৩৪০. বিষ্ণুর কৃপায় নারদের বিশ্বরূপদর্শন

৩৪০তম অধ্যায়

বিষ্ণুর কৃপায় নারদের বিশ্বরূপদর্শন

ভীষ্ম কহিলেন, “তপোধনাগ্রগণ্য দেবর্ষি নারদ এইরূপ গুহ্য নামসমুদয় উচ্চারণপূৰ্ব্বক বিশ্বরূপ ভগবান্ নারায়ণের স্তব করিলে তিনি প্রসন্ন হইয়া তাঁহাকে স্বীয় রূপ প্রদর্শন করিলেন। তখন দেবর্ষি নারদ দেখিলেন, এক অসংখ্যনেত্র, অসংখ্যমস্তক, অসংখ্যবাহু ও অসংখ্যোদর মহাপুরুষ তাঁহার সমীপে অবস্থান করিতেছেন। তাঁহার শরীরের কোন স্থান শুকপক্ষীর ন্যায়, কোন স্থান স্ফটিকের ন্যায়, কোন স্থান নীলকজ্জলের ন্যায়, কোন স্থান সুবর্ণের ন্যায়, কোন স্থান প্রবালের ন্যায়, কোন স্থান শ্বেতবৈদূর্য্যমণির ন্যায়, কোন স্থান নীল-বৈদূর্য্যমণির ন্যায়, কোন স্থান ইন্দ্রনীলমণির ন্যায়, কোন স্থান ময়ূরগ্রীবার ন্যায় ও কোন স্থান মুক্তাহারের ন্যায় বর্ণে সুশোভিত এবং কোন স্থান বা নিতান্ত অব্যক্ত। তিনি একমুখে ওঙ্কারযুক্ত সাবিত্রী উচ্চারণ ও অন্যান্য মুখসমুদয়ে আরণ্যক [উপনিষদ] প্রভৃতি বিবিধ বেদমন্ত্র গান করিতেছেন এবং তাঁহার করে বেদ, কমণ্ডলূ, বিবিধ শুভ্ৰমণি, কুশ, মৃগচর্ম্ম, দণ্ডকাষ্ঠ ও জ্বলিত হুতাশন বিদ্যমান রহিয়াছে; চরণে অপূৰ্ব্ব পাদুকা শোভা পাইতেছে। দেবর্ষি নারদ ভগবান্ নারায়ণের সেই অপরূপ রূপ-দর্শনে পুলকিত হইয়া ভক্তিভাবে তাঁহাকে অভিবাদন ও তাঁহার স্তব করিতে লাগিলেন।

“তখন সেই দেবাদিদেব ভগবান নারায়ণ নারদকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘দেবর্ষে! পূৰ্ব্বে মহর্ষি একত, দ্বিত ও ত্রিত আমার দর্শনলালসায় এই স্থানে আগমন করিয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহারা আমাকে দর্শন করিতে সমর্থ হয়েন নাই। ঐকান্তিক ভক্তি না থাকিলে কেহই আমাকে দেখিতে পায় না। তুমি আমার প্রতি একান্ত ভক্তিপরায়ণ; এই নিমিত্ত আমার দর্শনলাভে সমর্থ হইলে। আমার এই মূৰ্ত্তি ধর্ম্মের গৃহে চারি-অংশে সমুৎপন্ন হইয়াছে; অতএব তুমি নিরন্তর সেই সমুদয় মূৰ্ত্তির আরাধনা করিবে। আজ আমি তোমার প্রতি নিতান্ত প্রসন্ন হইয়াছি; অতএব যদি তোমার কোন বরলাভের বাঞ্ছা থাকে, তাহা প্রকাশ কর।’

“নারদ কহিলেন, ‘ভগবন্! আজ আপনাকে দর্শন করিয়া তপস্যা, যম ও নিয়মের সম্পূর্ণ ফল লাভ করিলাম। যখন আমি আপনার এই অপূর্ব্বরূপদর্শনে সমর্থ হইয়াছি, তখন আমার অদ্য অন্য বরে প্রয়োজন কি?”

