৩৫তম অধ্যায়
মহাদেবের অসুরবধস্বীকার
“দুৰ্য্যোধন কহিলেন, ‘হে মদ্ররাজ! এইরূপে ভগবান্ ভবানীপতি দেবর্ষিগণকে অভয় প্রদান করিলে লোকপিতামহ ব্রহ্মা তাঁহাকে অভিবাদনপূর্ব্বক সর্ব্বলোকের হিতকর কথা কহিতে আরম্ভ করিলেন। হে দেবেশ! আমি তোমার অনুগ্রহে প্রাজাপত্যপদে অধিষ্ঠিত হইয়া দানবগণকে অতি মহৎ বর প্রদান করিয়াছি। এক্ষণে তুমি ভিন্ন আর কেহই সেই মৰ্য্যাদানাশক দানবগণকে সংহার করিতে সমর্থ হইবে না। অতএব তুমি যাচমান [প্রার্থী] দেবগণের প্রতি প্রসন্ন হইয়া দানবগণকে পরাজিত কর। তোমার অনুগ্রহে সমুদয় জগৎ সুখী হউক। হে লোকেশ! তুমি সকলের শরণ্য বলিয়া আমরা তোমার শরণাগত হইয়াছি।
ত্রিপুরাসুরের বধকৌশল নিরূপণ
তখন দেবাদিদেব রুদ্রদেব কহিলেন,—হে দেবগণ! আমার মতে তোমাদিগের শত্রুগণকে বিনাশ করা অবশ্য কর্ত্তব্য; কিন্তু দানবগণ নিতান্ত বলদর্পিত বলিয়া আমি একাকী তাহাদের সহিত সংগ্রামে উৎসাহী হইতেছি না। অতএব তোমরা সকলে সমবেত হইয়া আমার অর্দ্ধবল গ্রহণপূর্ব্বক শত্রুগণকে পরাজিত কর। একতা মহাবল উৎপাদনের কারণ। দেবগণ কহিলেন,—হে মহেশ্বর! আমরা তাহাদিগের বলবিক্রম প্রত্যক্ষ করিয়াছি। তাহাদিগের বলবীৰ্য্য আমাদিগের অপেক্ষা দ্বিগুণতর হইবে। মহেশ্বর কহিলেন,—সেই অপরাধী পাপাত্মাদিগকে যেরূপে হউক নিহত করিতে হইবে, অতএব তোমরা আমার অর্দ্ধতেজ লইয়া তাহাদিগকে বিনাশ কর। সুরগণ কহিলেন, —হে ভূতভাবন! আমাদিগের তোমার অর্দ্ধতেজ ধারণ করিবার শক্তি নাই; অতএব তুমিই আমাদিগের বলার্দ্ধ লইয়া শত্রুগণকে বিনাশ কর। তখন মহাদেব কহিলেন, —হে সুরগণ! যদি তোমরা আমার বলার্দ্ধ ধারণ করিতে অসমর্থ হও, তাহা হইলে আমিই তোমাদিগের বলার্দ্ধ গ্রহণপূর্ব্বক দানবগণকে নিপাতিত করিব। ভগবান্ মহেশ্বর এই বলিয়া দেবগণের বলার্দ্ধ গ্রহণপূর্ব্বক সর্ব্বাপেক্ষা মহাবলশালী হইয়া উঠিলেন। তদবধি তিনি মহাদেব নামে বিখ্যাত হইয়াছেন।
দেবগণকর্ত্তৃক মহাদেবের রথনিৰ্মাণ
‘অনন্তর সেই দেবাদিদেব মহাদেব দেবগণকে কহিলেন, —হে সুরগণ! আমি ধনুর্ব্বাণ ধারণ ও রথারোহণপূর্ব্বক তোমাদিগের শত্রুগণকে বিনাশ করিব। তোমরা আমার রথ ও ধনুর্ব্বাণ প্রস্তুত কর, তাহা হইলে আমি অবিলম্বেই দানবগণকে নিপাতিত করিতে সমর্থ হইব। দেবগণ কহিলেন, —হে দেবেশ্বর! আমরা ত্রিলোক সমুদয় মূৰ্ত্তি আহরণ করিয়া, বিশ্বকর্ম্মা যেরূপ রথ নিৰ্মাণ করিতে পারেন, তোমার জন্য তদ্রূপ এক দ্যুতিমান্ রথ প্রস্তুত করিব। সুরগণ এই বলিয়া রথ প্রস্তুত করিতে আরম্ভ করিলেন। তাঁহারা