৩৪৮তম অধ্যায়
হয়গ্রীবমূৰ্ত্তির আবির্ভাবপ্রশ্নে সৃষ্টিপ্রসঙ্গ
শৌনক কহিলেন, হে সৌতে! আমি তোমার মুখে সেই পরমাত্মার মাহাত্ম, ধৰ্ম্মের আলয়ে নরনারায়ণরূপে তাঁহার আবির্ভাব, মহাবরাহকৃত পূর্ব্বতন পিণ্ডোৎপত্তি এবং প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তিধৰ্ম্মের বিষয় শ্রবণ করিয়াছি। তুমি যে মহাসাগরের সন্নিধানে ঈশানকোণে হব্যকব্যভোজী ভগবান্ বিষ্ণুর মূৰ্ত্তিবিশেষ হয়গ্রীবের বৃত্তান্ত কীৰ্ত্তন করিয়াছ, ব্রহ্মা সেই হয়গ্রীবকে প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন। এক্ষণে জিজ্ঞাসা করি, সেই লোকপালক হয়গ্রীবের রূপ কিরূপ ও প্রভাবই বা কি প্রকার? আর সর্ব্বলোকপিতামহ ব্রহ্মা সেই অদ্ভূত পবিত্রমূর্ত্তি নিরীক্ষণ করিয়াই কিরূপ অনুষ্ঠান করিলেন? হে ব্ৰহ্মন্! আমাদিগের এই বিষয়ে অতিশয় সংশয় উপস্থিত হইয়াছে; অতএব এক্ষণে তুমি ঐ বিষয় কীৰ্ত্তন কর। তুমি পরমপবিত্র পুরাণ কীৰ্ত্তন করিয়া আমাদিগকে পবিত্র করিয়াছ।
তখন সৌতি কহিলেন, মহাত্মন্! ভগবান্ বৈশম্পায়ন রাজা জনমেজয়ের নিকট যাহা কীৰ্ত্তন করিয়াছিলেন, আমি সেই বেদমূলক পুরাণ কহিতেছি, শ্রবণ করুন। রাজা জনমেজয় দেবাদিদেব বিষ্ণুর হয়গ্রীবমূৰ্ত্তির বিষয় শ্রবণপূৰ্ব্বক অতিশয় সংশয়াপন্ন হইয়া বৈশম্পায়নকে জিজ্ঞাসা করিলেন, মহর্ষে! প্রজাপতি ব্রহ্মা যে হয়গ্রীবমূর্ত্তি নিরীক্ষণ করিয়াছিলেন, কি কারণে সেই মূৰ্ত্তির আবির্ভাব হয়, আপনি আমার নিকট তাহা কীৰ্ত্তন করুন।
তখন বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! এই লোকে যে সমস্ত দেহাদি দৃশ্যপদার্থ বিদ্যমান রহিয়াছে, তৎসমুদয়ই ঈশ্বরের সঙ্কল্প হইতে সমুৎপন্ন পঞ্চভূতের সমষ্টি। সৰ্ব্বভূতের অন্তরাত্মা ঈশ্বর এই বিশ্বসংসার সৃষ্টি করেন এবং তাহা হইতেই ইহার প্রলয় হইয়া থাকে। এক্ষণে যেরূপে প্রলয় হয়, তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। সৰ্ব্বাগ্রে পৃথিবী সলিলে লীন হয়, তৎপরে সলিল জ্যোতিতে, জ্যোতি বায়ুতে, বায়ু আকাশে, আকাশ মনোমধ্যে, মন মহত্তত্ত্বে, মহত্তত্ত্ব প্রকৃতিতে, প্রকৃতি জীবাত্মায়, জীবাত্মা পরমাত্মায় লীন হয়। তখন সমুদয়ই ঘোরতর অন্ধকারে আচ্ছন্ন হইয়া যায়। তৎকালে আর কিছুই অনুভূত হয় না।
সৃষ্টিপ্রলয়প্রসঙ্গে মধুকৈটভের উৎপত্তিকথা
