যুধিষ্ঠিরাদির হস্তিনা-গমনে ধৃতরাষ্ট্রের অনুরোধ
অনন্তর পরীক্ষিত্ৰন্দন [জনমেজয়] ধৃতরাষ্ট্রাদির বনবাসের শেষ বৃত্তান্ত শ্রবণে অভিলাষী হইয়া বৈশম্পায়নকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ব্রহ্মন্! অন্ধরাজ ধৃতরাষ্ট্র ও রাজা যুধিষ্ঠির ইঁহারা উভয়ে পুত্রপৌত্রাদিকে দর্শন করিয়া কি করিলেন, তাহা কীর্ত্তন করুন।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! ধৃতরাষ্ট্র সেই আশ্চর্য্য ব্যাপার অবলোকন করিয়া শোকশূন্য হইয়া পুনরায় স্বীয় আশ্রমে আগমন করিলেন। তখন ঋষিগণ ও অন্যান্য লোকসমুদয় ধৃতরাষ্ট্রের আদেশানুসারে স্ব স্ব স্থানে প্রতিনিবৃত্ত হইলেন। মহাত্মা পাণ্ডবগণও স্ব স্ব পত্নী ও পরিমিত সৈন্যসমভিব্যাহারে পুনরায় ধৃতরাষ্ট্রের আশ্রমে গমন করিলেন।
ঐ সময় ত্রিলোকপূজিত মহর্ষি বেদব্যাস ধৃতরাষ্ট্রের আশ্রমে সমুপস্থিত হইয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “কৌরবেন্দ্র! তুমি বেপবেদাঙ্গপারদর্শী পরমধার্ম্মিক জ্ঞানবৃদ্ধ মহর্ষিদিগের নিকট বিবিধ বিচিত্র কথা শ্রবণ করিয়াছ; অতএব, এক্ষণে আর শোকে সমাকৃষ্ট হইও না। পণ্ডিতব্যক্তিরা কখন স্বীয় দুরদৃষ্টনিবন্ধন ব্যথিত হয়েন না। তুমি দেবর্ষি নারদের নিকট দেবরহস্যসমুদয় শ্রবণ করিয়াছ এবং এক্ষণে ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্মানুসারে সমরশায়ী পুত্রগণকে সুগতি লাভ করিয়া স্বেচ্ছানুসারে ভ্রমণ করিতে দেখিলে। অতঃপর ধীমান যুধিষ্ঠিরকে স্বীয় পত্নী, সুহৃদগণ ও ভাতৃগণের সহিত রাজ্যগমনে অনুমতি কর। উঁহারা সকলেই তোমার অনুমতির প্রতীক্ষা করিতেছেন। এক মাসের অধিক কাল অতীত হইল, উঁহারা এই তপোবনে অবস্থান করিতেছেন। আর অধিক দিন অবস্থান করা উহাদের কর্ত্তব্য নহে। রাজ্য বিবিধ বিঘ্নের আস্পদ, অতএব নিয়ত যত্নপূৰ্ব্বক উহা রক্ষা করা উঁহাদের সর্ব্বতোভাবে বিধেয়।”
অমিতপরাক্রম, মহর্ষি বেদব্যাস এই কথা কহিলে রাজা ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে আহ্বান করিয়া কহিলেন, “বৎস! তোমার মঙ্গলাভ হউক। তোমার অনুগ্রহে আমার শোকসন্তাপসমুদয় দূরীভূত হইয়াছে। এক্ষণে বোধ হইতেছে, যেন আমি তোমাদিগের সহিত হস্তিনানগরে অবস্থান করিতেছি। তুমি আমার পুত্রের কাৰ্য্য করিয়াছ। আমি তোমার প্রতি পরম পরিতুষ্ট হইয়াছি। এক্ষণে আর আমার শোকের লেশমাত্র নাই। অতঃপর তুমি অচিরাৎ হস্তিনানগরে গমন কর। আর বিলম্ব করিও না। তোমাকে দর্শন করিয়া স্নেহনিবন্ধন আমার তপস্যার ব্যাঘাত হইতেছে। আমি কেবল তোমার দর্শনে এ কাল পর্য্যন্ত এই তপঃকৃশ শরীর ধারণ করিয়া