পর্ব্বত, বন, দ্বীপ ও ভূতগণপরিবৃত বিশাল নগরসম্পন্ন বসুন্ধরাকে দেবাদিদেবের রথ করিলেন। মন্দরপর্ব্বত ও দানবালয় জলনিধি ঐ রথের অক্ষ, মহানদী ভাগীরথী জঙ্ঘা; দিগ্বিদিক ভূষণ; নক্ষত্রসকল ঈষা; সত্যযুগ ও স্বর্গ যুগকাষ্ঠ; ভুজগরাজ অনন্তদেব কুবর; হিমালয়, বিন্ধ্যাচল, সূর্য্য ও চন্দ্র চক্র; সপ্তর্ষিমণ্ডল চক্ররক্ষক; গঙ্গা, সরস্বতী, সিন্ধু ও আকাশ ধুর্ভাগ; জল ও নদীসকল বন্ধন সামগ্রী; দিবা, রাত্রি, কলা কাষ্ঠা ছয় ঋতু ও দীপ্তগ্রহসমুদয় অনুকর্ষ, তারাগণ বরূথ; ধর্ম্ম, অর্থ ও কাম ত্রিবেণু; ফলপুষ্পপরিশোভিত ওষধি ও লতাসকল ঘণ্টা; রাত্রি ও দিবা পূর্ব্ব ও অপর পক্ষ; ধৃতরাষ্ট্র প্রমুখ দশ নাগপতি ঈষা; মহোরথগণ যোক্ত্র; সংবৰ্ত্তক মেঘ যুগ, চর্ম্ম ও কালপৃষ্ঠ; নহুষ, কর্কোটক, ধনঞ্জয় ও অন্যান্য নাগগণ অশ্বগণের কেশরবন্ধন; সমুদয় দিক্, প্রদিক এবং ধর্ম্ম, সত্য, তপ ও অর্থ অশ্বরশ্মি; সন্ধ্যা, ধৃতি, মেধা, স্থিতি, সন্নতি ও গ্রহনক্ষত্রাদিদ্বারা পরিশোভিত নভোমণ্ডল বাহ্যাবরণ; লোকেশর ইন্দ্র, বরুণ, যম ও কুবের অশ্ব; পূর্ব্ব অমাবস্যা, পূর্ব্ব পৌর্ণামাসী, উত্তর অমাবস্যা ও উত্তর পৌর্ণমাসী অশ্ব যোক্ত্র পূর্ব্ব অমাবস্যায় অধিষ্ঠিত পিতৃগণ। যুগকীলক; মন রথোপস্থ; সরস্বতী রথের পশ্চাদ্ভাগ; চক্ৰচাপসম্বলিত বিদ্যুৎ পবনোচ্যূত পতাকা; বষট্কার প্রতোদ এবং গায়ত্রী শীর্ষবন্ধন হইলেন। তখন বিষ্ণু, সোম ও হুতাশন এই তিন মহাত্মার যোগে মহেশ্বরের বাণ কল্পিত হইল। অগ্নি সেই বাণের কাণ্ড, সোম ফলক এবং বিষ্ণু তীক্ষ্ণধারস্থ রূপ হইলেন। পূর্ব্বে মহাত্মা ঈশানের যজ্ঞে যে সংবৎসর কল্পিত হইয়াছিল, এক্ষণে তাহা উহার শরাসনরূপ মহাস্বন সাবিত্রী ও মৌৰ্ব্বীরূপ ধারণ করিলেন। কালচক্র হইতে মহামূল্য রত্নভূষিত অভেদ্য দিব্যবর্ম্ম বহিষ্কৃত হইল। মৈনাক ও মেরুপৰ্বত ধ্বজযষ্ঠি হইল এবং সৌদামিনীসম্বলিত মেঘমালা পতাকা হইয়া ঋতিক্গণমধ্যস্থ প্রজ্বলিত পাবকের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। এইরূপে সেই অপুর্ব্ব রথ ও শরাসনাদি নির্ম্মিত হইলে দেবগণ সমুদয় তেজ একত্র সমবেত অবলোকনপূর্ব্বক বিস্মিত হইয়া মহেশ্বরের নিকট সমুদয় বৃত্তান্ত নিবেদন করিলেন।
