৩৩তম অধ্যায়
দুৰ্য্যোধনকর্ত্তৃক শল্যের কর্ণসারথ্য প্রার্থনা
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! দুৰ্য্যোধন কর্ণকে এই বলিয়া বিনয়পূর্ব্বক মহারথ মদ্ররাজের সমীপে গমন করিয়া তাঁহাকে প্রণয়পুরস্কারে কহিলেন, ‘হে মদ্ররাজ। আপনি সত্যব্রত, শত্রুপাতন ও অরাতিসৈন্যের ভয়ঙ্কর। মহাবীর কর্ণ প্রধান প্রধান ভূপালগণের মধ্যে আপনাকে যেরূপে বরণ করিয়াছেন, তাহা আপনার শ্রুতিগোচর হইয়াছে। এক্ষণে আমি নতশিরাঃ ও বিনীত হইয়া শত্রুনাশার্থ আপনার নিকট প্রার্থনা করিতেছি, আপনি প্রণয়ানুরোধে পার্থবিনাশ ও আমার হিতসাধন করিবার নিমিত্ত কর্ণের সারথ্যকাৰ্য্য স্বীকার করুন। আপনি সারথির পদে অভিষিক্ত হইলে সূতপুত্র অনায়াসে শত্রুগণকে পরাজিত করিতে পারিবেন।
হে মহাত্মন্! আপনি বাসুদেবের সমান, সুতরাং আপনি ভিন্ন আর কেহই কর্ণের অশ্বরশ্মি ধারণ করিবার উপযুক্ত নহে; অতএব কমলযোনি যেমন মহেশ্বরকে ও কৃষ্ণ যেমন বিপন্ন অর্জ্জুনকে রক্ষা করেন, আপনি সেইরূপ কর্ণকে পরিত্রাণ করুন। হে মদ্ররাজ! পুর্ব্বে বীৰ্য্যবান্ ভীষ্মদেব, দ্রোণাচার্য্য, কৃপাচার্য্য, কর্ণ, ভোজরাজ, শকুনি, অশ্বত্থামা, আপনি ও আমি আমরা অরাতিসৈন্যগণকে নিহত করিবার নিমিত্ত নয়ভাগে বিভক্ত হইয়াছিলাম। এক্ষণে ভীষ্ম ও দ্রোণের অংশ উন্মুলিত হইয়াছে। মহাবীর শান্তনুতনয় ও আচাৰ্য্য স্ব স্ব হন্তব্য [বধযোগ্য] সৈন্যগণকে নিহত করিয়া অন্যান্য অসংখ্য অরাতির প্রাণসংহার করিয়া পরিশেষে কেবল বিপক্ষদিগের ছলপ্রভাবে প্রাণপরিত্যাগপূর্ব্বক স্বর্গারোহণ করিয়াছেন। অস্মপক্ষীয় অন্যান্য প্রধান প্রধান যোধগণও যথাশক্তি আমাদের হিতসাধন করিয়া সমরে অরাতিহস্তে নিপাতিত হইয়া স্বর্গারূঢ় হইয়াছেন! হে রাজন্। পাণ্ডবগণ পূর্ব্বে, অল্পসংখ্যক হইয়াও আমাদের অধিকাংশ সেনা নিহত করিয়াছে। এক্ষণে সেই সত্যবিক্রম পাণ্ডুপুত্রগণ যাহাতে আমাদের অধিকাংশ সেনার হতাবশিষ্টগণকে বিনষ্ট করিতে না পারে, আপনি তাহার উপায় করুন। হে মদ্ররাজ। মহাবাহু কর্ণ ও আপনি আপনারা দুইজনেই সৰ্ব্বলোকাতিগামী, মহারথ ও আমাদের হিতানুষ্ঠান নিরত। অদ্য মহাবীর রাধেয় অর্জ্জুনের সহিত যুদ্ধ করিতে বাঞ্ছা করিতেছেন। তন্নিবন্ধন আমাদের জয়াশাও বলবতী হইয়াছে; কিন্তু উহার অশ্বরশ্মি গ্রহণ করে, পৃথিবীতে আপনি ভিন্ন আর কাহাকেও এমন