এক্ষণে যেরূপে উৎপত্তি হয়, তাহাও শ্রবণ কর। তমোরূপ প্রকৃতি হইতে জগৎকারণ ব্রহ্মের প্রকাশ হয়। ঐ ব্রহ্মই প্রকৃতির মূল ও অমৃতস্বরূপ। তিনি বিশ্বভাব প্রাপ্ত হইয়া পৌরুষদেহ আশ্রয় করিয়া থাকেন। তিনিই অনিরুদ্ধ, প্রধান, অব্যক্ত ও ত্রিগুণাত্মক। সেই অনিরুদ্ধনামক হরি বিদ্যাসহায়সম্পন্ন হইয়া যোগনিদ্ৰা অধিকারপূৰ্ব্বক সলিলোপরি শয়ন করিয়া জগৎসৃষ্টিবিষয় চিন্তা করিয়াছিলেন। সৃষ্টির বিষয় চিন্তা করিতে করিতে তাঁহার নাভিপদ্ম হইতে অহঙ্কারস্বরূপ সৰ্ব্বলোকপিতামহ চতুর্ম্মুখ ব্রহ্মা প্রাদুর্ভূত হইলেন। পদ্মলোচন ভগবান্ হিরণ্যগর্ভ উৎপন্ন হইয়া পদ্মে উপবেশনপূৰ্ব্বক সমুদয় জলময় নিরীক্ষণ করিয়া সত্ত্বগুণ অবলম্বনপূৰ্ব্বক ভূতসমুদয়ের সৃষ্টি করিতে মানস করিলেন। কমলযোনি ব্রহ্মা তৎকালে যে পদ্মে উপবেশন করিয়াছিলেন, সেই সূর্য্যসঙ্কাশ পদ্মের পত্রে নারায়ণনিক্ষিপ্ত দুই বিন্দু জল নিপতিত ছিল। ঐ বিন্দুদ্বয়ের মধ্যে এক বিন্দু মধুর ন্যায় প্রভাসম্পন্ন। তদ্দর্শনে অনাদিনিধান নারায়ণ কহিলেন, “এই জলবিন্দু হইতে তমোগুণাবলম্বী মধুদৈত্য উৎপন্ন হউক।” তিনি আজ্ঞা করিবামাত্র সেই জলবিন্দু হইতে মধুদৈত্য প্রাদুর্ভূত হইল। অন্য জলবিন্দু অতিশয় কঠিন ছিল। ঐ জলবিন্দু হইতে নারায়ণের আদেশানুসারে রজোগুণাবলম্বী কৈটভ উৎপন্ন হইল।
অনন্তর সেই রজ ও তমোগুণাবলম্বী মহাবলপরাক্রান্ত গদাধারী অসুরদ্বয় ঐ পদ্মমধ্যে ভ্রমণ করিতে করিতে দেখিল, উহার মধ্যে ভগবান্ ব্রহ্মা সৰ্ব্ব প্রথমে মনোহর বেদের সৃষ্টি করিতেছেন। ব্রহ্মাকে বেদসৃষ্টি করিতে দেখিয়া তাহাদের মনে ঈর্ষার সঞ্চার হইল। তখন তাহারা কমলযোনির নিকট হইতে সেই বেদ গ্রহণপূৰ্ব্বক সমুদ্রমধ্যে গমন করিয়া রসাতলে প্রবেশ করিল। বেদ অপহৃত হইলে পদ্মযোনি ব্রহ্মা নিতান্ত কাতর হইয়া নারায়ণকে কহিলেন, “ভগবন্! বেদ আমার দিব্যচক্ষু ও উৎকৃষ্ট বল, বেদ আমাদের তেজ ও উপাস্য বস্তু। এক্ষণে মধুকৈটভনামক দানবদ্বয় বলপূৰ্ব্বক উহা অপহরণ করিয়াছে। বেদবিরহে আমি লোকসমুদয় অন্ধকারময় দেখিতেছি। বেদ ব্যতীত আমি কিরূপে লোক সৃষ্টি করিব? ফলতঃ বেদ বিনষ্ট হওয়াতে আমার যারপরনাই দুঃখ উপস্থিত ও হৃদয় অতিশয় সন্তপ্ত হইয়াছে। আজ কোন্ ব্যক্তি সেই বেদসমুদয় আনয়ন করিয়া আমাকে এই শোকসাগর হইতে উদ্ধার করিবে?”