বিষ্ণুর চারিমূর্ত্তিতে স্বরূপপ্রকাশ

“তখন ভগবান নারায়ণ নারদকে পুনৰ্ব্বার কহিলেন, ‘বৎস! এই চন্দ্রের ন্যায় দেদীপ্যমান জিতেন্দ্রিয় ভক্তগণ আহারবিহীন হইয়া একাগ্রচিত্তে আমার ধ্যান করিতেছে। তুমি এই স্থানে অবস্থান করিলে ইহাদিগের বিঘ্ন হইতে পারে; অতএব অবিলম্বে অন্যত্র গমন করা তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য। এই মহাত্মারা রজঃ ও তমোগুণ হইতে এককালে নির্ম্মুক্ত হইয়াছে এবং আমার প্রতি একান্ত ভক্তিপরায়ণ হইয়া সিদ্ধিলাভ করিয়াছে। ইহারা পরিণামে আমাতেই প্রবেশ করিবে সন্দেহ নাই।

‘যিনি রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ ও শব্দবিহীন; ত্রিগুণাতীত এবং সৰ্ব্বলোকের আত্মা ও সাক্ষিস্বরূপ; প্রাণীগণের দেহনাশে যাঁহার নাশ নাই; যিনি অজ, নিত্য, নির্গুণ, নিরাকার, চতুৰ্ব্বিংশতিতত্ত্বাতীত, ক্রিয়াবিহীন ও জ্ঞানদৃশ্য বলিয়া অভিহিত হয়েন এবং ব্রাহ্মণগণ যাঁহাতে প্রবেশ করিয়া মুক্তিলাভ করেন, সেই সনাতন পরমাত্মাকেই বাসুদেব বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। তাঁহার মাহাত্ম ও মহিমা সর্ব্বত্র বিরাজিত রহিয়াছে। তিনি শুভাশুভ কাৰ্য্যে কদাচ লিপ্ত হয়েন না। সত্ত্ব, রজঃ ও তম এই তিন গুণ জীবমাত্রেরই দেহে নিরন্তর অবস্থান ও বিচরণ করে। জীবাত্মা ঐ সমুদয় গুণের ভোক্তা; কিন্তু পরমাত্মা ঐ সমুদয় হইতে পৃথক্‌। তিনি নির্গুণ, গুণপালক, গুণস্রষ্টা ও গুণাতীত বলিয়া অভিহিত হয়েন। সমুদয় জগৎ সলিলে, সলিল জ্যোতিতে, জ্যোতি বায়ুতে, বায়ু আকাশে, আকাশ মনে, মন প্রকৃতিতে, প্রকৃতি পরব্রহ্মে লীন হইয়া থাকে। সেই সনাতন পরব্রহ্ম কিছুতেই লীন হয়েন না, তাহা হইতে শ্রেষ্ঠ আর কেহই স্নাই; ইহলোকে স্থাবরজঙ্গমাত্মক সমুদয় প্রাণীই অনিত্য; কেবল সেই সৰ্ব্বভূতের আত্মভূত বাসুদেবই নিত্য বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়া থাকেন।

