৩৩১. সুখদুঃখের কারণ—প্রতিকার উপায়

৩৩১তম অধ্যায়

সুখদুঃখের কারণ—প্রতিকার উপায়

“নারদ কহিলেন, ‘হে বৎস! শোকনাশন শান্তিকর শাস্ত্র শ্রবণ করিলে বিশুদ্ধ বুদ্ধি লাভ ও পরমসুখ অনুভূত হইয়া থাকে। সহস্র প্রকার শোক ও ভয় প্রতিদিন মূঢ়দিগকেই আশ্রয় করে; পণ্ডিতেরা কখনই ঐ সমুদয়ে অভিভূত হয়েন না। এক্ষণে আমি তোমার অনিষ্টনাশের নিমিত্ত তোমাকে কতকগুলি উপদেশ প্রদান করিতেছি, শ্রবণ কর।

‘বুদ্ধিকে বশীভূত করিতে পারিলেই শোকসমুদয় বিনষ্ট হইয়া যায়। অল্পবুদ্ধি মূঢ়ব্যক্তিরাই অনিষ্টসংযোগ ও ইষ্টবিয়োগনিবন্ধন মানসিক দুঃখে অভিভূত হয়; অতএব অতীত বস্তুর গুণ চিন্তা করা কাহারও কর্ত্তব্য নহে। যাহারা অতীত বিষয়ের চিন্তায় আসক্ত হয়, তাহারা কোন কালেই স্নেহপাশ হইতে মুক্তিলাভে সমর্থ হয় না, মহাত্মারা কোন বিষয়ে অনুরাগ জন্মিবার উপক্রম হইলে সেই বিষয় অনিষ্টজনক ও দোষের আকর বিবেচনা করিয়া অচিরাৎ তাহা পরিত্যাগ করেন। যাহারা অতীত বিষয়ের নিমিত্ত অনুতাপ করে, তাহাদিগকে ধৰ্ম্ম ও যশোলাভে বঞ্চিত হইয়া অতিকষ্টে কালহরণ করিতে হয়। অনুতাপদ্বারা কখনই অতীত বিষয় লাভ করা যায় না। সমুদয় প্রাণীই কখন বিষয়প্রাপ্ত ও কখন বা বিষয়চ্যুত হইতেছে। ইহলোকে কোন ব্যক্তিই সমুদয় ঘটনাদ্বারা শোকমুক্ত হয় না। যাহারা মৃতব্যক্তির উদ্দেশ্যে অথবা প্রিয়বস্তুর বিয়োগে দুঃখ প্রকাশ করে, তাহারা দুঃখদ্বারা দুঃখই লাভ করিয়া থাকে।

যাঁহারা ইহলোকে জন্ম-মরণ-প্রবাহ অবলম্বন করিয়া ইষ্টবিয়োগে শোকপ্রকাশ ও অশ্রুপাত না করেন তাঁহারাই যথার্থ সম্যগদর্শী। কোন প্রকার শারীরিক বা মানসিক দুঃখ উপস্থিত হইলে যদি প্রভূত যত্নদ্বারাও উহা নিবারণ করা না যায়, তাহা হইলে ঐ দুঃখের চিন্তা করা কখনই কর্ত্তব্য নহে; চিন্তা না করাই দুঃখশান্তি করিবার মহৌষধ। চিন্তা করিলে কখনই দুঃখের হ্রাস হয় না, বরং বৃদ্ধিই হইয়া থাকে। অতএব জ্ঞানদ্বারা মানসিক দুঃখ ও ঔষধদ্বারা শারীরিক দুঃখ নিবারণ করা সৰ্ব্বতোভাবে কৰ্ত্তব্য। শাস্ত্রজ্ঞানপ্রভাবেই এইরূপ কার্য্যের অনুষ্ঠান করা যায়। নিতান্ত বালকের ন্যায় শোক-হর্ষাদিতে অভিভূত হওয়া কদাপি বিধেয় নহে। যৌবন, রূপ, জীবন, দ্রব্যসঞ্চয়, আরোগ্য ও প্রিয়সংসর্গ চিরস্থায়ী নহে। পণ্ডিত ব্যক্তিরা কখনই ঐ সমুদয় বিষয়ে আসক্ত হয়েন না। ইহলোকে সকলেরই পুত্রাদিবিয়োগ হইতেছে; অতএব তন্নিবন্ধন শোকপ্রকাশ করা বুদ্ধিমান ব্যক্তির কদাপি কর্ত্তব্য নহে। যদি পুত্রাদিবিয়োগদর্শনে শোকের উপক্রম হয়, তাহা হইলে প্রযত্নসহকারে উহা নিবারণ করা অবশ্য কর্ত্তব্য। ইহলোকে প্রায় সমুদয় মনুষ্যকেই সুখের পর বহুবিধ দুঃখভোগ করিতে হয় এবং সকলেই মোহবশতঃ বিশেষ অনুরাগ প্রকাশ ও মৃত্যুকে অপ্রিয়জ্ঞান করিয়া থাকে। উঁহাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সুখ ও দুঃখ উভয়ই পরিত্যাগ করিতে পারেন, তিনিই পরমার্থ ব্ৰহ্মপদার্থলাভে সমর্থ হয়েন। পণ্ডিতেরা তাঁহাকে ইহলোক হইতে প্রস্থান করিতে দেখিয়া কখনই শোক করেন না।

