শীত বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে, এর মধ্যে দুদিন তুষারপাত হয়ে গেল। পাতলা কোটে আর চলছে না, এবার আমার একটা ওভারকোট দরকার।
বঙ্গসন্তানের পক্ষে ওভারকোট একটা অত্যুক্তি বিশেষ। কিংবা অবাস্তব জিনিসও বলা যায়। দু-মাস, ছ’মাসের জন্য কলকাতা থেকে যারা পশ্চিম গোলার্ধে বেড়াতে যায়, তারা সাধারণত চেনাশুনো, বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে ধার নিয়ে আসে। আমার সে সুযোগ ঘটেনি। খুব একটা চেষ্টাও করিনি, কারণ আমি এদেশে এসেছি ঘোর গ্রীষ্মে, কলকাতা থেকে ওভারকোট নিয়ে এলে সারা গ্রীষ্ম ও শরঙ্কাল আমাকে অকারণে সেই বোঝা বইতে হত।
সুতরাং আমাকে একটা ওভারকোট কিনতে হবে।
একটা ভদ্রগোছের গরম কাপড়ের ওভারকোটের দাম অন্তত আড়াইশো ডলার। এ ছাড়া সিনথেটিক জিনিসের হাওয়া বন্ধ করা, শীত জব্দ-করা একরকমের জ্যাকেট পাওয়া যায় কিছু সস্তায়। সেগুলোতেও কাজ চলে বটে, কিন্তু কাউ বয়, মোটর রেসিং-এর চাম্পিয়ন কিংবা ব্যাঙ্ক ডাকাতদের মতন যাদের চেহারা তাদের গায়েই ওই জিনিস মানায়। আমি ওই রকম জ্যাকেট পরলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেই হাসব।
অতএব আমি একটা ওভারকোট কিনে ফেললুম। সেটা দেখতে বেশ জমকালো ও প্রথাসম্মত। প্রথম-প্রথম অনেকেই দেখে বলত, এই ওভারকোটটা নতুন কিনলে বুঝি? বাঃ, বেশ সুন্দর দেখতে তো! কাপড়টাও বেশ ভালো। যথেষ্ট গরম হয়, তাই না?
আমি যদি বলতুম, নিউ ইয়র্ক তথা আমেরিকার সর্বশ্রেষ্ঠ দোকান (কেউ-কেউ বলে সারা পৃথিবীরও) মেসি থেকে তিনশো ছিয়াত্তর ডলার দিয়ে এটা কিনেছি, তা হলে বোধহয় কেউ অবিশ্বাস করত না এখানে। কিন্তু কলকাতায় আমার বন্ধুবান্ধবরা ঠিক ধরে ফেলত। তারা ভুরু তুলে বলত, এ। তুই দু-পয়সার খদ্দের, তুই কিনেছিস পৌনে চারশো ডলার দিয়ে ওভারকোট। বললেই হল।
আসলে, আমি ওই চমৎকার ওভারকোটটা কিনেছি মাত্র দশ ডলার দিয়ে। কী করে অত সস্তার পেলুম, সে রহস্য আমি একটু পরেই খুলে বলছি।
এ দেশে দোকানের নাম নিয়ে চাল মারার খুব রেওয়াজ আছে। কারুর বাড়িতে নতুন কোনও জিনিস দেখলেই সেটা কোন দোকান থেকে কেনা সেটাও শুনিয়ে দেবে। অর্থাৎ কোনও বিখ্যাত দোকান। জিনিসের দামও দোকান অনুযায়ী বদলায়। প্রায় একই জিনিস কোনও সাধারণ দোকানে যা দাম, বিখ্যাত দোকানে দাম তার দ্বিগুণ। মেয়েরা এইসব বিখ্যাত দোকানগুলোর দাম খুব মুখস্থ রাখে। আবার বেশ সস্তারও দোকান আছে যেমন কে-মার্ট। এই কে-মার্ট দোকান এদেশের প্রায় প্রত্যেক শহরেই একটা করে আছে। এইসব দোকানে জুতোর ফিতে থেকে টিভি রেফ্রিজারেটার সবই পাওয়া যায়। দাম এমনিতেই সস্তা তারপর প্রায়ই লেগে থাকে ‘সেল’। ‘সেল’-এর সময় জিনিসের দাম অর্ধেকও কমে যায়। সেই জন্যই হিসেবি গৃহিণীরা প্রায়ই সন্ধের দিকে একবার কে-মার্ট ঘুরে যায়। কোন দিন কোন জিনিসের ‘সেল’ দিচ্ছে দেখবার জন্য। ক্যালিফোর্নিয়ার মোহিতেশ ব্যানার্জি বলেছিলেন, ‘কে-মার্ট হল বাঙালি মেয়েদের নাইট ক্লাব।
আমি কিন্তু আমার ওভারকোটটা কে-মার্ট থেকেও কিনিনি। কারণ কে-মার্টেও সস্তার একটা সীমা আছে, সেখানে তিনশো ডলারের জিনিস দেড়শো ডলারে দিতে পারে বড় জোর, দশ ডলারে তো দেবে না।