‘হে মদ্ররাজ! দেবগণ এইরূপে শত্রুমর্দ্দন শ্রেষ্ঠ রথ নির্ম্মাণ করিলে দেবাদিদেব মহাদেব উহাতে স্বকীয় প্রধান শরসমুদয় সংস্থাপনপূর্ব্বক আকাশকে ধ্বজযষ্ঠি করিয়া উহার উপর মহাবৃষভকে সন্নিবেশিত করিলেন; ব্রহ্মদণ্ড, কালদণ্ড, রুদ্রদণ্ড, ও জ্বর রথের পার্শ্বরক্ষক, অথর্ব্ব ও আঙ্গিরস চক্ররক্ষক; ঋগ্বেদ, সামবেদ ও পুরাণসকল পুরঃসর, ইতিহাস ও যজুৰ্বেদ পৃষ্ঠরক্ষক এবং সমুদয় স্তোত্রাদি, দিব্যবাক্য, বিদ্যা ও বষট্কার পার্শ্বচর হইল। ওঁকার রথের সম্মুখে শোভা পাইতে লাগিল। তখন ভগবান দেবদেব ছয়ঋতুসম্পন্ন সংবৎসরকে বিচিত্র শরাসন করিয়া আপনার ছায়াকেই মৌৰ্ব্বী করিলেন। ভগবান্ রুদ্র সাক্ষাৎ কালস্বরূপ; সংবৎসর তাঁহার শরাসন, এই নিমিত্তই তাহার তাঁছায়ারূপ কালরাত্রি ঐ শরাসেনের মৌৰ্বী হইল। বিষ্ণু, অগ্নি ও চন্দ্র ইহারা তাঁহার বাণস্বরূপ হইলেন। সমুদয় জগৎ অগ্নিসোম ও বিষ্ণুময়; বিশেষতঃ, বিষ্ণুও অমিততেজাঃ ভগবান ভূতনাথের আত্মস্বরূপ; সুতরাং সেই শর অমরগণেরও অসহ্য হইয়া উঠিল। ভগবান্ ভূতনাথ সেই শরে ভৃগু ও অঙ্গিরার যজ্ঞসভৃত দুঃসহ ক্রোধাগ্নি নিহিত করিলেন।
মহাদেবের সারথিনিরূপণ
‘হে মদ্ররাজ! ঐ সময় যে নীললোহিত ব্যাঘ্রাজিনধারী ভবানীপতি অযুত সূর্য্যের ন্যায় তেজঃসম্পন্ন, ইন্দ্রেরও নিপাতনে সমর্থ, ব্রহ্মবিদ্বেষীদিগের নিহন্তা, ধাৰ্মিকগণের পরিত্রাতা ও অধার্ম্মিকগণের সংহত্তা এবং যাঁহার অঙ্গ আশ্রয় করিয়া এই অদ্ভুতদর্শন স্থাবরজঙ্গমাত্মক জগৎ শোভা পাইতেছে, সেই মহাত্মা ভীমবল, ভীমরূপ ও প্রমথনশীল আত্মগুণে পরিবৃত হইয়া বিচিত্র শোভা ধারণ করিলেন। অনন্তর দেবগণ কবচ ও শরাসনধারী ভগবান্ ভবানীপতিকে অগ্নি, সোম ও বিষ্ণুস্তৃত দিব্যশর গ্রহণপূর্ব্বক রথারোহণে উৎসুক দর্শন করিয়া পূণ্যগন্ধবাহী সমীরণকে তাঁহার অনুকূলে সঞ্চারিত করিতে লাগিলেন। তখন ভগবান্ মহাদেব ধরাতল কম্পিত ও দেবগণকে বিভ্রাসিত করিয়া সেই রথারোহণে সমুদ্যত হইলেন। মহর্ষি, দেব, গন্ধৰ্ব্ব, অপ্সরা, ব্রহ্মর্ষি ও বন্দিগণ তাঁহার স্তুতিবাদ করিতে লাগিলেন। নর্ত্তকেরা নৃত্য করিতে আরম্ভ করিল। ঐ সময়ে খড়্গ, বাণ ও শরাসনধারী ভগবান্ মহাদেব হাস্য করিয়া কহিলেন, হে দেবগণ! এক্ষণে কোন্ মহাত্মা আমার সারথ্যকাৰ্য্য করিবেন? সুরগণ কহিলেন, হে দেবেশ! তুমি যাহাকে নিয়োগ করিবে, তিনিই তোমার সারথি হইবেন, সন্দেহ নাই। তখন দেবাদিদেব মহাদেব পুনরায় কহিলেন,—হে দেবগণ! যিনি আমার অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর হইবেন, তোমরা বিবেচনাপূর্ব্বক অবিলম্বে তাঁহাকেই সারথি কর।