‘অর্থ উপার্জ্জন, রক্ষা ও পরিত্যাগ করিবার সময় বিষমদুঃখ ভোগ করিতে হয়। অর্থ সকল অবস্থাতেই মনুষ্যকে ক্লেশ প্রদান করে; অতএব অর্থনাশনিবন্ধন চিন্তাসাগরে নিমগ্ন হওয়া কাহারও কৰ্ত্তব্য নহে। মূঢ়ব্যক্তিরাই উত্তরোত্তর ধনের উন্নতি লাভ করিয়া বিষয়ভোগে পরিতৃপ্ত না হইলেই বিনষ্ট হয়, কিন্তু পণ্ডিতেরা সকল অবস্থাতেই সন্তোষ লাভ করিয়া থাকেন। কালক্রমে সমুদয় সঞ্চিত পদার্থেরই ক্ষয়, সমুদয় উন্নত বস্তুর পতন, সংযোগমাত্রেরই বিয়োগ এবং জীবিত ব্যক্তিমাত্রেরই মরণ হইবে। বিষয়তৃষ্ণার অন্ত নাই। সন্তোষই পরমসুখের মূল; এই নিমিত্ত পণ্ডিতেরা সন্তোষকেই পরমধন জ্ঞান করিয়া থাকেন। আয়ু নিরন্তর ক্ষয়প্রাপ্ত হইতেছে; নিমেষমাত্ৰও উহার বিশ্রাম নাই। অতএব শরীর যখন চিরস্থায়ী নহে, তখন ইহলৌকিক কোন বিষয়ই চিন্তা করা মনুষ্যের কৰ্ত্তব্য নহে। যাঁহারা স্বীয় বুদ্ধিদ্বারা মনের অগোচর সৰ্ব্বভূতের অন্তর্গত পরমাত্মাকে চিন্তা করিয়া শোক পরিত্যাগ করিতে পারেন, তাঁহারাই পরমগতিলাভে সমর্থ হয়েন। ব্যাঘ্র যেমন পশুকে গ্রহণ করিয়া প্রস্থান করে, তদ্রূপ মৃত্যু অর্থান্বেষণপরায়ণ বিষয়ভোগে অতৃপ্ত মূঢ়দিগকে হরণ করিয়া লইয়া যায়। অতএব মৃত্যুযন্ত্ৰণামোচনের উপায় চিন্তা করা মনুষ্যের অবশ্য কর্ত্তব্য। মানবগণ শোকবিহীন হইয়া কার্য্যারম্ভ এবং বিষয়মুক্ত হইয়া দুঃখ পরিত্যাগ করিবে। কি বলবান, কি নিৰ্দ্ধন, যে ব্যক্তি যে সময়ে রূপরসাদি বিষয়সমুদয় ভোগ করে, তাহার তৎকালেই সুখলাভ হয়; কিন্তু পরে সেই সুখের লেশমাত্রও থাকে না। যখন পরস্পর সংযোগের পূৰ্ব্বে প্রাণীগণের দুঃখ উপস্থিত হয় না, তখন পরস্পরের বিয়োগে শোক করা প্রকৃতিস্থ ব্যক্তিদিগের কখনই কৰ্ত্তব্য নহে।

‘মানবগণ ধৈর্য্যদ্বারা শিশ্ন ও উদর, চক্ষুদ্বারা হস্ত ও পদ, মনদ্বারা চক্ষু ও কর্ণ এবং বিদ্যাদ্বারা মন ও বাক্য রক্ষা করিবে। যাঁহারা কি পূজ্য, কি ইতর, সমুদয় লোকের সহিত প্রণয় পরিত্যাগপূৰ্ব্বক প্রশান্তচিত্তে কালহরণ এবং যাঁহারা অধ্যাত্মতত্ত্বনিরত, নিরপেক্ষ ও লোভহীন হইয়া আত্মাকে সহায় করিয়া ইহলোকে বিচরণ করেন, তাঁহাদিগকেই যথার্থ সুখী ও পণ্ডিত বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়।”