৩৩২তম অধ্যায়
অমোঘ দৈবপ্রভাব
“নারদ কহিলেন, “হে বৎস! যখন দৈবপ্রভাবে লোকের দুঃখ উপস্থিত হয়, তখন কি পৌরুষ, কি প্রজ্ঞা, কি নীতিবল কিছুতেই উহা নিবারণ করা যায় না। যাহা হউক, স্বভাবতঃ সর্ব্বদা সাবধান হওয়া আবশ্যক। সাবধান ব্যক্তিকে প্রায়ই অবসন্ন হইতে হয় না। জরা, মৃত্যু ও রোগ হইতে প্রিয়তম আত্মাকে উদ্ধার করা সৰ্ব্বতোভাবে বিধেয়। শারীরিক ও মানসিক রোগসমুদয় ধনুর্ব্বেদবিশারদ ধনুর্দ্ধরনিক্ষিপ্ত সুতীক্ষ্ণ সায়কের ন্যায় শরীরকে নিতান্ত নিপীড়িত করে। রোগাৰ্ত্ত, একান্ত অবসন্ন, জীবিততৃষ্ণা[বাঁচিবার আগ্রহ]পরায়ণ মানবদিগের শরীর ক্রমশঃ ক্ষীণ হইয়া মৃত্যুমুখে নিপতিত হয়। দিবা ও রজনী জীবগণের আয়ু গ্রহণ করিয়া নদীর স্রোতের ন্যায় ক্রমাগত অপক্রান্ত হইতেছে, কখনই প্রত্যাগত হইবে না। কৃষ্ণ ও শুক্লপক্ষ পর্য্যায়ক্রমে অনবরত গমনাগমন করিয়া মানবগণকে জীর্ণ করিতেছে; সূর্য্য স্বয়ং অজর, কিন্তু উনি পর্য্যায়ক্রমে সমুদয় ও অস্তমিত হইয়া জীবগণের সুখদুঃখ জীর্ণ করিতেছেন; রাত্রিও মানবদিগের অদৃষ্টপূৰ্ব্ব ঘটনাসমুদয়কে সহচর করিয়া প্রস্থান করিতেছে।
যদি ক্রিয়াফলসমুদয় পরাধীন না হইত, তাহা হইলে যে যাহা বাসনা করিত, তাহার তাহাই সিদ্ধ হইত। অনেক সময় নিয়মধারী [নিয়মনিষ্ঠ] কার্য্যদক্ষ মতিমান্ ব্যক্তিও সমুদয় সৎকম্র্ম হইতে পরিভ্রষ্ট হইয়া ফললাভে বঞ্চিত হয়, আবার অনেক সময় অনেক নির্গুণ নরাধম মূর্খও উৎকৃষ্ট ফললাভ করিয়া থাকে। ইহকালে কেহ কেহ সৰ্ব্বদা লোকের হিংসা ও বঞ্চনা করিয়াও পরমসুখে কালাতিপাত করিতেছে; কেহ কেহ বিনা চেষ্টায় অতুল ঐশ্বর্য্যের অধিপতি হইতেছে; আবার কেহ কেহ বা বিবিধ সৎকৰ্ম্মের অনুষ্ঠান করিয়াও কিছুমাত্র ফল লাভ করিতে সমর্থ হইতেছে না।
‘আর দেখ, মানবদিগের বীর্য্য এক স্থানে সম্ভূত হইয়া পুনরায় অন্য স্থানে গমনপূৰ্ব্বক সন্তানোৎপাদন করিতেছে। উহা অনেক সময় যথাস্থানে নিবেশিত হইয়াও গর্ভ উৎপাদন না করিয়াই চ্যুত [তরুশাখা হইতে স্খলিত] কুসুমের ন্যায় বিনষ্ট হইয়া যায়। কেহ পুত্রার্থে নানাবিধ যত্ন করিয়াও কৃতকার্য্য হইতে পারিতেছে না; আবার কেহ কেহ বা গর্ভকে ক্রুদ্ধ আশীবিষের ন্যায় ক্লেশকর জ্ঞান করিয়াও দীর্ঘজীবী