৩৪তম অধ্যায় – ভীম–দুর্য্যোধনের গদাযুদ্ধোদযোগ
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! রাজা দুর্য্যোধন এইরূপে বারংবার তর্জ্জন-গর্জ্জন করিলে মহামতি বাসুদেব ক্রোধাবিষ্ট হইয়া যুধিষ্ঠিরকে কহিলেন, “মহারাজ! আপনি কোন সাহসে দুর্য্যোধনকে কহিলেন যে, তুমি আমাদিগের মধ্যে একজনকে বিনাশ করিয়া রাজ্যপদ লাভ কর?” ঐ দুরাত্মা যদি আপনাকে অথবা অৰ্জ্জুন, নকুল বা সহদেবকে যুদ্ধার্থ বরণ করে, তাহা হইলে আপনার কি দুর্দশা হইবে? বোধ হয়, আপনারা কেহই উহার সহিত গদাযুদ্ধে সমর্থ নহেন। দুর্য্যোধন ভীমসেনের নিধনবাসনায় ত্রয়োদশ বর্ষ পর্যন্ত লৌহময় পুরুষের সহিত ব্যায়াম করিয়াছে। অতএব এক্ষণে কিরূপে আমাদিগের কাৰ্য্য সম্পন্ন হইবে? আপনি কৃপাপরবশ হইয়া নিতান্ত সাহসের কাৰ্য্য করিয়াছেন। আমাদের মধ্যে ভীমসেন ব্যতীত দুৰ্য্যোধনের সমকক্ষ আর কেহই নহে। তিনিও দুর্য্যোধনের ন্যায় গদাযুদ্ধ অধিক অভ্যাস করেন নাই। অতএব বোধ হয়, পূৰ্ব্বে শকুনির সহিত আপনার যেরূপ দ্যূতক্রীড়া হইয়াছিল, এক্ষণে পুনরায় তদ্রূপ দ্যূতক্রীড়া আরম্ভ হইল। ভীমসেন বলবান ও পরাক্রমশালী, কিন্তু দুর্য্যোধন গদাযুদ্ধে কৃতী। বলবান ও কৃতী ব্যক্তিই সমধিক ক্ষমতাপন্ন। আপনি সেই ক্ষমতাপন্ন শত্রুকে আমাদিগের মঙ্গলপথে নিবেশিত করিয়া স্বয়ং বিষম সঙ্কটে নিপতিত হইলেন এবং আমাদিগকেও বিপদসাগরে নিপাতিত করিলেন। কোন ব্যক্তি সমস্ত শত্রু বিনাশ করিয়া একমাত্র অরাতিকে বহুকষ্টে আক্রমণপূর্ব্বক তাঁহার হস্তে প্রাপ্ত রাজ্য সমর্পণ করিয়া থাকে? দুর্য্যোধন গদাযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলে অমরগণের মধ্যেও কেহ্ উহাকে পরাজয় করিতে সমর্থ নহেন। ঐ বীর গদাযুদ্ধে অতিশয় দক্ষ; অতএব ন্যায়ানুসারে যুদ্ধ করিলে কি আপনি কি ভীমসেম, কি নকুল, কি সহদেব, কি অর্জ্জুন কেহই উহাকে পরাজিত করিতে পারিবেন না। যখন মহাবলপরাক্রান্ত বৃকোদর দুর্য্যোধনের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলেও আমাদের জয়লাভে সংশয় উপস্থিত হয়, তখন আপনি কিরূপে উহাকে যে কোন পাণ্ডবের সহিত গদাযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া তাঁহাকে বিনাশসাধনপূর্ব্বক রাজ্য গ্রহণ করিতে অনুমতি করিলেন? এক্ষণে নিশ্চয় বোধ হইতেছে, পাণ্ডুতনয়গণের কখনই রাজ্যভোগ হইবে না। বিধাতা উহাদিগকে চিরকাল বনে বাস বা ভিক্ষাব্রত অবলম্বন করিবার নিমিত্ত নিৰ্মাণ করিয়াছেন।’
