৩৩তম অধ্যায়
যুদ্ধে সুশর্ম্মার পরাজয়
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! এইরূপে ভূলোক ধূলিজাল ও গাঢ়তিমির দ্বারা সমাচ্ছন্ন হইলে সৈন্যগণ মুহূর্ত্তকাল নিশ্চেষ্ট হইয়া রহিল। ক্ষণেক পরে ভগবান কুমুদিনীনায়ক [চন্দ্র] অন্ধকার নিরাকৃত করিয়া নভোমণ্ডলে সুমদিত হইলেন, রজনী নির্ম্মল হইল ও ক্ষত্ৰিয়গণ আলোক-লাভে পুলকিত হইয়া পুনর্ব্বার ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ করিলেন। তখন আর কেহ কাহার নয়নগোচর হইল না। ইত্যবসরে ত্রিগর্ত্তাধিপতি সুশৰ্মা কনিষ্ঠ ভ্রাতার সহিত রথারোহণ করিয়া মৎস্যরাজ বিরাটের অভিমুখে ধাবমান হইলেন এবং সত্বরে রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া গদাগ্রহণপূর্ব্বক ক্ৰোধাভরে রথ-সকল চূৰ্ণ করিতে লাগিলেন। তখন বিরাটসেনা রোষাবিষ্ট হইয়া গদা, খড়্গ, পরশু ও সুতীক্ষ্ন পাশ হস্তে লইয়া ত্রিগর্ত্তদিগের প্রতি ধাবমান মহারাজ সুশৰ্মা স্বীয় বলবীৰ্য্যপ্রভাবে মৎস্যসেনাগণকে মন্থন ও পরাজয় করিয়া মহাবেগে বিরাটের প্রতি ধাবমান হইলেন এবং তাহার পার্ষ্ণি [পার্শ্বরক্ষক] ও সারথি সংহারপূর্ব্বক তাঁহাকে রথচ্যুত ও স্বীয় রথে আরোপিত করিয়া মহাবেগে নিজনগরাভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। মৎস্যসেনাগণ তদর্শনে নিতান্ত ভীত ও ত্ৰিগর্ত্তদিগের বলবীৰ্য্যে একান্ত পীড়িত হইয়া রণ পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়ন করিতে লাগিল।
তখন মহারাজ যুধিষ্ঠির ভীমসেনকে কহিলেন, “বৃকোদর! ঐ দেখ ত্রিগর্ত্তাধিপতি সুশৰ্মা মৎস্যরাজকে লইয়া প্রস্থান করিতেছেন। তুমি সত্বর উহাকে মোচন কর, উনি যেন কদাচ বিপক্ষের বশীভূত না হয়েন। আমরা উহার অধিকারে সর্ব্বকামসম্পন্ন হইয়া পরমসুখে বাস করিয়াছি; অতএব এক্ষণে তুমি উহাকে উদ্ধার করিয়া তাঁহার সমুচিত নিষ্ক্রয় [প্রত্যুপকার] প্রদান কর।
ভীমসেন কহিলেন, “মহারাজ! আমি আপনার নির্দেশানুসারে বিরাটকে শক্ৰহস্ত হইতে পরিত্ৰাণ করিব। আমি একাকী স্বীয় বাহুবলপ্রভাবে শক্রগণের সহিত সংগ্রাম করি; আপনি ভ্রাতৃগণের সহিত একান্তে অবস্থিত হইয়া আমার অদ্ভূত কর্ম্মসমুদয় প্রত্যক্ষ করুন। আমি সম্মুখস্থিত মহাস্কন্ধ পাদপ উৎপাটনপূর্ব্বক ইহা দ্বারা শত্ৰুগণকে বিদ্রাবিত করিব।” ভীমপরাক্রম ভীমসেন এই বলিয়া মত্ত মাতঙ্গের ন্যায় সেই বৃক্ষ নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন।