‘হে মদ্ররাজ! দেবগণ ভবানীপতির সেই বাক্যশ্রবণে পিতামহের নিকট গমনপূর্ব্বক তাঁহাকে প্রসন্ন করিয়া কহিলেন, হে ব্রহ্ম! তুমি দৈত্যবিনাশের নিমিত্ত যেরূপ কহিয়াছিলে, আমরা তদনুরূপ অনুষ্ঠান করিয়াছি। বৃষধ্বজ প্রসন্ন হইয়াছেন, বিচিত্র আয়ুধযুক্ত রথও প্রস্তুত করা হইয়াছে, কিন্তু সেই উত্তম রথে কে সারথি হইবে, তাহার কিছুই স্থির হয় নাই; অতএব তুমি কোন প্রধান ব্যক্তিকে সারথি বিধান করিয়া আমাদিগের বাক্য রক্ষা কর। আর তুমিও পূর্ব্বে বলিয়াছিলে যে, আমি তোমাদিগের হিতানুষ্ঠান করিব, অতএব এক্ষণে তোমার তদনুরূপ কাৰ্য্য করা সর্ব্বতোভাবে বিধেয়। হে কমলাসন! দেবগণের মূৰ্ত্তির সংযোগে সেই শত্রুবিদারণ রথ নির্ম্মিত হইয়াছে। সপৰ্বত ধরিত্রী রথ হইয়াছেন। চারি বেদ উহার চারি অশ্ব ও নক্ষত্রমালা বরূথ হইয়াছে। দৈত্যনিসুদন ভগবান পিনাকপাণি উহার রথী হইয়াছেন, কিন্তু সারথি লক্ষিত হইতেছে না। যিনি সমুদয় দেবতা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ তাঁহাকেই সারথি করিতে হইবে। আমাদিগের রথ, অশ্ব, যোদ্ধা, কবচ, শস্ত্র ও কার্ম্মাক প্রভৃতি সমস্ত প্রস্তুত হইয়াছে। এক্ষণে তোমা ভিন্ন আর কাহাকেও এই রথের উপযুক্ত সারথি লক্ষিত হইতেছে না। তুমি সর্ব্বগুণান্বিত ও সর্ব্বাপেক্ষা প্রধান; অতএব তুমি অবিলম্বে সেই রথে আরোহণপূর্ব্বক উৎকৃষ্ট অশ্বগণকে সংযত কর।
ব্রহ্মার মহাদেবসারথ্যগ্রহণ
‘হে মদ্ররাজ! এইরূপে সুরগণ আপনাদিগের জয় ও শত্রুগণের পরাজয়ের নিমিত্ত অবনত হইয়া পিতামহ ব্রহ্মাকে সারথি হইতে অনুরোধ করিয়া প্রসন্ন করিতে লাগিলেন। তখন পিতামহ কহিলেন, —হে দেবগণ! তোমরা যাহা কহিতেছ, তাহা যুক্তিবিরুদ্ধ নহে। আমি যুদ্ধকালে মহাদেবের অশ্বসমুদয় সংযত করিব। অনন্তর দেবগণ সেই বিশ্বস্রষ্টা ভগবান্ পিতামহকে মহাত্মা মহেশ্বরের সারথির পদে অভিষিক্ত করিলেন। ভগবান্ প্রজাপতি সেই লোকপূজিত রথে আরোহণ করিলে পবনের ন্যায় বেগবান্ অশ্বগণ ভূমিষ্ঠ হইয়া তাঁহাকে নমস্কার করিল। তখন ত্রিলোকনাথ ব্রহ্মা ও প্রতোদ গ্রহণপূর্ব্বক মহাদেবকে কহিলেন, —হে ভগবন্! রথারোহণ কর। তখন ভগবান্ শূলপাণি সেই বিষ্ণুসোমাগ্নি সমুৎপন্ন শর গ্রহণপূর্ব্বক শরাসননিঃস্বনে বসুন্ধরা কম্পিত করিয়া রথে আরোহণ করিলেন। দেব, গন্ধৰ্ব্ব, অপ্সরা ও মহর্ষিগণ তাঁহাকে রথারূঢ় দেখিয়া স্তব করিতে লাগিলেন। তখন ভগবান্ ভবানীপতি শর, শরাসন ও অসি ধারণপূর্ব্বক স্বীয় তেজে ত্রিভুবন। আলোকময় করিয়া পুনর্ব্বার ইন্দ্রাদি দেবগণকে কহিলেন, —হে সুরগণ! আমি অসুরগণকে নিপাতিত করিতে অসমর্থ হইব মনে করিয়া তোমরা শোক করিও না। আমার এই বাণে তাহাদিগকে নিহত বোধ কর। তখন দেবগণ ‘তোমার বাক্য সত্য, অসুরগণ -নিহত হইয়াছে’ এই বলিয়া মহাদেবকে উৎসাহিত করিতে লাগিলেন এবং শঙ্করের বাক্য মিথ্যা হইবার নহে বিবেচনা করিয়া পরম পরিতুষ্ট হইলেন।
