৩৫তম অধ্যায় – ভীম–দুৰ্য্যোধনের গদাযুদ্ধ—বলরাম–আগমন
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! এইরূপে সেই বীরদ্বয়ের ভীষণ গদাযুদ্ধ উপস্থিত হইলে পাণ্ডবপক্ষীয় অন্যান্য বীরগণ সকলেই উপবিষ্ট হইলেন। ঐ সময় তালধ্বজ বলদেবশিষ্যদ্বয়ের সংগ্রাম বৃত্তান্ত অবগত হইয়া তথায় আগমন করিলেন। পাণ্ডবগণ তাঁহার সন্দর্শনে অতিমাত্র প্রীত হইয়া কেশব-সমভিব্যাহারে তাঁহাকে প্রত্যুৰ্গমনপূর্ব্বক যথাবিধি অচনা করিয়া কহিলেন, ‘মহাশয়! শিষ্যদ্বয়ের যুদ্ধকৌশল অবলোকন করুন।’ তখন বলদেব কৃষ্ণ সমবেত পাণ্ডবগণকে ও গদাধারী রাজা দুর্য্যোধনকে অবলোকন করিয়া কহিলেন, “হে বীরগণ! আজ দ্বিচম্বারিংশৎ [বিয়াল্লিশ] দিবস হইল, আমি তীর্থযাত্রায় নির্গত হইয়াছিলাম। আমি পুষ্যানক্ষত্রে [পুষ্যা-নক্ষত্রে যাত্রা করিয়া শ্রবণায় প্রত্যাবর্তন করিলে দ্বিস্বারিংশৎ অর্থাৎ ৪২ দিন হয় না। কারণ, পুষ্যানক্ষত্রের সংখ্যা ৮ এবং শ্রবণানক্ষত্রের সংখ্যা ২২; ৮ হইতে ২২ নক্ষত্রের দিন-পরিমাণ হয়, মাত্র ১৫। বলরামের এই আগমন পুষ্যার অব্যবহিত। পরবর্তী শ্রবণীয় নহে, পূষ্যার পর মধ্যে একটি শ্রবণা অতীত হওয়ার পর তৎপরবর্তী শ্রবণায় তিনি আসিয়াছেন। তাহাতে হইল এই যে, পুষ্যা হইতে শ্রবণা ১৫ এবং শ্রবণা হইতে পুনঃ শ্রবণা ২৭ সমান = ৪২। এই ত’ গেল, বলরামের আগমন দিন সংখ্যার সমাধান। ইহাতে আর একটি জটিল সমস্যার সম্ভাবনা দেখা যায়। টীকাকার নীলকণ্ঠ স্বয়ং ঐ প্রশ্নটিকে দুঃসমাধ্যে অর্থাৎ কঠিন সমস্যা বলিয়া টীকায় তাহার সুসমাধান করিয়াছেন। ভীষ্মপৰ্ব্বের ১৭শ অধ্যায়ে যুদ্ধারম্ভ দিন সম্বন্ধে মূলের “মঘা-বিষয়গঃ সোমসুদ্দিনং প্ৰত্যপদ্যত” এই বচন অনুসারে লিখিত হইয়াছে—”ঐ দিন চন্দ্রমা মঘানক্ষত্রে গমন করিয়াছিলেন।” এই “মঘা” শব্দ দর্শনে মঘা নক্ষত্রে যুদ্ধারম্ভ কেহ কেহ বলেন বাস্তবিক তাহা নহে কারণ, মঘা নক্ষত্রের সংখ্যা ১০, তারপর ১৮ দিন যুদ্ধ হইলে সপ্তবিংশতি ২৭ সংখ্যক রেবতী নক্ষত্রে যুদ্ধ পরিসমাপ্তি হওয়া উচিত, কিন্তু তাহা হয় নাই। তাহা হইলে বলরামবাক্যে বিরোধ হয়। যুদ্ধ শেষ হইয়াছে। শ্রবণানক্ষত্রে–যুদ্ধে অষ্টাদশাহে যেদিন ভীম-দুৰ্য্যোধনের গদাযুদ্ধ হয় – যাহা দেখিবার জন্য স্বয়ং বলরাম উপস্থিত। বলরামের আগমনের সহিত যুদ্ধ উপসংহারের সমতা করিলে মৃগশিরা নক্ষত্রেই যুদ্ধ আরম্ভ নির্ণীত হয়। মঘা নক্ষত্রের অধিপতি পিতৃগণ, সেই পিতৃগণের সহিত