তখন যুধিষ্ঠির ভীমসেনকে কহিলেন, “হে ভীম! তুমি কদাচ এরূপ সাহস প্রকাশ করিও না। বৃক্ষ দ্বারা শত্ৰুগণকে পরাজয় করিলে সকলেই তোমার ঐ অলৌকিক কাৰ্য্য-দর্শনে তোমাকে জ্ঞাত হইবে; অতএব এক্ষণে পাদপোৎপাটনের প্রয়োজন নাই; ধনু, শক্তি খড়গ, পরশু প্রভৃতি অন্য কোন মনুষ্য-গ্রহণোচিত অস্ত্ৰ ধারণপূর্ব্বক অলক্ষিত রূপে অরাতিগণের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হও । মহাবল নকুল ও সহদেব তোমার চক্ররক্ষক [চতুষ্পার্শ্বের রক্ষক] হইবেন। তুমি অনতিবিলম্বে মৎস্যরাজকে মোচন কর।”
তখন মহাবল-পরাক্রান্ত ভীমসেন শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক বারিধারার ন্যায় অনবরত শরবর্ষণ করিয়া “তিষ্ঠ তিষ্ঠ” বলিয়া মহাবেগে সুশৰ্মার অভিমুখে ধাবমান হইলেন এবং বিরাটরাজের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া তাহাকে অভয় প্রদান করিলেন। সুশৰ্মা কালান্তক যমোপম ভীমসেনকে পশ্চাদ্ভাগে নিরীক্ষণ করিয়া অতিশয় ব্যাকুল হইয়া ভ্রাতৃগণ-সমভিব্যাহারে প্রত্যাবর্ত্তন ও শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক তাঁহার সহিত ঘোরতর সংগ্রাম করিতে লাগিলেন।
অনন্তর ভীমসেন নিমেষমাত্র বিরাট-সন্নিধানে সহস্ৰ সহস্র রথ, গজ, অশ্ব ও মহাবল-পরাক্রান্ত ধনুৰ্দ্ধরগণকে সংহার করিলেন এবং শক্রগণের হস্ত হইতে গদা গ্রহণপূর্ব্বক পদাতিগণকে বিনাশ করিতে লাগিলেন। সমরবিশারদ সুশৰ্মা তাদৃশ ঘোরতর যুদ্ধ-সন্দর্শনে বিস্ময়াপন্ন হইয়া মনে করিলেন, ‘এ কে সহসা আমার সৈন্যমধ্যে আগমন করিল? দেখিতেছি, আমার সৈন্য প্রায় নিঃশেষিত হইয়াছে।” এইরূপ চিন্তা করিয়া পরিশেষে শরাসন আকৰ্ণ আকর্ষণপূর্ব্বক অনবরত সুতীক্ষ্ন শরনিকর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। তখন পাণ্ডবেরা ক্রুদ্ধ হইয়া ক্রোধাভরে ত্ৰিগর্ত্তদিগের প্রতি ধাবমান হইয়া শরপ্রয়োগ আরম্ভ করিলেন। বিরাটের পুত্ৰ ও পাণ্ডবগণকে যুদ্ধে উদ্যত উৎসাহ সহকারে ক্রোধাভরে যুদ্ধ করিতে লাগিলেন।
রাজা যুধিষ্ঠির এক সহস্ৰ, ভীমসেন সপ্ত সহস্ৰ, নকুল সপ্ত শত এবং সহদেব ত্রিশত সৈন্য সংহার করিলেন। তৎপরে মহাবীর সহদেব যুধিষ্ঠিরের আদেশানুসারে আয়ুধ উদ্যত করিয়া সুশৰ্মার সম্মুখীন হইলেন; রাজা যুধিষ্ঠিরও সত্বর সুশর্ম্মার প্রতি ধাবমান হইয়া তাহাকে নয়টি ও তাঁহার অশ্বচতুষ্টয়কে চারিটি বাণ দ্বারা বিদ্ধ করিলেন।
তখন মহাবল-পরাক্রান্ত বৃকোদর সুশর্ম্মার অভিমুখে গমনপূর্ব্বক তদীয় অশ্বগণকে প্রোথিত ও পৃষ্ঠরক্ষকদিগকে বিনষ্ট করিয়া রথ হইতে সারথিকে পাতিত করিলেন। সুবিখ্যাত চক্ররক্ষক মদিরাক্ষ সুশর্ম্মাকে রথচ্যুত দেখিয়া প্রহার করিতে লাগিল।