মহাদেবের সমরযাত্রা
অনন্তর ভগবান্ নীলকণ্ঠ সেই অনুপম রথে আরোহণপূর্ব্বক দেবগণে পরিবেষ্টিত এবং পরস্পর তর্জমান [গর্জনপরায়ণ], চতুর্দ্দিকে ধাবমান, মাংসভোজী, নৃত্যানুরক্ত, দুরাসদ, স্বীয় পারিষদগণকর্ত্তৃক পূজ্যমান হইয়া গমন করিতে লাগিলেন। তপোনিরত মহাভাগ মহর্ষি ও দেবগণ তাঁহার বিজয় প্রার্থনায় প্রবৃত্ত হইলেন। এইরূপে অভয়দাতা দেবাদিদেব যুদ্ধে নির্গত হইলে অমরগণ ও জগতীতলস্থ যাবতীয় লোকের আনন্দের আর পরিসীমা রহিল না। ঋষিগণ তাঁহাকে নানাবিধ স্তব করিয়া বারংবার তাঁহার তেজ পরিবর্ধিত করিতে লাগিলেন। তৎকালে অর্ব্বুদ অর্ব্বুদ গন্ধর্ব্ব বিবিধ বাদ্যবাদন করিতে আরম্ভ করিলেন। অনন্তর ব্রহ্ম অসুরগণের উদ্দেশে রথ সঞ্চালন করিতে আরম্ভ করিলে ভূতনাথ তাঁহাকে সাধুবাদ প্রদানপূর্ব্বক কহিলেন,—হে দেব! তুমি অতন্দ্রিতচিত্তে দৈত্যগণের অভিমুখে অশ্বচালন কর। আজ আমি শত্রুগণকে সংহারপূর্ব্বক তোমাকে বাহুবল প্রদর্শন করিব। ভগবান্ কমলযোনি ভূতনাথের বাক্যানুসারে দৈত্যদানবরক্ষিত ত্রিপুরের অভিমুখে পবনতুল্য বেগবান্ অশ্বগণকে পরিচালিত করিতে আরম্ভ করিলে বোধ হইতে লাগিল যেন, তাহারা আকাশ পান করিবার নিমিত্ত ধাবমান হইতেছে।
‘এইরূপে ভগবান্ ভবানীপতি সেই লোকপূজিত অশ্বসংযোজিত স্যন্দনে [রথে] সমারূঢ় হইয়া দানবজয়ের নিমিত্ত ধাবমান হইলে তাঁহার ধ্বজাগ্রস্থিত বৃষভ ভীষণ নিনাদ করিয়া দশদি পরিপূর্ণ করিতে লাগিল। সেই ভয়াবহ নিনাদ-শ্রবণে অসংখ্য দৈত্য প্রাণত্যাগ করিল এবং অনেকে যুদ্ধার্থ অভিমুখীন হইল। তদ্দর্শনে শূলপাণি মহাদেব ক্রোধে অধীর হইলেন। তখন সমুদয় প্রাণী ভীত, ত্রৈলোক্য বিকম্পিত ও ঘোর নিমিত্তসকল লক্ষিত হইতে লাগিল। তৎকালে মহাদেবের সেই রথ সোম, অগ্নি, বিষ্ণু, ব্রহ্মা, রুদ্র এবং সেই শরাসনের সঞ্চালনে অবসন্ন হইল। তখন নারায়ণ সেই শরভাগ হইতে বিনির্গত হইয়া বৃষরূপ ধারণপূর্ব্বক সেই মহারথ উদ্ধৃত করিলেন। ঐ সময় রথ অবসন্ন ও শত্রুগণ গর্জমান হওয়াতে মহাবলপরাক্রান্ত ভগবান্ দেবাদিদেব অশ্বপৃষ্ঠ ও বৃষভের মস্তকে অবস্থানপূর্ব্বক সিংহনাদ করিয়া দানবপুর নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন এবং অশ্বের স্তন ছেদন ও বৃষের খুর দুইখণ্ডে বিভক্ত করিয়া ফেলিলেন। সেই অবধি গোসমূহের খুর দুইখণ্ডে বিভক্ত ও অশ্বগণ স্তনবিহীন হইয়াছে। হে মহারাজ! অনন্তর মহাদেব শরাসন অধিজ্য ও সেই শর পাশুপতাস্ত্রে সংযোজনপূর্ব্বক কার্ম্মুকে নিহিত করিয়া ত্রিপুরের অপেক্ষা করিয়া দণ্ডায়মান রহিলেন। তখন সেই পুরত্রয় এক সমবেত হইল। তদ্দর্শনে দেবতা, সিদ্ধ ও মহর্ষিগণ যারপরনাই পরিতুষ্ট হইয়া মহেশ্বরের স্তব করিয়া জয়ধ্বনি করিতে লাগিলেন।