রহিয়াছি। শীর্ণপত্রজীবিনী কুন্তী ও গান্ধারীও আর অধিককাল ইহলোকে অবস্থান করিবেন না। মহর্ষি বেদব্যাসের প্রভাব ও তোমার সমাগমে আমি পরলোকগত দুৰ্য্যোধনাদিকে দর্শন করিলাম। আর আমার জীবিত থাকিবার প্রয়োজন নাই। অতঃপর আমি তোমার আদেশানুসারে ঘোরতর তপস্যা অবলম্বন করিব। এক্ষণে তোমাতে আমাদিগের পিণ্ড, কীৰ্ত্তি ও কুল প্রতিষ্ঠিত রহিল। তুমি কল্যই হউক বা অদ্যই হউক, হস্তিনানগরে গমন কর; আর বিলম্ব করিও না। তুমি অনেকবার রাজনীতি শ্রবণ করিয়াছ; অতএব এক্ষণে তোমাকে আর কিছু উপদেশ প্রদান করিতে হইবে না।”
হস্তিনা-প্রত্যাবর্ত্তনে পরাঙ্মুখ যুধিষ্ঠিরের প্রবোধ
অন্ধরাজ ধৃতরাষ্ট্র এই কথা কহিলে, রাজা যুধিষ্ঠির তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “তাত! আমি নিরপরাধী, আপনি আমাকে পরিত্যাগ করিবেন না। এক্ষণে আমার ভ্রাতৃগণ ও অনুচরগণ হস্তিনানগরে গমন করুন। আমি এই স্থানে অবস্থান করিয়া আপনার ও জননীদ্বয়ের শুশ্রূষা করিব।”
ধৰ্ম্মরাজ এই কথা কহিলে গান্ধারী তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “বৎস! অমন কথা কহিও না। তুমি কৌরবদিগের বংশধর ও আমার শ্বশুরের জলপিণ্ডস্থল। তুমি এ কাল পর্য্যন্ত আমাদিগের যথেষ্ট সেবা করিলে, এক্ষণে অচিরাৎ রাজধানীতে গমন কর। রাজার বচন রক্ষা করা তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য।”
অন্ধরাজমহিষী গান্ধারী এই কথা কহিলে, রাজা যুধিষ্ঠির স্বীয় বাষ্পকুলিত নেত্রদ্বয় পরিমার্জ্জিত করিয়া কুন্তীকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “মাতঃ! রাজা ও যশস্বিনী গান্ধারী আমাকে রাজধানীগমনে অনুরোধ করিতেছেন; কিন্তু আমি আপনার একান্ত অনুগত; আপনাকে পরিত্যাগ করিয়া কিরূপে গমন করিব? আপনার তপোবিঘ্ন করিতেও আমার বাসনা নাই। তপস্যা,– অপেক্ষা উৎকৃষ্ট আর কিছুই নাই। তপস্যাদ্বারা অতিমহৎ ফললাভ হইয়া থাকে। এক্ষণে আমার আর পূৰ্ব্বের ন্যায় রাজ্যভোগে অভিলাষ নাই। আমার মন সম্পূর্ণভাবে তপস্যায় অনুরক্ত হইয়াছে। বিশেষতঃ এই পৃথিবী লোকশূন্যা হওয়াতে আর উহার প্রতিপালনে আমার কিছুতেই উৎসাহ হইতেছে না। আমাদিগের বান্ধবগণ বিনষ্ট হইয়াছে, আর তাদৃশ সৈন্যসামন্তও নাই। পাঞ্চালগণ একেবারে উৎসন্ন হইয়া গিয়াছে। উহাদের বংশরক্ষা করে, এমন আর কেহই নাই। দ্রোণাচাৰ্য্য সমরাঙ্গনে উহাদিগকে নিঃশেষিতপ্রায় করিলে, যাহারা অবশিষ্ট ছিল, আচাৰ্য্যতনয় রজনীযোগে তাহাদিগকেও বিনাশ করিয়াছেন। চেদি ও মৎস্যবংশও নিঃশেষ হইয়াছে। এক্ষণে কেবল বাসুদেবের প্রভাবে একমাত্র বৃষ্ণিবংশই অবশিষ্ট রহিয়াছে। তাহাদিগকে দর্শন করিয়া কেবল ধর্ম্মসাধনার্থই রাজ্যমধ্যে অবস্থান করিতে আমার বাসনা হয়। এক্ষণে আপনি নির্ব্বিঘ্নে আমাদিগের সকলকে দর্শন করুন। সকলের সহিত আর আপনার দর্শনলাভ হওয়া নিতান্ত কঠিন হইবে। জ্যেষ্ঠতাত এক্ষণে আপনাদের সহিত ঘোরতর তপস্যায় প্রবৃত্ত হইবেন।”
