৩৩৩. শুকের যোগাবলম্বন—আত্মদর্শন

৩৩৩তম অধ্যায়

শুকের যোগাবলম্বন—আত্মদর্শন

ভীষ্ম কহিলেন, “অনন্তর মহাত্মা ব্যাসতনয় সেই পৰ্ব্বতের শৃঙ্গে আরোহণপূর্ব্বক পরিচ্ছন্ন, জনশূন্য সমতল প্রদেশে উপবেশন করিয়া পাদ-অবধি কেশাগ্ৰ পর্য্যন্ত সৰ্ব্বশরীরে একমাত্র আত্মাকে অবলোকন করিতে লাগিলেন। পরে দিবাকর উদিত হইলে পূর্ব্বাস্য হইয়া বিনীতভাবে কর-চরণ সংযমপূৰ্ব্বক উপবেশন করিয়া রহিলেন। যে স্থানে শুকদেব যোগসাধন করিতে আরম্ভ করিলেন, তথায় পক্ষীর কোলাহল বা জনমানবের সঞ্চারমাত্র রহিল না। তিনি অতি অল্পক্ষণমধ্যেই সৰ্ব্বসঙ্গবিমুক্ত আত্মাকে প্রত্যক্ষ করিয়া হাস্য করিতে লাগিলেন। ঐ সময় তাঁহার আহ্লাদের পরিসীমা রহিল না। তখন তিনি দেবর্ষি নারদকে প্রদক্ষিণপূর্ব্বক আপনার যোগের বিষয় তাঁহার কর্ণগোচর করিয়া 
কহিলেন, ‘তপোধন! আপনি আমাকে যোগপথ প্রদর্শন করিয়াছেন, এক্ষণে আমি আপনার অনুকম্পায় স্বকার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়া অভীষ্ট গতিলাভ করিব।’
 

“দ্বৈপায়নতনয় শুক এই বলিয়া নারদকে অভিবাদন ও তাঁহার অনুজ্ঞা গ্রহণপূৰ্ব্বক পুনরায় যোগে মনোনিবেশ করিয়া আকাশমার্গে উত্থিত হইয়া বায়ুর ন্যায় বিচরণ করিতে লাগিলেন। তৎকালে তাঁহাকে মনোমারুতবেগে গমন করিতে দেখিয়া সকলেই বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া উঠিল। সেই সূৰ্য্যোজ্জ্বলসঙ্কাশ [সূর্য্য ও অগ্নির প্রভাবপুঞ্জযুক্ত] মহাত্মা শুকদেব ত্রিলোককে আত্মময় বিবেচনা করিয়া ক্রমে ক্রমে দূরপথে গমন করিতে লাগিলেন। স্থাবরজঙ্গমাত্মক সমস্ত প্রাণী তাঁহাকে অব্যগ্রমনে অকুতোভয়ে গমন করিতে দেখিয়া সাধ্যানুসারে তাঁহার অর্চ্চনা করিতে লাগিল। দেবগণ তাঁহার উপর পুষ্পবৃষ্টি করিতে আরম্ভ করিলেন। মহর্ষি, সিদ্ধ, অঙ্গরা ও গন্ধৰ্ব্বগণ তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিয়া বিস্ময়াবিষ্টচিত্তে কহিলেন, ‘এই মহাত্মা তপোবলে সিদ্ধিলাভ করিয়া অন্তরীক্ষে সঞ্চরণ এবং দেহের উত্তরার্দ্ধলম্বিত [দীর্ঘাকার] করিয়া ঊৰ্দ্ধমুখে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিতেছেন, ইনি 
কে?’
 

“অনন্তর সেই ধৰ্ম্মপরায়ণ ত্রিলোকবিশ্রুত মহাত্মা শুকদেব পূর্ব্বাস্য হইয়া দিবাকরের প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপপূৰ্ব্বক গভীরশব্দে নভোমণ্ডল পরিপূর্ণ করিয়া ক্রমাগত গমন করিতে লাগিলেন। পঞ্চচূড়াদি অপ্সরাগণ তাঁহাকে সহসা আগমন করিতে দেখিয়া সসম্ভ্রমে, বিস্ময়-বিস্ফারিত-লোচনে পরস্পর কহিতে লাগিল, ‘এই মহাত্মা উৎকৃষ্ট গতিলাভপূৰ্ব্বক বিমুক্তের ন্যায় নিস্পৃহভাবে এইদিকে আগমন করিতেছেন, ইনি কোন দেবতা?’ অনন্তর শুকদেব সেইস্থান হইতে মলয়পৰ্ব্বতাভিমুখে ধাবমান হইয়া ক্রমে ঐ পর্ব্বত অতিক্রম করিলেন। ঐ পৰ্ব্বতে অপ্সরা ঊর্ব্বশী ও পূর্ব্বচিত্তি বাস করিতেছিল। উহারা শুককে দর্শন করিয়া যারপরনাই বিস্ময়াবিষ্ট হইল। উর্ব্বশী পূর্ব্বচিত্তিকে কহিল, ‘দেখ, বেদাভ্যাসনিরত ব্রাহ্মণের কি বুদ্ধির একাগ্রতা! ইনি পিতৃশুশ্রূষাদ্বারা উৎকৃষ্ট বুদ্ধিলাভ করিয়া অনতিকালমধ্যে চন্দ্রের ন্যায় অন্তরীক্ষ অতিক্রম করিতেছেন। ইনি সাতিশয় পিতৃভক্তিপরায়ণ ও পিতার অতিশয় প্রিয়। ইহার পিতা ইহাকে কিরূপে অনায়াসে পরিত্যাগ করিলেন?’

“উর্ব্বশী এই কথা কহিবামাত্র ধর্ম্মাত্মা শুকদেবের পিতৃবৃত্তান্ত স্মৃতিপথে সমুদিত হইল। তখন তিনি অন্তরীক্ষ, চতুর্দ্দিক, শৈল, কানন, সরিৎ ও সরোবরসমুদয়ের প্রতিই দৃষ্টিনিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। ঐ সময় দেবগণ কৃতাঞ্জলিপুটে অভ্রান্তচিত্তে শুকদেবকে নিরীক্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন। অনন্তর মহাত্মা ব্যাসতনয় সেই শৈলকানন প্রভৃতি সকলকেই সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘হে আত্মীয়গণ! যদি আমার পিতা আমার নাম গ্রহণপূৰ্ব্বক মুক্তকণ্ঠে আমাকে আহ্বান করিতে করিতে আমার অনুসরণ করেন, তাহা হইলে তোমরা সকলে সমাহিতমনে তাঁহার বাক্যের প্রত্যুত্তর প্রদান করিবে। তোমরা আমার প্রতি স্নেহনিবন্ধন আমার এই বাক্যটি অবশ্য রক্ষা করিও।’

‘মহাত্মা শুকদেব এই কথা কহিলে দিঙ্মণ্ডল, কানন, শৈল, সমুদ্র ও নদীসমুদয় তাঁহাকে কহিল, ‘মহাত্মন্! আপনি যেরূপ অনুজ্ঞা করিতেছেন, আমরা তাহা সম্পাদন করিব। আপনার পিতা মহর্ষি ব্যাস আপনাকে আহ্বান করিলেই আমরা তাঁহাকে প্রত্যুত্তর প্রদান করিব।’ ”