দেখিয়া ব্যাকুল হৈল বিদুরের মন।
ধৃতরাষ্ট্রে ডাকি তবে বলিছে বচন।।
আমি যত বলি, তব মনে নাহি লয়।
মৃত্যুকালে রোগী যেন ঔষধ না খায়।।
ওহে অন্ধরায় তুমি হইলা কি স্তব্ধ।
জন্মকালে এই পুত্র কৈল খর-শব্দ।।
তখনি বলিনু আমি সকল বিস্তার।
কুরুকুল-ক্ষয় হেতু হইল কুমার।।
না শুনিলা মম বাক্য করিয়া হেলন।
সেই সব রাজা ব্যক্ত হতেছে এখন।।
সংহার-রুপেতে এই আছে তব ঘরে।
স্নেহেতে ভুলিয়া নাহি পাও দেখিবারে।।
দেব-গুরু-নীতি রাজা কহি সে তোমারে।
মধুহেতু মধুলোভী উঠে বৃক্ষোপরে।।
নাহিক পতন-ভয় মধুর কারণ।
সেইরূপ মত্ত হইয়াছে দুর্য্যোধন।।
মহারথিগণ সহ করয়ে বৈরিতা।
পশ্চাৎ জানিবে, এবে নাহি শুন কথা।।
এইরূপে কংস ভোজ হইল উৎপত্তি।
সপ্তবংশ পিতার নাশিল দুষ্টমতি।।
উগ্রসেন আদি সবে করি এ প্রকার।
গোবিন্দের হাতে তবে হইল সংহার।।
সপ্তবংশ সুখে বৈসে গোবিন্দ সংহতি।
মম বাক্য শুন রাজা, পাবে বড় প্রীতি।।
শীঘ্রগতি পার্থে আজ্ঞা করহ রাজন।
দুর্য্যোধনে রাখ গিয়া করিয়া বন্ধন।।
নির্ভয়ে পরম-সুখে থাকহ নৃপতি।
কাক-হস্তে ময়ুরের না কর দুর্গতি।।
শিবা-হস্তে সিংহের না কর অপমান।
শোক-সিন্ধু মধ্যে রাজা না কর প্রয়াণ।।
যে পক্ষী প্রসব করে অমূল্য রতন।
মাংসলোভে তারে নাহি খায় বিজ্ঞজন।।
সুবর্ণের বৃক্ষ রাজা রোপিয়া যতনে।
বৃক্ষ রক্ষা কৈলে, পুষ্প পায় অনুদিনে।।
যে হইল, এখন নিবর্ত্ত নরপতি।
পুত্রগণে কেন কর যমের অতিথি।।
এ পঞ্চ জনের সহ কে করিবে রণ।
কহ শুনি রাজা তব আছে কোন্ জন।।
দিক্পাল সহ যদি আইসে বজ্রপাণি।
পাণ্ডবে জিনিতে নারে, তোমা কিসে গণি।।
হে ভীষ্ম, হে দ্রোণ, কৃপ নাহি শুন কেনে।
সবে মেলি রঙ্গ দেখ, বুঝিলাম মনে।।
অগাধ সমুদ্রে নৌকা না ডুবাহ হেলে।
সবে মিলি যম-গৃহে যাইতে বসিলে।।
অক্রোধ অজাত-শত্রু ধর্ম্মের তনয়।
যে ক্ষণে করিবে ক্রোধ ভীম ধনঞ্জয়।।
যমজ যুগল যবে করিবেক ক্রোধ।
কে আছে সহায় তব করিতে বিরোধ।।
হে অন্ধ, পাশাতে যত লইবে বেসাত।
বুঝিলা কি তাহাতে তোমার নাহি হাত।।
কপট করিয়া তাহে কোন্ প্রয়োজন।
আজ্ঞামাত্র দিবে সব ধর্ম্মের নন্দন।।
এই শকুনিরে আমি ভালমতে জানি।
কপট কুবুদ্ধি খলগণ-চূড়ামণি।।
কোথায় পর্ব্বতপুর ইহার নিবাস।
কে আনিল হেথায় করিতে সর্ব্বনাশ।।
বিদায় করহ, ঘরে যাক আপনার।
উঠ গো শকুনি পাশা করি পরিহার।।
সভাতে এতেক যদি বিদুর বলিল।
জ্বলন্ত অনলে যেন ঘৃত ঢালি দিল।।
দুর্য্যোধন বলে, আমি তোমা না জিজ্ঞাসি।
কার হৈয়ে কহ ভাষা সভামাঝে বসি।।
জিহবাতে হৃদয়-তত্ত্ব মনুষ্যের জানি।
সদাকাল চাহ তুমি ধৃতরাষ্ট্র-হানি।।
পাণ্ডু-পুত্র প্রিয় তব সর্ব্বলোকে জানে।
নিকটে না রাখি কভু শত্রু-হিত জনে।।
উঠিয়া যথায় ইচ্ছা যাহ আপনার।
হেথায় রহিতে যোগ্য না হয় তোমার।।
কুজনরে যদি রাখে করিয়া যতন।
তথাপি অসৎ-পথে করিবে গমন।।
সভামধ্যে যতেক কহিলা তুমি ভাষা।
অন্য হৈলে নাহি থাকে জীবনের আশা।।
যতেক তোমারে আমি করি পূজা মান।
তত অনাদর মোরে কর অল্পজ্ঞান।।
সভামধ্যে কহ কথা যেন স্বয়ং প্রভু।
এ হেন হেয় উক্তি না কহে কেহ কভু।।
বিদুর বলেন, আমি না কহি তোমারে।
ধৃতরাষ্ট্র-দুঃখ দেখি হৃদয় বিদরে।।
তোরে কি কহিব, ধৃতরাষ্ট্র নাহি শুনে।
হতায়ু জনেতে কভু হিত নাহি মানে।।
আমারে কি হেতু তুমি জিজ্ঞাসিলে কথা।
জিজ্ঞাসহ নিজ তুল্য লোক পাও যথা।।
এত বলি নীরব হৈল ক্ষত্তা মহাশয়।
পুনঃ আরম্ভিল পাশা সুবল-তনয়।।