কৃষ্ণকে অর্ঘ্য প্রদানে শিশুপালের ক্ৰোধ-সভামধ্যে শিশুপালের কৃষ্ণনিন্দা
শিশুপাল কহিলেন, “হে পাণ্ডব! এই সমস্ত রাজগণ উপস্থিত থাকিতে কৃষ্ণ কোনক্রমেই পূজার্হ হইতে পারে না। তুমি কার্যতঃ কৃষ্ণের অর্চনা করিয়াছ, এরূপ ব্যবহার তোমাদিগের উপযুক্ত হয় নাই। তোমরা বালক, সুতরাং ধর্মের কিছুই জান না; ধর্ম্ম অতি সূক্ষ্ম পদার্থ, আর এই ভীষ্ম অদূরদর্শী এবং স্মৃতিশক্তিবিহীন। হে ভীষ্ম! তোমার ন্যায় প্ৰিয়চিকীর্ষু ধাৰ্মিক ব্যক্তি সাধুসমাজে অত্যন্ত অবমানিত হয়। যে কৃষ্ণ কখন রাজা নয়, তাহাকে তোমরা কি বলিয়া অর্ঘ্য প্ৰদান করিলে এবং সেই বা কিরূপে সকল মহীপালের মধ্যে পূজা প্রতিগ্ৰহ করিল! অথবা কৃষ্ণকে স্থবির মনে হইল? হে কুরুনন্দন! কৃষ্ণ সর্ব্বদাই তোমার অনুবৃত্তি করে এবং তোমার প্রিয়ার্থী যথার্থ বটে, কিন্তু দ্রুপদ থাকিতে কৃষ্ণের পূজা করা তোমার উচিত হয় নাই। যদি কৃষ্ণকে আচাৰ্য্য মনে করিয়া থাক, তাহা হইলে দ্রোণ থাকিতে কৃষ্ণ কেন অৰ্চিত হইল। অথবা কৃষ্ণকে ঋত্বিক মনে করিয়া থাকিলে বৃদ্ধ দ্বৈপায়ন উপস্থিত থাকিতে কৃষ্ণকে পূজা করা তোমার উচিত হয় নাই। হে রাজন! অশ্বথামা, রাজেন্দ্ৰ দুৰ্য্যোধন, ভারতাচাৰ্য্য কৃপ, কিংপুরুষাচাৰ্য্য দ্রুম, রাজা রুক্সী এবং মদ্রাধিপ শল্য, এই সমস্ত মহাত্মারা থাকিতে কৃষ্ণকে কেন অর্ঘ্য প্রদান করিলে? হে রাজন! যিনি জামদগ্ন্যের প্রিয় শিষ্য এবং যিনি আত্মবল আশ্রয় করিয়া রণক্ষেত্রে সমুদয় রাজলোক পরাভব করিয়াছিলেন, সেই মহাবলপরাক্রান্ত কর্ণকে অতিক্ৰম করিয়া কিরূপে কৃষ্ণের পূজা করিলে! বাসুদেব ঋত্বিক নয়, আচাৰ্য্য নয় এবং রাজাও নয়; হে কুরুশ্রেষ্ঠ! কেবল প্ৰিয়চিকীর্ষ হইয়া তুমি কৃষ্ণকে অর্ঘ্য প্রদান করিয়াছ। অথবা যদি কৃষ্ণকেই অর্ঘ্য প্রদান করিবে, মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়াছিলে, তবে কি নিমিত্ত এই সকল রাজগণকে আহ্বান করিয়া তাহাদিগের অপমান করিলে? আমরাও মহাত্মা কৌন্তেয়ের ভয়, সান্তুনা অথবা লোভাবশতঃ তাহাকে কর প্রদান করি নাই, তিনি ধর্ম্মাচরণে প্ৰবৃত্ত এবং সাম্রাজ্যে দীক্ষিত, এই বলিয়াই কর প্রদান করিয়াছিলাম, কিন্তু তিনি আমাদিগের সম্মান রক্ষা করিলেন না; এই রাজসভায় অপ্রাপ্তলক্ষণ কৃষ্ণকে অর্ঘ্য প্ৰদান করিলে, ইহার পর আর আমাদিগের অপমানের বিষয় কি আছে? ‘ধর্ম্মপুত্রের ধর্ম্মাত্মতা’ এই যশ নিতান্ত অকারণ, সন্দেহ নাই। কোন ধাৰ্মিক পুরুষ ধর্ম্মভ্ৰষ্ট ব্যক্তিকে সজ্জনোচিত পূজা করিয়া থাকে; যে বৃষ্ণিকুলে জন্মগ্রহণ করিয়াছে এবং পূর্ব্বে অন্যায়াচরণ দ্বারা মহাত্মা জরাসন্ধের প্রাণসংহার করিয়াছে, সেই দুরাত্মা কৃষ্ণকে অর্ঘ্য নিবেদন করাতে আদ্য যুধিষ্ঠিরের নীচত্ব প্রদর্শিত ও ধাৰ্মিকতা বিনষ্ট হইল। কুন্তীতনয়েরা ভীত, নীচস্বভাব ও তপস্বী, কিন্তু ওহে কৃষ্ণ! তোমার সবিশেষ পৰ্য্যালোচনা করা কর্তব্য; তাহারাই যেন নীচতাপ্রযুক্ত তোমাকে পূজা প্রদান করিল, কিন্তু তুমি স্বয়ং অযোগ্য হইয়া কিরূপে তাহা স্বীকার করিলে; যেমন গোপনে ঘৃতের কণামাত্ৰা ভক্ষণ করিয়া কুকুর আত্মশ্লাঘা করে, তাহার ন্যায় তুমি আপনার অনুপযুক্ত পূজার বহু মান করিতেছ! ওহে কৃষ্ণ! ইহাতে রাজেন্দ্রগণের অবমাননা হয় নাই; স্পষ্টই প্রতীতি হইতেছে যে, পাণ্ডবেরা তোমাকেই বিদ্রুপ করিয়াছে। যেমন ক্লীবের দারপরিগ্রহ ও অন্ধের রূপদৰ্শন নিরর্থক, সেইরূপ রাজ্যবিহীনেরও রাজসম্মান অতীব লজ্জাকর। রাজা যুধিষ্ঠির ও ভীষ্মের যেরূপ বিদ্যাবুদ্ধি এবং কৃষ্ণ যাদৃশ, তাহাও দৃষ্ট হইল।” শিশুপাল তাঁহাদিগকে এই কথা বলিয়া আসন হইতে গাত্ৰোত্থানপূর্ব্বক রাজগণ-সমভিব্যাহারে সভা হইতে প্ৰস্থান করিতে উদ্যত হইলেন।