অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত : লোকায়তিক ধ্যানধারণার উৎস-প্রসঙ্গে
লোকায়তিক ধ্যানধারণা প্রসঙ্গে ওই পঞ্চমকারের আলোচনা কেন? কেননা, প্রাচীনেরাই লোকায়তিকদের প্রসঙ্গে এমন কথা বলেছেন যা প্রায় অনিবার্যভাবেই পঞ্চমকারের অন্তত প্রধানতম মকারগুলির কথা মনে পড়িয়ে দেয়। এবং প্রাচীনদের এ-জাতীয় উক্তি আধুনিক বিদ্বানদেরও চোখে পড়েছে; কিন্তু দুঃখের বিষয় আধুনিক বিদ্বানের আধুনিক যুগের ধ্যানধারনা নিয়ে এত রিভোর যে, ওই পঞ্চমকারের প্রসঙ্গ দেখে তাঁরা লোকায়তিকদের সম্বন্ধে শুধু ঘৃণাই প্রকাশ করেছেন, লোকায়তিক চিন্তাধারার আদি-তাৎপর্য সন্ধানে অগ্রসর হয়নি।
একটি নমুনা দেখা যাক। অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত(৫৯৬) লিখছেন :
Gunaratna, however, in his commentary on Sad-darsanasamuccaya, speaks of the Carvakas as being a nihilistic sect who only eat but do not regard the existence of virtue and do not trust anything else but what can be directly perceived. They drank wine and ate meat and were given to unrestricted sex indulgence. Each year they gathered together on a particular day and had unrestricted intercourse with women. They behaved like common people and for this reason they were called lokayata.
কিন্তু যড়-দৰ্শন-সমুচ্চয়ের টীকায় গুণরত্ব বলছেন, চাৰ্বাকরা হলো এক রকম নাস্তিক সম্প্রদায়ের লোক যারা শুধুই খাওয়া-দাওয়া করতো এবং ধর্মাধৰ্ম মানতে না এবং যারা প্রত্যক্ষভাবে-জানতে-পারা ছাড়া আর কোনো কিছুর সত্বাই স্বীকার করতো না—তারা মদ্যপান করতো, মাংস ভোজন করতো এবং অবারিত মৈথুনে প্ৰমত্ত হতো। প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট দিনে তারা একত্রিত হতো এবং মেয়েদের সঙ্গে নির্বিচারে মিলিত হতো। তারা সাধারণ লোকের মতো ব্যবহার করতো এবং এই কারণেই তাদের বলা হতো লোকায়ত।
প্রাচীন কালের কোনো একটি দার্শনিক সম্প্রদায় প্রসঙ্গে এ-জাতীয় উক্তি নিশ্চয়ই বিস্ময়কর। কিন্তু আধুনিক কালের অতো বড়ে একজন বিদ্বানের পক্ষে এই উক্তিটি সংগ্রহ এবং উদ্ধৃত করবার পরও এ-বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন থাকাও কম বিস্ময়কর নয়। অথচ, অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত এমনভাবে তথ্যটির উল্লেখ করলেন যেন মনে হয় এ-বিষয়ে আর কিছুই ভাববার নেই। কেননা, তিনি এ-নিয়ে আর কোনো আলোচনাই তুললেন না—এ-কথা বলবার পরে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র প্রসঙ্গের অবতারণা করলেন। অতএব তাঁর এ-উক্তির একমাত্র তাৎপর্য এই হয়ে রইলো যে, লোকায়তিকেরা নেহাতই দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তি ছিলো, তারা ধর্মধর্মের প্রভেদ মানতো না এবং আধুনিক যুগের লম্পটদের মতোই মদ্য, মাংস ও মৈথুন নিয়ে প্ৰমত্ত থাকতো।
কিন্তু গুণরত্নের এই উক্তিকে অতোখানি সহজ-সরল অর্থে গ্রহণ করায় বাধা আছে। প্রথমে গুণরত্ন(৫৯৭) ঠিক কী বলছেন তাই দেখা যাক :
।। অথ লোকায়তমতম্।।
