৩৪তম অধ্যায়
শল্যসন্তোষাৰ্থ ত্রিপুরাসুরপ্রসঙ্গে ত্রিপুর-উৎপত্তি
সঞ্জয় কহিলেন, “অনন্তর দুৰ্য্যোধন শল্যকে পুনরায় কহিলেন, ‘হে মদ্ররাজ! পূর্ব্বকালে দেবাসুরযুদ্ধে যেরূপ ঘটনা হইয়াছিল, মহর্ষি মার্কণ্ডেয় আমার পিতার নিকট তাহা কীৰ্ত্তন করেন। এক্ষণে আমি আপনাকে সেই বৃত্তান্ত কহিতেছি, অবিচারিত চিত্তে উহা শ্রবণ করুন। পূর্ব্বে দেবদানবগণ পরস্পর জিগীষাপরবশ হইয়া। ঘোরতর সংগ্রাম সমুপস্থিত করেন তৎকালে দৈত্যগণ তারকাসুরের অধীন ছিল। ঐ যুদ্ধে দেবগণ দৈত্যগণকে পরাজিত করিলে তারকাক্ষ, কমলাক্ষ ও বিদ্যুন্মালী—তারকাসুরের তিনপুত্র কঠোর তপানুষ্ঠান করিয়া অতি সুকঠিন নিয়ম অবলম্বনপূর্ব্বক স্ব স্ব দেহ পরিশুষ্ক করিতে লাগিল। কিয়ৎকাল পরে বরদাতা সর্ব্বলোকপিতামহ ব্রহ্মা তাহাদিগের দম, তপ, নিয়ম ও সমাধিদর্শনে পরমপ্রীত হইয়া তাহাদিগকে বরদান করিতে আগমন করিলেন। তখন তারকাপুত্রেরা সকলে সমাগত হইয়া তাঁহার নিকট প্রার্থনা করিল,-হে ভগবন্! যদি প্রসন্ন হইয়া থাকেন, তবে আমাদিগকে এই বর প্রদান করুন যে, আমরা যেন সর্ব্বদা সর্ব্বভূতের অবধ্য হই। পিতামহ তাহাদের বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন,—হে অসুরগণ! কেহই সর্ব্বভূতের অবধ্য নহে, অতএব তোমরা উহা ভিন্ন অন্য যাহা অভিরুচি হয়, তাহা প্রার্থনা কর। তখন সেই অসুরত্রয় একতা অবলম্বনপূর্ব্বক স্থিরনিশ্চয় করিয়া প্রণতিপুরঃসর পিতামহকে কহিল–হে দেব! আমরা এই বর প্রার্থনা করি যে, তিনজনে পুরত্রয়ে অবস্থানপূর্ব্বক জনসমাজে পূজিত হইয়া এই ভূমণ্ডলে বিচরণ করিব এবং সহস্র বৎসর অতীত হইলে পূনরায় পরস্পর মিলিত হইব। তখন সেই পুরত্ৰয়ও একাকার হইবে। তৎকালে যে ব্যক্তি একবাণে সেই একত্র সমবেত পুরত্রয় সংহার করিতে পারিবেন, আমরা তাঁহার হস্তেই নিহত হইব। লোকপিতামহ ব্রহ্মা অসুরগণের বাক্যশ্রবণে তাহাদিগকে ‘তথাস্তু’ বলিয়া স্বর্গারোহণ করিলেন।
‘তারকাসুরের পুত্রেরা এইরূপে বরলাভ করিয়া প্রীতিপ্রফুল্লচিত্তে পুরত্রয়নিৰ্মাণের নিমিত্ত দৈত্যদানবপূজিত, রোগবিহীন, স্থপতি ময়দানবকে নিযুক্ত করিল। ধীমান্ ময়দানব স্বীয় তপঃপ্রভাবে স্বর্গে কাঞ্চনময়, অন্তরীক্ষে রজতময় ও মর্ত্যে লৌহময় পুর নির্ম্মাণ করিয়া দিল। ঐ পুরত্রয়ের এক একটি শতযোজন বিস্তীর্ণ ও শতযোজন আয়ত এবং বহুতর গৃহ, অট্টালিকা, প্রাকার, তোরণ, জনতাযুক্ত, রাজপথ ও বিবিধ দ্বারে পরিশোভিত। তারকাসুরের তিনপুত্র ঐ পুরত্রয়ের অধীশ্বর হইল। তারকাক্ষের সুবর্ণময়, কমলাক্ষের রজতময় ও বিদ্যুন্মালীর লৌহময় পুরী নির্দ্দিষ্ট হইল। অনন্তর সেই অসুরত্রয় অস্ত্রবলে ত্রিলোক আক্রমণ করিয়া অবস্থান করিতে লাগিল। তখন তাহারা আর প্রজাপতিকেও তৃণতুল্য