‘পৃথিবী, বায়ু, আকাশ, সলিল ও তেজ এই পঞ্চভূত একত্র মিলিত হইয়া শরীররূপে পরিণত হয়। যেমন পঞ্চভূত ব্যতীত শরীর উৎপন্ন হয় না, তদ্রূপ জীব ভিন্ন শরীরস্থ বায়ু কোনক্রমেই সঞ্চালিত হইতে পারে না। এই নিমিত্ত জীবাত্মা শরীরে আবির্ভূত হইলেই লোকের শরীর চেষ্টাযুক্ত হয়। পণ্ডিতেরা সেই জীবাত্মাকেই ভগবান, অনন্ত ও সঙ্কৰ্ষণ বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন। ঐ সঙ্কর্ষণাখ্য জীব হইতে প্রদ্যুম্নের উৎপত্তি হয়। তিনি সৰ্ব্বভূতের মনঃস্বরূপ। প্রলয়কালে সমুদয় প্রাণীই তাঁহাতে লীন হইয়া থাকে। ঐ প্রদ্যুম্নখ্য মন হইতে অনিরুদ্ধের উৎপত্তি হয়। তিনি সৰ্ব্বভূতের অহঙ্কারস্বরূপ। তাঁহা হইতে কৰ্ত্তা, কারণ, কার্য্য ও স্থাবরজঙ্গমপরিপূর্ণ সমুদয় জগৎ উৎপন্ন হয়। তাঁহাকেই ঈশান ও সৰ্ব্বকাৰ্য্যের প্রকাশক বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়।

‘পণ্ডিতেরা নির্গুণাত্মক পরমাত্মা বাসুদেব ও জীবাত্মা সঙ্কর্ষণকে এক বলিয়া জ্ঞান করেন। সঙ্কর্ষণ হইতে প্রদ্যুম্নমনঃ ও প্রদ্যুম্নমনঃ হইতে অনিরুদ্ধাখ্য অহঙ্কারের সৃষ্টি হইয়াছে। আমি এই স্থাবর জঙ্গমাত্মক সমুদয় জগতের সৃষ্টিকর্ত্তা। আমা হইতেই সৎ, অসৎ, ক্ষয় ও অক্ষয় সমুদয় পদার্থের সৃষ্টি হইয়াছে। আমার ভক্তগণ মুক্ত হইয়া আমাতেই প্রবেশ করিয়া থাকে। পণ্ডিতেরা আমাকেই চতুর্ব্বিংশতিতত্ত্বাতীত, নির্গুণ, নিষ্ক্রিয়, নির্ব্বন্দ্ব, নিষ্পরিগ্রহ পুরুষ বলিয়াই নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন। তুমি আমাকে রূপবান্ অবলোকন করিতেছ। কিন্তু বস্তুত আমার রূপ নাই। আমি ইচ্ছা করিলেই মুহূৰ্ত্তমধ্যে এই রূপ সংহার করিতে পারি। তুমি কেবল আমার মায়াপ্রভাবেই আমাকে এইরূপ দর্শন করিতেছ। হে দেবর্ষে! এই আমি তোমার নিকট মূর্ত্তিচতুষ্টয়ের বৃত্তান্ত সবিস্তরে কীৰ্ত্তন করিলাম।

‘পণ্ডিতেরা আমাকেই জীবস্বরূপ বলিয়া নির্দ্দেশ করেন; জীব আমাতেই লীন হইয়া থাকে। জীব দৃশ্য পদার্থ নহে; অতএব আমি জীবাত্মাকে দর্শন করিয়াছি, এইরূপ বুদ্ধি যেন তোমার উপস্থিত না হয়। আমি সৰ্ব্বস্থানে ও সৰ্ব্বভূতের অন্তরে অবস্থান করিতেছি। প্রাণীগণের দেহ বিনষ্ট হইলেও আমার বিনাশ হয় না। লোকৈকনিদান [একমাত্র বিশ্বকারণ] বেদপাঠনিরত চতুরানন ব্রহ্মা আমার নানাবিধ কার্য্যের চিন্তা করিয়া থাকেন। ভগবান্ রুদ্রদেব ক্রোধপ্রযুক্ত আমার ললাটদেশ হইতে বহির্গত হইয়াছেন। এই দেখ, একাদশ রুদ্র আমার দক্ষিণপার্শ্বে, দ্বাদশ আদিত্য আমার বামপার্শ্বে, অশ্বিনীকুমারদ্বয় পৃষ্ঠভাগে এবং দেবশ্রেষ্ঠ অষ্টবসু আমার সম্মুখে অবস্থান করিতেছে। এই দেখ, দক্ষাদি প্রজাপতি, সপ্তমহর্ষি, বেদ, অসংখ্য যজ্ঞ, অমৃত, ওষধি, তপস্যা, নিয়ম, অষ্টসংযম, শ্ৰী, লক্ষ্মী, কীৰ্ত্তি, পৃথিবী, বেদমাতা সরস্বতী, জ্যোতিঃশ্রেষ্ঠ ধ্রুবনক্ষত্র, মেঘ, সমুদ্র, সরোবর ও নদীসমুদয়, সত্ত্বাদিগুণত্রয় এবং মূৰ্ত্তিমান্‌ চতুর্ব্বিধ পিতৃগণ সকলেই আমাতে অবস্থান করিতেছেন। দেব ও পিতৃগণের মধ্যে আমিই অদ্বিতীয় আদি পিতা। আমি হয়গ্রীব হইয়া পশ্চিম ও উত্তরসমুদ্রমধ্যে শ্রদ্ধাসহকারে প্রদত্ত হব্যকব্য ভক্ষণ করিয়া থাকি।

