৩৬১. ক্রোধের দোষদর্শন—নাগ-নাগপত্নীসংবাদ

৩৬১তম অধ্যায়

ক্রোধের দোষদর্শন—নাগ-নাগপত্নীসংবাদ

ভীষ্ম কহিলেন, “নাগপত্নী এই কথা কহিলে নাগরাজ তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘প্রিয়ে! তুমি সেই ব্রাহ্মণকে দর্শন করিয়া কি স্থির করিয়াছ? তিনি কি মনুষ্য, না কোন দেবতা মনুষ্যাকার ধারণপূৰ্ব্বক সমাগত হইয়াছেন? আমার বোধ হয়, তিনি মনুষ্য নহেন। কারণ, মনুষ্য কখনই আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে বাসনা করিয়া আমাকে আপনার নিকট গমন করিতে আজ্ঞা করিতে পারে না। দেবতা, অসুর ও দেবর্ষিদিগের অপেক্ষা নাগসমুদয় মহাবলপরাক্রান্ত, সমধিক বরদ [বরদাতা] ও বন্দনীয়। মনুষ্যেরা কখনই আমাদিগের সন্দর্শনলাভে কৃতকার্য্য হইতে পারে না।’

‘তখন নাগপত্নী কহিলেন, ‘নাথ! আমি সেই ব্রাহ্মণের সরলতা দর্শনে অবগত হইয়াছি যে, তিনি কখনই দেবতা নহেন। তিনি আপনার একান্ত ভক্ত। তিনি কোন কার্য্য উপলক্ষে জলাভিলাষী চাতকের ন্যায় আপনার দর্শনাভিলাষে কালপ্রতীক্ষা করিতেছেন। জগদীশ্বর করুন যেন, আপনার অদর্শননিবন্ধন তাঁহার কোন অমঙ্গল উপস্থিত না হয়। সদ্বংশজাত কোন ব্যক্তিই অতিথির প্রতি অনাদর প্রকাশ করেন না; অতএব নৈসর্গিক রোষ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করা আপনার অবশ্য কৰ্ত্তব্য। আজ যেন সেই ব্রাহ্মণের আশা উম্মলিত করিয়া আপনাকে ক্লেশে নিপতিত হইতে না হয়। রাজা বা রাজপুত্র যদি আশাযুক্ত ব্যক্তিদিগের আশা পরিপূরণপূর্ব্বক নেত্রজল পরিমার্জ্জন না করেন, তাহা হইলে তাঁহাদিগকে নিশ্চয়ই ব্রহ্মহত্যাপাপে লিপ্ত হইতে হয়। মৌনদ্বারা জ্ঞানলাভ, দানদ্বারা যশোলাভ এবং সত্যবাক্যদ্বারা বাগ্মিতা ও পরলোকে সম্মানলাভ হইয়া থাকে। ভূমিদান করিলে শুভফললাভ হয়। আত্মহিতকর ধৰ্ম্মকার্য্য অনুষ্ঠান করিলে কখনই নিরয়গামী হইতে হয় না।

নাগরাজ কহিলেন, ‘প্রিয়ে। আমার জাতিনিবন্ধন কিছুমাত্র অভিমান নাই। অন্যান্য ভুজঙ্গমের ন্যায় আমি কখনই ক্রোধে অজ্ঞান হই না। আমার যে নৈসর্গিক অল্পমাত্র ক্রোধ ছিল, তাহাও এক্ষণে তোমার বচনানলে দগ্ধ হইয়াছে। ক্রোধের ন্যায় শত্রু আর কেহই নাই। দেখ, ইন্দ্রের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রবল প্রতাপশালী দশানন রোষপরবশ হইয়া রামচন্দ্রের হস্তে বিনষ্ট হইয়াছেন। ইন্দ্রতুল্য কাৰ্ত্তবীর্য্য, জমদগ্নির পুত্র পরশুরাম “অন্তঃপুরমধ্যস্থিত কামধেনু প্রত্যাহরণ করিয়াছেন” শুনিয়া ক্রোধভরে তাঁহার সহিত যুদ্ধ করিয়া পুত্রগণের সহিত শমনসদনে গমন করিয়াছেন।

‘এক্ষণে আমি তোমার বাক্যশ্রবণে শ্ৰেয়োনাশক তপস্যার প্রধান শত্রু ক্রোধকে এককালে পরিত্যাগ করিয়াছি। আজ তুমি আমার যৎপরোনাস্তি উপকার করিলে। এক্ষণে তোমার সদৃশ ভাৰ্য্যা লাভ করিয়া আমি আপনাকে শ্লাঘ্য বিবেচনা করিতেছি। অতঃপর আমি গোমতীতীরে সেই ব্রাহ্মণের নিকট চলিলাম। আমি অবশ্যই তাঁহার মনোরথ পূর্ণ করিব, তিনি নিশ্চয়ই কৃতকার্য্য হইয়া গমন করিতে কৃতার্থ সমর্থ হইবেন।’ ”