পুত্র লাভ করিতেছে। অনেকানেক কুলকামিনী, পুত্রকামনায় ঘোরতর তপানুষ্ঠানপূর্ব্বক দশমাস গর্ভধারণ করিয়া কুলাঙ্গার পুত্র প্রসব করে; কেহ কেহ জন্মাবধি পিতৃসঞ্চিত ধনধান্য ও বিপুল ঐশ্বর্য্যের অধিপতি হইতেছে; আবার কেহ কেহ বা চিরকাল দুঃখে অতিবাহিত করিতেছে। স্ত্রীপুরুষের পরস্পর সহযোগসময়ে পুরুষের শুক্র জীবরূপে পরিণত হইয়া স্ত্রীর গর্ভকোষে প্রবিষ্ট হয়। তৎপরে ক্রমে ক্রমে সেই জীবের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সমুৎপন্ন হইলে সে নৌকার উপর সংস্থাপিত নৌকার ন্যায় মাতৃগর্ভে অবস্থান করে। কিন্তু কি আশ্চর্য্য! সেই শুক্র উদরমধ্যে থাকিয়া অন্নপানীয় ও অন্যান্য ভক্ষ্য বস্তুর ন্যায় জীর্ণ হইয়া যায় না।
‘সকলকেই মূত্রপুরীষের আধার গর্ভমধ্যে জন্মপরিগ্রহ করিতে হয়। কেহই আপনার ইচ্ছানুসারে গর্ভমধ্যে বাস ও উহা হইতে বহির্গমন করিতে পারে না। কেহ কেহ গর্ভস্রাবে, কেহ কেহ জন্মপরিগ্রহের সময় এবং কেহ কেহ জন্মিবামাত্র বিনষ্ট হইয়া যায়। স্থাবির্য্য [অত্যন্ত বার্দ্ধক্যে মতিচ্ছন্নতা—মূঢ়তা] ও প্রাণরোধ প্রভৃতি দশাসমুদয় দেহকেই আক্রমণ করে; আত্মাকে কখনই আশ্রয় করে না। লোকে রোগে একান্ত আক্রান্ত হইলে তাহার উত্থানশক্তি তিরোহিত হইয়া যায়। তখন সে আরোগ্যলাভের নিমিত্ত সুনিপুণ চিকিৎসকগণকে বিপুল অর্থ প্রদান করে; কিন্তু চিকিৎসকগণ যারপরনাই যত্নবান হইয়াও উহাকে সুস্থ করিতে সমর্থ হয় না। কালক্রমে ঔষধসঞ্চয়নিরত সুবিজ্ঞ বৈদ্যগণকেও ব্যাঘ্রপীড়িত মৃগগণের ন্যায় দারুণ রোগে সমাক্রান্ত হইতে হয়। তাহারা বিবিধ কটুকষায় রস ও ঘৃত পান করিয়াও জরার হস্ত হইতে মুক্ত হইতে পারে না। যাহাদিগের চিকিৎসা করাইবার ক্ষমতা থাকে, রোগ তাহাদিগকেই আক্রমণ করে। দেখ, মৃগ, পক্ষী, শ্বাপদ ও দরিদ্রগণকে কেহই চিকিৎসা করে না, অথচ তাহারা প্রায়ই সুস্বশরীরে কালহরণ করিতেছে। কিন্তু উগ্রতেজাঃ দুর্দ্ধর্ষ নরপতিগণ নিরন্তর বিবিধ রোগে আক্রান্ত হইয়া যারপরনাই ক্লেশ পাইতেছেন।