প্রথমম্ নাস্তিক স্বরূপমুচ্যতে। কাপালিকাঃ ভস্মোদ্ধুলনপরাঃ যোগিনঃ ব্রাহ্মণাদ্যস্ত্যজাতাশ্চ কেচন নাস্তিকা ভবন্তি। তে চ জীবপুণ্যপাপাদিকং ন মন্যন্তে। চতুর্ভূতাত্মকং জগদাচক্ষতে। কেচিত্তু চার্ব্বাকৈকদেশীয়া আকাশং পঞ্চমং ভূতমভিমন্যমানাঃ পঞ্চভূতাত্মকং জগদিতি নিগদন্তি। তন্মতে ভূতেভ্যো মদশক্তিবচ্চৈতন্যমুতূদ্যতে। জলবুদ্বুদবজ্জীবাঃ। চৈতন্যবিশিষ্টঃ কায়ঃ পুরুষঃ ইতি। তে চ মদ্যমাংসে ভুঞ্জতে মাত্রাদ্যগম্যাগমনমপিকুর্বতে। বর্ষে বর্ষে কস্মিন্নপি দিবসে সর্বে সংভূয় যথানামনির্গমং স্ত্রীভিরভিরমন্তে। ধর্মং কামাদপরং ন মন্যতে। তন্নামানি চার্ব্বাকাঃ লোকায়তাঃ ইত্যাদীনি। গলচর্ব অদনে। চর্ব্বয়ন্তি ভক্ষয়ন্তি তত্ত্বতঃ ন মন্যন্তে পুণ্যপাপাদিকং পরোক্ষং বস্তুজাতমিতি চার্ব্বাকাঃ। …লোকাঃ নির্ব্বিচারাঃ সামান্যাঃ লোকাস্তদ্বদাচরন্তি স্মেতি লোকায়তা লোকায়তিকা ইত্যপি। বৃহস্পতিপ্রণীতমতত্বেন বার্হস্পত্যাশ্চ ইতি।
অর্থাৎ,
অনন্তর লোকায়ত। প্রথমে নাস্তিকদের কথা। কাপালিক :–ভস্ম আচ্ছাদিত যোগীগণ এবং অন্ত্যজ ব্রাহ্মণাদি কেহ কেহ নাস্তিক। তাহারা জীবগণের পুণ্য পাপ প্রভৃতির বিচার করে না। তাহারা জগতকে চতুর্ভূতাত্মক বলিয়া মনে করে। চার্বাক প্রভৃতি মতাবলম্বীদিগের কেহ কেহ আকাশকে পঞ্চম ভূত রূপে ধরিয়া জগতকে পঞ্চভূতাত্মক বলিয়া থাকে। তাহাদের মতে চৈতন্য মদশক্তির ন্যায় আবির্ভূত হয়। জীবগণ জলবুদবুদ্ তুল্য। পুরুষ চৈতন্যবিশিষ্ট শরীরমাত্র। তাহারা মদ্যপান ও মাংস ভোজন করিয়া থাকে এবং মাতা প্রভৃতি অগম্য নারী প্রভৃতিতেও গমন করিয়া থাকে। প্রতি বৎসর কোনো একদিনে সকলে একত্র হইয়া যথাভিপ্রেত স্ত্রীগণের সহিত রমন করিয়া থাকে। কাম ব্যতীত ধর্ম নাই। এই জন্যই চার্বাকদিগকে লোকায়ত বলা হইয়া থাকে। পরোক্ষ বস্তুসমূহ হইতে জাত গলাধঃকরণ ও চর্বণ হেতুই চার্বাক বলা হইয়া থাকে। …নির্বিচারে সাধারণ লোকের ন্যায় আচরণ করে বলিয়াই তাহাদিগকে লোকায়ত বা লোকায়তিকও বলা হইয়া থাকে। তাহাদের মত বৃহস্পতি প্রণীত বলিয়াই তাহাদের বার্হস্পত্যও বলে।
গুণরত্বের কয়েকটি কথা বিচার করা যাক।
ওরা ‘সাধারণ মানুষের মতো’ ব্যবহার করে আর, সেই কারণেই ওদের বলা হয় লোকায়ত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সাধারণ মানুষ হিসাবে আমরা জামাদের আশেপাশে, যাদের দেখি,—কিম্বা খৃষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীর লেখক গুণরত্ন তাঁর আশেপাশে যাদের দেখতেন,—তারা কি সত্যিই ওইভাবে মদ খায়, মাংস খায়, প্ৰমত্ত হয় অবাধ মৈথুনে? তারা কি সত্যিই বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে ওইভাবে অবাধ-মিলনের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে একত্র মিলিত হয়? নিশ্চয়ই নয়। এর সবচেয়ে স্পষ্ট প্রমাণ হলে, বছরের একটি বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনের উল্লেখ। যারা লম্পট তারা নিশ্চয়ই দিনক্ষণ বেছে লাম্পট্য করে না। অতএব, গুণরত্নের লেখায় একটি নির্দিষ্ট দিনের উল্লেখ থেকেই বোঝা যায়, লোকায়তিকদের এই বাৎসরিক সম্মেলনটা্র আসলে একটা আনুষ্ঠানিক তাৎপর্ষ—ritual significance—নিশ্চয়ই ছিলো। তাহলে গুণরত্বের ওই ‘সাধারণ মানুষ’ বলতে সত্যিই কি কোনো রকম