ইত্যবসরে বিরাটরাজ সত্বর সুশৰ্মার রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া তাঁহারই গদা গ্রহণপূর্ব্বক দ্রুতপদে তদাভিমুখে ধাবমান হইলেন। এবং বৃদ্ধ হইয়াও তরুণের ন্যায় রণস্থলে ভ্ৰমণ করিতে লাগিলেন। অনন্তর ভীমসেন সুশর্ম্মাকে পলায়ন করিতে দেখিয়া কহিলেন, “হে রাজকুমার! প্রতিনিবৃত্ত হও; রণস্থল হইতে পলায়ন করা তোমার কর্ত্তব্য নহে। তোমাকে ধিক! তুমি এইরূপ বলবীৰ্য্যসম্পন্ন হইয়া গোধন অপহরণ করিতে আগমন করিয়াছিলে! এখন অনুচরবর্গকে শত্ৰুগণমধ্যে পরিত্যাগ করিয়া কি নিমিত্ত বিষণ্ন হইতেছ?” মহাবীর সুশৰ্মা ভীমসেনের এই কথা শ্ৰবণ করিবামাত্ৰ সহসা প্রতিনিবৃত্ত হইয়া “তিষ্ঠ তিষ্ঠ” বলিয়া তাঁহার অভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। ভীমপরাক্রম ভীমসেন তৎক্ষণাৎ রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া সুশর্ম্মার বিনাশসাধনার্থ মহাবেগে তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন এবং সিংহ যেমন ক্ষুদ্র মৃগকে আক্রমণ করে, তদ্রূপ সুশর্ম্মার কেশপাশ গ্রহণপূর্ব্বক রোষাভরে তাঁহাকে শূন্যে উত্তোলিত ও মহীতলে নিস্পিষ্ট করিয়া তাঁহার মস্তকে পাদপ্রহার, অরত্নি দ্বারা জঙঘা—গ্রহণ ও বক্ষে জানুপ্ৰদান করিলেন। সুশৰ্মা প্ৰহারিবেগে নিতান্ত পীড়িত হইয়া মূৰ্ছাপন্ন হইলেন। ত্ৰিগৰ্তসেনাগণ তদর্শনে প্রাণভয়ে একান্ত ভীত হইয়া পলায়ন করিতে লাগিল! এইরূপে মহারথ পাণ্ডবগণ সুশর্ম্মাকে পরাজয় ও বিরাটের গোধন প্রত্যাহরণপূর্ব্বক সকলে একস্থানে উপস্থিত হইলেন। তখন ভীমসেন কহিলেন, “এই পাপাত্মাকে জীবিত রাখিতে আমার বাসনা নাই; কিন্তু রাজা নিতান্ত দয়াশীল, সুতরাং আমি এক্ষণে ইহার কি করিতে পারি?” এই বলিয়া তিনি ধূল্যবলুষ্ঠিতকলেবর বিচেতন সুশৰ্মার গলগ্রহণপূর্ব্বক সংযত রথে আরোপিত করিলেন এবং রণমধ্যস্থিত রাজা যুধিষ্ঠিরের সন্নিকটস্থ হইয়া সন্দর্শন করাইলেন। ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির সুশর্ম্মাকে দেখিবামাত্র হাস্যমুখে ভীমসেনকে কহিলেন, “হে ভীম! তুমি ইহাকে মুক্ত কর।” ভীম তদীয় আজ্ঞা শ্রবণানন্তর সুশর্ম্মাকে কহিলেন, “অরে মূঢ, যদি তোর্ জীবিত থাকিতে বাসনা থাকে, তবে আমি যাহা কহিতেছি, শ্রবণ কর। আজি সভামধ্যে তোকে বিরাটরাজের দাস বলিয়া আপনার পরিচয় প্ৰদান করিতে হইবে, তাহা হইলে আমি তোকে পরিত্যাগ করিব। কারণ, যুদ্ধে পরাজিত ব্যক্তির প্রতি এইরূপই ব্যবহার করিতে হয়।” তখন রাজা যুধিষ্ঠির প্রণয়সম্ভাষণপূর্ব্বক ভীমসেনকে কহিলেন, “হে ভ্ৰাতঃ! যদি আমায় তোমার আস্থা থাকে, তাহা হইলে অবিলম্বে ইহাকে পরিত্যাগ কর। এ এক্ষণে বিরাটরাজের দাসত্ব প্ৰাপ্ত হইয়াছে।” এই বলিয়া তিনি সুশর্ম্মাকে কহিলেন, “এক্ষণে তুমি দাসত্ব হইতে মুক্ত হইলে; আর কদাচ এরূপ করিও না।”