৩৪৬তম অধ্যায়
নারদের দেবপিতৃকার্য্যের অনুষ্ঠান
বৈশম্পায়ন কহিলেন, একদা ধৰ্ম্মের জ্যেষ্ঠপুত্র ভগবান্ নারায়ণ দেবর্ষি নারদকে দেবকার্য্যসমাধানানন্তর পিতৃকার্য্যানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত দেখিয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “তপোধন! তুমি এই দৈব ও পৈত্ৰকাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হইয়া কোন্ ফললাভের নিমিত্ত কাহার আরাধনা করিতেছ, তাহা আমার নিকট কীৰ্ত্তন কর।”
নারদ কহিলেন, “ভগবন্! পূর্ব্বে আপনিই কহিয়াছিলেন, দেবগণের আরাধনা করা অবশ্য কর্ত্তব্য। দৈবই পরমযজ্ঞ ও সনাতন পরমাত্মার স্বরূপ। আমি আপনার সেই বাক্যানুসারে নিরন্তর নারায়ণের উপাসনা করিতেছি। সৰ্ব্বলোকপিতামহ ভগবান্ ব্রহ্মা সেই সনাতন নারায়ণ হইতে উৎপন্ন হইয়াছেন। আমার পিতা দক্ষ প্রজাপতি তাঁহার পুত্র। আমি ভগবান্ ব্রহ্মার মানসপুত্র হইয়াও অভিশাপবশতঃ সেই দক্ষ হইতে জন্মগ্রহণ করিয়াছি। লোকে পিতৃযজ্ঞে পিতা, মাতা ও পিতামহস্বরূপ সেই সনাতন নারায়ণেরই অর্চ্চনা করিয়া থাকে। এই নিমিত্ত আমি পিতৃযজ্ঞে প্রবৃত্ত হইয়া সেই পরমাত্মার উপাসনা করিতেছি। শ্রুতিশাস্ত্রে নির্দ্দিষ্ট আছে, দেবগণ অগ্নিষ্বাত্তাদিকে [অগ্নিস্বত্বাদি দিব্যপিতৃলোকদিগকে] বেদাধ্যয়ন করাইয়া অসুরগণের সহিত যুদ্ধার্থ গমন করেন। ঐ যুদ্ধ বহুকাল হওয়াতে বেদ তাঁহাদের স্মৃতিপথ হইতে তিরোহিত হয়। তন্নিবন্ধন তাঁহারা সেই অগ্নিষ্বাত্তাদির নিকট পুনরায় বেদাধ্যয়ন করেন। দেবগণ অগ্নিদাত্তাদির নিকট বেদাধ্যয়ন করাতে অগ্নিষ্বাত্তাদি দেবগণের পুত্র হইয়াও পিতৃত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করিয়াছেন। দেবগণ যে পিণ্ডত্রয় প্রদানপূর্ব্বক পরস্পর পরস্পরের পূজা করিয়াছিলেন, ইহা আপনাদিগের অবিদিত নাই। যাহা হউক, পূৰ্ব্বে পিতৃগণ কিরূপে পিণ্ডসংজ্ঞা লাভ করিয়াছিলেন, এক্ষণে আপনারা সেই বিষয় আমার নিকট কীৰ্ত্তন করুন।”
নারদসমীপে নারায়ণের পিতৃকার্য্যপ্রশংসা
তখন ভগবান্ নরনারায়ণ দেবর্ষি নারদকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “তপোধন! পূৰ্ব্বে ভগবান নারায়ণ বারহমূৰ্ত্তিধারণপূৰ্ব্বক পৃথিবীকে উদ্ধৃত ও যথাস্থানে নিবেশিত করিয়া মধ্যাহ্নকাল উপস্থিত হইলে কর্দ্দমাঙ্কিত দেহে পূর্ব্বাস্য হইয়া ভূমিতে কুশ সংস্থাপন ও আত্মদেহের উত্তাপসমুদ্ভূত স্নেহগর্ভ তিলদ্বারা প্রোক্ষণপুরঃসর দংষ্ট্রাদ্বারা সেই তিনটি মৃন্ময় পিণ্ড উত্তোলন ও সেই কুশোপরি সংস্থাপনপূৰ্ব্বক লোকের নিয়মসংস্থাপনার্থ কহিয়াছিলেন, “আমিই লোকসমুদয়ের সৃষ্টিকৰ্ত্তা। এক্ষণে আমি স্বয়ং পিতৃগণের সৃষ্টি করিতে উদ্যত হইয়াছি। আমার দন্তদ্বারা মৃৎপিণ্ড নিক্ষিপ্ত হইয়া দক্ষিণদিক্ আশ্রয় করিয়াছে; এই নিমিত্ত অদ্যাবধি পিণ্ডসমুদয় পিতৃগণ [পিণ্ডে পিতৃমূৰ্ত্তির ধ্যান ধর্ম্মশাস্ত্রসিদ্ধ] বলিয়া কীর্ত্তিত হইবে। আমি এই যে পিণ্ডত্রয়ের সৃষ্টি করিলাম, ইহারা আমার আদেশক্রমে পিতৃত্ব লাভ করুক। পণ্ডিতেরা আমাকেই পিণ্ডত্রয়ে অবস্থিত পিতা, পিতামহ ও প্রপিতামহ বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন। আমা হইতে শ্রেষ্ঠ ও পূজ্য কেহই নাই। কেহই আমার পিতা নহে। আমিই সকলের পিতা, পিতামহ ও প্রপিতামহম্বরূপ। দেবদেব ভগবান্ নারায়ণ উহা কহিয়া বরাহপৰ্ব্বতে পিণ্ডদানপূৰ্ব্বক আপনার পূজা করিয়া অন্তর্হিত হইলেন। সেই অবধি পিতৃগণ পিণ্ডনামে অভিহিত হইয়া পূজা গ্রহণ করিয়া থাকেন। যাঁহারা কায়মনোবাক্যে পিতৃগণ, দেবতা, গুরু, অতিথি ও ব্রাহ্মণগণ এবং পৃথিবী, গো ও জননীর অর্চ্চনা করেন, তাঁহাদের বিষ্ণুপূজার ফললাভ হইয়া থাকে। সুখদুঃখবিহীন ভগবান নারায়ণ নিরন্তর সৰ্ব্বভূতের অন্তরে অবস্থান করিতেছেন।”