অসাধারণ মানুষের দলকে বুঝতে হবে? তাও নয়। কেননা সমাজ-বিকাশের পিছিয়ে-পড়া পর্যায়ে সাধারণ মানুষ বলতে বোঝায় এই রকম মানুষই। এবং তাদের এ-জাতীয় আচরণ যে লাম্পট্য নয়, এ-কথা আমরা ইতিপূর্বেই আলোচনা করেছি। তাই গুণরত্বের সাধারণ মানুষেরা সত্যিই সাধারণ মানুষ,—কেবল অনুন্নত পর্যায়ের সাধারণ মানুষ, কিংবা এমনতরো কৃষিজীবীদের দল যাদের মধ্যে ওই অনুন্নত পর্যায়ের স্মারক অত্যন্ত জোরালো। তাই মদ্য, মাংস ও মৈথুনের উপর তারা যে-গুরুত্ব আরোপ করে তাকে নিছক নীতিবোধের অভাব বা নীতিপরায়ণতা বলে অনুমান করা নিশ্চয়ই সঙ্গত নয়। অন্তত, ভারতীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তা যে একান্তই অসঙ্গত, এ-কথা নিশ্চয়ই অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্তের মতো ভারততত্ত্ববিদকে স্মরণ করিয়ে দেবার কোনো প্রয়োজন নেই। কেননা, অন্যান্য নানা শাস্ত্রের মতোই তন্ত্ৰ-শাস্ত্রে তার জ্ঞান অত্যন্ত সুবিস্তীর্ণ(৫৯৮)। এবং যড়-দৰ্শন-সমুচ্চয়ে বর্ণিত লোকায়তিকদের সঙ্গে তান্ত্রিকদের সাদৃশ্য যে সত্যিই কতোখানি তার আর একটি নজির হিসেবে এখানে মণিভদ্রের টীকার উল্লেখ করা যায়। ষড়-দৰ্শন-সমুচ্চয়ের(৫৯৯) একটি শ্লোকে বলা হয়েছে : “পিব খাদ চ চারুলোচনে” —ইত্যাদি। টীকা-প্রসঙ্গে মণিভদ্র বলছেন, “পিবেতি অধরাদিপানং কুরু, খাদেতি ভোগা উপভুঙক্ষ্ব, ইতি কাম্যুপদেশ”। অতএব, এখানেও কামতত্ত্বের কথা—এবং এই কামতত্ত্ব অত্যন্ত প্রকটভাবে তান্ত্রিক ধ্যানধারণারই পরিচায়ক।
তাছাড়া, গুণরত্ন স্পষ্টভাষায় বলছেন, লোকায়তিকের গায়ে ভষ্ম মাখে, তারা যোগী, তারা কাপালিক।
অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত যদি এ-বিষয়ে সচেতন হতেন যে, এ-যুগেও আমাদের দেশে তান্ত্রিকাদি ধ্যানধারণার এমন ব্যাপক ও গভীর প্রভাবকে শুধুমাত্র জাতীয় নীতিপরায়ণতা বলে ব্যাখ্যা করা চলে না এবং তিনি যদি গুণরত্ন-বণিত লোকায়তিক ও তান্ত্রিক ধ্যানধারণার মধ্যে আমন স্পষ্ট যোগাযোগকে একেবারে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা না করতেন তাহলে নিশ্চয়ই তাঁর মতে বিদ্বানের পক্ষে লোকায়তের উৎস-সংক্রান্ত সমস্যার উপর অত্যন্ত মূল্যবান আলোকপাত করা সম্ভবপর হতো। কিন্তু হুঃখের বিষয় তাঁর মনে এ জাতীয় কোনো সমস্যাই জাগেনি। ব্যাপারটা আরো বেশি দুঃখের এই কারণে যে, তাঁর পূর্বগামী ভারততত্ত্ববিদ্দের মধ্যে অন্তত একজনের কাছে এই যোগাযোগটির কথা ধরা পড়েছে এবং এ-দিক থেকে যে অন্তত কিছুকিছু মৌলিক সমস্যা ওঠে তার পরিচয় তিনি দিয়ে গিয়েছেন। আমরা ইতিপূর্বে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মন্তব্য উদ্ধৃতি করেছি। সেই মন্তব্যগুলিকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত লোকায়তের উৎস-প্রসঙ্গে যে-সিদ্ধান্তে উপনীত হবার চেষ্টা করছেন তা স্বভাবতই অত্যন্ত কৃত্রিম হয়ে দাঁড়িয়েছে(৬০০) :
It seems possible, therefore, that probably the lokayata doctrines had their beginnings in the preceding Sumerian civilization in the then prevailing customs of adorning the dead and the doctrine of bodily survival after death.
