হেনমতে যত রথ রথী মহাবীরে।
একে একে দেখালেন অর্জ্জুন উত্তরে।।
পুনরপি উত্তরেরে কহে মহামতি।
কর্ণের সম্মুখে রথ লহ শীঘ্রগতি।।
আকাশ হইতে শীঘ্র তারা যেন ছুটে।
চালাইয়া দিল রথ কর্ণের নিকটে।।
কর্ণের সম্মুখে ছিল যত রথিগণ।
অর্জ্জুন উপরে করে বাণ বরিষণ।।
শেল শূল শক্তি জাঠি মুষল মুদগর।
পরশু ভূষণ্ডী ভিন্দিপাল যে তোমর।।
বরিষাকালেতে যেন বর্ষে জলধর।
ঝাঁকে ঝাঁকে চতুর্দ্দিকে পড়িছে তোমর।।
পর্ব্বত-আকার হস্তী ভীষণ-দর্শন।
চরণে কম্পিত ক্ষিতি, জলদ গর্জ্জন।।
দেখিয়া হাসিয়া বীর কুন্তীর নন্দন।
দিব্য অস্ত্র গাণ্ডীবেতে যোড়েন তখন।।
না হতে নিমেষ পূর্ণ, ছাড়িতে নিশ্বাস।
শরজাল করি প্রপূরিল দিকপাশ।।
বরিষাকালেতে যেন বরিষয়ে মেঘে।
দিনকর-তেজ যেন সর্ব্ব ঠাঁই লাগে।।
পদাতি কুঞ্জর রথী যত হয়গণ।
জর্জ্জর করিয়ে বিন্ধে ইন্দ্রের নন্দন।।
চালায় সারথি রথ অতি বিচক্ষণ।
ক্ষিপ্রগামী মনোজব জিনিয়া পবন।।
বামে দক্ষিণেতে ক্ষণে আগে পিছে ছুটে।
ভূমিতে ক্ষণেক পড়ে, ক্ষণে শূণ্যে উঠে।।
ক্ষণেক ভিতরে যায়, ক্ষণেক বাহির।
রথবেগে পড়ি গেল বহু মহাবীর।।
মৃগেন্দ্র বিহরে যেন গজ্ন্দ্রে মণ্ডলে।
নাগে নাগান্তক যেন মারে কতূহলে।।
কাটিল রথের ধ্বজ সারথি সহিত।
খণ্ড খণ্ড হয়ে ক্রমে পড়ে চতুর্ভিত।।
ধনুর সহিত বাম হাত ফেলে কাটি।
বুকে বাজি পড়ে কেহ, কামড়ায় মাটি।।
অস্ত্রানলে দগ্ধ কেহ, করে ছটফটি।
কাটিয়া ফেলিল কারো দন্ত দুই পাটি।।
শ্রবণ নাসিকা গেল, দেখি বিপরীত।
কাটিয়া ফেলিল মুণ্ড কুণ্ডল সহিত।।
মধ্যদেশ কাটি পাড়ে কত শত বীর।
অস্ত্রাঘাতে কোন রথী উভে হৈল চীর।।
কাটিল রথের ধ্বজ করি খণ্ড খণ্ড।
মধ্য চক্রে কাটিলেন সারথির মুণ্ড।।
তীক্ষ্ণবাণাঘাতে মত্ত কুঞ্জর সকল।
আর্ত্তনাদ করি পড়ে মন্থি বহু দল।।
চক্রাকারে ভ্রমি পড়ে ভূমে দিয়া দন্ত।
পেটেতে বাজিয়া কার, বাহিরায় অন্ত্র।।
এইমত মহামার করিল ফাল্গুনি।
সকল সৈন্যেরে বিন্ধি করিল চালনি।।
দুই দুই অঙ্গুলি অন্তরে অঙ্গ ছেদি।
পড়িল অনেক সৈন্য, রক্তে বহে নদী।।
বিচিত্র হইল শোভা ধরণীর তলে।
পড়িল অনেক সৈন্য, রক্তে বহে নদী।।
বিচিত্র হইল শোভা ধরণীর তলে।
অশোক কিংশুক যেন বসন্তের কালে।।