আরও এক রকমের দোকান আছে, যেগুলোর নাম বাজেট স্টোর, নেকসট টু নিউ, সেকেন্ডস, যাগ-স্টক এই ধরনের। এই সব দোকানে ছাত্র ছাত্রীরাই বেশি যায়, আর মধ্যবিত্তরা সেখানে যায় লুকিয়ে, ঘোর দুপুরবেলা, যখন অন্য কেউ দেখবে না। আর ভারতীয়রা তো অতি মাত্রায় হিপোক্রিট, তারা মরলেও স্বীকার করবে না যে কেউ কোনওদিন ওই সব দোকান থেকে জিনিস কিনেছে। সেই হিসেবে আমিই বোধহয় প্রথম ভারতীয় যে ওই রকম দোকানের ক্রেতা হল। সোজা বাংলায় ওগুলো হল সেকেন্ড হ্যান্ড জিনিসের দোকান।
সেরকম একটি বাজেট স্টোরে ঢুকে আমার তো চোখ ছানাবড়া হওয়ার উপক্রম। কতরকমের জিনিস, আর দাম কি অবিশ্বাস্য সস্তা! একটা সিল্কের সার্টের দাম দু-ডলার, একটা লিভাইজ জিনস-এর দাম তিন ডলার, পাঁচ ডলারে একটা জ্যাকেট। দশ ডলারের একটা বইয়ের দাম এক সিকি, একজোড়া বরফের জুতোর দাম দেড় টাকা। ইচ্ছে হয় সব কিছু কিনে নিই।
সব জিনিসই যে ব্যবহৃত তা নয়। কিছু কিছু জিনিস নতুনও আছে। যেসব পোশাকের ফ্যাশান বদলে গেছে, অনেক বড় দোকান সেই সব পোশাক লট ধরে জলের দরে বিক্রি করে দেয়। যেমন ধরা যাক, হাত কাটা, সামনে-খোলা সোয়েটার, এর আর ফ্যাশান নেই ইদানীং বড় বড় রাস্তার নাম করা সব দোকানে মাথা খুঁড়লেও সেরকম সোয়েটার খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু বাজেট স্টোরে সেই রকম সোয়েটার সারি-সারি ঝুলছে।
অনেক পরিবার তাদের বাড়ির অব্যবহৃত জিনিসপত্র স্যালভেশন আর্মিকে দান করে দেয়। যেমন, কোনও মহিলার স্বামী তাকে ছেড়ে শহরের অন্য প্রান্তে অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে বসবাস করছে কিংবা কোনও ভদ্রলোকের স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে গিয়ে সিনেমার অভিনেত্রী হয়েছে, এই সব প্রাক্তন স্বামী বা স্ত্রীর জামাকাপড় এরা জমিয়ে রাখে না বেশি দিন, বিক্রিও করে না, দান করে দেয় কোনও সেবা প্রতিষ্ঠানকে। এরা যখন গৃহত্যাগ করে, তখন সব জিনিসপত্র নিয়ে যায় না, শুধু গয়নাগাটি আর দু-একটা জরুরি পোশাক একটা ছোট সুটকেসে ভরে বেরিয়ে যায়। সেবা প্রতিষ্ঠানগুলি সেইসব বিনা পয়সায় পাওয়া জিনিসগুলো এই সব দোকান মারফৎ বিক্রি করে। স্বাস্থ্য ব্যাপারে খুঁতখুঁতে বলে আগে এরা ভালোভাবে সব কিছু জীবাণুমুক্ত করে নেয়। ঘনঘন ফ্যাশান বদলাবার কারণে বাতিল জামা কাপড়ের সংখ্যা এত বেশি, তাই দামও এরকম সস্তা।
অপরের ব্যবহৃত রুমাল বা অন্তর্বাস ব্যবহার করা সম্পর্কে আমার আপত্তি আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু অন্যের ব্যবহার করা ওভারকোট গায়ে দেওয়ার ব্যাপারে আমার কোনও শুচিবাই নেই। আমেরিকার একজন বিখ্যাত কবি একবার আমার ব্যবহৃত টুথব্রাশ দিয়ে দিব্যি অবলীলাক্রমে দাঁত মেজেছিলেন। এটা আমাদের কাছে অকল্পনীয়। কিন্তু সেই কবি বলেছিলেন, ভালো করে ধুয়ে নিলে সব কিছুই নাকি ব্যবহারযোগ্য হয়।