বেদ-উদ্ধারের জন্য ব্রহ্মার নারায়ণস্তব
কমলযনি নারায়ণের নিকট এইরূপ দুঃখ প্রকাশ করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁহাকে স্তব করিতে করিতে কহিলেন, “ভগবন্! তুমি ব্ৰহ্মস্বরূপ ও আমার পুৰ্ব্বজাত। তুমি লোকের আদি, সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ও সাঙ্খ্যযোগনিধি। তুমি মহত্তত্ত্ব ও প্রকৃতির স্রষ্টা, অচিন্তনীয় ও শ্রেয়ঃপথাবলম্বী। তুমি বিশ্বসংহারক, সৰ্ব্বভূতের অন্তরাত্মা ও স্বয়ম্ভূ; তোমাকে নমস্কার। আমি তোমার অনুগ্রহেই জন্মপরিগ্রহ করিয়াছি। প্রথমে তোমার মানস হইতে, দ্বিতীয়বার চক্ষু হইতে, তৃতীয়বার বাক্য হইতে, চতুর্থবার শ্রবণ হইতে, পঞ্চমবার নাসিকা হইতে ও যষ্ঠবার অণ্ডমধ্য হইতে আমার উদ্ভব হইয়াছে। এই আমার সপ্তম জন্ম। এবারে আমি তোমার নাভিপদ্ম হইতে জন্মগ্রহণ করিয়াছি। হে পুণ্ডরীকাক্ষ! আমি কল্পে কল্পে সৃষ্টির সময় বিশুদ্ধসত্ত্বসম্পন্ন ও তোমার জ্যেষ্ঠপুত্র হইয়া থাকি। তুমি ঈশ্বর ও স্বয়ম্ভূ। আমি তোমা হইতে সদ্ভূত হইয়াছি। বেদ আমার চক্ষুঃস্বরূপ। দুরাত্মা দানবদ্বয় আজ আমার সেই চক্ষু অপহরণ করাতে আমি এক্ষণে অন্ধ প্রায় হইয়াছি; অতএব নিদ্রাপরিত্যাগপূৰ্ব্বক আমাকে চক্ষু প্রদান কর। তুমি আমার প্রতি যেরূপ স্নেহ কর, আমিও তোমার প্রতি সেইরূপ ভক্তি করিয়া থাকি।”
হয়গ্রীবমূর্ত্তিতে নারায়ণের বেদ-উদ্ধার
লোকপিতামহ ব্রহ্মা এইরূপ স্তব করিলে, ভগবান্ নারায়ণ নিদ্ৰাপরিত্যাগপূৰ্ব্বক গাত্রোত্থান করিয়া বেদোদ্ধারের নিমিত্ত উদ্যত হইলেন। ঐ সময় তিনি অণিমাদি ঐশ্বর্য্য প্রয়োগদ্বারা দ্বিতীয় হয়গ্রীবমূর্ত্তি ধারণ করিলে তাঁহার শরীর ও নাসিকাদি অবয়বসমুদয় চন্দ্রতুল্য কমনীয় হইয়া উঠিল। নক্ষত্রতারাসমবেত স্বর্গ তাঁহার মস্তক, সূর্য্যকিরণ কেশপাশ, আকাশ ও পাতাল কর্ণদ্বয়, পৃথিবী ললাট, গঙ্গা ও সরস্বতী নিতম্বদ্বয়, মহাসমুদ্রদ্বয় ভ্রূযুগল, চন্দ্র ও সূর্য্য চক্ষুর্ধ্বয়, সন্ধ্যা নাসিকা, ওঙ্কার সংস্কার, বিদ্যুৎ জিহ্বা, সোমপায়ী পিতৃগণ দন্তসমুদয়, গোলোক ও ব্রহ্মলোক ওষ্ঠ ও অধর এবং কালরাত্রি তাঁহার গ্রীবাস্বরূপ হইল। ভগবান্ নারায়ণ এইরূপে বিবিধ মূর্ত্তিপরিবৃত হয়গ্রীবমূর্ত্তি ধারণপূর্ব্বক তথা হইতে অন্তর্হিত হইয়া রসাতলে প্রবেশ করিলেন। তথায় প্রবিষ্ট হইয়া তিনি ঘোরতর যোগানুষ্ঠানপূৰ্ব্বক উদাত্তাদি স্বরসমুদয় অবলম্বন করিয়া সামগান