একেশ্বর ধনঞ্জয় কুরুসৈন্য দলি।
মহাবাতাঘাতে যেন পড়িল কদলী।।
কালাগ্নি সমান শিক্ষা দেখি পার্থ বীর।
চক্ষু মেলি কার শক্তি চাহিবারে পারে।।
মারিয়া সকল সৈন্য পার্থ ধনুর্দ্ধর।
চালাইয়া দেন রথ কর্ণের গোচর।।
কর্ণের অঙ্গজ ছিল বিকর্ণ নামেতে।
আগুলিল পার্থে আসি ধনুঃশর হাতে।।
হাসেন অর্জ্জুন বীর দেখিয়া বিকর্ণ।
ভুজঙ্গে পাইল যেন বুভুক্ষু সুপর্ণ।।
দুই বাণে ধ্বজ ধনু কাটিয়া তাহার।
অর্দ্ধচন্দ্র বাণে কুণ্ড কাটিলেক তার।।
বিকর্ণ পড়িল, দেখি কর্ণে হৈল ক্রোধ।
টঙ্কারিয়া ধনুর্গুণ যায মহাযোধ।।
সিংহ দেখি সিংহ যেন করেয়ে গর্জ্জন।
দুই মত্ত হস্তী যেন হস্তিনী কারণ।।
চিরকাল স্ববাঞ্ছিত মিলাইল বিধি।
দরিদ্র পাইল যেন মহারত্ন নিধি।।
দোঁহে দোঁহে দোঁহাকার হইল হরষ।
কর্ণে চাহি ধনঞ্জয় বলেন কর্কশ।।
রাধাসুত ত্যজ গর্ব্ব, ত্যজ সিংহনাদ।
আজি তব ঘুচাইব সংগ্রামের সাধ।।
তোমারে মারিব, সবে দেখুক নয়নে।
নিস্তেজ করিব আজি রাজা দুর্য্যোধনে।।
যখন কপটে দুষ্ট খেলাইলি পাশা।
মনে জাগে যত কিছু কৈলে কটুভাষা।।
সেই সব আজি তোমা করাব স্মরণ।
বহুদিনে তব সহ হৈল দরশন।।
হাসিয়া বলিল কর্ণ, দৈব বলবান।
যারে খুঁজি সেই জন এল বিদ্যমান।।
তোরে মারি পাণ্ডবের দর্প করি চূর্ণ।
দুর্য্যোধন-মনোরথ করিব যে পূর্ণ।।
এত বলি কর্ণবীর পূরিল সন্ধান।
অর্জ্জুন উপরে প্রহারিল দশ বাণ।।
গাণ্ডীব ধনুকে চারি, চারি অশ্বে চারি।
উত্তরের দুই ভুজে দুই অস্ত্র মারি।।
ছাড়েন বিংশতি বাণ ইন্দ্রের নন্দন।
দশ অস্ত্রে কর্ণ বীর কাটে সেইক্ষণ।।
পুনঃ ষড়বিংশ বাণ ছাড়েন কিরীটী।
সেই অস্ত্র কর্ণ বীর ফেলাইল কাটি।।
আকর্ণ পূরিয়া কর্ণ এড়ে পঞ্চ বাণ।
অর্দ্ধপথে পার্থ করিলেন দশ খান।।
দোঁহে দোঁহা অস্ত্র মারে, যেবা যত জানে।
বরিষাকালেতে যেন বর্ষে মেঘগণে।।
বজ্রের প্রহারে যেন পড়য়ে ঝঞ্ঝনা।
ঝাঁকে ঝাঁকে বৃষ্টি হয় আগুণের কণা।।
বাঁশবনে অগ্নি দিলে যথা শব্দ উঠে।
চট্ চট্ শব্দে অঙ্গে তথা অস্ত্র ফুটে।।
ঘন শঙ্খ পূরে ঘন ঘন হুহুঙ্কার।
শব্দেতে পূরিল ক্ষিতি ধনুক টঙ্কার।।
সহস্র সহস্র বাণ একবারে এড়ে।
অন্ধকার করি দোঁহাকার গায় পড়ে।।
দোঁহে অস্ত্র নিবারিছে, রণে বিচক্ষণ।
বায়ুতে উড়ায় যেন মেঘ বরিষণ।।