যুদ্ধমৃতগণের মিলন করার অধিকার চন্দ্রের। সেই চন্দ্র মৃগশিরা নক্ষত্রের অধিপতি। মূলের এই ‘মঘাবিষয়গঃ’ শব্দ দ্বারা মৃগশিরা নক্ষত্রই যে যুদ্ধারম্ভের দিন, তাহা ভীষ্মপর্বে মীমাংসিত। (ভীষ্মপৰ্ব্ব ১৭। অঃ পাদটীকা দ্রষ্টব্য)। যুদ্ধারম্ভ মৃগশিরা হইলেই মিল হয়। মৃগশিরা নক্ষত্রের সংখ্যা ৫, বলরামের আগমন-দিবসীয় শ্রবণা নক্ষত্রের সংখ্যা ২২; ৫ হইতে ২২ নক্ষত্রের দিন পরিমাণ ১৮।] আবাস বহির্গত হইয়া শ্রবণায় প্রত্যাগমন করিয়াছি। এক্ষণে শিষ্যদ্বয়ের গদাযুদ্ধ সংবাদ অবগত হইয়া উহা দর্শন করিবার মানসে এই স্থানে উপস্থিত হইলাম।’ তখন গদাযুদ্ধ সমুদ্যত মহাবীর দুর্য্যোধন ও বৃকোদর বলদেবের বাক্য শ্রবণ করিবামাত্র প্রীতিপ্ৰফুল্লমনে অতিমাত্র শোভা পাইতে লাগিলেন।
অনন্তর ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির বলদেবকে আলিঙ্গনপূর্ব্বক স্বাগত ও কুশল প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলেন। তৎপরে মহাবীর অর্জ্জুন ও বাসুদেব প্রীতমনে তাঁহাকে আলিঙ্গন ও অভিবাদন, মাদ্ৰীতনয়দ্বয় ও দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র তাঁহাকে নমস্কার এবং রাজা দুর্য্যোধন ও ভীমসেন তাঁহার যথোচিত সৎকার করিয়া স্বাগত প্রশ্ন। জিজ্ঞাসাপূর্ব্বক কহিলেন, ‘মহাবাহো! এক্ষণে আপনি এই গদাযুদ্ধ নিরীক্ষণ করুন।’ তখন মহাবলপরাক্রান্ত বলদেব পাণ্ডব ও সৃঞ্জয়গণকে আলিঙ্গনপূর্ব্বক অন্যান্য পার্থিবদিগকে যথাক্রমে সৎকার করিয়া কুশলপ্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলে তাঁহারাও তাঁহাকে পূজা ও অনাময়বার্তা [কুশল-সংবাদশারীরিক স্বাস্থ্যাদি] জিজ্ঞাসা করিলেন। অনন্তর বলদেব প্রীতিপ্রফুল্লমনে জনার্দন ও সাত্যকিকে আলিঙ্গন ও তাঁহাদের মস্তকাঘ্রাণপূর্ব্বক কুশলবার্তা জিজ্ঞাসা করিলে তাঁহারা ইন্দ্র ও উপেন্দ্র যেমন প্রজাপতি ব্রহ্মাকে পূজা করিয়া থাকেন, তদ্রূপ হৃষ্টমনে শাস্ত্রানুসারে তাঁহার সৎকার করিলেন।
তখন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির রোহিণীনন্দনকে কহিলেন, ‘হে রাম! আপনি এক্ষণে আমার ভ্রাতৃদ্বয়ের গদাযুদ্ধ নিরীক্ষণ করুন।’ নীলাম্বরধারী ধবলকায় বলদেব যুধিষ্ঠিরের বাক্যশ্রবণ করিয়া পরম প্রীতমনে সেই ভূপালগণমধ্যে উপবেশনপূর্ব্বক নভোমণ্ডলে নক্ষত্রপরিবৃত নিশাকরের ন্যায় অপূৰ্ব্ব শোভা ধারণ করিলেন। ঐ সময় দুর্য্যোধন ও বৃকোদরের ঘোরতর গদাযুদ্ধ আরম্ভ হইল।”