‘আমি যজ্ঞরূপী। পূৰ্ব্বে ভগবান্ ব্রহ্মা আমাকর্ত্তৃক সৃষ্ট হইয়া যজ্ঞানুষ্ঠানপূর্ব্বক আমার আরাধনা করিয়াছিলেন। তন্নিবন্ধন আমি অত্যন্ত প্রীত হইয়া তাঁহাকে এই বলিয়া বর প্রদান করিয়াছিলাম যে, “হে ব্ৰহ্মন্! তুমি কল্পের প্রথমে আমার পুত্র ও সমুদয় লোকের অধ্যক্ষ ও পৰ্য্যায়ক্রমে কার্য্যদ্বারাই নানাবিধ নাম লাভ করিবে। তুমি যে সীমা [শাস্ত্র ও লোকব্যবহারাদির নিয়ম] নির্দ্দেশ করিবে, তাহা কোন ব্যক্তিই অতিক্রম করিতে সমর্থ হইবে না। তুমি বরাভিলাষীদিগকে বর প্রদান করিতে পারিবে। দেব, অসুর, ঋষি, পিতৃগণ ও বিবিধ জীবগণ তোমার উপাসনা করিবে। আমি দেবগণের কার্য্যসাধনার্থ অবনীমণ্ডলে অবতীর্ণ হইলে তুমি আমাকে পুত্রের ন্যায় শাসন ও কাৰ্য্যে নিয়োগ করিবে।”

‘হে তপোধন! আমি ব্রহ্মাকে এইরূপ বিবিধ বরপ্রদানপূর্ব্বক নিবৃত্তিমার্গ অবলম্বন করিয়া আছি। নিবৃত্তিই পরমধর্ম্ম; অতএব নিবৃত্তি অবলম্বন করাই সকলের কর্ত্তব্য।

‘সাঙ্খ্যশাস্ত্রজ্ঞ আচার্য্যেরা আমাকে বিদ্যাশক্তিসম্পন্ন সূর্য্যমণ্ডলস্থ কপিল বলিয়া কীৰ্ত্তন করেন। আমি বেদশাস্ত্রে ভগবান হিরণ্যগর্ভ ও যোগশাস্ত্রে যোগানুরক্ত বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়াছি। আমি এক্ষণে প্রকাশ্যভাবে স্বর্গে অবস্থান করিতেছি; কিন্তু সহস্রযুগ অতীত হইলে পুনরায় এই জগৎ সংহারপূৰ্ব্বক স্থাবরজঙ্গমাত্মক সমুদয় জীবকে শরীরস্থ করিয়া একাকী বিদ্যাশক্তির সহিত বিহার করিব। অনন্তর আমার প্রভাবে সেই বিদ্যাশক্তি হইতে পুনরায় সমুদয় বিশ্বের সৃষ্টি হইবে। আমার আদিমূর্ত্তি বাসুদেব হইতে অনন্তদেব সঙ্কৰ্ষণ, সঙ্কৰ্ষণ হইতে প্রদ্যুম্ন, প্রদ্যুম্ন হইতে অনিরুদ্ধ, অনিরুদ্ধ হইতে ব্রহ্মা এবং সেই ব্রহ্মা হইতে এই চরাচর বিশ্ব সমুৎপন্ন হয়। কল্পে কল্পে বারংবার এইরূপে সৃষ্টি হইয়া থাকে।