দেখিতে পাই না। অতএব বাসুদেব সমরে যেরূপ পার্থের অশ্বরশ্মি গ্রহণ করেন, আপনিও সেইরূপ কর্ণের অশ্বরশ্মি গ্রহণ করুন। অর্জ্জুন কৃষ্ণের সাহায্যে রক্ষিত হইয়া যে সমস্ত কার্য্যানুষ্ঠান করে, তাহা আপনি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিয়াছেন। পূর্ব্বে ধনঞ্জয় অন্যান্য বিপক্ষগণের সহিত সমরে প্রবৃত্ত হইয়া এরূপ শত্রুক্ষয় করিতে সমর্থ ছিল না; এক্ষণে কেবল কৃষ্ণের সহিত মিলিত হইয়াই সমধিক বিক্রমসহকারে প্রতিদিন কৌরবসেনা বিভ্রাবিত করিতেছে। হে মদ্ররাজ! এক্ষণে কর্ণের ও আপনার হন্তব্য অরাতিসৈন্যের অল্প অংশ অবশিষ্ট রহিয়াছে; অতএব দিবাকর যেরূপ অরুণের সহিত মিলিত হইয়া অন্ধকার ধ্বংস করেন, তদ্রূপ আপনিও কর্ণের সহিত মিলিত হইয়া যুগপৎ সেই অংশদ্বয় বিনষ্ট করিয়া অর্জ্জুনকে নিহত করুন। পাণ্ডবপক্ষীয় মহারথগণ উদিত বালসূৰ্য্যদ্বয়ের ন্যায় কর্ণকে ও আপনাকে সন্দর্শন করিয়া পলায়ন করুক। যেরূপ সূৰ্য্য ও অরুণের দর্শনে অন্ধকার তিরোহিত হয়, তদ্রূপ পাণ্ডব, পাঞ্চাল ও সৃঞ্জয়গণ আপনাদিগকে দেখিয়া বিনষ্ট হউক। কর্ণ রথীগণের অগ্রগণ্য, আপনিও সারথিশ্রেষ্ঠ, বিশেষতঃ সমরে আপনার তুল্য আর কাহাকেও দৃষ্ট হয় না। অতএব বাসুদেব যেমন সকল অবস্থাতে অর্জ্জুনকে রক্ষা করেন, আপনিও সেইরূপে সমরে কর্ণকে পরিত্রাণ করুন। আমি নিশ্চয় কহিতেছি যে, আপনি সারথি হইলে পাণ্ডবগণের কথা দুরে থাকুক, ইন্দ্রাদি দেবগণও কর্ণকে পরাজিত করিতে পারিবেন না।
কর্ণের সারথ্যপ্রস্তাবে শল্যের ক্রোধ
“হে মহারাজ! কুল, ঐশ্বৰ্য্য, শাস্ত্রজ্ঞান ও বলমদে মত্ত মদ্ররাজ শল্য দুর্য্যোধনের বাক্যশ্রবণে ক্রোধান্ধ হইয়া ললাটে ত্ৰিশিখ ভ্রূকুটি বিস্তারপূর্ব্বক বারংবার করযুগল বিকম্পিত ও রোষারুণ নেত্ৰদ্বয় পরিবর্তিত করিয়া কহিতে লাগিলেন, ‘হে কুরুরাজ! তুমি আমাকে নিঃশঙ্কচিত্তে সারথ্যকাৰ্য্য স্বীকার করিতে অনুরোধ করাতে স্পষ্টই বোধ হইতেছে যে, তুমি আমাকে হীনবীৰ্য্য জ্ঞান করিয়া অবমাননা করিতেছ। তুমি কর্ণকে আমা হইতে সমধিক বলশালী বিবেচনা করিয়া তাহার প্রশংসা করিতেছ; কিন্তু আমি তাহাকে সমকক্ষ ব্যক্তি বলিয়া গণনাই করি না। এক্ষণে তুমি আমাকে কর্ণ অপেক্ষা অধিক অংশ নির্দেশ করিয়া দাও। আমি উহা অনায়াসে পরাজিত করিয়া স্বস্থানে গমন করিব অথবা আমি এক্ষণে একাকীই যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া শত্ৰু সংহার করিতেছি; তুমি আমার বাহুবল অবলোকন কর। হে মহারাজ! তুমি নিশ্চয় জানিবে যে, মাদৃশ ব্যক্তি কখনই অবমানিত হইয়া সংগ্রামে প্রবৃত্ত হয় না; আর যুদ্ধে আমার অবমাননা করাও তোমার কর্ত্তব্য নহে। দেখ, আমার বাহুযুগল নিতান্ত স্থূল ও বজ্রের ন্যায় সুদৃঢ়। আমার শরাসন বিচিত্র, শরনিকর ভুজগের ন্যায় একান্ত ভয়ঙ্কর; রথ সুসজ্জিত ও বায়ুবেগগামী তুরঙ্গমে সংযোজিত এবং গদা সুবর্ণপট্টসমলঙ্কৃত। আমি স্বীয় তেজঃপ্রভাবে সমগ্র মহীমণ্ডল বিদীর্ণ, মহীধরসকল বিক্ষিপ্ত এবং সমুদ্রসকল শুষ্ক করিতেও অসমর্থ নহি। হে মহারাজ! আমি এইরূপ মহাবলপরাক্রান্ত ও শত্রুনিগ্রহে সুদক্ষ; তুমি তথাপি কি নিমিত্ত আমাকে নীচকুলোৎপন্ন কর্ণের সারথ্যকাৰ্য্যে নিয়োগ করিতেছ? আমাকে অকাৰ্য্যে নিয়োগ করা তোমার কর্ত্তব্য নহে। শ্রেষ্ঠতর পুরুষ, নীচব্যক্তির দাসত্ব স্বীকার করিতে কদাচ উৎসাহিত হয় না; প্রীতিপূর্ব্বক সমাগত ও বশীভূত মহব্যক্তিকে নীচাশয় পুরুষের আয়ত্ত করিয়া রাখিলে উৎকৃষ্ট ও অপকৃষ্টের বৈপরীত্যকরণজনিত গুরুতর পাপের অনুষ্ঠান করা হয়। বেদে এইরূপ নির্দ্দিষ্ট আছে যে, ব্রাহ্মণগণ ব্রহ্মার মুখ হইতে, ক্ষত্রিয়েরা বাহু হইতে, বৈশ্যেরা উরুদ্বয় হইতে এবং শুদ্র পাদযুগল হইতে প্রাদুর্ভূত হইয়াছেন। এই বর্ণচতুষ্টয়ের পরস্পর ভিন্নবর্ণসংযোগে অনুলোমজ [বিপরীত ব্যবহার—উল্টা করা] ও প্রতিলোমজ [অনুলোমের বিপরীত উচ্চজাতীয় নারীতে অপেক্ষাকৃত নীচজাতীয় পুরুষজাত] সঙ্করজাতিসকল সমুৎপন্ন হইয়াছে। অর্থসংগ্রহ, দান ও প্রজাপালন—এই কয়েকটি ক্ষত্রিয়ের ধর্ম্ম; যাজন, অধ্যাপন, বিশুদ্ধ প্রতিগ্রহ ও লোকের প্রতি অনুগ্রহপ্রদর্শনই ব্রাহ্মণের ধর্ম্ম; কৃষিকাৰ্য্য, পশুপালন ও ধর্ম্মতঃ দান—এই কয়েকটি বৈশ্যের ধর্ম্ম এবং ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের পরিচর্য্যা করাই শূদ্রের পরমধর্ম্ম বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। সূতেরাও ক্ষত্রিয়ের পরিচারক। অতএব সূতের শুশ্রুষা করা ক্ষত্রিয়ের কাৰ্য্য নহে। আমি মূৰ্দ্ধাভিষিক্ত, রাজর্ষি কুলসম্ভূত, মহারথ এবং বন্দিগণের সেবনীয় ও স্তুতিভাজন; সুতরাং সংগ্রামে সূতপুত্রের সারথ্যস্বীকার করা আমার নিতান্ত অকৰ্ত্তব্য। হে মহারাজ! আজ আমি ত্বৎকৃত অপমান সহ্য করিয়া কখনই যুদ্ধ করিব না, অতএব এক্ষণে বিদায় দাও, স্বগৃহে প্রস্থান করি।’ এই বলিয়া মহাবীর শল্য অবিলম্বে ক্রোধভরে ভূপালগণমধ্য হইতে উত্থিত হইয়া গমন করিতে লাগিলেন।
