৩৩৫. নরনারায়ণতত্ত্ব—নারায়ণ-নারদসংবাদ

৩৩৫তম অধ্যায়

নরনারায়ণতত্ত্ব—নারায়ণ-নারদসংবাদ

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! গৃহস্থ, ব্রহ্মচারী, বানপ্রস্থাশ্রমী ও ভিক্ষুকদিগের মধ্যে যে ব্যক্তি সিদ্ধিলাভের বাসনা করিবেন, কোন্ দেবতার আরাধনা করা তাঁহার কৰ্ত্তব্য? তিনি কাহার প্রসাদে স্বর্গ ও মোক্ষলাভ করিতে সমর্থ হয়েন এবং কোন্ বিধি অনুসারে দেবতা ও পিতৃগণের উদ্দেশে হোম করা তাঁহার আবশ্যক? লোকে মুক্ত হইলে কোন্ স্থানে গমন করে? মোক্ষতত্ত্ব কিরূপ? কোন্ কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিলে স্বর্গ হইতে পরিভ্রষ্ট হইতে হয় না? দেবতা ও পিতৃগণের পিতা কে এবং কোন পুরুষই বা সেই দেবতা ও পিতৃগণের পিতা হইতেও শ্রেষ্ঠ? এই সমুদয় বিষয় আমার নিকট কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! তুমি যে সকল নিগূঢ় প্রশ্ন করিলে, আমি ভগবান্ নারায়ণের প্রসন্নতা ও জ্ঞানলাভ করিতে না পারিলে তর্কশাস্ত্রানুসারে শতবর্ষেও ঐ সমুদয়ের উত্তর প্রদানে সমর্থ হইতাম না। এক্ষণে এই উপলক্ষে নারায়ণ-নারদসংবাদ নামক পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। পূৰ্ব্বে আমার পিতা আমাকে কহিয়াছিলেন, সত্যযুগে স্বায়ম্ভূব মনুর অধিকারকালে বিশ্বাত্মা সনাতন নারায়ণ ধৰ্ম্মের পুত্র হইয়া নর, নারায়ণ, হরি ও কৃষ্ণ এই চারি অংশে অবতীর্ণ হইয়াছেন। তাঁহাদিগের মধ্যে নরনারায়ণ উভয়েই বদরিকাশ্রমে গমনপূৰ্ব্বক কঠোর তপানুষ্ঠান করেন। তাৎকালে তাঁহাদিগের তপোবল ও তেজ এরূপ বর্দ্ধিত হইয়াছিল যে, দেবগণও তাঁহাদিগকে দর্শন করিতে সমর্থ হয়েন নাই। তাঁহারা যে দেবের প্রতি প্রসন্ন হইতেন, তিনিই তাঁহাদিগকে দর্শন করিতে পারিতেন।

“একদা তপোধনাগ্রগণ্য দেবর্ষি নারদ সেই মহাপুরুষদ্বয়ের ইচ্ছানুসারে সুমেরুশৃঙ্গ হইতে গন্ধমাদনপৰ্ব্বতে আগমনপূৰ্ব্বক তত্ৰত্য সমুদয় স্থান পরিভ্রমণ করিতে লাগিলেন এবং পরিশেষে নর ও নারায়ণের আহ্নিকসময়ে বদরিকাশ্রমে আগমনপূর্ব্বক পুলকিত হইয়া মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলেন, আহা! এই স্থান দেবতা, গন্ধৰ্ব্ব, অসুর, কিন্নর ও মহোরগ প্রভৃতি সমুদয় লোকের আবাসভূমি। ইহাতে ভগবান্ নর ও নারায়ণ অবস্থান করিতেছেন। ভগবান্ নারায়ণ চারি অংশে বিভক্ত হইয়াছেন। আজ সেই ভগবানের অংশ নর, নারায়ণ, কৃষ্ণ ও হরির অনুগ্রহে আমার ধর্ম্মোপার্জ্জন সফল হইল। পূর্ব্বে ভগবান্ কৃষ্ণ ও হরি এই স্থানে অবস্থান করিয়াছিলেন। এই তেজঃপুঞ্জকলেবর মহাপুরুষদ্বয় এক্ষণে আহ্নিকক্রিয়ায় প্রবৃত্ত হইয়াছেন। কি আশ্চর্য্য! ইহারা পরব্রহ্মস্বরূপ। ইহাদিগের আবার আহ্নিকক্রিয়া কি? ইহারা সৰ্ব্বভূতের পিতা ও দেবতাস্বরূপ হইয়া কোন্ দেবতার বা কোন্ পিতৃলোকের আরাধনা করেন, কিছু বুঝিতে পারিতেছি না।’

“দেবর্ষি নারদ ভক্তিভাবে মনে মনে এইরূপ চিন্তা করিয়া সহসা নর ও নারায়ণের সর্ম্মুখে সমুপস্থিত হইলেন। তাহারাও দেবতা ও পিতৃগণের পূজা সমাধানপূর্ব্বক দেবর্ষি নারদকে দর্শন করিয়া তাঁহার যথাবিধি সৎকার করিলেন।

“তখন তপোধনাগ্রগণ্য নারদ নর ও নারায়ণের সমীপে উপবেশনপূৰ্ব্বক যারপরনাই প্রীত হইয়া মহাত্মা নারায়ণকে প্রণাম করিয়া কহিলেন, ‘ভগবন্! বেদ, বেদাঙ্গ ও পুরাণসমুদয়ে তোমার গুণ বর্ণিত আছে। তুমি অজ, ধাতা, নিত্য ও অমৃতস্বরূপ। তোমাতেই সমুদয় জগৎ প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে। চারি আশ্রমবাসী লোকেরা সকলেই তোমাকে নানারূপে নিরন্তর উপাসনা করে এবং পণ্ডিতেরা তোমাকেই জগতের পিতা ও গুরু বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন। কিন্তু তুমি আজ কোন দেবতা ও কোন পিতৃলোকের আরাধনা করিতেছ?’