শিবশরে ত্রিপুরধ্বংস
‘অনন্তর সেই পুরত্রয় অসুর-সংহারে প্রবৃত্ত, অসহ্যপরাক্রম, উগ্রমূৰ্ত্তি, ভগবান্ শঙ্করের সমক্ষে প্রাদুর্ভূত হইল। তখন ত্রিলোকেশ্বর মহেশ্বর সেই দিব্যশরাসন আকর্ষণ করিয়া পুরত্রয়কে লক্ষ্য করিয়া সেই ত্রৈলোক্যসারভূত শর পরিত্যাগ করিলেন। শর পরিত্যক্ত হইবামাত্র সেই পুরত্রয় তৎক্ষণাৎ ভূতলে নিপতিত হইল। অসুরগণ ঘোরতর আর্ত্তস্বর পরিত্যাগ করিতে লাগিল। তখন ভগবান্ শঙ্কর তাহাদিগকে দগ্ধ করিয়া পশ্চিমসাগরে নিক্ষেপ করিলেন।
‘হে মহারাজ! এইরূপে সেই পুরত্রয় ও দানবগণ ত্রিলোকের হিতানুষ্ঠানপরতন্ত্র ভগবান্ শঙ্করের রোষপ্রভাবে ভস্মসাৎ হইয়া গেল। তখন তিনি হাহাকার শব্দ উচ্চারণপূর্ব্বক স্বীয় ক্রোধসম্ভূত হুতাশনকে নিবারিত করিয়া কহিলেন, —হে হুতাশন! তুমি এই ত্রিলোককে ভস্মসাৎ করিও না। অনন্তর রুদ্রদেবের প্রযত্নে পূর্ণমনোরথ প্রজাপতিপ্রমুখ দেব, মহর্ষি ও অন্যান্য লোকসমুদয় প্রকৃতিস্থ হইয়া অতি উদারবাক্যে তাঁহার স্তব করিয়া তাঁহার আদেশানুসারে স্ব স্ব আলয়ে প্রস্থান করিলেন।
‘হে মদ্ররাজ! এইরূপে সেই লোকস্রষ্টা দেবাসুরগণের অধ্যক্ষ মহেশ্বর লোকের মঙ্গলবিধান করিয়াছিলেন। পূর্ব্বে পিতামহ ব্রহ্মা যেমন রুদ্রদেবের সারথ্য স্বীকার করিয়াছিলেন, এক্ষণে আপনিও তদ্রূপ মহাবীর সূতপুত্রের সারথ্য গ্রহণ করুন। আপনি কৃষ্ণ, অর্জ্জুন ও কর্ণ অপেক্ষা উৎকৃষ্ট, তাহাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। হে মদ্ররাজ! এই সূতপুত্র সংগ্রামে রুদ্রের সদৃশ এবং আপনিও নীতিপ্রয়োগে ব্রহ্মার তুল্য; অতএব আপনি নিশ্চয়ই অসুরতুল্য এই শত্রুগণকে পরাজিত করিতে সমর্থ হইবেন। এক্ষণে আজ কর্ণ যাহাতে কৃষ্ণসারথি অর্জ্জুনকে প্ৰমথিত ও বিনষ্ট করিতে পারেন, আপনি শীঘ্র তাহার উপায়বিধান করুন। হে মদ্ররাজ! আপনাতেই আমাদিগের রাজ্যলাভপ্রত্যাশা, জীবিতাশা এবং কর্ণের সাহায্যনিবন্ধন জয়াশা বিদ্যমান রহিয়াছে। আমাদের রাজ্য, জয়লাভ এবং মহাবীর কর্ণ ও আমরা আপনারই আয়ত্ত; অতএব আপনি এক্ষণে অশ্বরশ্মি গ্রহণ করুন। হে মদ্ররাজ! আর এক ধর্ম্মপরায়ণ ব্রাহ্মণ আমার পিতার সমক্ষে যে ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিয়াছিলেন, আপনি এক্ষণে তাহাও শ্রবণ করুন। সেই হেতুগর্ভ কার্য্যার্থযুক্ত অত্যাশ্চর্য্য ইতিহাস শ্রবণ ও অবধারণ করিয়া আমি যে বিষয়ের নিমিত্ত আপনাকে অনুরোধ করিতেছি, অসন্দিগ্ধমনে তাহার অনুষ্ঠান করুন।