সাধু কর্ণ, বলি ডাকে যত কুরুবল।
সাধু পার্থ, বলি ডাকে অমর সকল।।
ক্রোধে পার্থ দিব্য অস্ত্র করেন সন্ধান।
কাটিয়া কর্ণের ধ্বজ করে খান খান।।
চারি অশ্ব কাটি তবে কাটে ধনুর্গুণ।
সারথির মাথা তবে কাটেন অর্জ্জুন।।
কর্ণেরে বিরথী করি সারথিরে নাশি।
ভীষ্ম দ্রোণ প্রতি চান, মুখে মৃদু হাসি।।
শীঘ্রতর অন্য রথ যোগায় সারথি।
আর ধনু লয় কর্ণ অতি শীঘ্রগতি।।
লজ্জিত হইয়া কর্ণ সর্পবাণ এড়ে।
সহস্র সহস্র সর্প পার্থেগিয়া বেড়ে।।
এড়েন গরুড়-বাণ ইন্দ্রের নন্দন।
ধরিয়া সকল ফণী করিল ভক্ষণ।।
অগ্নিবাণ এড়িলেন বীর ধনঞ্জয়।
দশদিক মহাতেজ ধরে অগ্নিময়।।
যেমন প্রলয়কালে সংহারিতে সৃষ্টি।
ঝাঁকে ঝাঁকে সৈন্যে হৈল হুতাশন-বৃষ্টি।।
পলায় সকল সৈন্য, কেহ নাহি রয়।
মেঘবাণে নিবারিল সূর্য্যের তনয়।।
ঘোর মেঘে বর্ষে যেন মুষলের ধার।
বায়ু-অস্ত্রে উড়ালেন ইন্দ্রের কুমার।।
হাসিয়া গন্ধর্ব্ব-বাণ এড়ে ধনঞ্জয়।
সকল সৈন্যের মধ্যে হৈল পার্থময়।।
রথে রথে, গজে গজে, হৈল মারামারি।
পড়িল অনেক সৈন্য হানাহানি করি।।
এইমত দুই বীর করিল সংগ্রাম।
চক্ষু পালটিতে দোঁহে না করে বিশ্রাম।।
দোঁহে মহাবীর্য্যবন্ত, কেহ নহে ঊন।
দৈববলে বলাধিক হইল অর্জ্জুন।।
ইন্দ্রদত্ত দিব্য অস্ত্র পূরিয়া সন্ধান।
একেবারে ছাড়িলেন অষ্টগোটা বাণ।।
দুই দুই ভুজে বক্ষে যুগল ললাটে।
চর্ম্ম ছেদি মর্ম্ম ভেদি অঙ্গে অস্ত্র ফুটে।।
ফুটিয়া কর্ণের অঙ্গে বহিল শোণিত।
রথেতে পড়িল কর্ণ হইয়া মূর্চ্ছিত।।
মূর্চ্ছিত দেখিয়া পার্থ সম্বরেন বাণ।
রথ লয়ে সারথি যে হৈল পাছুয়ান।।
কর্ণ-ভঙ্গ দেখি তবে যত কুরুশূর।
বেড়িল অর্জ্জুনে আসি হয়ে শতপুর।।
পদাতি মাতঙ্গ রথ রথী অতি বেগে।
নানা অস্ত্র শস্ত্র তারা ফেলে চতুর্দ্দিকে।।
পর্ব্বত আকার হস্তিগণ যূথে যূথ।
পার্থোপরি টোয়াইয়া দিলেক মাহুত।।
হাসিয়া গন্ধবর্ব-বাণ ছাড়েন কিরীটী।
পার্থরূপী মহাবীর সর্ব্বসৈন্য কাটি।।
আত্ম আত্ম সৈন্য ক্রমে হয় মারামারি।
পড়িল অনেক সৈন্য আর্ত্তনাদ করি।।
রথধ্বজ পতাকায় ঢাকিল মেদিনী।
মুকুট কুণ্ডল হার নানা রত্নমণি।।
সারি সারি পড়ে হস্তী, কত রথধ্বজ।
পড়িল দীঘলদন্ত লক্ষ লক্ষ গজ।।