অতএব, মনে হয়, পূর্ববর্তী স্থমেরীয় সভ্যতায় মৃতদেহকে বিভূষিত করার যে প্রথা এবং মৃত্যুত্তীর্ণ দৈহিক সত্তায় যে বিশ্বাস—তারই মধ্যে লোকায়ত মতবাদের উৎস।
সিদ্ধান্তটি যে অত্যন্ত চমকপ্রদ এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই : দেশের সমস্ত ঐতিহ্য অগ্রাহ্য করে একেবারে সুমেরীয় সভ্যতার সৎকার-ব্যবস্থার মধ্যে অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত লোকায়তিক ধ্যানধারণার বীজ অনুসন্ধান করছেন। ঠিক কোন ধরনের তথ্যের উপর নির্ভর করে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে চাইছেন?
অধ্যাপক মুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত এই সিদ্ধান্তের সমর্থনে মাত্র একটি নজির পেশ করেছেন,—ছান্দোগ্য-উপনিষদের প্রজাপতি ও ইন্দ্র-বিরোচন সংবাদ।
যে-হেতু শুধু এই নজিরটির উপর নির্ভর করে অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত এতোবড়ো একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে চেয়েছেন সেইহেতু আমরা ছান্দোগ্য-উপনিষদের ওই উপাখ্যানটি সম্পূর্ণভাবে উদ্ধৃত করবো :
প্রজাপতি এক সময়ে বলিয়াছিলেন—‘যে আত্মা পাপরহিত, জরারহিত, মৃত্যুরহিত, শোকরহিত, অশনেচ্ছারহিত, পিপাসারহিত, যিনি সত্যকাম ও সত্যসঙ্কল্প, তাঁহাকেই অন্বেষণ করিতে হইবে, তাঁহাকেই বিশেষরূপে জানিতে হইবে। যিনি তাহাকে অনুসন্ধান করিয়া অবগত হন, তিনি সমুদয় লোক ও সমুদয় কামনা লাভ করেন।। ৮।৭।১।।
দেব ও অসুরগণ উভয়েই লোকপরম্পরায় এই উপদেশের কথা শুনিয়াছিলেন। তাঁহারা বলিলেন, ‘যে আত্মাকে অনুসন্ধান করিলে সর্বলোক ও সর্বকাম্যবস্তু লাভ করা যায়, আমরা সেই আত্মাকে অনুসন্ধান করিব। (এই উদ্দেশ্যে) দেবগণের মধ্যে ইন্দ্র এবং অসুরগণের মধ্যে বিরোচন (প্রজাপতির) অভিমুখে গমন করিলেন। তাঁহারা পরস্পরকে না জানাইয়া সমিৎপাণি হইয়া প্রজাপতির সমীপে উপস্থিত হইলেন।। ৮।৭।২।।
তাঁহারা দুইজন ৩২ বৎসর ব্রহ্মচর্য আচরণ করিয়া বাস করিলেন। তদন্তর প্রজাপতি তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কী ইচ্ছা করিয়া তোমরা বাস করিলেন? তাঁহারা বলিলেন, “ভগবানের বাক্য বলিয়াই বিদিত যে—যে আত্মা পাপরহিত, জরারহিত, শোকরহিত, অশনেচ্ছারহিত, যিনি সত্যকাম ও সত্যসঙ্কল্প —তাঁহাকেই অন্বেষণ করিতে হইবে, তাঁহাকেই বিশেষরূপে জানিতে হইবে। যিনি এই আত্মাকে অনুসন্ধান করিয়া জানেন, তিনি সর্বলোক ও সমুদয় কাম্যবস্তু লাভ করেন। সেই আত্মাকেই জানিতে ইচ্ছা করিয়া আমরা দুইজনে বাস করিয়াছি’।। ৮।৭।৩।।
প্রজাপতি সেই দুইজনকে বলিলেন—‘চক্ষুতে এই যে পুরুষ দৃষ্ট হয় ইনিই আত্মা’। তিনি আরও বলিলেন—‘উনিই অমৃত অভয় এবং ইনিই ব্রহ্ম’। তাঁহারা জিজ্ঞাসা করিলেন—’হে ভগবন্! এই যে পুরুষ জলে দৃষ্ট হয়, আর এই যে পুরুষ দর্পণে দৃষ্ট হয়, ইহা কে?’ প্রজাপতি বলিলেন– ‘এই সমুদয়েই আত্মা পরিদৃষ্ট হন’ ॥ ৮।৭।৪ ॥
প্রজাপতি বলিলেন–‘জলপূর্ণ পাত্রে আপনাকে (দেখ), দেখিয়া আত্মার বিষয় যাহা বুঝিবে না, তাহা আমাকে বলিও।’ তাঁহারা জলপূৰ্ণ পাত্রে আপনাদিগকে দেখিলেন। (অনন্তর) প্রজাপতি তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন—‘কী দেখিলে?’ তাঁহারা বলিলেন—‘হে ভগবন! আমরা সমগ্র আত্মা—লোম ও নখ পর্যন্ত ইহার প্রতিরূপ দৰ্শন করিলাম’ ॥ ৮।৮।১ ॥
প্রজাপতি তাঁহাদিগকে বলিলেন—‘সুন্দর অলঙ্কারে ভূষিত হইয়া, বসন পরিধান করিয়া, পরিষ্কৃত হইয়া জলপূর্ণ পাত্রে দর্শন কর। তাঁহারা সুন্দর অলঙ্কারে ভূষিত হইয়া সুবসন পরিধান করিয়া এবং পরিষ্কৃত হইয়া জলপুর্ণ পাত্রে দর্শন করিলেন। প্রজাপতি তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন—‘কী দেখিলে? ॥ ৮।৮।২।।
