস্তার।।
অসতী দেখিলে পাপ বাড়য়ে বিস্তর।
সতীরে দেখিলে পাপ পলায় সত্বর।।
সত্যের পালন করে মিথ্যা পরিত্যাগ।
দিনে দিনে ধর্ম্মপথে বাড়ে অনুরাগ।।
ধার্ম্মিকের বংশে জন্মি করে অনাচার।
আপনার দোষে হয় সবংশে সংহার।।
মুনিপুত্র দশানন জন্ম ব্রহ্ম-অংশে।
অনাচার অপকর্ম্মে সর্ব্বলোকে হিংসে।।
সৃষ্টিরে সৃজিয়া ব্রহ্মা করেন পালন।
বিশ্বশ্রবা করেন দেখ ধর্ম্ম-উপাসন।।
হেন বংশে জন্মি রাবণ করে কোন্ কর্ম্ম।
ধর্ম্মের নাহিক লেশ সকলি অধর্ম্ম।।
শ্রীরাম বলেন তব নাহি অগোচর।
রম্ভার বৃত্তান্ত কিছু কহ আরবার।।
মুনি বলিলেন শুন পুরাণ-কথন।
তদন্তরে রম্ভাবতী করিল গমন।।
শৃঙ্গারে রম্ভার বেশ হইল সংচূর।
স্বামীর চরণ ধরি কান্দিল প্রচুর।।
বলয়ে নলকূবর বেশ কেন আন।
কার ঠাঁই পাইয়াছ এত অপমান।।
কান্দিতে কান্দিতে রম্ভা তার পায়ে পড়ে।
তব কোপানলে প্রভু ত্রিভুবন পুড়ে।।
এতদিন ভ্রমি আমি ত্রিভুবনময়।
হেন অপমান মম কভু নাহি হয়।।
কোথাকার কার্য্য কোথা বিধাতা ঘটায়।
আচম্বিতে রাবণ আমার দেখা পায়।।
যে দিন যা হইবে বিধাতা সব জানে।
দৈবের ঘটনা হেন বুঝি অনুমানে।।
এমত বিপত্তি নাহি দেখি কোন কালে।
পথে পেয়ে রাবণ চাপিয়া ধরে কোলে।।
ধর্ম্মলোপ করিলেক বলে চেপে ধরি।
বলহীনা নারীজাতি কি করিতে পারি।।
দেবতা না পারে তারে আমি নারীজাতি।
রাবণের হাতে কিসে পাব অব্যাহতি।।
যতেক মিনতি করি তত কোপ বাড়ে।
সপ্ত রাত্রি পাপিষ্ঠ আমারে নাহি ছাড়ে।।
নলকূবর বলে রম্ভা জানি তুমি সতী।
তব দোষ নাহি রাবণ রাক্ষস দুর্ম্মতি।।
কুকর্ম্ম দেখিয়া নলকূবরের রোষ।
ধ্যানেতে সে জানিল রম্ভার নাহি দোষ।।
ক্রোধে নলকূবর লাগিল জ্বলিতে।
হাতে নিল জল রাবণেরে শাপ দিতে।।
আজি হৈতে শাপ মোর হউক প্রচার।
বলে ধরি রাবণ যেই করিবে শৃঙ্গার।।
সেইক্ষণে মরিবেক যাবে দশ মাথা।
নলকূবরের শাপ না হবে অন্যথা।।
রাবণের শাপ হইল হৃষ্ট দেবগণ।
সীতার সতীত্ব রক্ষা এই সে কারণ।।
উঠে নিদ্রা হইতে রাবণ রতিসাধে।
শাপ শুনি অমনি সে বসিল বিষাদে।।
শুনিয়া রাবণ রাজা দুঃখ ভাবে চিতে।
কেন আইলাম আমি হেন ছার পথে।।
ঘোর শাপ দিল মোরে কুবের-নন্দন।
বলে রতি করিতে না পারিব কখন।।
আর শাপ দিত যদি তাহা প্রাণে সয়।
ঘোর শাপ দিল মোরে পুড়িছে হৃদয়।।
এই সে রহিল মোর মনে অনুতাপ।
ভাইপো হইয়া মোরে দিল হেন শাপ।।
অগস্ত্যের কথা শুনি রামের উল্লাস।
মুনি আর কিছু তার কহ ইতিহাস।।
রম্ভারে হরিয়া কোথা গেল সে রাবণ।
কহ কহ শুনি মুনি পুরাণ-কথন।।