৩৩৪তম অধ্যায়
পুত্রস্নেহে ব্যাসের চিত্তচাঞ্চল্য
“মহাতপস্বী শুকদেব শৈলকানন প্রভৃতিকে এইরূপ অনুরোধ করিয়া ক্রমে ক্রমে ধৰ্ম্ম, জ্ঞান, বৈরাগ্য ও ঐশ্বর্য্যজনিত চতুর্ব্বিধ দোষ এবং তম, রজ ও সত্ত্বগুণ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক নিরাকার নির্গুণ ব্রহ্মে আসক্ত হইয়া ধূমশূন্য পাবকের ন্যায় অবস্থান করিতে লাগিলেন। ঐ সময় মহাত্মা পৃথিবী পরিত্যাগ করিতে উদ্যত হওয়াতে চতুর্দ্দিকে উল্কাপাত, দিগ্দাহ ও ভূমিকম্প প্রভৃতি বিবিধ দুর্নিমিত্ত সমুদয় প্রাদুর্ভূত হইল। বৃক্ষশাখা ও পৰ্ব্বতশৃঙ্গসমুদয় নিপতিত হইতে লাগিল। বোধ হইল যেন, নির্ঘাতশব্দে [বজ্রশব্দে] হিমালয় বিদীর্ণ হইয়া যাইতেছে। ভাস্করের প্রভা একেবারে তিরোহিত হইয়া গেল, অগ্নিশিখা নিৰ্ব্বাণ হইল এবং হ্রদ, নদ, নদী ও সাগর প্রভৃতি জলাশয় সমুদয় সংক্ষুব্ধ হইয়া উঠিল। তখন সেই মহাত্মার তৃপ্তিসাধনের নিমিত্ত দেবরাজ ইন্দ্র সুগন্ধ বারিবর্ষণ ও পবনদেব দিব্যগন্ধ গ্রহণপূৰ্ব্বক ইতস্ততঃ সঞ্চরণ করিতে লাগিলেন।
“অনন্তর মহাত্মা শুকদেব উত্তরদিকে হিমাচল ও মেরুপৰ্ব্বতের পরস্পর সংশ্লিষ্ট সুবর্ণ ও রজতময় শতযোজনা বিস্তীর্ণ অতি মনোহর শৃঙ্গদ্বয় দর্শন করিয়া তদভিমুখে ধাবমান হইলেন। তিনি সেই শৃঙ্গদ্বয়ের সমীপবর্ত্তী হইবামাত্র উহারা তাঁহার গতিরোধ করিতে না পারিয়া সহসা দ্বিধা বিদীর্ণ হইয়া তাঁহাকে পথ প্রদান করিল। শুকদেব অচিরাৎ সেই পথ দিয়া নির্গত হইলেন। তদ্দর্শনে সকলেই চমৎকৃত হইয়া উঠিল। স্বর্গে দেবতাদিগের ঘোরতর কোলাহল শব্দ সমুত্থিত হইল। গন্ধৰ্ব্ব, ঋষি, যক্ষ, রাক্ষস ও বিদ্যাধরগণ এবং ঐ হিমালয়নিবাসী যাবতীয় প্রাণী মুক্তকণ্ঠে দ্বৈপায়নতনয়কে সাধুবাদ প্রদান করিতে লাগিলেন। অন্তরীক্ষ হইতে দিব্য পুষ্পবৃষ্টি হইতে লাগিল। অনন্তর মহাত্মা শুকদেব আকাশমার্গে গমন করিতে করিতে পুষ্পিত বৃক্ষ ও উপবনযুক্ত অতি রমণীয় মন্দাকিনী সন্দর্শন করিলেন। ঐ নদীতে অলৌকিক রূপলাবণ্যসম্পন্ন অপ্সরাগণ বিবস্ত্র হইয়া ক্রীড়া করিতেছিল। তাহারা শুকদেবকে অবলোকন করিয়া কিছুমাত্র লজ্জিত হইল না।
“ঐ সময় মহর্ষি বেদব্যাস শুকদেবের ঊৰ্দ্ধপ্রয়াণের [ঊর্ধ্বগতির] বিষয় অবগত হইয়া পুত্রস্নেহনিবন্ধন তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলেন। মহাত্মা শুকদেব এককালে মমতাশূন্য হইয়া বায়ুর ঊর্ধ্বে গমনপূর্ব্বক স্বীয় প্রভাবপ্রদর্শন করিয়া পরব্রহ্মে লীন হইলেন।
ব্যাস-শুকের যোগপ্রভাব-তারতম্য