তাঁহারা বলিলেন—‘হে ভগবন! এই আমরা যেমন সুন্দর অলঙ্কারে ও সুবসনে বিভূষিত এবং পরিষ্কৃত, হে ভগবন! তেমনি জলের মধ্যে এই দুইজন সুন্দর অলঙ্কারে ও সুবসনে বিভূষিত এবং পরিষ্কৃত’। প্রজাপতি বলিলেন—‘ইনিই আত্মা; ইনিই অমৃত ও অভয় ও ইনিই ব্রহ্ম’। অনন্তর দুইজন শান্ত হৃদয় হইয়া প্রতিগমন করিলেন।। ৮।৮।৩।।
তাঁহাদিগকে (চলিয়া যাইতে) দেখিয়া প্রজাপতি মনে মনে বলিলেন—(ইঁহারা) আত্মাকে উপলব্ধি না করিয়াই, আত্মাকে অবগত না হইয়াই চলিয়া গেল। ইহাদিগের মধ্যে যে ইহাকেই উপনিষৎ (অর্থাৎ প্রকৃত জ্ঞান) বলিয়া গ্রহণ করিবে—দেবতাই হউক বা অসুরই হউক—সে বিনাশপ্রাপ্ত হইবে’।
বিরোচন শান্ত হৃদয়ে অসুরগণের নিকট গমন করিলেন এবং তাহাদিগকে এই শিক্ষা দিলেন—‘এই পৃথিবীতে দেহেরই পূজা করিবে এবং দেহেরই পরিচর্যা করিবে। দেহকে মহীয়ান করিলে এবং দেহের পরিচর্যা করিলেই ইহলোক ও পরলোক—এই উভয় লোকই লাভ করা যায়’।।৮।৮।৪।।
উপনিষদের উপাখ্যানটি অবশ্য এইখানেই শেষ নয়। এর পর বলা হয়েছে, যদিও অসুরদের প্রতিনিধি বিরোচন ওইভাবে দেহকেই আত্মা বলে জেনে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন তবুও দেবতাদের প্রতিনিধি ইন্দ্র এর পর প্রজাপতির কাছে প্রত্যাবর্তন করলেন এবং দেহাত্মবোধের ভ্রম উত্তীর্ণ হয়ে তিনি ক্রমশ সচ্চিদানন্দ আত্মাকে উপলব্ধি করবার দিকে অগ্রসর হন। উপাখ্যানটির এই শেষাংশের উপর অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্তের সিদ্ধান্ত নির্ভরশীল নয়। আমরা যতোটুকু উদ্ধৃত করেছি তারই উপর নির্ভর করে তিনি লোকায়তের উৎস-প্রসঙ্গে ওই অত্যাশ্চর্য সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছেন : লোকায়ত ধ্যানধারণা খাঁটি স্বদেশী মত নয়—খুব সম্ভব সুমেরীয় সভ্যতা থেকেই তার আমদানি হয়েছিলো।
অথচ, কতো বড়ো একজন বিদ্বান কতো তুচ্ছ যুক্তি ও তথ্যের উপর নির্ভর করে কতোখানি কাল্পনিক এক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন— অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্তের উদ্ধৃত যুক্তিটি বোধ হয় তারই এক চূড়ান্ত নিদর্শন।
উপনিষদের উপাখ্যানটির ঠিক কী ইঙ্গিতের উপর নির্ভর করে অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে চাইছেন?
প্রথমত, লোকায়ত হলো দেহতত্ত্ব, দেহাত্মবাদ। ছান্দোগ্যে বলা হয়েছে, এই দেহাত্মবাদ অসুরদের উপনিষৎ—বা প্রকৃত জ্ঞান। এই দেহাত্মবাদের দরুনই অসুরেরা মৃতদেহকে মাল্যগন্ধাদি ও বসন-অলঙ্কারে সুসজ্জিত করে। অসুর মানে হলো প্রাচীন সুমের-সভ্যতার মানুষ। এবং তাদের মধ্যেও এই জাতীয় সৎকার প্রণালীই প্রবর্তিত ছিলো। অতএব দেহাত্মবাদী ওই লোকায়তিক মতবাদ খুব সম্ভব প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতা থেকেই আমদানি হয়েছিলো। অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত(৬০১) অবশ্যই বলছেন :
The later Lokayatas or the Carvakas also believed that this body was the self, but the difference between them and the dehatmavadins referred to in the Chandogya is that they admitted “another world” where the bodies rose from the dead and prospered in the fine clothes, ornaments and food that were given-to the dead, body……This later on became sofar changed that it was argued that since the self and the body were identical and since the body was burnt after death,, there could not be any survival after death and hence there could not be anotherworld after death. .
