৩৩৯. নারদের শ্বেতদ্বীপে গমন-বিষ্ণুস্তব

৩৩৯তম অধ্যায়

নারদের শ্বেতদ্বীপে গমন-বিষ্ণুস্তব

ভীষ্ম কহিলেন, “হে মহারাজ! অনন্তর দেবর্ষি নারদ শ্বেতদ্বীপে সমুপস্থিত হইয়া, পূর্ণচন্দ্রসদৃশ তত্রস্থ মানবগণকে সন্দর্শন করিয়া ভক্তিভাবে তাঁহাদিগকে নমস্কার করিলে, তাঁহারাও মনে মনে তাঁহার অর্চ্চনা করিলেন।

“অনন্তর তিনি ভগবান্ নারায়ণের দর্শনাভিলাষে জপপরায়ণ ও উৰ্দ্ধবাহু হইয়া একাগ্রচিত্তে সেই নির্গুণ বিশ্বময় নারায়ণের স্তবপাঠে প্রবৃত্ত হইয়া কহিলেন, ‘হে দেবদেবেশ! তুমি নিষ্ক্রিয়, নির্গুণ, লোকসাক্ষী, ক্ষেত্রজ্ঞ, পুরুষোত্তম, মহাপুরুষ, অনন্ত, ত্রিগুণময়, অমৃত, অমৃতাক্ষ, অনন্তদেব, আকাশ ও নিত্যস্বরূপ। কার্য্যকারণদ্বারা কখন তোমাকে জ্ঞাত হওয়া যায়; আবার কখন অবগত হওয়া নিতান্ত দুঃসাধ্য। হে নারায়ণ! তুমি সত্যময়, আদিদেব ও সমুদয় কর্ম্মের ফলপ্রদ। তুমি প্রজাপতি, সুপ্রজাপতি, মহাপ্রজাপতি, বনস্পতি, উর্জ্জস্পতি, বাচস্পতি, জগৎপতি, মনস্পতি, দিবস্পতি, মরুৎপতি, সলিলপতি, পৃথিবীপতি ও দিক্‌পতি। মহাপ্রলয় উপস্থিত হইলে তুমি জগতের একমাত্র আধার হইয়া থাক। তুমি অপ্রকাশ ও ব্রহ্মার বেদোপদেষ্টা। তুমি যজ্ঞ ও অধ্যয়নাদিস্বরূপ। শাস্ত্রে তোমাকেই মহারাজিকাদি [সাধ্যগণাদি] গণচতুষ্টয় বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়া থাকে। তুমি দীপ্তিশীল ও মহাদীপ্তিশীল। তুমি চতুর্দ্দশ যম, যমপত্নী ও চিত্রগুপ্তাদিস্বরূপ। তোমাকে তুষিত [প্রাণ, অপানাদি বায়ু] মহাতুষিত নামক দেবগণ বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। তুমি রোগ ও আরোগ্য, কামাদিবশীভূত ও জিতেন্দ্রিয় এবং স্বাধীন ও পরাধীন। তুমি অপরিমেয়, যজ্ঞ, মহাযজ্ঞ, পঞ্চযজ্ঞ, ঋত্বিক্‌, বেদ, অগ্নি ও যজ্ঞের অঙ্গস্বরূপ। যজ্ঞে তোমাকেই স্তব করিয়া থাকে এবং তুমি সমুদয় যজ্ঞভাগ অধিকার কর। তুমি দিবারাত্রি, মাস, ঋতু, অয়ন ও সংবৎসর এই পঞ্চকাল-বিধাতার অধিপতি। পঞ্চরাত্র বেদে [পঞ্চরাত্ৰনামক বেদের সংহিতাগ্রন্থে] তোমারই মহিমা কীৰ্ত্তিত আছে। তুমি বৈকুণ্ঠ, অপরাজিত ও মানসিক। তোমাতে সমুদয় নামের সম্ভব হয়। তুমি ব্রহ্মারও নিয়ন্তা। তুমি দেবব্রত সমাপ্ত করিয়া অভভূতে [যজ্ঞান্ত