কুন্তী-সান্ত্বনায় যুধিষ্ঠিরাদির হস্তিনায় গমন
ধৰ্ম্মাত্মা যুধিষ্ঠির এই কথা কহিলে, মহাবাহু সহদেব বাষ্পকুললোচনে তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “রাজন্! আমি ত’ কোনক্রমে মাতাকে পরিত্যাগ করিতে পারিব না। অতএব আপনি অবিলম্বেই রাজধানীতে গমন করুন; আমি এই স্থানে অবস্থানপূর্ব্বক রাজা ও মাতৃদ্বয়ের পদসেবা এবং ঘোরতর তপানুষ্ঠান করিয়া কলেবর পরিশুষ্ক করি।” সহদেব বিনীতভাবে এই কথা কহিলে, ভোজনন্দিনী কুন্তী তাঁহাকে আলিঙ্গন করিয়া কহিলেন, “বৎস! তুমি আমার বাক্যানুসারে হস্তিনানগরে গমন কর। তোমাদিগের শাস্ত্রজ্ঞান পরিবর্দ্ধিত হউক এবং তোমরা পরমসুখে অবস্থান কর। তোমরা এ স্থলে অবস্থান করিলে আমাদিগের তপস্যার ব্যাঘাত হইবে, তোমার স্নেহপাশে বদ্ধ। হওয়াতে আমার উৎকৃষ্ট তপস্যা ক্রমশঃ ক্ষীণ হইতেছে। আমাদিগের পরলোকগমনের আর অধিক বিলম্ব নাই। অতএব তুমি এক্ষণে রাজ্যে প্রতিনিবৃত্ত হও।”
মনস্বিনী কুন্তী এইরূপে বহুবিধ সান্ত্বনা করিলে, সহদেব ও রাজা যুধিষ্ঠিরের চিত্ত স্থির হইল। তখন পাণ্ডবগণ সকলে সমবেত হইয়া অন্ধরাজের চরণবন্দনপূৰ্ব্বক অনুনয় করিতে আরম্ভ করিলেন।
ঐ সময় রাজা যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! আপনি যখন আমাদিগকে অনুজ্ঞা করিতেছেন, তখন আমরা অবশ্যই আহ্লাদসহকারে নগরে প্রতিগমন করিব।” ধৰ্ম্মরাজ এই কথা কহিলে, অন্ধরাজ তাঁহাকে অভিনন্দন, ভীমসেনকে সান্ত্বনা এবং অর্জ্জুন, নকুল ও সহদেবকে আলিঙ্গন করিয়া তাঁহাদিগকে অচিরাৎ হস্তিনায় গমন করিতে আদেশ করিলেন। তখন পাণ্ডবগণ গান্ধারী ও কুন্তীকে অভিবাদন এবং তাঁহাদের নিকট বিদায়গ্রহণপূর্ব্বক ধৃতরাষ্ট্রকে বারংবার প্রদক্ষিণ ও নিরীক্ষণ করিয়া হস্তিনাভিমুখে ধাবমান হইলেন। দ্রৌপদী প্রভৃতি কৌরবপত্নীগণ শ্বশ্রূদ্বয় ও শ্বশুরের পাদবন্দনা করিয়া তাঁহাদিগের কর্ত্তৃক অনুজ্ঞাত ও কর্ত্তব্যবিষয়ে উপদিষ্ট হইয়া পাণ্ডবগণসমভিব্যাহারে নগরাভিমুখে প্রস্থান করিলেন। ঐ সময় উষ্ট্রের চীৎকারধ্বনি ও অশ্বের হ্রেষারবে আশ্রমমণ্ডল পরিপূরিত হইল এবং সারথিগণ ‘অশ্বযোজনা কর, অশ্বযোজনা কর’ বলিয়া বারংবার চীৎকার করিতে লাগিল। অনন্তর রাজা যুধিষ্ঠির স্বীয় পত্নী এবং সৈন্যগণসমভিব্যাহারে সবান্ধবে নির্ব্বিঘ্নে পুনরায় হস্তিনানগরে আগমন করিলেন।