৩৩৮. উপরিচরের অভিশাপকারণ

৩৩৮তম অধ্যায়

উপরিচরের অভিশাপকারণ

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! রাজা উপরিচর অতিশয় বিষ্ণুভক্ত ছিলেন, তবে তিনি কি নিমিত্ত দেবলোক হইতে পরিভ্রষ্ট হইয়া ভূগর্ভে প্রবেশ করিলেন?”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! এই স্থলে মহর্ষিত্রিদশসংবাদ নামক এক প্রাচীন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। একদা সুরগণ মহর্ষিদিগকে কহিলেন, ‘অজচ্ছেদন করিয়া যজ্ঞানুষ্ঠান করাই কৰ্ত্তব্য। শাস্ত্রানুসারে ছাগপশুকেই অজ বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়।’ মহর্ষিগণ কহিলেন, ‘বেদে নির্দ্দিষ্ট আছে, বীজদ্বারাই যজ্ঞানুষ্ঠান করিবে। বীজের নামই অজ; অতএব যজ্ঞে ছাগপশু ছেদন করা কদাপি কৰ্ত্তব্য নহে। যে ধৰ্ম্মে পশুচ্ছেদন করিতে হয়, তাহা সাধুলোকের ধৰ্ম্ম বলিয়া কখনই স্বীকার করা যায় না। বিশেষতঃ ইহা সর্ব্বশ্রেষ্ঠ সত্যযুগ। এই যুগে পরহিংসা করা কিরূপে কৰ্তব্য বলিয়া পরিগণিত হইতে পারে?’

“দেবতা ও মহর্ষিগণ পরস্পর এইরূপে বাদানুবাদ করিতেছেন, এই অবসরে মহারাজ উপরিচর আপনার বল ও বাহনের সহিত আকাশমার্গ দিয়া তথায় আগমন করিতে লাগিলেন। তখন ব্রাহ্মণেরা মহারাজ উপরিচরকে তথায় আগমন করিতে দেখিয়া দেবতাদিগকে কহিলেন, ‘সুরগণ! এই মহাত্মাই আমাদিগের সন্দেহ দূর করিবেন। এই রাজা যাজ্ঞিক, দানশীল ও সৰ্ব্বভূতের হিতানুষ্ঠানে তৎপর। ফলতঃ ইনি সৰ্বাংশেই শ্রেষ্ঠ, অতএব আমরা এই বিষয় জিজ্ঞাসা করিলে ইনি কদাচই বিপরীত সিদ্ধান্ত করিবেন না।

“তাঁহারা এইরূপ পরামর্শ করিয়া মহারাজ উপরিচরের নিকট গমনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘মহারাজ! ছাগপশু ও ওষধি এই দুই বস্তুর মধ্যে কোন্ বস্তুদ্বারা যজ্ঞানুষ্ঠান করা কর্ত্তব্য? আমাদিগের এই বিষয়ে অতিশয় সংশয় উপস্থিত হইয়াছে, তুমি উহা নিরাকরণ কর। আমাদিগের মতে তুমি যাহা কহিবে, তাহাই প্রমাণ।’ তখন মহারাজ বসু কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁহাদিগকে কহিলেন, ‘আপনাদিগের মধ্যে কাহার কিরূপ অভিপ্রায়, অগ্রে আমার নিকট তাহা ব্যক্ত করুন।’ মহর্ষিগণ কহিলেন, ‘মহারাজ! আমাদিগের মতে ধান্যদ্বারাই যজ্ঞ করা বিধেয়। কিন্তু দেবগণ কহিতেছেন, যজ্ঞে ছাগপশু ছেদন করাই শ্রেয়ঃ। এক্ষণে এ বিষয়ে তোমার কি অভিপ্রায়, তাহা প্রকাশ কর।’

“তখন মহারাজ বসু দেবগণের অভিপ্রায় পরিজ্ঞাত হইয়া তাঁহাদিগের প্রতি পক্ষপাত প্রদর্শনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘হে ব্রাহ্মণগণ! ছাগ ছেদন করিয়া যজ্ঞানুষ্ঠান করা বিধেয়।’ তখন সেই ভাস্করের ন্যায় তেজস্বী মহর্ষিগণ বিমান মহারাজ উপরিচরকে আপনাদিগের মতের বিরুদ্ধবাদী দেখিয়া ক্রোধভরে কহিলেন, ‘মহারাজ! তুমি নিশ্চয়ই দেবগণের প্রতি পক্ষপাত করিয়া এই কথা কহিতেছ; অতএব অচিরাৎ দেবলোক হইতে পরিভ্রষ্ট হও। আজ অবধি তোমার দেবলোকে গতিরোধ হইল। তুমি আমাদিগের অভিশাপপ্রভাবে ভূমি ভেদ করিয়া তন্মধ্যে প্রবেশ করিবে।’