বোধ করিল না। পূর্ব্বে যেসকল মাংসাশী সুদৃপ্ত দানবগণ সুরগণকর্ত্তৃক নিরাকৃত হইয়াছিল, এক্ষণে তাহারা বিপুল ঐশ্বৰ্য্যপ্রার্থনায় ক্রমে ক্রমে প্রযুত প্ৰযুত, অর্ব্বুদ অর্ব্বুদ, কোটি কোটি জন একত্র সমবেত হইয়া সেই অসুরত্রয়ের সমীপে আগমনপূর্ব্বক ত্রিপুরদুর্গে আশ্ৰয় করিল এবং পুনরায় সকলে সম্মিলিত হইয়া অকুতোভয়ে অবস্থান করিতে লাগিল। ঐ সমুদয় ত্রিপুরনিবাসী দানব যে যাহাতে অভিলাষী হইল, ময়দানব মায়াবলে তাহাকে তাহাই প্রদান করিতে আরম্ভ করিল।
‘ঐ সময় তারকাক্ষের হরিনামে মহাবলপরাক্রান্ত পুত্র কঠোর তপোনুষ্ঠানপূর্ব্বক লোকপিতামহ প্রজাপতিকে পরম পরিতুষ্ট করিলে তিনি তাহাকে বর প্রার্থনা করিতে কহিলেন। তখন তারকাক্ষপুত্র কৃতাঞ্জলিপুটে কহিল, ‘হে দেব! আমি আমাদিগের পুরমধ্যে একটি বাপী [জলাশয়-দীঘি] প্রস্তুত করিব। ঐ বাপীজলে যে সমস্ত অস্ত্রনিহত বীরগণকে নিক্ষেপ করা হইবে, তাহারা যেন আপনার প্রসাদে পুনর্জীবিত ও সমধিক বলশালী হয়। পিতামহ দানবনন্দনের বাক্যশ্রবণে ‘তথাস্তু’ বলিয়া তাহাকে অভিলষিত বর প্রদান করিলেন। তখন তারকাক্ষের পুত্র সেই বিধাতৃদত্ত বরলাভে পরম পরিতুষ্ট হইয়া আপনাদের পুরমধ্যে এক মৃতসঞ্জীবনী বাপী প্রস্তুত করিল। দৈত্যগণ যে বেশে নিহত হইত, ঐ বাপীতে নিক্ষেপ করিবামাত্র তাহারা সেই বেশে জীবিত হইয়া উঠিত। এইরূপে দৈত্যগণ সেই বাপীপ্রভাবে নিহত দানবগণকে পুনঃপ্রাপ্ত হইয়া ত্রিলোকের ক্লেশোৎপাদন করিতে লাগিল। দুষ্কর তপঃপ্রভাবে তাহারা সংগ্রামে অক্ষয় হইয়া উঠিল। তখন দেবগণও তাহাদের নিকট ভীত হইতে লাগিলেন।
ত্রিপুরনাশে ইন্দ্রের অসামর্থ্য-বজ্রের ব্যর্থতা
‘হে মদ্ররাজ! নির্ল্লজ্জ দানবগণ এইরূপে ব্রহ্মার বরপ্রভাবে দর্পিত ও লোভ-মোহে একান্ত অভিভূত হইয়া দেবগণকে বিদ্রাবণপূর্ব্বক স্বেচ্ছাক্রমে রমণীয় দেবারণ্য, তপস্বিগণের পবিত্র আশ্রম ও সুরম্য জনপদসমুদয়ে বিচরণ করিয়া সকলের মৰ্য্যাদা নষ্ট করিতে লাগিল। দেবরাজ ইন্দ্র দানবগণকর্ত্তৃক ত্রিভুবন নিপীড়িত দেখিয়া দেবগণে পরিবেষ্টিত হইয়া দানবগণের পুরত্রয়ের প্রতি বস্ত্র নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন; কিন্তু বিধাতার বরপ্রভাবে সেই অভেদ্য পুরসকল ভেদ করিতে পারিলেন না। তখন তিনি তৎসমুদয় পরিত্যাগপূর্ব্বক দৈত্যগণের দৌরাত্ম্যজ্ঞাপনার্থ দেবগণের সহিত ব্রহ্মার নিকট সমুপস্থিত হইলেন। সুরগণ নতশিরাঃ হইয়া ভগবান্ পিতামহকে প্রণতিপূর্ব্বক সমুদয় বৃত্তান্ত নিবেদন করিয়া দানবগণের বধোপায় জিজ্ঞাসা করিলে কমলযোনি কহিলেন, -হে দেবগণ! যে তোমাদের অনিষ্টাচরণ করে, সে আমার নিকট অপরাধী হয়; অতএব দুরাত্মা অসুরগণ তোমাদিগকে নিপীড়িত করিয়া আমার নিকট অপরাধী হইয়াছে। আমি সকল প্রাণীকে সমান জ্ঞান করি; কিন্তু অধার্ম্মিকগণের প্রাণসংহার করা আমার অবশ্যকর্ত্তব্য কর্ম্ম। হে দেবগণ! অসুরগণের পুরত্রয় এক বাণেই ভেদ করিতে হইবে, সুতরাং ঐ কাৰ্য্য মহাদেব ভিন্ন আর কাহারও সাধ্যায়ত্ত নহে। অতএব তোমরা সেই অক্লিষ্টকর্ম্মা জয়শীল যোদ্ধা মহেশ্বরকে যুদ্ধার্থে বরণ কর। তিনিই তাহাদিগকে নিপাতিত করিবেন।