করিতে আরম্ভ করিলে রসাতল প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিল। তখন মধুকৈটভ সেই শব্দ শ্রবণ করিবামাত্র ব্যগ্র হইয়া রসাতলমধ্যে বেদ নিক্ষেপপূৰ্ব্বক শব্দানুসারে ধাবমান্ হইল। অসুরদ্বয়, বেদনিক্ষেপ করিবামাত্র হয়গ্রীবমূৰ্ত্তিধারী ভগবান্ নারায়ণ তাহাদের অগোচরে সমুদয় বেদ গ্রহণ ও স্বস্থানে আগমন করিয়া ব্রহ্মার হস্তে সমর্পণ করিলেন এবং মহাসমুদ্রের ঈশানকোণে স্বীয় হয়গ্রীবমূৰ্ত্তি স্থাপন করিয়া স্বয়ং পূর্ব্বরূপ ধারণপূৰ্ব্বক নিদ্রিত হইলেন।
এ দিকে মধুকৈটভ বহুক্ষণ সেই শব্দের কারণ অনুসন্ধানপূৰ্ব্বক কুত্রাপি কিছুমাত্র অবলোকন না করিয়া পরিশেষে যে স্থানে বেদ নিক্ষেপ করিয়াছিল, তথায় আগমন ও বেদ অন্বেষণ করিতে লাগিল; কিন্তু মহাত্মা নারায়ণ ইতিপূর্ব্বে বেদ লইয়া প্রস্থান করিয়াছিলেন, সুতরাং উহারা ঐ স্থানে উহার অনুসন্ধান পাইল না। তখন তাহারা পুনরায় রসাতল হইতে উত্থিত হইয়া দেখিল, সেই পূর্ণচন্দ্রনিভ অমিতপরাক্রম শুভ্রবর্ণ আদিপুরুষ নারায়ণ সলিলের উপর কিরণজালসমাবৃত স্বীয় দেহপ্রমাণ অনন্তশয্যায় শয়ান হইয়া নিদ্রাসুখ অনুভব করিতেছেন। তাঁহাকে দর্শন করিবামাত্র ঐ দানবদ্বয় ক্রোধাবিষ্ট হইয়া উচ্চৈঃস্বরে হাস্য করিয়া কহিল, “এই সেই শ্বেতবর্ণ পুরুষ নিদ্রাসুখ অনুভব করিতেছে। রসাতল হইতে বেদ অপহরণ করা ইহারই কৰ্ম্ম, সন্দেহ নাই।”
নারায়ণকর্ত্তৃক মধুকৈটভবধ
দুরাত্মা অসুরদ্বয় এই স্থির করিয়া নারায়ণের নিকট গমনপূৰ্ব্বক, “এ কে? কি নিমিত্ত অনন্তশয্যায় শয়ন করিয়া নিদ্রা সুখ অনুভব করিতেছে?” উচ্চৈঃস্বরে এইরূপ বাক্যবিন্যাসপূৰ্ব্বক তাহার নিদ্রাভঙ্গ করিল। নারায়ণ জাগরিত হইবামাত্র দানবদ্বয়কে যুদ্ধার্থী অবলোকনপূৰ্ব্বক স্বয়ং যুদ্ধার্থ প্রস্তুত হইয়া তাহাদের সহিত ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ করিলেন এবং কিয়ৎক্ষণ পরে ব্রহ্মার উপকারার্থ তাহাদিগের উভয়কেই এককালে সংহার করিয়া ফেলিলেন। এইরূপে দানবদ্বয়ের বিনাশ ও নিখিল বেদের উদ্ধারদ্বারা ব্রহ্মার শোকাপনোদন হইলে কমলযোনি বেদ ও নারায়ণের সাহায্যবলে স্থাবরজঙ্গমাত্মক বিশ্বসংসারের সৃষ্টি করিতে আরম্ভ করিলেন।
