৩৪৭তম অধ্যায়
নারায়ণমাহাত্ম্য-শ্রবণফল
বৈশম্পায়ন কহিলেন, “হে মহারাজ! দেবর্ষি নারদ নরনারায়ণের নিকট এইরূপ বাক্য শ্রবণ করিয়া পরমাত্মার প্রতি ভক্তিপরায়ণ ও একান্ত অনুরক্ত হইলেন। তিনি নরনারায়ণের আশ্রমে সহস্র বৎসর অবস্থান, তাঁহাদিগের নিকট নারায়ণোপাখ্যান শ্রবণ ও তথায় বিশ্বরূপ হরিকে সন্দর্শন করিয়া হিমালয় পর্ব্বতস্থিত স্বীয় আশ্রমে প্রত্যাগমন করিলেন। সেই বিখ্যাত তপস্বী মহর্ষি নরনারায়ণও রমণীয় বদরিকাশ্রমে অবস্থানপূৰ্ব্বক ঘোরতর তপশ্চরণ করিতে লাগিলেন। আজ তুমি আমার নিকট এই পূৰ্ব্ববৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া পবিত্র হইলে। যে ব্যক্তি কায়মনোবাক্যে সেই অনাদিনিধান নারায়ণের প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশ করে, কি ইহলোক, কি পরলোক কুত্রাপি তাহার নিস্তার নাই। যে ব্যক্তি দেবশ্রেষ্ঠ নারায়ণের বিদ্বেষ করে, সেই সকলেরই দ্বেষ্য ও তাহার পূর্ব্বপুরুষগণ অনন্তকাল ঘোরতর নরকে নিপতিত হয়। নারায়ণ সৰ্ব্বভূতের আত্মস্বরূপ; সুতরাং তাঁহার দ্বেষ করিলে আত্মদ্বেষী হইতে হয়। আমাদিগের উপাধ্যায় গন্ধবতীপুত্র [মৎস্যগন্ধার পুত্র] মহর্ষি বেদব্যাসের নিকট যেরূপ নারায়ণমাহাত্ম্য শ্রবণ করিয়াছি, তাহা তোমার নিকট কীৰ্ত্তন করিলাম। দেবর্ষি নারদ স্বয়ং ভগবান নারায়ণের নিকট তাঁহার মাহাত্ম্য শ্রবণ করিয়াছিলেন; আমি পূৰ্ব্বে ভগবদ্গীতা কীৰ্ত্তনসময়ে ঐ মাহাত্ম্য সংক্ষেপে কীৰ্ত্তন করিয়াছি। ভগবান্ বেদব্যাস নারায়ণস্বরূপ। তিনি ভিন্ন আর কেহই মহাভারত রচনা ও যথাবিধি বিবিধ ধর্ম্মোপদেশপ্রদানে সমর্থ নহেন। যাহা হউক, এক্ষণে তুমি যে অশ্বমেধযজ্ঞের সংকল্প করিয়াছ, তাহা নির্ব্বিঘ্নে সমারব্ধ হউক।
সৌতি কহিলেন, হে শৌনক! নরপতি জনমেজয় এই বিস্তীর্ণ নারায়ণমাহাত্ম্য শ্রবণ করিয়া অশ্বমেধযজ্ঞের উদ্যোগ করিতে লাগিলেন। তুমি এই সমুদয় মহর্ষিসমভিব্যাহারে যে নারায়ণমাহাত্ম জিজ্ঞাসা করিয়াছিলে, এই আমি তাহা কীৰ্ত্তন করিলাম। পূর্ব্বে দেবর্ষি নারদ কৃষ্ণ, ভীষ্ম, পাণ্ডবগণ ও মহর্ষিসমুদয়ের সমক্ষে সুরগুরু বৃহস্পতির নিকট ঐ মাহাত্ম্য কীৰ্ত্তন করিয়াছিলেন। ভগবান্ নারায়ণ সমুদয় মহর্ষি ও ত্রিভুবনের অধিপতি। তিনি বেদের বিধাতা। তিনিই এই সুবিস্তীর্ণ ভূমণ্ডল ধারণ করিয়া রহিয়াছেন। শমদমাদি নিয়মসমুদয় তাঁহা হইতেই উদ্ভূত হইয়াছে। ব্রাহ্মণগণ তাঁহাকে পূজা করিয়া থাকেন। তিনি দেবগণের হিতার্থে অসুরদিগের বিনাশসাধন করিয়াছেন। তিনি তপোনিধি, যশোভাজন, মধুকৈটভনিহন্তা এবং ধর্ম্মবিৎ ব্যক্তিদিগের একমাত্র গতি ও অভয়দাতা। তিনি সগুণ, বাসুদেবাদি মূৰ্ত্তিচতুষ্টয়ধারী এবং যজ্ঞ ও খাতাদির ফলভাগহারী [জলাশয়প্রতিষ্ঠার অংশভাগী]। সেই দুর্জ্জয় মহাবলপরাক্রান্ত ভগবান্ নারায়ণ পুণ্যাত্মা মহর্ষিদিগের উৎকৃষ্ট গতিবিধান করিয়া থাকেন। সাঙ্খ্যমতাবলম্বী পণ্ডিত ও যোগিগণ তাঁহাকে ত্রিলোকের আদিকারণ, মোক্ষের আধার এবং সূক্ষ্ম, অচল ও সনাতন পুরুষ বলিয়া কীৰ্ত্তন করেন। লোকপিতামহ ভগবান্ ব্রহ্মাও সেই ত্রিলোকসাক্ষী জন্মবিহীন আদিপুরুষ নারায়ণকে নমস্কার করিয়া থাকেন; অতএব আপনারা একান্তচিত্তে সেই ত্রিলোকনাথকে নমস্কার করুন।