বিষ্ণুর বিশেষ বিশেষ অবতারপরিচয়

‘সূর্য্য গগনপথে সমুদিত হইয়া অস্তগমন করিলে, কাল যেমন বলপূৰ্ব্বক পুনরায় তাহাকে স্বস্থানে আনয়ন করে, তদ্রূপ এই সসাগরা ধরিত্রী জলনিমগ্ন হইলে, আমি জীবগণের হিতসাধনার্থ বরাহমূর্ত্তি ধারণ করিয়া বলপূৰ্ব্বক পুনরায় ইহাকে স্বস্থানে আনয়ন করিব। আমি নৃসিংহদেহ ধারণ করিয়া বলগর্ব্বিত দিতিনন্দন হিরণ্যকশিপুকে বিনাশ করিব। হিরণ্যকশিপুবিনাশের পর বিরোচনের বলিনামে এক মহাবলপরাক্রান্ত পুত্র জন্মিবে। ত্রিলোকমধ্যে কেহই তাহাকে বিনাশ করিতে পারিবে না। সে ইন্দ্রকে পদচ্যুত করিয়া ত্রৈলোক্য অপহরণ করিবে। মহাবলপরাক্রান্ত বলি এইরূপ উপদ্রব আরম্ভ করিলে আমি কশ্যপের ঔরসে অদিতির গর্ভে জন্মগ্রহণপূৰ্ব্বক দেবগণের অবধ্য দানবেন্দ্র বলিকে পাতালবাসী করিয়া ইন্দ্রকে ইন্দ্রত্ব প্রদান ও অন্যান্য দেবগণকে স্ব স্ব পদে সংস্থাপন করিব। পরে ত্রেতাযুগে ভৃগুবংশে জন্মগ্রহণপূৰ্ব্বক পরশুরামনামে বিখ্যাত হইয়া, ক্ষত্রিয়দিগকে একবারে উৎসন্ন করিয়া ফেলিব। তৎপরে ত্রেতা ও দ্বাপরযুগের সন্ধিসময়ে দশরথগৃহে অবতীর্ণ হইয়া রামনামে বিখ্যাত হইব। ঐ সময় একত ও দ্বিতনামে মহর্ষিদ্বয় ত্রিতমহর্ষির হিংসায় প্রবৃত্ত হইয়া বানরত্ব লাভ করিবেন। উঁহাদিগের বংশে যেসকল বানর জন্মগ্রহণ করিবে, তাহারা ইন্দ্ৰতুল্য মহাবলপরাক্রান্ত হইবে। আমি দেবকার্য্যসাধনার্থ তাহাদিগের সহায়তা গ্রহণ করিয়া পুলস্ত্যকুলকলঙ্ক রাক্ষসাধিপতি রাবণকে সবংশে বিনাশ করিব।