দুৰ্য্যোধনস্তবতুষ্ট শল্যের কর্ণসারথ্য স্বীকার
“তখন মহারাজ দুৰ্য্যোধন শল্যের প্রতি প্রণয় ও বহুমাননিবন্ধন তাঁহার করগ্রহণ করিয়া শান্তভাবে সর্ব্বার্থসাধন, মধুরবাক্যে কহিতে লাগিলেন, হে মদ্ররাজ! আপনি যাহা কহিতেছেন, তদ্বিষয়ে আর কিছুমাত্র সংশয় নাই; কিন্তু আমি যে অভিপ্রায়ে আপনাকে সারথি হইতে অনুরোধ করিতেছি, তাহা শ্রবণ করুন। কর্ণ আপনার অপেক্ষা কখনই সমধিক বলশালী নহেন এবং আমিও আপনাকে হীন বলিয়া আশঙ্কা করি না। হে মাতুল! আপনি যাহা কহিতেছেন, তাহা কদাচ মিথ্যা হইবার নহে। আমার মতে আপনার পূর্ব্বপুরুষেরা কদাচ অনৃতবাক্য [মিথ্যা] প্রয়োগ করিতেন না। এই নিমিত্ত আপনার নাম আৰ্ত্তায়নি বলিয়া প্রখ্যাত হইয়াছে। আপনি যুদ্ধে শত্রুগণের শল্যস্বরূপ; এই নিমিত্ত শল্যনামে প্রসিদ্ধ হইয়াছেন। অতএব আপনি পূর্ব্বে যাহা কহিয়াছেন, আমার হিতার্থ তাহার অনুষ্ঠান করুন। আমি বা কর্ণ আমরা কেহই আপনার অপেক্ষা সমধিক বলশালী নহি। হে মহাত্মন্! আমি কর্ণকে ধনঞ্জয় অপেক্ষা এবং আপনাকে বাসুদেব অপেক্ষা সমধিক গুণশালী জ্ঞান করিয়া থাকি। মহাবীর সূতপুত্র অস্ত্রযুদ্ধে ধনঞ্জয় অপেক্ষা উৎকৃষ্ট এবং আপনিও বাসুদেব অপেক্ষা দ্বিগুণ অশ্ববিদ্যাভিজ্ঞ ও সমধিক বলবীৰ্য্যসম্পন্ন। আমি এই নিমিত্তই এক্ষণে আপনাকে উৎকৃষ্ট অশ্বসমুদয়ের যন্তৃপদে [পরিচালক-সারথি] ববণ করিতে অভিলাষ করি।’
“হে মহারাজ! মহাবীর শল্য দুর্য্যোধনের বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, ‘কুরুরাজ! তুমি আমাকে সৈন্যগণমধ্যে যে দেবকীপুত্র অপেক্ষা উৎকৃষ্ট বলিয়া কীৰ্ত্তন করিলে, ইহাতেই, আমি তোমার প্রতি অতিমাত্র প্রীত হইলাম। এক্ষণে আমি তোমার অভিলাষানুসারে ধনঞ্জয়ের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত সূতপুত্রের সারথ্য স্বীকার করিতেছি, কিন্তু উহার সহিত আমার এই একটি নিয়ম নির্দ্দিষ্ট রহিল যে, আমি উহারই সমক্ষে স্বেচ্ছানুসারে বাক্য প্রয়োগ করিব।’ হে মহারাজ! তখন আপনার আত্মজ দুৰ্য্যোধন ও কর্ণ ইঁহারা তৎক্ষণাৎ তাঁহার বাক্য স্বীকার করিলেন।”