“হে মহারাজ! তখন মহাবল-পরাক্রান্ত ভীমসেন মধুসূদনের সেই বাক্য শ্রবণপূর্ব্বক তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে যদুনন্দন! আর বিষাদ করিও না, আজ আমি নিশ্চয়ই দুর্য্যোধনকে বিনাশ করিয়া বৈরানল নিৰ্ব্বাণ করিব। ধৰ্ম্মরাজের জয়লাভ স্পষ্টই প্রতীয়মান হইতেছে, দুৰ্য্যোধনের গদা অপেক্ষা আমার গদা সার্ধৈক [দেড়গুণে] গুণে গুরুতর, আমি সেই গদা অবলম্বন করিয়া অবিলম্বেই উহার সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইতেছি, তোমরা দর্শকভাবে অবস্থান কর। ক্ষুদ্র শত্রু দুৰ্য্যোধনের কথা দূরে থাকুক, অমর প্রভৃতি তিন লোক নানাবিধ অস্ত্রশস্ত্র ধারণপূর্ব্বক সমরে প্রবৃত্ত হইলে আমি অনায়াসে তাঁহাদিগকেও বিনাশ করিতে পারি।’
ভীম কর্ত্তৃক গদাযুদ্ধে দুৰ্য্যোধনের আহ্বান
“হে মহারাজ! তখন মহাত্মা বাসুদেব ভীমের বাক্য শ্রবণে পুলকিত হইয়া তাঁহাকে প্রশংসা করিয়া কহিলেন, ‘হে বীর! ধর্মরাজ তোমার বাহুবলেই অরাতিবিহীন হইয়া স্বীয় রাজলক্ষী লাভ করিবেন, সন্দেহ নাই। তুমি ধৃতরাষ্ট্রের সমুদয় পুত্র এবং কৌরবপক্ষীয় অসংখ্য রাজা, রাজকুমার ও নাগগণকে নিপাতিত করিয়াছ; তোমার প্রভাবেই কলিঙ্গ, মাগধ, প্রাচ্য, গান্ধার ও কৌরবগণ সংগ্রামে নিহত হইয়াছে; এক্ষণে তুমি দুর্য্যোধনকেও নিপাতিত করিয়া, বিষ্ণু যেমন দেবরাজকে স্বর্গরাজ্য প্রদান করিয়াছিলেন, তদ্রূপ ধৰ্ম্মরাজকে সসাগরা পৃথিবী প্রদান কর। পাপ-পরায়ণ দুর্য্যোধন তোমার হস্তেই বিনষ্ট হইবে, তুমি অচিরাৎ তাঁহার উরুদ্বয় ভগ্ন করিয়া আপ্রতিজ্ঞা প্রতিপালন করিবে; কিন্তু ঐ দুরাত্মা অতিশয় বলবান্ ও যুদ্ধবিশারদ। সৰ্ব্বদা যত্নসহকারে উহার সহিত যুদ্ধ করিও।’
মহাত্মা বাসুদেব এই কথা কহিলে মহাবীর সাত্যকি এবং ধৰ্ম্মরাজ-প্রমুখ পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণ ভীমসেনকে বারংবার প্রশংসা করিতে লাগিলেন। তখন ভীমপরাক্রম ভীমসেন সূৰ্য্যের ন্যায় প্রতাপশালী সৃঞ্জয়গণ-পরিবেষ্টিত রাজা যুধিষ্ঠিরকে কহিলেন, “মহারাজ! আমি দুৰ্য্যোধনের সহিত সমরে প্রবৃত্ত হই। ঐ পুরুষাধম কখনই আমাকে পরাজিত করিতে পারিবে না। অর্জ্জুন যেমন খাণ্ডবারণ্যে অগ্নি প্ৰদান করিয়াছিলেন, তদ্রূপ আমি আজ দুৰ্য্যোধনের প্রতি হৃদয় নিহিত ক্রোধানল নিক্ষেপ করিব। আজ গদার আঘাতে ঐ পাপাত্মার প্রাণ সংহারপূর্ব্বক আপনার হৃদয়স্থিত শল্য উদ্ধার করিয়া ফেলিব। আজ আপনি সুস্থশরীর হইবেন। আজ আমি আপনার শত্রুহৃত কীর্তিময়ী মালা প্রত্যাহরণ করিব। আজ দুর্য্যোধন প্রাণ, শ্ৰী ও রাজ্য পরিত্যাগ করিবে এবং রাজা ধৃতরাষ্ট্র দুর্য্যোধনকে আমার হস্তে বিনষ্ট শ্রবণ করিয়া শকুনির দুস্ক্রিয়া-জনিত কুকৰ্ম্ম-সমুদয় স্মরণ করিবেন।