কৃষ্ণাবতারবিবরণ

‘অনন্তর দ্বাপর ও কলির সন্ধিতে দুরাত্মা কংসের বিনাশসাধনের নিমিত্ত মথুরানগরীতে আমার জন্ম হইবে। ঐ স্থানে সুরবৈরী অসুরগণকে বিনাশ করিয়া পরিশেষে দ্বারকায় বাস করিব। আমি তথায় বাস করিয়া দেবমাতা অদিতির কুণ্ডলাপহারী নরকাসুর এবং ভৌম, মরু ও পীঠনামক অসুরগণকে বহন করিয়া প্ৰাগজ্যোতিষপুর দ্বারকায় আনয়ন, বাণরাজের প্রিয়কারী সুরগণপূজিত মহেশ্বর ও কাৰ্ত্তিকেয়কে পরাজয় এবং বলিতনয় সহস্রবাহুসম্পন্ন বাণরাজাকে পরাজয় করিয়া সৌভবিমাননিবাসী সমস্ত অসুরকে সংহার করিব। আমার কৌশলপ্রভাবেই গার্গ্যের ঔরসপুত্র কালযবন প্রাণপরিত্যাগ করিবে। ঐ সময় সমুদয় ভূপতির বিরোধী মহাবলপরাক্রান্ত জরাসন্ধনামে এক অসুর গিরিব্রজের রাজা হইবে। সেই দুরাত্মা আমার অপ্রিয়চরণ করিয়া আমার বুদ্ধিপ্রভাবেই মৃত্যুমুখে আত্মসমর্পণ করিবে।

‘জরাসন্ধবিনাশের পর ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের রাজসূয়যজ্ঞে পৃথিবীস্থ সমস্ত ভূপালগণ সমাগত হইলে, আমি তাঁহাদের সমক্ষে শিশুপালকে বিনাশ করিব। এই সকল কার্য্যকালে একমাত্র মহাত্মা অৰ্জ্জুনই আমার সাহায্য করিবেন। তৎপরে আমি ভ্রাতৃগণের সহিত রাজা যুধিষ্ঠিরকে রাজ্যে অভিষিক্ত করিব। তৎকালে সকলেই কহিবে যে, মহাত্মা নর ও নারায়ণ পৃথিবীর কার্য্যসাধনের নিমিত্ত কৃষ্ণার্জ্জুনরূপে ক্ষত্রিয়কুল নির্মূল করিলেন। যুধিষ্ঠিরের রাজ্যলাভের পর আমি স্বেচ্ছানুসারে ভূভারহরণার্থ দ্বারকাপুরী উন্মূলিত করিব। আমারই প্রভাবে যদুবংশীয়গণ মোহান্ধ হইয়া পরস্পর বিনষ্ট হইবে।

‘এইরূপে আমি দ্বাপর ও কলির সন্ধিতে বাসুদেবাদি মূর্ত্তিচতুষ্টয় ধারণপূৰ্ব্বক প্রভূত কার্য্য সমাধান করিয়া স্বীয় লোকসমুদয় লাভ করিব। আমি হংস, কূৰ্ম্ম, মৎস্য, বরাহ, নরসিংহ, বামন, পরশুরাম, দাশরথি রাম, কৃষ্ণ ও কল্কি এই দশরূপে অবতীর্ণ হইয়া থাকি। শ্রুতি বিনষ্ট হইলে আমি তাহার উদ্ধারসাধন করি। বেদ ও শ্রুতি সত্যযুগে প্রস্তুত [আবির্ভূত] হইয়াছে, পুরাণে উহার তাৎপর্য্যার্থ বর্ণিত আছে। আমার মূর্ত্তিসমুদয় বারংবার প্রাদুর্ভূত হইয়া লোককার্য্যসংসাধনপূৰ্ব্বক পুনরায় স্ব স্ব প্রকৃতি প্রাপ্ত হইয়াছে।

‘হে নারদ! আজ তুমি একান্তমনে আমার যে রূপদর্শনলাভ করিলে, ব্রহ্মারও এই দর্শন লাভ কখনই হয় নাই। তুমি আমার পরমভক্ত; এই নিমিত্ত আমি তোমার নিকট পুরাণ, ভবিষ্য ও রহস্যবিষয়সমুদয় কীৰ্ত্তন করিলাম।’ বিশ্বস্বরূপ অবিনাশী নারায়ণ দেবর্ষি নারদকে এই বলিয়া অচিরাৎ অন্তর্হিত হইলেন; মহর্ষি নারদও অভিলষিত অনুগ্রহ লাভ করিয়া নরনারায়ণকে দর্শন করিবার নিমিত্ত অবিলম্বে বদরিকাশ্রমে গমন করিলেন। তিনি এই নারায়ণমুখনির্গত বেদচতুষ্টয়মূলক উপনিষদ্ ব্রহ্মার নিকট কীৰ্ত্তন করিয়াছিলেন।”