‘এইরূপে মানবগণ সংসারসাগরের প্রবলস্রোতে নিক্ষিপ্ত ও প্রবাহিত হইয়া সতত শোকমোহে পরিব্যাপ্ত ও বেদনায় নিতান্ত সমাক্রান্ত হইতেছে। কেহই রাজ্য, ধন বা কঠোর তপস্যাদ্বারা স্বভাবকে অতিক্রম করিতে সমর্থ হয় না। যদি সকল কার্য্যেরই উদ্যোগ সফল হইত, তাহা হইলে ইহলোকে কাহাকেও জীর্ণ বা মৃত্যুমুখে নিপতিত হইতে হইত না; সকলেই সকল বিষয়ে সিদ্ধিলাভ করিতে পারিত। ইহলোকে মনুষ্যমাত্রেই সৰ্ব্বাপেক্ষা উন্নত হইবার নিমিত্ত যথাসাধ্য চেষ্টা করে; কিন্তু কেহই কৃতকার্য্য হইতে পারে না। অনেকানেক অপ্রমত্ত সরলস্বভাব পরাক্রান্ত ব্যক্তিও সুরাপানে উন্মত্ত ঐশ্বর্য্যমদে মত্ত মূঢ়দিগকে উপাসনা করিয়া থাকে। কোন কোন ব্যক্তি ক্লেশ সমুপস্থিত হইলে উহার নিবারণের উপায়বিধান করিবার পূর্ব্বেই অনায়াসে উহা হইতে বিমুক্ত হয় এবং কেহ কেহ বা আপনার বিপুল অর্থ থাকিতেও উহা প্রাপ্ত না হইয়া যারপরনাই ক্লেশ ভোগ করে। ইহলোকে কৰ্ম্মনিষ্ঠদিগের কর্ম্মের বৈলক্ষণ্যনিবন্ধন ফলের বৈলক্ষণ্য লক্ষিত হইয়া থাকে।
‘দেখ, কেহ কেহ শিবিকায় [পালকিতে] আরোহণ, আবার কেহ কেহ বা শিবিকা বহন করিয়া গমন করিতেছে; কেহ কেহ রথে আরোহণ করিতেছে, আবার কেহ কেহ বা রথের অগ্রে অগ্রে ধাবমান হইতেছে। শত শত পুরুষ স্ত্রীবিরহিত হইয়া কালযাপন করিতেছে, আবার শত শত স্ত্রীও পুরুষবিরহে দুঃখসাগরে নিমগ্ন হইতেছে। এইরূপে সমুদয় প্রাণীকেই কামনানিবন্ধন সংসারে জন্মগ্রহণ করিয়া স্বীয় স্বীয় কার্য্যের ফল ভোগ করিতে হয়; অতএব তুমি মোহবিহীন হইয়া প্রথমতঃ জ্ঞানবলে ধৰ্ম্ম অধর্ম্ম এবং সত্য ও মিথ্যা পরিত্যাগ করিয়া পশ্চাৎ জ্ঞানকেও পরিত্যাগ কর। এই আমি তোমার নিকট পরমগূঢ় বিষয় কীৰ্ত্তন করিলাম। দেবগণ এই উপায় অবলম্বন করিয়া মৰ্ত্তলোক পরিত্যাগপূর্ব্বক স্বর্গলোক লাভ করিয়াছেন।’
নারদের উপদেশে শুকের বৈরাগ্য
“তপোধনাগ্রগণ! নারদ এই উপদেশ প্রদান করিলে ধর্ম্মপরায়ণ শুকদেব তাঁহার বাক্য শ্রবণ করিয়া মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলেন, ‘স্ত্রীপুত্রাদি পরিবারবর্গে পরিবৃত হইয়া বাস করিলে বহুতর কষ্টভোগ করিতে হয়, আর বেদবিদ্যার অনুশীলনও সামান্য পরিশ্রমের সাধ্য নহে। অতএব অল্পায়াসসাধ্য নিত্যস্থান লাভ করিতে না পারিলে কিছুতেই সুখলাভের সম্ভাবনা নাই। ঐ স্থান কিরূপ?’ মহাত্মা শুকদেব এইরূপে অতি অল্পকালমাত্র তর্কবিতর্ক করিতেই নিত্যস্থান যে কিরূপ, তাহা তাঁহার হৃদয়ঙ্গম হইল। তখন তিনি পুনরায় মনে মনে এই চিন্তা করিতে লাগিলেন, ‘আহা! আমি কিরূপে সেই উৎকৃষ্ট স্থানে গমন করিব? ঐ স্থানে গমন করিলে আর আমাকে সংসারসাগরে নিমগ্ন হইতে হইবে না; কাহারও সহিত আমার কিছুমাত্র সংসর্গ থাকিবে; আমার আত্মা এককালে শান্তি লাভ করিবে এবং আমি অক্ষয় হইয়া অনন্তকাল পরমসুখে অতিবাহিত করিব। এক্ষণে যোগ ব্যতীত সেই পরমপদলাভের উপায়ান্তর নাই।
‘জ্ঞানী ব্যক্তিরা কখনই কর্ম্মপাশে বদ্ধ হয় না। অতএব আমি যোগবলে এই কলেবর পরিত্যাগপূর্ব্বক বায়ুভূত [অতিসূক্ষ্ম বায়ুস্বরূপ] হই। তেজোরাশিপরিপূর্ণ অর্কমণ্ডলে প্রবেশ করিব। চন্দ্র দেবগণের সহিত ক্ষয়প্রাপ্ত হইয়া একবার ভূতলে নিপতিত ও পুনৰ্ব্বার স্বর্গে অধিরূঢ় হয়েন এবং বারংবার তাঁহার হ্রাসবৃদ্ধি হইয়া থাকে; এই নিমিত্ত চন্দ্রমণ্ডলে প্রবেশ করিতে আমার অভিলাষ হইতেছে না। চন্দ্রের ন্যায় সূর্য্যের হ্রাসবৃদ্ধি বা পতন নাই। তিনি নিরন্তর তীক্ষ্ণ কিরণজাল বিস্তারপূৰ্ব্বক লোকসমুদয়কে তাপিত করিতেছেন। অতএব আমি এই কলেবর পরিত্যাগপূৰ্ব্বক একমাত্র পরমাত্মাকে আশ্রয় করিয়া বৃক্ষ, পৰ্ব্বত, পৃথিবী, দিকসমুদয়, আকাশ, দেব, দানব, গন্ধৰ্ব্ব, পিশাচ, উরগ ও রাক্ষসগণের সহিত সূর্য্যমণ্ডলে প্রবিষ্ট হইয়া নিঃশঙ্কচিত্তে অবস্থান করিব। আজ দেবতা, সিদ্ধ ও মহর্ষিগণ আমার যোগবল দর্শন করুন। যোগবলে সমুদয় প্রাণীতেই আমার অব্যর্থ গতিলাভ হইবে, সন্দেহ নাই।
“মহাত্মা শুকদেব মনে মনে এইরূপ নিশ্চয় করিয়া লোকবিশ্রুত নারদের অনুজ্ঞা গ্রহণপূৰ্ব্বক স্বীয় পিতা বেদব্যাসের নিকট উপস্থিত হইলেন এবং তাঁহাকে প্রণাম ও প্রদক্ষিণ করিয়া তাঁহার নিকট আপনার অভিলাষ ব্যক্ত করিলেন। তখন ভগবান্ বেদব্যাস পুত্রের সেইরূপ বাক্যশ্রবণে তাঁহাকে যোগানুষ্ঠানার্থ প্রস্থানোদ্যত বিবেচনা করিয়া পরমপ্রীত হইয়া কহিলেন, ‘বৎস! তুমি ক্ষণকাল অপেক্ষা কর, আমি তোমাকে দর্শন করিয়া নয়নদ্বয় চরিতার্থ করি।’
“ব্যাসদেব এইরূপ সস্নেহবাক্য প্রয়োগ করিলেও মহাত্মা শুকদেব তাহাতে কিছুমাত্র বিচলিত না হইয়া পিতাকে পরিত্যাগপূৰ্ব্বক নিঃসন্দিগ্ধচিত্তে মোক্ষলাভের উপায় চিন্তা করিতে করিতে সিদ্ধগণনিষেবিত কৈলাসপর্ব্বতে আরোহণ করিলেন।”