“মহাবল-পরাক্রান্ত বৃকোদর এই বলিয়া, বাসব যেমন বৃত্রাসুরকে আহ্বান করিয়াছিলেন, তদ্রূপ দুর্য্যোধনকে যুদ্ধার্থ আহ্বান করিয়া গদা উত্তোলনপূর্ব্বক দণ্ডায়মান হইলেন। তখন আপনার পুত্র মহাবল-পরাক্রান্ত দুর্য্যোধন ভীমসেনের আহ্বান সহ্য করিতে না পারিয়া মত্তমাতঙ্গ যেমন মত্তমাতঙ্গের প্রতি ধাবমান হয়; তদ্রূপ ভীমসেনের প্রতি গমন করিতে লাগিলেন। পাণ্ডবগণ শিখর পরিশোভিত কৈলাস-পৰ্ব্বত-সদৃশ মহাবীর দুর্য্যোধনকে যুখবিহীন মাতঙ্গের ন্যায় সমরে সমুপস্থিত দেখিয়া যার পর নাই আহ্লাদিত হইলেন; মহাবাহু দুর্য্যোধনও সিংহের ন্যায় নির্ভয়শরীরে ও অসঙ্কুচিতচিত্তে সমরক্ষেত্রে অবস্থান করিতে লাগিলেন। তখন ভীমপরাক্রম ভীমসেন দুর্য্যোধনকে গদা উদ্যত করিতে দেখিয়া কহিলেন, “হে দুর্য্যোধন! রাজা ধৃতরাষ্ট্র ও তুমি, তোমরা হস্তিনায় আমাদিগের প্রতি যে সমস্ত অসদ্ব্যবহার করিয়াছিলে, এক্ষণে তাহা স্মরণ কর। তুমি শকুনির বুদ্ধিপ্রভাবে দ্যূতক্রীড়ায় যুধিষ্ঠিরকে পরাজিত করিয়া সভামধ্যে রজঃস্বলা দ্রৌপদীকে অপমান এবং নিরপরাধ পাণ্ডবগণকে কষ্ট প্রদান করিয়া যে পাপানুষ্ঠান করিয়াছ, এক্ষণে নিশ্চয়ই তাহার ফল প্রাপ্ত হইবে। হে কুলনাশক নরাধম তোমার নিমিত্তই আমাদিগের পিতামহ মহাযশাঃ ভীষ্মদেব নিহত হইয়া শরশয্যায় শয়ন করিয়াছেন। তোমার নিমিত্তই মহাবীর দ্রোণ, কর্ণ ও শল্য নিহত হইয়াছেন। তোমার পাপেই তোমার সহোদরগণ, পুত্রগণ ও সমরনিপুণ বহুসংখ্যক ভূপতি, অসংখ্য সৈন্য এবং আমাদের এই বিবাদের মূলীভূত কারণ দুরাত্মা শকুনি ও দ্রৌপদীর ক্লেশদাতা পাপাত্মা প্রান্তিকামী [দূত–দুৰ্য্যোধনের দূত] শমনসদনে গমন করিয়াছে। এক্ষণে কেবল তুমি একাকী অবশিষ্ট রহিযাছ। আজ গদাপ্রহারে নিশ্চয়ই তোমাকে নিপাতিত করিব। আজ পাণ্ডবগণের ক্লেশ এবং তোমার দর্প ও বিপুল রাজ্যলালসা দূরীভূত হইবে।
“কুরুরাজ ভীমসেনের বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “হে বৃকোদর! অধিক বাগাড়ম্বর করিবার প্রয়োজন নাই। অবিলম্বে আমার সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হও। আজই তোমার যুদ্ধপ্রবৃত্তি উচ্ছিন্ন করিব। আমি হিমালয়-শিথরের ন্যায় গদাধারণ করিয়া সংগ্রামে সমুদ্যত হইয়াছি। ন্যায়ানুসারে গদাযুদ্ধে সুররাজ পুরন্দরও আমাকে পরাজিত করিতে সমর্থ নহেন। তুমি সলিলবিহীন শরৎকালীন মেঘের ন্যায় আর বৃথা গর্জ্জন করিও না। যত দূর পরাক্রম থাকে, সংগ্রাম করিয়া প্রকাশ কর।’ হে মহারাজ! কুরুরাজ এই কথা কহিলে পাণ্ডব ও সৃঞ্জয়গণ তলশব্দ দ্বারা উন্মত্ত মাতঙ্গকে যেমন আমোদিত করে, তদ্রূপ তাঁহার বাক্যের ভূয়সী প্রশংসা করিয়া তাঁহাকে আমোদিত করিতে লাগিলেন। ঐ সময় পাণ্ডবপক্ষীয় কুঞ্জরগণ অনবরত বৃংহিতধ্বনি ও অশ্বগণ বারংবার হ্রেষারব করিতে আরম্ভ করিল এবং বিজয়াকাঙ্ক্ষী পাণ্ডবগণের অস্ত্র সমুদয় প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল।”