মেঘ চাপ দেখি যেন পর্ব্বত উপরে।
পড়িল মাতঙ্গযূথ দারুণ প্রহারে।।
যেন মহাবাতে নিবারিল মেঘমালা।
সমুদ্র লহরী যেন নিবারিল ভেলা।।
অনন্ত ফণীন্দ্র যেন মন্থে সিন্ধুজল।
একাকী অর্জ্জুন মথিলেন কুরুবল।।
যে ছিল পলায় সবে লইয়া পরাণ।
অর্জ্জুনে দেখয়ে যেন শমন সমান।।
দেখিয়া বিরাট পুত্র মানিল বিস্ময়।
কৃতাঞ্জলি হয়ে তবে পার্থ প্রতি কয়।।
এ তিন ভুবনে এই অদ্ভুত কাহিনী।
চক্ষে কি দেখিব, কভু কর্ণে শুনিনু শ্রবণে।।
সাক্ষাতে দেখিনু আজি আপন নয়নে।
ক্ষত্র হয়ে হেন জন নহিবে নহিল।।
তোমার সারথি হৈনু, পূর্ব্বভাগ্য ছিল।।
এখন আমারে আজ্ঞা কর মহাশয়।
কোন্ ভিতে চালাইয়া দিব রথ-হয়।।
হাসিয়া কহেন পার্থ, কি কহ উত্তর।
কি দেখিলে, এখনি কি হইল সমর।।
দুরন্ত সাগরবৎ এ কৌরব-সেনা।
পার নাহি হইয়াছি, তার এক জনা।।
ওই দেখনীলবর্ণ যে রথ পতাকা।
কৃপাচার্য্য উনি হন মম পিতৃসখা।।
শীঘ্র রথ লহ মম তাঁহার সম্মুখে।
আমার হস্তের বেগ দেখাব তাঁহাকে।।
সপ্তকুম্ভ কমণ্ডলু ধ্বজ যাঁর রথে।
শীঘ্র রথ লহ মম তাঁহার অগ্রেতে।।
কুরুবংশ গুরু তিনি দ্রোণাচার্য্য নাম।
বহু বর্ষ পরে দেখা, করিব প্রণাম।।
যদি গুরুদেব মোরে করেন প্রহার।
আমিও হানিব অস্ত্র, নাহিক বিচার।।
তাঁর পাছে অশ্বত্থামা, রাজা দুর্য্যোধন।
তথা রথ লহ মম বিরাট-নন্দন।।
যে রথে বেষ্টিত শ্বেতচ্ছত্র সারি সারি।
যত রাজগণ আছে যোড়হাত করি।।
অমরকুলের যথা কর্ত্তা পিতামহ।
আমার কুলের তেন ইহারে জানহ।।
পৃথিবীর যত রাজা পদে করে পূজা।
মম পিতৃ-জ্যেষ্ঠতাত ভীষ্ম মহাতেজা।।
তথাপিও বশ তিনি কুরু-নৃপতির।
এই হেতু ভয়ে বড় কাঁপিছে শরীর।।
দুর্য্যোধন রক্ষা হেতু যদি করে রণ।
কিমতে তাঁহার অঙ্গে করিব ঘাতন।।
অতি বড় দয়া তাঁর আমা পঞ্চ জনে।
পিতৃশোক না জানিনু তাঁহার পালনে।।
নির্দ্দয় ক্ষত্রিয় জাতি, নাহি উপরোধ।
পরাপর নাহি জ্ঞান যুদ্ধে হৈলে ক্রোধ।।
বেদব্যাস বিমন্থন করি বেদসিন্ধু।
জগতের হিতে জন্মালেন ভারতেন্দু।।
মূঢ় মূর্খ অজ্ঞান যতেক অন্ধজনে।
সর্ব্বশাস্ত্র জ্ঞাত হয় যাহার শ্রবণে।।
গণেশে লেখক করি বিরচিল ব্যাস।
মনোগত অন্ধকার করয়ে বিনাশ।।
কাশীরাম দাস কহে পাঁচালীর ছন্দে।
পীয়ে সাধুজন নিঙ্গড়িয়া সেই চান্দে।।