৩৩৭তম অধ্যায়
উপরিচরের অশ্বমেধযজ্ঞ
ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! মহাকল্পের অবসানে নানাগুণসম্পন্ন অঙ্গিরার পুত্র বৃহস্পতি জন্মগ্রহণপূর্ব্বক দেবতাদিগের পৌরোহিত্য করিলে দেবগণ যারপরনাই সুখী হইয়াছিলেন। মহারাজ উপরিচর তাঁহার শিষ্য হইয়া তাঁহার নিকট সপ্তর্ষিপ্রণীত সমুদয় শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। ঐ রাজা দৈববিধি অনুসারে সুরপতি ইন্দ্রের ন্যায় রাজ্যপালন করিতেন। উনি মহাসমারোহে অশ্বমেধযজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন। ঐ যজ্ঞে বৃহস্পতি হোতা এবং প্রজাপতি পুত্র একত, দ্বিত ও ত্রিত, মহর্ষি ধনুরাখ্য, রৈভ্য, অর্ব্বাসু, পরাবসু, মেধাতিথি, তাণ্ড্য, শান্তি, বেদশিরা, শালিহোত্রের পিতা কপিল, আদ্য কঠ, বৈশম্পায়নের জ্যেষ্ঠভ্রাতা তৈত্তিরি, মহর্ষি কথ ও দেবহোত্র সদস্য হইয়াছিলেন। নরপতির আজ্ঞাক্রমে যজ্ঞভূমিতে সমুদয় যজ্ঞীয় দ্রব্যসম্ভার সঞ্চিত হইয়াছিল। মহারাজ উপরিচর এরূপ অহিংসাপরায়ণ ছিলেন যে, তিনি ঐ যজ্ঞেও পশুহত্যা করেন নাই। অরণ্যসম্ভত বস্তুদ্বারা তাঁহার যজ্ঞভাগসমুদয় কল্পিত হইয়াছিল। সংসারভারহার্ত্তা ভগবান্ নারায়ণ ঐ যজ্ঞানুষ্ঠানসময়ে উপরিচরের প্রতি প্রসন্ন হইয়া নভোমণ্ডল হইতে কেবল তাঁহাকেই আত্মরূপ প্রদর্শনপূৰ্ব্বক স্বীয় যজ্ঞভাগ হরণ করেন। ঐ সময় আর কেহই তাঁহাকে দর্শন করিতে সমর্থ হয়েন নাই। তখন ভগবান্ বৃহস্পতি অলক্ষিতভাবে যজ্ঞভাগ গৃহীত হইল দেখিয়া অতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া পুনরায় নারায়ণের ভাগ কল্পিত ও আকাশপথে মহাবেগে স্রুক্ উদ্যত করিয়া বাষ্পপূর্ণনয়নে রাজা উপরিচরকে কহিলেন, ‘মহারাজ! এ আমি ভগবান্ নারায়ণের উদ্দেশ্যে যে যজ্ঞভাগ স্থাপন করিলাম, ইহা তিনি মূর্ত্তিমান্ হইয়া আমার সপক্ষে গ্রহণ করিবেন, সন্দেহ নাই।’ ”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! উপরিচরের যজ্ঞের সমুদয় দেবতা মূর্ত্তিমান হইয়া স্ব স্ব যজ্ঞভাগ গ্রহণ করিলেন; কিন্তু ভগবান্ নারায়ণ কি নিমিত্ত অলক্ষিতভাবে যজ্ঞভাগহরণে প্রবৃত্ত হইলেন, তাহা আমার নিকট কীৰ্ত্তন করুন।”
যজ্ঞে বৃত মহর্ষিগণের প্রতি আকাশবাণী
ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! তখন মহারাজ উপরিচর ও সদস্যগণ বৃহস্পতিকে প্রসন্ন করিয়া কহিলেন, ‘ভগবন্! ক্রোধ করা সত্যযুগের ধর্ম্ম নহে, অতএব ক্রোধপরিত্যাগ করা আপনার অবশ্য কর্ত্তব্য। আপনি যে দেবতার ভাগ কল্পনা করিতেছেন, তাঁহার ক্রোধ নাই। ঐ মহাত্মা যাঁহার প্রতি প্রসন্ন হয়েন, তিনিই। উঁহাকে দর্শন করিতে পারেন, তদ্ভিন্ন আর কাহারও তাঁহাকে দর্শন করিবার ক্ষমতা নাই।
“তখন সৰ্ব্বশাস্ত্রদর্শী মহাত্মা একত, দ্বিত ও ত্রিত বৃহস্পতিকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘সুরগুরো! আমরা ব্রহ্মার মানসপুত্র। পূৰ্ব্বে আমরা দেবদেব সনাতন নারায়ণের সাক্ষাৎকারলাভের আকাঙ্ক্ষায় ক্ষীরোদসাগরের অদূরবর্ত্তী সুমেরুর উত্তরভাগস্থ রমণীয় প্রদেশে গমনপূর্ব্বক একপদে দণ্ডায়মান হইয়া কাষ্ঠের ন্যায় নিশ্চলভাবে সমাহিতচিত্তে সংহস্র বৎসর কঠোর তপানুষ্ঠান করিয়াছিলাম। তপানুষ্ঠান সমাপনের পর আমাদিগের অবভৃতস্নানসময়ে স্নিগ্ধ ও গম্ভীরস্বরে এই আকাশবাণী আমাদের কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইল যে, “হে বিপ্রগণ! তোমরা ভগবান্ নারায়ণের প্রতি ভক্তিপরায়ণ হইয়া তাঁহার সাক্ষাৎকারলাভের নিমিত্ত অতিকঠোর তপানুষ্ঠান করিয়াছ বটে; কিন্তু তাঁহাকে দর্শন করা তোমাদের পক্ষে নিতান্ত দুষ্কর। ক্ষীরোদসমুদ্রের উত্তরভাগে শ্বেতদ্বীপনামে এক প্রভাবসম্পন্ন প্রসিদ্ধ স্থান আছে। ঐ দ্বীপে চন্দ্রের ন্যায় তেজস্বী বহুসংখ্যক মহাত্মা বাস করেন। উঁহারা সকলেই ইন্দ্রিয়বিহীন, স্পন্দহীন, সুগন্ধযুক্ত ও নারায়ণের প্রতি দৃঢ়ভক্তিপরায়ণ। ঐ মহাত্মারাই পুরুষোত্তম ভগবান্ নারায়ণের সাক্ষাৎকার লাভ করিতে সমর্থ হয়েন। ঐ স্থানে দেবদেব নারায়ণের আবির্ভাব হইয়াছে। অতএব তোমরা যদি তথায় গমন করিতে পার, তাহা হইলে কথঞ্চিৎ তাঁহার দর্শন লাভ করিতে পারিবে।”
মহর্ষিগণের শ্বেতদ্বীপদর্শন
‘এইরূপ দৈববাণী হইলে আমরা উহা শ্রবণ করিবামাত্র অতিমাত্র ব্যগ্র হইয়া ভগবানের দর্শনাকাঙ্ক্ষায় দৈবনির্দ্দিষ্ট মার্গ অবলম্বনপূৰ্ব্বক তদ্গতচিত্তে সেই শ্বেতদ্বীপে উপনীত হইলাম; কিন্তু সেই স্থানে গমন করিবামাত্র আমাদিগের দৃষ্টিপথ রুদ্ধ হইয়া গেল। তখন আমরা পরমপুরুষের কথা দূরে থাকুক, তত্রত্য অন্যান্য পুরুষগণকেও দেখিতে