“তখন মহর্ষি বেদব্যাস যোগগতিপ্রভাবে নিমেষমধ্যে শুকদেব যে স্থান হইতে সর্ব্বপ্রথমে আকাশমার্গে সমুদিত হইয়াছিলেন, তথায় সমাগত হইয়া দেখিলেন, মহাত্মা শুকদেব পৰ্ব্বতশৃঙ্গ বিদীর্ণ করিয়া তথা হইতে প্রস্থান করিয়াছেন। ঐ সময় মহর্ষিগণ চতুর্দ্দিক হইতে তাঁহার নিকট সমাগত হইয়া শুকদেবের অলৌকিক কার্য্যসমুদয় কীৰ্ত্তন করিলেন। মহর্ষি বেদব্যাস পুত্রের ঊর্দ্ধপ্রয়াণবার্ত্তা সবিশেষ অবগত হইয়া ‘হা বৎস!’ বলিয়া উচ্চৈঃস্বরে চীৎকার করিয়া ত্রিলোক অনুনাদিত করিলেন। তখন ব্রহ্মভাবপ্রাপ্ত ধর্ম্মাত্মা শুকদেব সৰ্ব্বগামী হইয়া পর্ব্বতাদি সকল পদার্থ হইতে ‘ভো’, এই শব্দ উচ্চারণপূর্ব্বক প্রত্যুত্তর প্রদান করিতে আরম্ভ করিলেন। এই সময় সমুদয় বিশ্বমধ্যে ‘ভো’ এই একাক্ষর শব্দ সমুচ্চারিত হইল; সেই অবধি অদ্যাপি গিরিগহ্বর প্রভৃতি স্থানে শব্দ উচারণ করিলে তাহার প্রতিশব্দ প্রাদুর্ভূত হয়।
“মহাত্মা শুকদেব এইরূপে শব্দাদি গুণসমুদয় পরিত্যাগপূৰ্ব্বক অন্তর্হিত হইয়া স্বীয় প্রভাব প্রদর্শনপূৰ্ব্বক ব্রহ্মপদ লাভ করিলে মহর্ষি বেদব্যাস অমিততেজাঃ স্বীয় পুত্রের প্রভাব দর্শনপূৰ্ব্বক সেই হিমালয় প্রস্থদেশে আসীন হইয়া তাহার বিষয় অনুধ্যান করিতে লাগিলেন। তখন সেই মন্দাকিনী তীরস্থিত বিবস্ত্রা অপ্সরাগণ তাঁহাকে অবলোকন করিবামাত্র অতিমাত্র লজ্জিত হইয়া কেহ কেহ জলে নিমগ্ন, কেহ কেহ বনমধ্যে প্রবিষ্ট এবং কেহ কেহ বা স্ব স্ব বসনগ্রহণে একান্ত তৎপর হইল। মহাত্মা ব্যাসদেব তদ্দর্শনে পুত্রকে মুক্ত ও আপনাকে বিষয়াসক্ত বিবেচনা করিয়া যুগপৎ হর্ষ ও লজ্জায় সমাক্রান্ত হইলেন।
শিবকর্ত্তৃক ব্যাসের সান্ত্বনা—বরপ্রদান
“অনন্তর মহর্ষিগণপূজিত ভগবান্ পিনাকপাণি [মহাদেব] দেবতা ও গন্ধৰ্ব্বগণে পরিবেষ্টিত হইয়া পুত্রশোকার্ত্ত মহর্ষি বেদব্যাসের নিকট আগমনপূৰ্ব্বক সান্ত্বনাবাক্যে তাঁহাকে কহিলেন, ‘মহর্ষে! পূৰ্ব্বে তুমি আমার নিকট অগ্নি, বায়ু, জল, ভূমি ও আকাশের ন্যায় বীর্য্যসম্পন্ন পুত্র প্রার্থনা করিয়াছিলে, আমিও তোমাকে তোমার প্রার্থনারূপ পুত্র প্রদান করিয়াছিলাম। এক্ষণে তোমার সেই দেবদুর্ল্লভ পরমগতিলাভ করিয়াছেন; অতএব তুমি কি নিমিত্ত অনুতাপ করিতেছ? নগর ও পৰ্ব্বতসমুদয় যে পর্য্যন্ত এই ভূণ্ডলে বিদ্যমান থাকিবে, সেই পর্য্যন্ত তোমার ও তোমার পুত্রের অক্ষয় কীৰ্ত্তির ঘোষণা হইবে। এক্ষণে আমি তোমাকে এই বর প্রদান করিতেছি যে, তুমি এই ভূমণ্ডলমধ্যে সর্ব্বদা সৰ্ব্বস্থানে স্বীয় পুত্রসদৃশ ছায়া সন্দর্শন করিতে পারিবে। ভগবান ভূতপতি ব্যাসদেবকে এইরূপ বর প্রদান করিলে তিনি পুত্রসদৃশ ছায়া সন্দর্শন করিয়া পরিতুষ্ট হইলেন।
“হে ধৰ্ম্মরাজ! তুমি আমাকে ধর্ম্মাত্মা শুকদেবের জন্ম ও সদ্গতি প্রভৃতি যেসকল বিষয় জিজ্ঞাসা করিয়াছিলে, তাহা বিস্তারিতরূপে কীৰ্ত্তন করিলাম। পূর্ব্বে দেবর্ষি নারদ ও মহাতপস্বী, বেদব্যাস বারংবার এই বৃত্তান্ত কীৰ্ত্তন করিয়াছিলেন। যিনি এই মোক্ষধৰ্ম্মযুক্ত পরমপবিত্র ইতিহাস শ্রবণ করেন, তিনি অনায়াসে শান্তগুণাবলম্বী হইয়া পরমগতিলাভ করিতে পারেন।”