পরের যুগের লোকায়ত বা চার্বাকরাও এই দেহকেই আত্মা মনে করেছে। কিন্তু ছান্দোগ্য-উপনিষদের দেহাত্মাবাদীদের সঙ্গে চার্বাকদের একটা তফাত আছে; ছান্দোগ্যের দেহাত্মাবাদীরা পরকাল মানে—সেই পরকালে মৃতদেহগুলির পুনরুজ্জীবন হবে এবং তখন তারা ওই বস্ত্র, অলঙ্কার, খাদ্য প্রভৃতি উপভোগ করবে। (ছান্দোগ্যের এই দেহাত্মবাদটা খুব সম্ভব প্রাচীন স্কুমেরীয়-সভ্যতা থেকে আমদানি হয়েছিলো)। কিন্তু উত্তর যুগে এই মতবাদটি এতোই পরিবর্তিত হলো যে, তর্ক করে বলা হলো, যেহেতু দেহই আত্মা এবং যেহেতু মৃত্যুর পর দেহ ভস্মীভূত হয় সেইহেতু মৃত্যুর পর আর কিছুই বাকি থাকে না এবং অতএব পরলোক বলেও কিছু নেই।
ছান্দোগ্যের ওই উপাখ্যানকে উপলক্ষ্য করে অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত লোকায়ত-দর্শনের সুমেরীয় উৎস প্রসঙ্গে যে অত্যাশ্চর্য সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন সেটিকে গ্রহণ করতে হলে অনেকগুলি কথা মেনে নেওয়া দরকার।
এক : বৈদিক সাহিত্যে অসুর বলতে প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতার মানুষদেরই উল্লেখ করা হয়েছে।
দুই; একমাত্র প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতাতেই মৃতদেহকে রতন-ভূষণ-খাদ্যের সম্ভার সহ কবর দেবার প্রথা ছিলো।
তিন : সুমেরীর সভ্যতার এই সৎকার প্রণালীর অন্তর্নিহিত দেহাত্মবাদই ক্রমশ লোকোত্তরে বিশ্বাস খুইয়ে ভারতীয় লোকায়ত দর্শনে পরিণত হয়।
দুঃখের বিষয়, এই তিনটি উক্তির একটিও ঐতিহাসিকভাবে সমর্থনযোগ্য হবে না।
প্রথমত, বৈদিক সাহিত্যে অসুর বলতে ঠিক কাদের বোঝানো হয়েছে তা আজো অনেকাংশে তর্কাধীন। এ-বিষয়ে প্রধানত দুটি মত পাই; কিন্তু সে-দুটির একটিও অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্তের সিদ্ধান্ত সমর্থন করবে না।
একটি মত(৬০২) হলো, অসুর শব্দে প্রাচীন আর্যভাষাভাষীদের ইরাণীয় শাখাটিকে বোঝানো হয়েছে। এই মতের সমর্থকদের যুক্তি হলো, বৈদিক সাহিত্যে অসুর শব্দটি বরাবরই হীনাৰ্থবাচক নয় : “পরো দেবেভিরসুরৈ যদস্তি” (ঋ. ১০.৮২.৫), “ইন্দ্রায় হি দৌরসুরো অনম্যত” (ঋ. ১.১৩১.১), “অপো নিষিঞ্চন্নসুরঃ পিতা নঃ” (ঋ, ৫.৮৩.৬), “মহস্পুত্রাসো অসুরস্য বীরা দিবো ধর্ত্তার উর্ব্বিয়া পরি খ্যন্” (ঋ. ১০.১০.২), ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই পরমাত্মা অসুরই আবেস্তায় অহুর বা অহুরমজদ রূপ ধারণ করিয়াছে।… অসুর শব্দের হীনার্থবাচিতার সহিত আবেস্তার ‘দএব’ অর্থাৎ দেব শব্দের হীনার্থবাচিতা তুলনীয়। আবেস্তায় ‘দএব’ শব্দের অর্থ দৈত্য, আমাদের অসুর। সম্ভবত ইরাণীয় ও ভারতীয় আর্যদিগের মধ্যে তীব্র ধর্মবিরোধের ফলেই সংস্কৃত ভাষায় অসুর এবং ইরাণীয় ভাষায় (আবেস্তার) ‘দএব’ (দেব) শব্দের অর্থ বিকৃতি ঘটিয়াছে(৬০৩)।
এই মতের সমর্থনে আরো বলা যায় যে, শতপথব্রাহ্মণ(৬০৪) অনুসারে অসুররাও প্রজাপতির পুত্র : দেবতাদের সঙ্গে পৃথিবীকে দখল করা নিয়ে তাদের ঘোর যুদ্ধ হয় এবং সেই যুদ্ধে তারা শেষ পর্যন্ত দেবতাদের কাছে পরাজিত হয়। ছান্দোগ্য-উপনিষদেও(৬০৫) বলা হয়েছে : দেবাসুর হ বৈ যত্র সংযেতির উভয়ে প্রাজাপত্যাঃ, ইত্যাদি। অর্থাৎ, দেব ও অসুর উভয়েই প্রজাপতির দুই সন্তান; উভয়ে পরস্পর যুদ্ধ করিয়াছিল। ইত্যাদি।
