মৃতব্যক্তিগণের স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান
বৈশম্পায়ন বলিলেন, অনন্তর সেই নিষ্পাপ ক্রোধমাৎসৰ্য্যবিহীন কুরু-পাণ্ডবপক্ষীয় বীরসমুদয় দেবগণের ন্যায় পুলকিতচিত্তে পরস্পর সম্ভাষণ করিতে লাগিলেন। ঐ সময় পুত্র পিতামাতার সহিত, ভাৰ্য্যা পতির সহিত, ভ্রাতা ভ্রাতার সহিত ও সখা সখার সহিত মিলিত হইল। পাণ্ডবগণ মহাধনুর্দ্ধর কর্ণ, অভিমন্যু ও দ্রৌপদেয়গণের সহিত সমবেত হইয়া প্রীতমনে পরস্পর সুহৃদ্ভাবে অবস্থান করিতে লাগিলেন এবং যোধগণ মহর্ষি বেদব্যাসের প্রসাদে বৈরভাব পরিত্যাগপূৰ্ব্বক পরস্পর সুহৃদ্ভাব অবলম্বন করিয়া অগাধ আনন্দসাগরে নিমগ্ন হইলেন। এইরূপে কৌরব ও অন্যান্য ভূপালগণ স্ব স্ব পুত্র ও বান্ধবগণের সহিত সমবেত হইয়া স্বর্গবাসী রাজাদিগের ন্যায় পরমসুখে সে রাত্রি যাপন করিতে লাগিলেন। ঐ রজনীতে তথায় শোক, ভয়, ত্রাস, অসন্তোষ ও অযশের লেশমাত্রও ছিল না। সমাগত রমণীগণ স্ব স্ব পিতা ও পতির সহিত মিলিত হইয়া পরম সুখ অনুভব করিয়াছিলেন।
অনন্তর সেই রজনী অতিবাহিত হইলে, সমাগত বীরগণ স্ব স্ব পত্নী ও অন্যান্য আত্মীয়গণকে আলিঙ্গনপূৰ্ব্বক যথাস্থানে প্রস্থান করিতে উদ্যত হইলেন। ভগবান্ বেদব্যাসও তাঁহাদের অভিপ্রায় অবগত হইয়া তাঁহাদিগকে গমনে অনুমতি করিলেন। তখন তাঁহারা সকলেই স্ব স্ব রথধ্বজের সহিত ভাগীরথীর সলিলে অবগাহনপূৰ্ব্বক অন্তর্হিত হইয়া কেহ কেহ দেবলোকে, কেহ কেহ ব্রহ্মলোকে, কেহ কেহ বরুণলোকে, কেহ কেহ কুবেরলোকে ও কেহ কেহ সূৰ্য্যলোকে গমন করিলেন। রাক্ষস ও পিশাচদিগের মধ্যে কেহ কেহ উত্তরকুরুতে এবং কেহ কেহ অন্যান্য স্থানে প্রস্থান করিল।
কুরুকামিনীগণের কলেবরত্যাগ—পতিলোকলাভ
এইরূপে সেই বীরসমুদয় অদৃশ্য হইলে, কুরুকুলহিতৈষী ধর্ম্মপরায়ণ মহাত্মা বেদব্যাস বিধবা রমণীগণকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে সীমন্তিনীগণ! তোমাদের মধ্যে যাহার যাহার পতিলোকলাভে বাসনা আছে, তাহারা অবিলম্বে এই জাহ্নবীজলে অবগাহন কর।” বেদব্যাস এই কথা কহিবামাত্র পতিব্রতা কৌরবকামিনীগণ সেই গঙ্গাজলে অবগাহন করিয়া অচিরাৎ মানুষদেহ হইতে মুক্তিলাভ ও দিব্যমূৰ্ত্তিধারণপূৰ্ব্বক দিব্য-আভরণ ও দিব্যমাল্যে বিভূষিত হইয়া বিমানারোহণে পতিলোকে প্রস্থান করিলেন। উঁহারা পরলোকে গমন করিলে তত্ৰত্য অন্যান্য ব্যক্তিগণ যিনি যাহা প্রার্থনা করিলেন, ভগবান্ বেদব্যাস তাঁহাকে তাহাই প্রদান করিতে লাগিলেন। ঐ সময় সেই নিহত ভূপতিদিগের পুনরাগমনবৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া নানা দেশস্থ মানবগণের আহ্লাদের পরিসীমা রহিল না।
যে ব্যক্তি শ্রদ্ধান্বিত হইয়া এই প্রিয়সমাগম-বৃত্তান্ত শ্রবণ করেন, তিনি উভয়লোকেই প্রিয়বস্তুসমুদয় লাভ করিয়া, বান্ধবগণের সহিত সুস্থশরীরে পরমসুখে কাল হরণ করিতে সমর্থ হয়েন। যে মহাত্মা অন্যকে ইহা শ্রবণ করান, তাঁহার ইহলোকে যশঃ ও পরলোকে উৎকৃষ্ট গতিলাভ হইয়া থাকে। মানবগণ স্বাধ্যায়সম্পন্ন, তপানুষ্ঠাননিরত, শমগুণান্বিত, সদাচার, দানশীল, সরলস্বভাব, শুচি, হিংসাবিহীন, সত্যপরায়ণ, আস্তিক ও শ্রদ্ধান্বিত হইয়া এই অদ্ভুত ব্যাপার শ্রবণ করিলে নিঃসন্দেহেই উৎকৃষ্ট গতি লাভ করিতে পারেন।