ব্রহ্মার বাক্যে দেবগণের মহাদেব-স্তুতি
“হে মদ্ররাজ! ধর্ম্মপরায়ণ ইন্দ্রাদি দেবগণ ব্রহ্মার এই বাক্য শ্রবণমাত্র তাঁহাকে অগ্রসর করিয়া ঋষিগণের সহিত মহাদেবের শরণাপন্ন হইলেন এবং তপোনিয়ম অবলম্বনপূর্ব্বক ব্রহ্মনাম উচ্চারণ করিয়া রক্ষোঘ্ন [রাক্ষস-নাশক-পূর্ব্বকালে কোথাও তপস্যা আরব্ধ হইলেই রাক্ষসেরা আসিয়া তাহা নষ্ট করিয়া দিত] বাক্যে তাঁহার স্তব করিতে লাগিলেন। তখন যিনি সর্ব্বত্র আত্মা ও পরমাত্মারূপে ব্যাপ্ত রহিয়াছেন, যিনি বিবিধ তপোবলে আত্মতত্ত্ব ও সাংখ্যযোগ অবগত হইয়াছেন এবং আত্মা সতত যাঁহার বশীভূত রহিয়াছে, সেই তেজোরাশি, ভগবান ঊমাপতি সুরগণের নয়নগোচর হইলেন। তাঁহারা সেই অনন্যসদৃশ অকল্মষ [নিষ্কল-নির্ম্মল] ভগবান্ দেবদেবকে নানারূপে কল্পিত করিয়াছিলেন, এক্ষণে বিস্ময়াপন্ন হইয়া সকলে সেই মহাত্মাকে স্ব স্ব কল্পনানুরূপ অবলোকন করিতে লাগিলেন। অনন্তর সমুদয় ব্রহ্মর্ষি ও দেবগণ দণ্ডবৎ হইয়া তাঁহার চরণবন্দনা করিলেন। তখন ভগবান শঙ্কর তাঁহাদিগকে উত্থাপিত করিয়া মঙ্গলসূচক বাক্যে সৎকার করিয়া হাস্যমুখে কহিলেন, হে সুরগণ! তোমরা কি কারণে আগমন করিয়াছ, তাহা আমার নিকট কীৰ্ত্তন কর। দেবগণ মহাদেব কর্ত্তৃক এইরূপ অনুজ্ঞাত হইয়া তাঁহাকে নমস্কারপূর্ব্বক কহিলেন, -হে ভগবান্! আপনি দেবাদিদেব, পিনাকধারী [বজ্র], বনমালাবিভূষিত দক্ষযজ্ঞবিনাশন, প্রজাপতিদিগের পূজ্য, সকলের স্তুত্য [স্তবযোগ্য, স্তুত হইতেছেন ও স্তুত হইয়া থাকেন] স্তূয়মান ও স্তুত। আপনি শম্ভু, বিলোহিত, রুদ্র, নীলগ্রীব, শূলধারী, অমোঘ, মৃগাক্ষ, প্রবরায়ুধ, যোধী, অর্থ, শুদ্ধ, ক্ষয়, ক্ৰথন, দুর্ব্বারণ, ক্ৰাথ, বিপ্র, ব্রহ্মচারী, ঈশান, প্রমেয়, নিয়ন্তা, ব্যাঘ্রচর্ম্মবাসা, তোনিরত, পিঙ্গ, ব্ৰতাবলম্বী, গজচর্ম্মবাসা, কার্ত্তিকেয়পিতা, ত্রিনেত্র, শরণাপন্নের ক্লেশসংহৰ্ত্তা, অসুরঘাতন, বৃক্ষপতি, নারীপতি, গোপতি, যজ্ঞপতি, সসৈন্য ও অমিতৌজা; আপনাকে নমস্কার। হে দেব! আমরা কায়মনোবাক্যে আপনার শরণাপন্ন হইলাম; আপনি অনুগ্রহ করিয়া আমাদের অভিলাষ পূর্ণ করুন।’ তখন ভগবান্ দেবাদিদেব দেবগণের বাক্যে প্রসন্ন হইয়া তাঁহাদিগকে স্বাগতপ্রশ্নে পরিতুষ্ট করিয়া কহিলেন, -হে দেবগণ! তোমাদের ভয় দূর হউক; এক্ষণে বল, আমাকে তোমাদের নিমিত্ত কি করিতে হইবে?