অভিশপ্ত উপরিচরের জন্য বসুধার ব্যবস্থা

“মহর্ষিগণ এইরূপ শাপ প্রদান করিবামাত্র রাজা উপরিচর ভূগর্ভে প্রবেশ করিবার নিমিত্ত নভোমণ্ডল হইতে অবতীর্ণ হইতে লাগিলেন; কিন্তু তৎকালে ভগবান্ নারায়ণের প্রসাদে তাঁহার স্মরণশক্তি বিলুপ্ত হইল না। ঐ সময় দেবগণ সমবেত হইয়া স্থিরচিত্তে উপরিচর বসুর শাপশান্তির উপায় চিন্তা করিতে লাগিলেন। তাঁহারা কহিলেন, ‘এই মহাত্মা আমাদিগের নিমিত্তই অভিশাপগ্রস্ত হইয়াছেন। এক্ষণে ইহার শাপমোচনের উপায়বিধান করা আমাদিগের অবশ্য কর্ত্তব্য।’ তাঁহারা পরস্পর এইরূপ কৃতনিশ্চয় হইয়া হৃষ্টমনে উপরিচরকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘মহারাজ! তুমি ভগবান বিষ্ণুর প্রতি গাঢ়তর ভক্তি প্রদর্শন করিয়া থাক। তিনি সুরাসুরগণের পরম গুরু। তিনিই প্রসন্ন হইয়া তোমার শাপমোচন করিয়া দিবেন। এক্ষণে মহাত্মা ব্রাহ্মণগণের সম্মান রক্ষা করা তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য। উঁহাদিগের তপোবলে অবশ্যই তোমার অভীষ্ট সিদ্ধ হইবে। অতঃপর তোমাকে নিশ্চয়ই দেবলোক হইতে পরিভ্রষ্ট হইয়া ভূগর্ভে প্রবিষ্ট হইতে হইবে। অতএব আমরা এক্ষণে তোমার উপকারার্থ তোমাকে এই বর প্রদান করিতেছি যে, তুমি অভিশাপদোষে যত দিন ভূগর্ভে বাস করিবে, তত দিন যজ্ঞকালে ব্রাহ্মণেরা গৃহভিত্তিতে যে ঘৃতধারা প্রদান করিবেন, সেই ঘৃতভক্ষণদ্বারা তোমার ক্ষুৎপিপাসা নিবৃত্ত হইবে। ঐ ঘৃতধারাকে লোকে বসুধারা বলিয়া কীৰ্ত্তন করিবে। এক্ষণে তুমি দুঃখিত হইও না। তুমি যখন ভূবিবরে বাস করিবে, তৎকালে ঐ বসুধারা ও আমাদিগের প্রদত্ত তেজঃপ্রভাবে ক্ষুৎপিপাসা তোমাকে কোনক্রমেই নিপীড়িত করিতে সমর্থ হইবে না। আমরা তোমাকে আরও এই বর প্রদান করিতেছি যে, সৰ্ব্বদেবপ্রধান ভগবান বিষ্ণু অবশ্যই তোমার প্রতি প্রীত ও প্রসন্ন হইয়া তোমাকে ব্রহ্মলোকে লইয়া যাইবেন।’ দেবগণ মহারাজ উপরিচরকে সেইরূপ বর প্রদান করিয়া ঋষিগণের সহিত স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিলেন।

বিষ্ণুর আদেশে উপরিচরের ঊর্ধ্বগতি

“অনন্তর রাজা উপরিচর ভূগর্ভে প্রবেশ করিয়া নারায়ণের পূজা, নারায়ণনির্দ্দিষ্ট মন্ত্র জপ এবং তাঁহারই উদ্দেশে পঞ্চকালে পঞ্চযজ্ঞের অনুষ্ঠান করিতে লাগিলেন। কিয়দ্দিন পরে ভগবান্ নারায়ণ রাজা উপরিচরের ভক্তিদর্শনে যারপরনাই প্রীত হইয়া মহাবেগসম্পন্ন পক্ষিরাজ গরুড়কে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘বৈনতেয়! ধর্ম্মপরায়ণ মহীপাল উপরিচর বসু রোষাবিষ্ট ব্রাহ্মণের অভিশাপপ্রভাবে ভূগর্ভে প্রবিষ্ট হইয়াছে। এক্ষণে তিনি সেই সমস্ত ব্রাহ্মণের প্রতি যথোচিত সম্মান প্রদর্শন করিয়াছেন, অতএব তুমি আমার আদেশানুসারে অবিলম্বে ঐ রাজাকে নভোমণ্ডলে আনয়ন কর।’ তখন বিহগরাজ পক্ষদ্বয় বিস্তারপূৰ্ব্বক বায়ুবেগে ভূগর্ভে প্রবিষ্ট ও উপরিচরের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া তাঁহাকে গ্রহণপূর্ব্বক সহসা নভোমণ্ডলে গমন করিয়া তাঁহাকে পরিত্যাগ করিবামাত্র মহারাজ উপরিচর পুনরায় দেবশরীর ধারণ করিয়া ব্ৰহ্মলোকে গমন করিলেন।

“হে ধৰ্ম্মরাজ! এইরূপে মহারাজ উপরিচর বাক্যদোষে ব্রাহ্মণগণের অভিশাপগ্রস্ত হইয়া অধোগতি লাভ এবং পরিশেষে দেবগণের অনুগ্রহে পুনরায় ব্রহ্মলোকে গমন করিয়াছিলেন। তিনি কেবল দেবাদিদেব হরির আরাধনা করিতেন বলিয়াই অচিরাৎ তাঁহার শাপশান্তি ও ব্রহ্মলোকপ্রাপ্তি হইয়াছিল। এই আমি তোমার নিকট উপরিচররাজার বৃত্তান্ত কীৰ্ত্তন করিলাম। এক্ষণে নারদ যেরূপে শ্বেতদ্বীপে গমন করিলেন, তাহাও আনুপূর্ব্বিক কীৰ্ত্তন করিতেছি, অবহিতচিত্তে শ্রবণ কর।”