৩৫১তম অধ্যায়
পরমপুরুষের একত্বনির্ণয়
জনমেজয় কহিলেন, তপোধন! পুরুষ এক না বহু? সৰ্ব্বশ্রেষ্ঠ কে এবং সকলের উৎপত্তিস্থানই বা কে?
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! সাঙ্খ্য ও যোগশাস্ত্র পুরুষকে বহু বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন; কিন্তু আমার মতে যেমন ঘটপটাদিগত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আকাশের একমাত্র মহাকাশই কারণ, সেইরূপ পরমাত্মাই সমস্ত পুরুষের কারণরূপে অভিহিত হয়েন। এক্ষণে আমি তপঃপরায়ণ পরমপূজনীয় মহর্ষি বেদব্যাসকে নমস্কার করিয়া, কপিলাদি মহর্ষিগণ অধ্যাত্মতত্ত্ব নিরূপণ করিতে গিয়া সামান্য ও বিশেকারে যাহা কহিয়াছে, সেই সৰ্ব্ববেদপ্রথিত এই সত্য বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।
আমার গুরু মহর্ষি বেদব্যাস সংক্ষেপে পুরুষের একত্বের বিষয় কীৰ্ত্তন করিয়া গিয়াছেন। এই স্থলে এ্যম্বক-ব্রহ্মসংবাদ নামে এক প্রাচীন ইতিহাস আছে, তুমি অবহিতমনে উহা শ্রবণ করিলে এই বিষয় সুস্পষ্ট হৃদয়ঙ্গম করিতে সমর্থ হইবে।
ক্ষীরোদসমুদ্রের মধ্যে সুবর্ণসপ্রভ [সোনার মত বর্ণবিশিষ্ট] বৈজয়ন্তনামে এক পৰ্ব্বত আছে। প্রজাপতি ব্রহ্মা প্রতিদিন ঐ পৰ্ব্বতে গমন করিয়া একাকী অধ্যাত্মতত্ত্ব চিন্তা করিতেন। তিনি একদা তথায় উপবেশন করিয়া আছেন, এই অবসরে তাঁহার ললাটদেশসমুৎপন্ন ভগবান্ মহেশ্বর যদৃচ্ছাক্রমে আকাশপথ দিয়া ঐ স্থানে আগমন করিলেন এবং অচিরাৎ কমলযোনির সর্ম্মুখবর্ত্তী হইয়া প্রীতমনে তাঁহার চরণে নিপতিত হইলেন। তখন প্রজাপতি ব্রহ্মা ত্রিলোচনকে চরণতলে নিপতিত দেখিয়া বামহস্তে তাঁহাকে গ্রহণপূৰ্ব্বক অবিলম্বে ভূতল হইতে উত্থাপিত করিলেন এবং তাঁহাকে বহুকাল বিলম্বে আগমন করিতে দেখিয়া প্রীতিপ্রফুল্লচিত্তে কহিলেন, “মহাবাহো! কেমন, তুমি নিৰ্ব্বিঘ্নে আগমন করিয়াছ ত’? এক্ষণে তপ ও বেদাধ্যয়নের কুশল ত’?”
রুদ্র কহিলেন, “ভগবন্! আপনার অনুগ্রহে আমার তপ ও বেদাধ্যয়নের কুশল, সমস্ত জগৎও নির্ব্বিঘ্নে আছে। আমি ব্রহ্মলোকে আপনার বিস্তর অনুসন্ধান করিয়াছি, কিন্তু তথায় আপনার সাক্ষাৎকার না পাইয়া এই পর্ব্বতে সমুপস্থিত হইলাম। আপনাকে এই নির্জ্জনস্থানে অবস্থান করিতে দর্শন করিয়া আমার মনে যারপরনাই কৌতূহল উপস্থিত হইয়াছে। বোধ হইতেছে, আপনি সামান্য কারণে এই পৰ্ব্বতবাস আশ্রয় করেন নাই। এক্ষণে আপনি কি নিমিত্ত সেই সুরাসুরসেবিত, ঋষি, গন্ধৰ্ব্ব ও অপ্সরাগণে পরিপূর্ণ, ক্ষুৎপিপাসাশূন্য, উৎকৃষ্ট ব্ৰহ্মলোক পরিত্যাগ করিয়া একাকী এই পৰ্ব্বতে বাস করিতেছেন, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”
ব্রহ্মা কহিলেন, “রুদ্র! আমি এই বৈজয়ন্তনামক পৰ্ব্বতে বাস করিয়া একাগ্রমনে বিরাট পুরুষকে চিন্তা করিতেছি।”
তখন রুদ্র কহিলেন, “ভগবন! আপনি বহুসংখ্যক পুরুষকে সৃষ্টি করিয়াছেন ও করিতেছেন; কিন্তু আপনি যাঁহাকে চিন্তা করেন, সেই বিরাট পুরুষ কে? আমার এ বিষয়ে অতিশয় সংশয় উপস্থিত হইয়াছে, আপনি. তাহা নিবারণ করুন।
ব্রহ্মা কহিলেন, “হে রুদ্র! আমি বহু পুরষের সৃষ্টি করিয়াছি, ইহা যথার্থ বটে এবং বেদমধ্যেও ইহার প্রমাণ সংস্থাপিত হইয়াছে; কিন্তু এক্ষণে যে একমাত্র বিরাট পুরুষের চিন্তা করিতেছি, তিনি ঐ সমস্ত পুরুষের কারণ। ঐ সমস্ত পুরুষেরা ঐ বিরাট হইতে উদ্ভূত হইয়া সাধনবলে নির্গুণ হইতে পারিলে সেই নির্গুণ বিশ্বব্যাপী পুরুষে প্রবেশ করিতে সমর্থ হয়েন।”