পাইলাম না। কিয়ৎক্ষণ পরে আমাদিগের জ্ঞানোদয় হইলে আমরা “কঠোর তপোবল না থাকিলে কেহই সেই পুরুষোত্তমকে দর্শন করিতে সমর্থ হয় না” এই বিবেচনা করিয়া সেই স্থানে পুনরায় সাত বৎসর ঘোরতর তপস্যা করিলাম। আমাদিগের তপস্যা সমাপ্ত হইলে দেখিলাম, চন্দ্রের ন্যায় পরম সুন্দর সর্ব্বলক্ষণসম্পন্ন মহাত্মারা কেহ প্রাঙ্মুখ ও কেহ উদঙ্মুখ হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে ব্ৰহ্মমন্ত্র জপ করিতেছেন।
তাঁহারা একাগ্রচিত্তে ভগবান্ নারায়ণের উপাসনা করেন বলিয়াই তিনি তাঁহাদিগের প্রতি প্রসন্ন হয়েন। যুগক্ষয়ে সূর্য্যের যেরূপ প্রভা প্রকাশিত হয়, শ্বেতদ্বীপবাসী প্রত্যেক ব্যক্তি সেইরূপ প্রভাসম্পন্ন। আমরা তত্ৰত্য সমুদয় ব্যক্তিকে তুল্যরূপ তেজঃসম্পন্ন দেখিয়া সেই দ্বীপকে তেজের আবাস বলিয়া বোধ করিলাম। অনন্তর যুগপৎ সমুত্থিত সহস্র সূর্য্যের প্রভা সহসা আমাদিগের দৃষ্টিপথে নিপতিত হইল। ঐ সময় সেই শ্বেতদ্বীপনিবাসী মহাত্মারা [মহাত্মাদিগের সকলেই] “আমিই সর্ব্বাগ্রে গমন করিলাম” এই কথা কহিতে কহিতে কৃতাঞ্জলিপুটে ভগবান্ নারায়ণকে নমস্কার করিয়া সেই তেজঃপুঞ্জাভিমুখে মহাবেগে ধাবমান হইয়া তাঁহাকে উপহার প্রদান করিলেন। তৎকালে সেই অলৌকিক তেজঃপ্রভাবে সহসা আমাদিগের দৃষ্টি, বল ও ইন্দ্রিয়শক্তিসমুদয় প্রতিহত হইয়া গেল। তখন কেবল এইমাত্র শব্দ আমাদিগের কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইল যে, “হে পুণ্ডরীকাক্ষ! তোমার জয় হউক, হে হৃষীকেশ! তুমি বিশ্বভাবন, মহাপুরুষ ও সকলের আদি, তোমাকে নমস্কার।” ঐ সময় বিবিধ গন্ধযুক্ত পবিত্র সমীরণ দিব্যপুস্প ও ওষধি বহন করিয়া প্রবাহিত হইতে লাগিল।
‘অনন্তর সেই তেজস্বী পুরুষগণ পরমভক্তিসহকারে কায়মনোবাক্যে সেই তেজঃপুঞ্জের পূজা আরম্ভ করিলেন। তৎকালে সেই মহাত্মাদিগের বাক্য শ্রবণ করিয়াই আমাদের বোধ হইল যে, ভগবান নারায়ণ নিশ্চয়ই তথায় সমুপস্থিত হইয়াছেন; কিন্তু আমরা তাঁহার মায়াভাবে মুগ্ধ হইয়া তাঁহাকে সন্দর্শন করিতে পারিলাম না। কিয়ৎক্ষণ পরে বায়ু প্রতিনিবৃত্ত ও পুজোপহারসমুদয় প্রদত্ত হইলে, আমরা নিতান্ত চিন্তাকুল হইলাম। ঐ সময় সেই বিশুদ্ধযোনি সম্ভূত সহস্র সহস্র মহাত্মার মধ্যে একজনও আমাদিগের প্রতি মনঃসংযোগ বা দৃষ্টিপাত করিলেন না। তাঁহারা সকলেই সুস্থচিত্তে একমাত্র ব্রহ্মের প্রতি চিত্তসমাধান করিয়া রহিলেন।