শ্রবণপরম্পরা বিষ্ণুমাহাত্মপ্রকাশ

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! ব্রহ্মা যে নারদের মুখে বিষ্ণুর অচিন্তনীয় মাহাত্ম্য শ্রবণ করিয়াছিলেন, তিনি কি পূৰ্ব্বে উহা অবগত ছিলেন না? সৰ্ব্বলোকপিতামহ ব্রহ্মা বিষ্ণুর সদৃশ; সুতরাং তিনি কি নিমিত্ত তাঁহার মহিমা অপরিজ্ঞাত ছিলেন?”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! সহস্র সহস্র মহাকল্প, সহস্র সহস্র সৃষ্টি ও সহস্র সহস্র প্রলয় অতীত হইয়া গিয়াছে। সৃষ্টির প্রারম্ভে প্রজাপতি ব্রহ্মা প্রজাসৃষ্টি করিয়া থাকেন। তিনি প্রথমাবধিই পরমাত্মা বিষ্ণুকে আপনা হইতে অধিক ও আপনার স্রষ্টা বলিয়া অবগত আছেন। কিন্তু পূর্ব্বে মহাত্মা নারায়ণের নিগূঢ় মাহাত্ম্য তাঁহার বোধগম্য হয় নাই। অনন্তর তিনি নারদের মুখে ঐ মাহাত্ম্য শ্রবণ করিয়া আপনার আলয়ে যেসমস্ত সিদ্ধপুরুষ সমাগত হইয়া থাকেন, তাঁহাদিগকে উহা শ্রবণ করাইয়াছিলেন। পরে সূর্য্যদেব ঐ সমস্ত সিদ্ধপুরুষ হইতে বিষ্ণুর মহিমা শ্রবণ করিয়া আপনার ষষ্টিসহস্র অগ্রগামীর [দেবকার্য্যের জন্য অগ্রসর অনুচরের] নিকট উহা কীৰ্ত্তন করেন। তৎপরে ঐ সমস্ত সূর্য্যসহচর সুমেরুপর্ব্বতে সমাগত দেবগণকে উহা শ্রবণ করাইয়াছিলেন। অনন্তর অসিতদেবল দেবগণের মুখে সেই মাহাত্ম্য শ্রবণ করিয়া পিতৃগণের নিকট কীৰ্ত্তন করেন। পরিশেষে আমার পিতা মহারাজ শান্তনু আমাকে উহা শ্রবণ করাইয়াছেন। এক্ষণে আমিও তোমার নিকট এই মাহাত্ম্য কীৰ্ত্তন করিলাম। দেবতা বা মহর্ষি হউন, যাঁহারা এই বিষ্ণুমাহাত্ম্য শ্রবণ করিয়াছেন, তাঁহারাই পরমাত্মা বিষ্ণুকে পূজা করিয়া থাকেন। যে ব্যক্তি বিষ্ণুভক্ত নহে, তুমি কদাচ তাহার নিকট এই ঋষিপ্রণীত পরম্পরাগত পুরাণ কীৰ্ত্তন করিও না। তুমি পূৰ্ব্বে আমার নিকট যেসমস্ত উপাখ্যান শ্রবণ করিয়াছ, উহা তৎসমুদয়ের সার। যেমন সুরাসুরগণ সমুদ্রমন্থন করিয়া অমৃত উদ্ধার করিয়াছিলেন, সেইরূপ ব্রাহ্মণগণ অনেক উপাখ্যান হইতে এই অমৃতোপম উপাখ্যান সংগ্রহ করিয়াছেন। যে মহাত্মা একান্তমনে নির্জ্জনে প্রতিনিয়ত এই উপাখ্যান পাঠ ও শ্রবণ করেন, তিনি শ্বেতদ্বীপে গমনপূৰ্ব্বক চন্দ্রের ন্যায় প্রভাসম্পন্ন হইয়া সহস্রার্চ্চি [সহস্র সহস্র কিরণযুক্ত] নারায়ণে প্রবেশ করিয়া থাকেন, সন্দেহ নাই ও পীড়িত ব্যক্তি ভক্তিভাবে এই মাহাত্ম্য আদ্যোপান্ত শ্রবণ করিলে নিশ্চয়ই রোগনির্ম্মুক্ত হয়। যাঁহার এই মাহাত্ম জ্ঞাত হইতে অভিলাষ হয়, তাঁহার ইচ্ছাসকল সফল হইয়া থাকে এবং যিনি বিষ্ণুর প্রতি ভক্তিপ্রদর্শন করেন, তিনি ভক্তের অভীষ্ট গতিলাভে সমর্থ হয়েন। হে ধৰ্ম্মরাজ! তুমি ভক্তিসহকারে সতত সেই পুরুষোত্তম নারায়ণের অৰ্চ্চনা কর। তিনি সকলের মাতা, পিতা ও বিশ্বগুরু। সেই ব্রহ্মণ্যদেব তোমার প্রতি প্রীত ও প্রসন্ন হউন।”