ভগবান নারায়ণ এইরূপে মধুকৈটভের বিনাশসাধন ও ব্রহ্মার অন্তরে লোকসৃষ্টির বুদ্ধি প্রদান করিয়া তথা হইতে অন্তর্হিত হইলেন। এইরূপে মহাত্মা হরি হয়গ্রীবমূর্ত্তি ধারণ করিয়াছিলেন। যে ব্রাহ্মণ এই নারায়ণবৃত্তান্ত শ্রবণ বা অভ্যাস করেন, তাঁহার কখনই বেদাধ্যয়নের বিঘ্ন জন্মে না। পূৰ্ব্বে পাঞ্চালরাজ দৈববাণী অনুসারে উগ্রতর তপানুষ্ঠানপূৰ্ব্বক হয়গ্রীবমূর্ত্তি নারায়ণকে আরাধনা করিয়া স্বীয় অধিকার প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। হে মহারাজ! তুমি ইতিপূৰ্ব্বে আমাকে ভগবান্ নারায়ণের যে হয়গ্রীবমূৰ্ত্তির কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলে, এই আমি তোমার নিকট তাহা কীৰ্ত্তন করিলাম। তিনি কার্য্যসাধন করিবার নিমিত্ত যখন যেরূপ মূর্ত্তি ধারণ করিতে বাসনা করেন, তখনই সেইরূপ মূর্ত্তি ধারণ করিয়া থাকেন। ঐ মহাত্মা বেদ ও তপস্যার নিধিস্বরূপ। তিনি সাঙ্যযোগ ও পরমব্রহ্ম; যজ্ঞসমুদয় তাঁহারই উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে। তিনিই সকলের পরমগতি, সত্য এবং প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তিলক্ষণ ধৰ্ম্মস্বরূপ। ভূমির গন্ধ, সলিলের রস, জ্যোতির রূপ, বায়ুর স্পর্শ, আকাশের শব্দ এবং প্রকৃতির গুণ, মন তাহা হইতেই উৎপন্ন হইয়াছে। গ্রহনক্ষত্রাদির গমনাগমননিবন্ধন যে কাল প্রাদুর্ভূত হয়, তাহাও নারায়ণাত্মক। কীৰ্ত্তি, শ্রী ও লক্ষ্মী প্রভৃতি দেবতাসমুদয় নারায়ণকেই আশ্রয় করিয়া আছেন। ফলতঃ নারায়ণই এই সমুদয় পদার্থের প্রধান কারণ ও কার্য্যস্বরূপ। তিনিই অধিষ্ঠানকর্ত্তা, পৃথগ্বিধকরণ, বিবিধ চেষ্টা ও দৈব।
যাঁহারা হেতুবাদ প্রদর্শনপূৰ্ব্বক যে তত্ত্ব জিজ্ঞাসা করিয়া থাকেন, মহাযোগী হরিই তাঁহাদিগের সেই তত্ত্বস্বরূপ। তিনি ব্রহ্মাদি দেবতা, ঋষি, সাঙ্খ্যমতাবলম্বী যোগী ও আত্মজ্ঞ যতিদিগের মনোভিলাষসমুদয় পরিজ্ঞাত হইতেছেন; কিন্তু ঐ সমস্ত মহাত্মারা কোনক্রমেই তাঁহার অভীষ্ট অবগত হইতে সমর্থ হয়েন না। এই ত্রিলোকমধ্যে যাঁহারা দৈব ও পৈত্ৰকার্য্য এবং দান ও তপানুষ্ঠান করিয়া থাকেন, ভগবান্ নারায়ণ তাঁহাদিগের সকলেরই আশ্রয়। তিনি সকলের বাসস্থান বলিয়া মহর্ষিগণ তাঁহাকে বাসুদেব নামে কীৰ্ত্তন করিয়া থাকেন। তিনি নিত্য, পরমমহর্ষি, মহাবিভূতি ও নির্গুণ। বসন্তাদি ঋতুতে কাল যেমন ঋতুচিহ্ন ধারণ করে, সেইরূপ তিনি সগুণ হইয়া রূপাদি ধারণ করিয়া থাকেন। মহাত্মারা তাঁহার গতি বা প্রত্যাগতি কিছুই অবধারণ করিতে সমর্থ হয়েন না। যে মহর্ষিগণ জ্ঞানবল আশ্রয় করিয়াছেন, তাঁহারাই তাঁহাকে হৃদয়মধ্যে দর্শন করিয়া থাকেন।