‘এইরূপে আমরা ইতিকৰ্ত্তব্যবিমূঢ় হইলে ক্ষণকাল পরে এই আকাশবাণী প্রাদুর্ভুত হইল যে, “হে মুনিগণ! তোমরা এই যে শ্বেতদ্বীপস্থ মানবগণকে সন্দর্শন করিলে, ইঁহারা বাহ্যেন্দ্রিয়শূন্য ; ইঁহারা ভগবান্ নারায়ণের সহিত সাক্ষাৎকারলাভে সমর্থ হয়েন। তোমরা অচিরাৎ স্বস্থানে প্রস্থান কর। ভক্তিহীন ব্যক্তিরা কখনই তাঁহার সহিত সাক্ষাৎকারলাভে সমর্থ হয়েন না। বহুকাল তপশ্চরণ করিতে করিতে একেবারে তদ্গতচিত্ত হইতে পারিলেই সেই দুর্নিরীক্ষ্য নারায়ণকে সন্দর্শন করিতে পারা যায়। এখনও তোমাদের কর্ম্ম শেষ হয় নাই। কিয়ৎকাল পরে তোমাদিগকে মহার্য্য সাধন করিতে হইবে। সত্যযুগ অতীত হইয়া বৈবস্বতকল্পে পুনরায় ত্রেতাযুগ উপস্থিত হইলে দেবগণের কার্য্যসিদ্ধির নিমিত্ত তোমাদিগকে তাঁহাদের সহচর হইতে হইবে।”
দেবশাপে উপরিচরের ভূগর্ভে প্রবেশবার্ত্তা
‘হে সুরাচার্য্য! আমরা তৎকালে সেই অমৃততুল্য অদ্ভুত আকাশবাণী শ্রবণ করিবামাত্র ভগবান্ নারায়ণের প্রসাদে অভীষ্ট স্থানে সমাগত হইলাম। আমরা এতাদৃশ কঠোর তপস্যা ও হব্যকব্য প্রদান করিয়াও যখন নারায়ণের সাক্ষাৎকারলাভ করিতে সমর্থ হই নাই, তখন তুমি কিরূপে তাঁহাকে সন্দর্শন করিবে? ভগবান্ নারায়ণ এই বিশ্বসংসারের সৃষ্টিকর্ত্তা, হব্যকব্যভোজী, জরামৃত্যুবিহীন, সূক্ষ্ম ও দেবদানবগণের পূজিত।’
“হে ধৰ্ম্মরাজ! একত, দ্বিত, ত্রিত ও সদস্যগণ এইরূপে বিবিধ অনুনয়বিনয় করিলে অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্ন মহাত্মা বৃহস্পতি, দেবগণের পূজা করিয়া যজ্ঞ সমাধান করিলেন। যজ্ঞ সমাপ্ত হইলে সত্যধর্ম্মপরায়ণ নরপতি উপরিচর পরমসুখে প্রজা প্রতিপালন করিতে লাগিলেন এবং পরিণামে কলেবর পরিত্যাগপূৰ্ব্বক সুরলোকে গমন করিলেন। ঐ মহাত্মা বহুকাল স্বর্গে বাস করিয়া ব্রহ্মশাপনিবন্ধন তথা হইতে পরিভ্রষ্ট হইয়া ভূগর্ভে প্রবিষ্ট হইয়াছিলেন। ঐ স্থানেও তাঁহার ধর্ম্মবুদ্ধির কিছুমাত্র বৈলক্ষণ্য হয় নাই। তিনি ভূগর্ভে থাকিয়াও নারায়ণের প্রতি দৃঢ়ভক্তি প্রদর্শন ও নারায়ণের মন্ত্র জপ করিয়া তাঁহার প্রসাদে পুনরায় মহীতল হইতে উত্থিত হইয়া ব্ৰহ্মলোকে গমন করিয়াছিলেন।”