দ্বিতীয় মত হলো, আজো ছোটোনাগপুর অঞ্চলে অসুর নামের যে ট্রাইব টিকে আছে তারাই সম্ভবত বৈদিক সাহিত্যে উল্লেখিত অসুরদের বংশধর। এই মত অনুসারে, প্রাচীন যুগে ওই অসুর-ট্রাইবের মানুষের বৈদিক মানুষদের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে ছোটনাগপুর অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করে; তারপর তারা আবার কোলারিয়ান ও ড্রাভিডিয়ান ট্রাইবের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে প্রায় নিশ্চিহ্ন হবার যোগাড় হয়েছে :
Whether the Asura living in Chota-Nagpur are the offspring of these opponents of the Aryans or are connected with the Asura builders of those ancient embankments still found in the Mirzapur district, is, ofcourse, an open question; yet there seems to be nothing to exculde such suppositions(৬০৬).
বলাই বাহুল্য, এই দুটি মতবাদের কোন্টি স্বীকারযোগ্য, সে-আলোচনার এখানে প্রয়োজন নেই। আমাদের যুক্তির পক্ষে যেটুকু কথা এখানে প্রাসঙ্গিক তা হলো, অসুরদের সনাক্তিকরণ সংক্রান্ত যে-প্রকল্পের ভিত্তিতে অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত লোকায়ত-দর্শনের সুমেরীয় উৎস অনুসন্ধান করছেন তার সঙ্গে এই দুটি মতবাদের একটিরও সঙ্গতি নেই এবং তিনি এই দুটি মতবাদের একটিকেও খণ্ডন করে আত্মপক্ষ-প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেননি।
দ্বিতীয়ত, সুমেরীয় সভ্যতার সৎকার-পদ্ধতির কথা। যদি এমন হতে যে, প্রাচীন পৃথিবীতে একমাত্র সুমেরীয়াতেই ওই জাতীয় সৎকার পদ্ধতির পরিচয় পাওয়া গিয়েছে তাহলে ছান্দোগ্য-বর্ণিত সৎকার-পদ্ধতির দিক থেকে ভারতীয় সাহিত্যের ওই দেহাত্মবাদীদের সুমেরবাসী বলে সনাক্ত করবার কিছুটা অবকাশ থাকতো। কিন্তু এখানেও ঐতিহাসিক তথ্য অত্যন্ত নির্মমভাবে অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্তের বিরুদ্ধে যায়। কেননা, এমন কি প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতাতেও শুধুমাত্র এইভাবে মৃতের সৎকার হতো না—মৃতদেহকে কবর দেওয়া ছাড়াও দগ্ধ করবার প্রথা অত্যন্ত ব্যাপকভাবেই প্রচলিত ছিলো(৬০৭) তাছাড়া, বসন-ভূষণ-খাদ্য ইত্যাদির সম্ভার সহযোগে কবর দেবার প্রথাটা প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতা ছাড়া—বস্তুত সুমেরীয় সভ্যতার বাইরেই–অনেক ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিলো(৬০৮)। এ-বিষয়ে প্রাচীন মিশর প্রভৃতির সুবিখ্যাত নজির উল্লেখ না করেও ভারতবর্ষীয় তথ্যেরই উল্লেখ করা যায় : মোহেনজোদারো-হরপ্পায়(৬০৯) তার নজির পাওয়া গিয়েছে, কোনো কোনো বিদ্বান অনুমান করেছেন বৈদিক সাহিত্যের প্রাচীনতর অংশে(৬১০) এই জাতীয় সৎকার পদ্ধতিরই ইঙ্গিত পাওয়া যায় এবং আধুনিক যুগেও ভারতবর্ষের নানান ট্রাইবের(৬১১) মধ্যে এই জাতীয় সৎকার প্রণালীর দৃষ্টান্ত সত্যিই দুর্লভ নয়।। সৎকার-প্রণালী নিয়ে আলোচনা অবশ্যই স্বতন্ত্র। কিন্তু এ-বিষয়ে কোনো রকম সন্দেহেরই অবকাশ নেই যে, অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত যখন শুধুমাত্র এই সৎকার-প্রণালীর নজির দেখিয়েই লোকায়তিক ধ্যানধারণার উৎস হিসেবে প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতার উল্লেখ করতে চাইছেন তখন তাঁর মন্তব্য তুচ্ছ ও ভঙ্গুর প্রমাণাশ্রয়ী হয়েছে।