স্নানে— যজ্ঞাবসানকালীন অভিষেকে] পূত হইয়াছ। লোকে তোমাকে হংস, পরমহংস, পরমযাজ্ঞিক, সাঙ্খ্যযোগ ও সাঙ্খ্যমূৰ্ত্তি বলিয়া নির্দ্দেশ করে। তুমি জীব, হৃদয়, ইন্দ্রিয়, সমুদ্রজল, দেব ও ব্রহ্মাণ্ড মধ্যে শয়ন কর বলিয়া তোমাকে অমৃতেশয়, হিরণ্যশয়, দেবেশয়, কুশেশয়, ব্রহ্মেশয় ও পদ্মশয় এই ছয়নামে আহ্বান করা যায়। তুমি বিশ্বেশ্বর, বিশ্বকসেন, জগতের আদিকারণ ও প্রকৃতি। তোমার আস্যদেশ অগ্নিস্বরূপ। তুমি বড়বানল, আহুতি, সারথি, বষট্‌কার, ওঙ্কার, তপস্যা, মন, চন্দ্রমা, চক্ষু, আজ্য, সূর্য্য, দিগ্‌ভানু, বিদিগ্‌ভানু, হয়গ্রীব, ঋগ্বেদোক্ত প্রথম মন্ত্ৰত্রয়, ব্রাহ্মণাদি বর্ণের রক্ষাকর্ত্তা, গার্হপত্যাদি পঞ্চ-অগ্নি, ষড়ঙ্গবেদ, প্রাগ্‌জোতিষ্‌, জ্যেষ্ঠসামগ ও সামবেদোক্ত ব্রতধারী অথর্ব্বশিরাঃ, পঞ্চ মহাকল্পে ফেনপাচার্য্য, বালখিল্য, বৈখানস, অভগ্নযোগ, পরিসঙ্খ্যাবিহীন, যুগাদি, যুগমধ্য, যুগান্ত, আখণ্ডল, প্রাচীনগর্ভ, কৌশিক, পুরুষ্টুত ও পুরুহূতস্বরূপ। তুমি বিশ্বকৰ্ত্তা ও বিশ্বরূপী! তুমি নাচিকেতনামক অগ্নিতে তিনবার যজ্ঞ করিয়াছ। তোমার গতি বা ভোগের ইয়ত্তা নাই। তুমি আদ্যন্তমধ্যবিহীন। তুমি ব্রতবাস, সমুদ্ৰাদিবাস, যশোবাস, তপোবাস, লক্ষ্যাবাস, দয়াবাস, বিদ্যাবাস, কীর্ত্ত্যাবাস, শ্রীনিবাস ও সৰ্ব্বাবাস। তুমি বাসুদেব, সৰ্ব্বচন্দ্রক, হরিহর, অশ্বমেধ, যজ্ঞভাগহর, বরপ্রদ, সুখপ্রদ ও ধনপ্রদ। তুমি যম, নিয়ম, মহানিয়ম, কৃচ্ছ, অতিকৃচ্ছ্র ও সৰ্ব্বকৃচ্ছ্র। তুমি নিয়মধর শ্রমবিহীন ব্রহ্মচারী, নৈষ্ঠিক, বেদক্রিয়, অজসৰ্ব্বগতি, সৰ্ব্বদর্শী, ইন্দ্রিয়ের অগ্রাহ্য, অচল, মহাবিভূতি, মাহাত্ম্যময়শরীর, পবিত্র, মহাপবিত্র, হিরন্ময়, বৃহৎ, অপ্রতর্ক্য, অবিজ্ঞেয়, ব্রহ্মাগ্রগণ্য, প্রজাসমূহের সৃষ্টিসংহারকর্ত্তা, মহামায়াধর, চিত্রশিখণ্ডী, বরপ্রদ ও পুরোডাশভাগহারী। তুমি সমুদয় যজ্ঞ অতিক্রম করিয়াছ। তোমার তৃষ্ণা বা সংশয়ের লেশমাত্র নাই। তুমি সমুদয় কার্য্যে প্রবৃত্ত; আবার সমুদয় হইতে নিবৃত্ত রহিয়াছ। তুমি ব্রাহ্মণরূপী, ব্রাহ্মণপ্রিয়, বিশ্বমূৰ্ত্তি, বান্ধব ও ভক্তবৎসল। তোমাকে অসংখ্য নমস্কার। হে ব্রহ্মণ্যদেব! আমি নিতান্ত ভক্ত; তোমার দর্শনার্থ একান্ত ব্যগ্র রহিয়াছি।’ ”