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে জনমেজয়! ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ভ্রাতৃগণসমভিব্যাহারে ভীষ্মের মুখে ভগবান নারায়ণের এইরূপ মাহাত্ম্য শ্রবণ করিয়া একান্ত বিষ্ণুপরায়ণ এবং বারংবার, ‘নারায়ণের জয় হউক’ এই বাক্য উচ্চারণ ও নারায়ণমন্ত্র জপ করিতে লাগিলেন। আমার গুরু মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন প্রতিনিয়ত নারায়ণমন্ত্র জপ এবং আকাশপথ অবলম্বনপূর্ব্বক ক্ষীরোদসাগরে গমন ও নারায়ণের অর্চ্চনা করিয়া পুনরায় আপনার আশ্রমে গমন করেন।

সৌতি [অনেক পৰ্ব্ব–অনেক বৃত্তান্ত বর্ণনের পর এখানে সৌতির ও শৌনকের কথা পুনরায় উঠিয়াছে। ব্যাসশিষ্য বৈশম্পায়ন মহারাজ জনমেজয়কে মহাভারত শ্রবণ করান; লৌমহর্ষণনামক সূতের তনয় সৌতি সেই ভারত-সভায় উপস্থিত থাকিয়া তাহা শ্রবণ করেন এবং সেই সব ভারতী কথা নৈমিষারণ্যে শুনকাদির নিকট কীৰ্ত্তন করেন। মহাভারতের সর্ব্বপ্রথমে এবং তৎপরও কদাচিৎ সূতের উক্তি স্মরণ করিলেই ব্যাখ্যান উপাখ্যানাদি বিষয়বস্তু সরল ও সহজে ধারণায় আসিয়া যাইবে।] কহিলেন, হে মহর্ষিগণ! মহর্ষি বৈশম্পায়ন রাজা জনমেজয়ের নিকট এই উপাখ্যান আনুপূর্ব্বিক কীৰ্ত্তন করিলে রাজা তদনুসারে কার্য্যানুষ্ঠান করিয়াছিলেন। আপনারা সকলেই নৈমিষারণ্যবাসী তপস্বী ও ব্রতপরায়ণ। আপনারা মহর্ষি শৌনকের যজ্ঞে পরমেশ্বরের উদ্দেশে হোমাদির অনুষ্ঠান করুন। পূৰ্ব্বে আমার পিতা আমার নিকট এই পরম্পরাগত কথা কীৰ্ত্তন করিয়াছিলেন।