নারদস্তবে তুষ্ট—নারায়ণের আত্মতত্ত্বপ্রকাশ

“তখন ভগবান্ নারায়ণ নারদকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘দেবর্ষে! তুমি এক্ষণে যাহা জিজ্ঞাসা করিলে, উহা নিতান্ত নিগূঢ়, উহা প্রকাশ করা কোনক্রমেই উচিত নহে; কিন্তু আমি তোমার ভক্তিদর্শনে নিতান্ত প্রীত হইয়াছি; সুতরাং উহা তোমার নিকট সবিস্তর কীৰ্ত্তন করিতে হইল। যিনি সূক্ষ্ম, অবিজ্ঞেয়, কার্য্যবিহীন, অচল, নিত্য এবং ইন্দ্রিয়, বিষয় ও সৰ্ব্বভূত হইতে অতীত, পণ্ডিতেরা যাঁহাকে সৰ্ব্বভূতের অন্তরাত্মা, ক্ষেত্রজ্ঞ ও ত্রিগুণাতীত বলিয়া নির্দ্দেশ করেন, যাঁহা হইতে সত্ত্বাদি গুণত্রয় সমুদ্ভূত হইয়াছে, যিনি অব্যক্ত হইয়াও ব্যক্তভাবে অবস্থানপূৰ্ব্বক প্রকৃতিনামে অভিহিত হইয়া থাকে, সেই পরমাত্মাই আমাদের উৎপত্তির কারণ। আমরা সেই পরমাত্মাকে পিতা ও দেবতা জ্ঞান করিয়া তাঁহার পূজা করিতেছি; তাহা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ পিতা, দেবতা বা ব্রাহ্মণ আর কেহই নাই। তিনিই আমাদিগের আত্মস্বরূপ। তাহা হইতে এই লোকোৎপত্তির নিয়ম প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। তাঁহারই আজ্ঞানুসারে মানবগণ দেবতা ও পিতৃগণের আরাধনা কৰ্ত্তব্য কৰ্ম্ম বলিয়া জ্ঞান করিয়া থাকে।

‘ব্রহ্মা, মহাদেব, মনু, দক্ষ, ভৃগু, ধৰ্ম্ম, যম, মরীচি, অঙ্গিরা, অত্রি, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু, বশিষ্ঠ, পরমেষ্ঠি, সূর্য্য, চন্দ্র, কর্দ্দম, ক্রোধ, বিক্রীত ও প্রচেতা এই একবিংশতি প্রজাপতি সেই পরমাত্মার দৈব ও পৈত্ৰকার্য্যসমুদয় অকগত হইয়া তাঁহার সনাতন নিয়ম প্রতিপালনপূৰ্ব্বক স্বীয় স্বীয় অভিষ্ট স্থানে গমন করিয়াছেন। স্বর্গবাসী প্রাণীগণ তাঁহাকে নমস্কার করিয়া তাঁহার প্রসাদে পরমগতি লাভ করিয়া থাকেন। যাঁহারা পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকৰ্ম্মেন্দ্রিয়, পঞ্চপ্রাণ এবং মন ও বুদ্ধি এই সপ্তদশাত্মক লিঙ্গ শরীর, পঞ্চদশ কলাত্মক স্থূলশরীর, সত্ত্বাদি গুণত্রয় ও কর্ম্মসমুদয় পরিত্যাগ করিতে পারেন, তাঁহাদিগকেই মুক্ত বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। মুক্তব্যক্তিরা পরমাত্মাকেই প্রাপ্ত হইয়া থাকেন। পরমাত্মা স্বভাবতঃ নির্গুণ হইয়া ও কেবল মায়াপ্রভাবেই সগুণ বলিয়া অভিহিত হয়েন। আমরা সেই পরমাত্মা হইতে সমুৎপন্ন হইয়া জ্ঞানবলে তাঁহাকে দর্শনপূর্ব্বক তাঁহার আরাধনা করিতেছি। বেদাধ্যয়ননিরত ব্রহ্মচারী ও অন্যান্য আশ্রমবাসিগণ ভক্তিসহকারে তাঁহার পূজা করিয়া তাঁহার প্রসাদে পরমগতি লাভ করিয়া থাকেন। যাঁহারা সেই পরমাত্মার প্রতি একান্ত ভক্তিপরায়ণ হয়েন, তাঁহারা পরিণামে সেই পরমপদার্থে লীন হইয়া মোক্ষপদ লাভ করেন, সন্দেহ নাই। আমি তোমার ভক্তিদর্শনে প্রীত হইয়া তোমার নিকট এই সমুদয় গূঢ় বিষয় কীৰ্ত্তন করিলাম।”