তাছাড়া, শুধুমাত্র সংকার-পদ্ধতি থেকেও দেহাত্মবাদে বিশ্বাস অনুমান করা যে সত্যিই সঙ্গত নয় তা অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত নিজেই অনুভব করেছেন। কেননা তিনি বলছেন, ছান্দোগ্য-বর্ণিত দেহাত্মবাদীদের সঙ্গে উত্তর যুগের লোকায়তিকদের মস্ত তফাত হলো, ওই দেহাত্মবাদীরা পরলোক মানতেন, কিন্তু লোকায়তিকর তা মানতেন না। অবশ্যই এই প্রভেদকে তিনি ঐতিহাসিক পরিবর্তনের পরিণাম হিসেবে ব্যাখ্যা করবার একটা চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সে-বিষয়ে কোনো রকম তথ্য দেখাবার চেষ্টা করেননি। তার কারণ কি এই যে, উক্ত পরিণামের কথাটা অধ্যাপকের কল্পনামাত্র বলেই তার মতো স্বনামধন্য বিদ্বানের পক্ষেও এ-বিষয়ে কোনো তথ্য সংগ্ৰহ করা সম্ভবপর হয়নি?
আসল কথা হলো, লোকায়তিক ধ্যানধারণার উৎস সন্ধানে ছান্দোগ্যের ওই কাহিনীটিই আমাদের কাছে একমাত্র সম্বল নয়। এ ছাড়াও আমাদের কাছে বহু তথ্য রয়েছে। তথ্যগুলি খণ্ড ও বিক্ষিপ্ত; এবং অসামান্য পাণ্ডিত্যের অধিকারী বলে অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্তই বোধহয় সবচেয়ে দক্ষভারে এগুলিকে সংকলিত করেছেন। কিন্তু এই খণ্ড ও বিক্ষিপ্ত তথ্যগুলি থেকে লোকায়তর একটা সামগ্রিক রূপ পুনর্গঠন করবার চেষ্টার বদলে তিনি প্রধানতই ছান্দোগ্য-উপনিষদের ওই উপাখ্যানটির উপর নির্ভর করে যে-সিদ্ধান্তে উপনীত হবার চেষ্টা করলেন তা স্বভাবতই কাল্পনিক হয়ে রইলো। :
আমরা একটু পরেই দেখতে পাবে, দেহতত্ত্বের ব্যাখ্যা খোঁজবার আশায় শুধুমাত্র কোনো সৎকার-পদ্ধতির বিশ্লেষণের মধ্যে আবদ্ধ থাকবার প্রয়োজন নেই। কেননা, তন্ত্র সহজিয়া প্রভৃতি সম্প্রদায়গুলির মধ্যে দেহতত্বের সুবিস্তৃত আলোচনা পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়। আমরা আরো দেখাবার চেষ্টা করবো যে, কৃষিভিত্তিক জাদু-অনুষ্ঠানের মতোই এই দেহতত্ত্বমূলক বিশ্বাসের উৎস খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু তার আগে লোকায়তর উৎস প্রসঙ্গে আর একটি প্রচলিত মতবাদের আলোচনা প্রয়োজন।
—————–
৫৯৬. S. N. Dasgupta HIP 3:533.
৫৯৭. গুণরত্ব : তর্করহস্যদীপিকা ৩০০ ।
৫৯৮. S. N. Dasgupta PA দ্রষ্টব্য।
৫৯০. শ্লোক ৮২।
৬০০. S. N. Dasgupta HIP 3:529.
৬০১. Ibid 3:528-9.
৬০২. বিশ্বকোষ (দ্বিতীয় সংস্করণ) ৩:৩১৮।
৬০৩. ঐ।
৬০৪. SBE 12:54, 59, 64, 110sq., 113sq., 125sq., 144sq., 150, 153-8, 171, 198εq., 265sq., 297, 310sq. , 26.14, 30-2, 74sq., 93, 98sq, 105sq., 115, 131, 142, 147, 175sq., 240, 249, 252, 279, 291, 301, ইত্যাদি, ইত্যাদি।
৬০৫. ছান্দোগ্য উপনিষদ ১, ২, ১ ।
৬০৬. ERE 2:157.
৬০৭. ERE 4:444.
৬০৮. ERE 4:411–510.
৬০৯. J. Marshall 1:79ff.
৬১০. ERE 4:476,
৬১১. 5RE 4:479-84.