পরশুরামশিষ্য কর্ণ-ইতিহাসে শল্যসন্তোষ
‘মহাযশাঃ মহর্ষি জমদগ্নি ভৃগুবংশে উৎপন্ন হইয়াছিলেন। তাঁহার পুত্রের নাম রাম। ঐ তেজোগুণসম্পন্ন জমদগ্নিনন্দন অস্ত্রলাভাৰ্থ অতি কঠোর তপানুষ্ঠানপূর্ব্বক রুদ্রদেবকে আরাধনা করিয়াছিলেন। কিয়দ্দিন পরে ভগবান্ মহাদেব তাঁহার ভক্তিভাব ও শান্তিগুণে একান্ত প্রীত ও প্রসন্ন হইলেন এবং তাঁহার অভিপ্রায় অনুধাবনপুৰ্ব্বক তথায় আবির্ভূত হইয়া কহিলেন, —হে রাম! আমি তোমার প্রতি সাতিশয় সন্তুষ্ট এবং তোমার অভিপ্রায় সম্যক অবগত হইয়াছি। এক্ষণে তুমি আপনাকে পবিত্র কর, তাহা হইলে তোমার মনোরথ পূর্ণ হইবে। হে ভৃগুনন্দন! যখন তুমি পবিত্র হইবে, তখন আমি তোমাকে অস্ত্রসমুদয় প্রদান করিব। ঐ সমস্ত অস্ত্র অপাত্র ও অসমর্থ ব্যক্তিকে ভস্মসাৎ করিয়া ফেলে। জমদগ্নিনন্দন রাম ভগবান্ শূলপাণিকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া প্রণতিপূর্ব্বক কহিলেন, —হে ভগবন্! আমি নিয়তই আপনার শুশ্রুষা করিতেছি; আপনি যখন আমাকে অস্ত্রধারণের উপযুক্ত পাত্র বোধ করিবেন, সেই সময়েই আমাকে উহা প্রদান করিবেন। এই বলিয়া জমদগ্নিনন্দন তপানুষ্ঠান, ইন্দ্রিয়নিগ্রহ, নিয়ম, পূজা, উপহার, বলি, মন্ত্র ও হোমদ্বারা বহু বৎসর শঙ্করের আরাধনা করিতে লাগিলেন। তখন ভগবান্ শঙ্কর মহাত্মা ভার্গবের প্রতি প্রসন্ন হইয়া দেবী পার্ব্বতীর সন্নিধানে কহিলেন,—প্রিয়ে! দৃঢ়ব্রতপরায়ণ রাম আমার প্রতি অতিমাত্র ভক্তি প্রদর্শন করিয়া থাকে। ভগবান্ ঊমাপতি পার্ব্বতীকে এইরূপ বলিয়া দেবগণ ও পিতৃগণসমক্ষে বারংবার জামদগ্নের গুণগরিমার পরিচয় প্রদান করিতে লাগিলেন।
‘হে মহারাজ! ঐ সময় মহাবলপরাক্রান্ত অসুরগণ মোহ ও গর্ব্বপ্রভাবে দেবগণকে নিপীড়িত করিতে প্রবৃত্ত হইল। সুরগণ মিলিত ও তাহাদিগের সংহারে কৃতনিশ্চয় হইয়া অসামান্য যত্ন করিতে লাগিলেন; কিন্তু উহাদিগকে কিছুতেই পরাজিত করিতে সমর্থ হইলেন না। তখন তাঁহারা ভগবান্ রুদ্রের সন্নিধানে সমুপস্থিত হইয়া ভক্তিপ্রভাবে তাঁহাকে প্রসন্ন করিয়া কহিলেন, ‘হে ভগবন্! আপনি আমাদিগের বিপক্ষগণকে সংহার করুন।’ রুদ্রদেব দেবগণের বাক্য শ্রবণে তাহাদের সমক্ষে বিপক্ষসংহারে অঙ্গীকার করিয়া রামকে আহ্বানপূর্ব্বক কহিলেন, —হে রাম! তুমি লোকের হিত ও আমার প্রীতিসাধনের নিমিত্ত দেবতাদিগের শত্রুগণকে সংহার কর। রাম কহিলেন,—হে দেবেশ! আমি অশিক্ষিতাস্ত্র, সুতরাং শিক্ষিতাস্ত্র যুদ্ধদুর্ম্মদ দানবদলকে দলন করিতে কিরূপে সমর্থ হইব? রুদ্র কহিলেন,—হে রাম! আমি কহিতেছি, তুমি সুরশত্রু অসুরগণকে সংহার করিতে সমর্থ হইবে। এক্ষণে আমার আদেশানুসারে যুদ্ধার্থ গমন কর। তুমি উহাদিগকে পরাজিত করিলে অসামান্য গুণগ্রাম প্রাপ্ত হইবে। তখন রাম রুদ্রদেবের বাক্য স্বীকার করিয়া সংগ্রামার্থ বলমদমত্ত দানবগণসন্নিধানে গমনপূর্ব্বক কহিলেন, —হে দৈত্যগণ! দেবাদিদেব মহাদেব তোমাদিগকে পরাজয় করিবার নিমিত্ত আমাকে প্রেরণ করিয়াছেন, এক্ষণে তোমরা আমার সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও। দৈত্যগণ রামের বাক্য শ্রবণমাত্র, সংগ্রাম আরম্ভ করিল; মহাবীর রামও অশনিসমস্পর্শ অস্ত্রদ্বারা অবিলম্বে তাহাদিগকে সংহার করিয়া ফেলিলেন। অনন্তর তিনি অসুরাস্ত্রে ক্ষতবিক্ষতকলেবর হইয়া রুদ্রদেবের সন্নিধানে গমন করিলে মহাদেব করস্পর্শদ্বারা তৎক্ষণাৎ তাঁহাকে ব্রণশূন্য করিয়া প্রীতমনে বহুবিধ বরপ্রদানপূর্ব্বক কহিলেন, —হে রাম! তুমি অনবরত নিপতিত অসুরাস্ত্র সমুদয় সহ্য করিয়া মনুষ্যগণের অসাধ্য কর্ম্মের অনুষ্ঠান করিয়াছ। এক্ষণে তুমি আমার নিকট অভিলষিত দিব্যাসমুদয় গ্রহণ কর।
‘অনন্তর রাম রুদ্রদেবের প্রসাদে অভিলষিত বর ও দিব্যাস্ত্রসমুদয় গ্রহণপূর্ব্বক তাঁহাকে নমস্কার করিয়া তাঁহার আদেশানুসারে স্বস্থানে প্রস্থান করিলেন। হে মদ্ররাজ! মহর্ষি আমার পিতার নিকট এই পুরাবৃত্ত কীৰ্ত্তন করিয়াছিলেন। সেই ভৃগুবংশাবতংস মহাবীর পরশুরাম প্রীতমনে কর্ণকে দিব্যধনুৰ্ব্বেদে দীক্ষিত করেন। যদি কর্ণের কিছুমাত্র দোষ থাকিত, তাহা হইলে মহর্ষি রাম তাঁহাকে কদাচ দিব্যাস্ত্রজাল প্রদান করিতেন না। এই নিমিত্ত আমি কর্ণকে সূতকুলোৎপন্ন বলিয়া বিবেচনা করি না। আমার মতে উনি ক্ষত্রিয়কুলপ্রসূত দেবকুমার এবং মহগোত্রসম্পন্ন। উনি কখনই সূতকুলসম্ভূত নহেন। যেমন মৃগীর গর্ভে ব্যাঘ্রের উৎপত্তি হওয়া নিতান্ত অসম্ভব, তদ্রূপ সামান্য নারীর গর্ভে কুণ্ডলালঙ্কৃত, কবচধারী, দীর্ঘবাহু, আদিত্যসঙ্কাশ, মহারথ পুত্র সমুৎপন্ন হওয়া কদাপি সম্ভবপর নহে। হে মদ্ররাজ! কর্ণের ভুজযুগল করিকরসদৃশ নিতান্ত পীন ও বক্ষঃস্থল অতি বিশাল, অতএব উনি কদাচ প্রাকৃত মনুষ্য নহেন। উনি মহাবলপরাক্রান্ত রামের শিষ্য ও মহাত্মা।’