আমাকে বাজেট স্টোরে চিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল উরুগুয়ের এক লেখক বন্ধু। তার নাম পেপে। পেপে অতি সুসজ্জিত ও সুপুরুষ। সে একগাদা জামা-প্যান্ট-কোট কিনে ফেলল। তিনটে বেশ বড় বোঁচকা হয়ে গেল। আমি পেপে-কে জিগ্যেস করলুম, তুমি এত পোশাক নিয়ে কী করবে? পেপে বলল, আমার স্বভাব কি জানো, পরি আর না পরি, আমার ওয়ার্ডরোবে অনেক জামাকাপড় ঝুলিয়ে রাখতে খুব ভালো লাগে।
আমি অবশ্য ওভারকোট ছাড়া অন্য জিনিসপত্রে আর লোভ করলুম না, কারণ অনেক ঘোরাঘুরি করতে হবে, বেশি জিনিসপত্র বইবার ঝামেলা নিতে চাই না।
ওভারকোটটা পরে একটু ঘোরাঘুরি করতেই নিজেকে বেশ সাহেব-সাহেব মনে হল। ওভারকোটের পকেটে দু-হাত ঢুকিয়ে দিলে হাঁটার স্টাইলই পালটে যায়। আমার এই ওভারকোটটায় প্রায় সাত-আটটা পকেট। প্রথম দিন ভালোভাবে দেখিনি, দ্বিতীয় দিনে সবকটি পকেটে তদন্ত করতে আমি পেয়ে গেলুম কিছু খুচরো পয়সা, কয়েকটা কাগজ আর দুটো লাল পাথরের দুল। এই দুল জোড়া হাতে নিয়ে আমি বিমূঢ় হয়ে গেলুম। ওভারকোটটা যে-কোনও পুরুষের তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সেই কোটের পকেটে মেয়েলি দুল কেন? এ যে রহস্য কাহিনির মতন।
দুল দুটো সোনালি হলেও সোনার নয়, পাথর দুটোও দামি মনে হয় না, এগুলোকে এদেশে বলে কস্টিউম জুয়েলারি। রহস্য কাহিনি বানাবার প্রতিভা আমার নেই, কিন্তু দুল দুটো নিয়ে আমি বেশ চিন্তায় পড়ে গেলুম। আমার কোটের ভূতপূর্ব মালিক কীরকম লোক ছিল? সে ডাকাত নিশ্চয়ই না, তার পকেটে এত সস্তার দুল কেন? তা হলে কি সে ছিল খুব প্রেমিক ধরনের? কিংবা খুনি?
টিউব ট্রেনে যেতে-যেতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলুম। হঠাৎ ভাবলুম, কোথায় যাচ্ছি? এ যে আমার গন্তব্যের উলটোদিক। পরের স্টেশনেই নেমে ওপরে উঠে দেখলুম ফিফথ অ্যাভিনিউ আর ফিফটি নাইনথ স্ট্রিটের মুখে এসেছি। এ-পাড়ায় তো আমার কোনও দরকার নেই, এখানে এলুম কেন? এ তো বড়লোকের পাড়া। ওভারকোটের ভূতপূর্ব মালিক কি এ পাড়াতেই থাকত?
সেন্ট্রাল পার্কের গা ঘেঁষে হাঁটতে লাগলুম ধীর পায়ে। মিহিন তুষারপাতে হচ্ছে, তার ওপর জুতোর দাগ ফেলতে বেশ লাগে। ওভারকোটের সঙ্গে একটা টুপিও দিয়েছে, সেটা পরে নিলুম মাথায়। এখন মনে হচ্ছে সিগারেটের বদলে একটা পাইপ ধরাতে পারলে বেশ হত।
হাঁটতে-হাঁটতে চলে এলুম প্লাজা হোটেলের কাছে। এই হোটেলের সামনে যতবারই এসেছি, একটা অভিনব দৃশ্যের দিকে চোখ আটকে যায়। লাইন করে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটি ফিটন। যে দেশে এখন মোটরগাড়িতে-মোটরগাড়িতে ধূল পরিমাণ, সেখানে এখনও কয়েকটি ঘোড়ায় টানা গাড়ি টিকিয়ে রাখার চেষ্টা সত্যি বেশ মজার।
আমি একবার ভাবলুম, প্লাজা হোটেলে ঢুকে একটু চা-টা খেয়ে তারপর একটা ফিটন গাড়ি ভাড়া করে সেন্ট্রাল পার্কে এক চক্কর ঘুরে এলে কেমন হয়?
পরক্ষণেই ভাবলুম, আমার কি মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেছে? আমি কি সাহারার জমিদার যে প্লাজা হোটেলে চা খাওয়ার শখ হয়েছে? ভেতরে ঢুকলেই কুচ করে গলা কেটে নেবে। আর ফিটন গাড়ির ভাড়া ট্যাক্সি ভাড়ার প্রায় কুড়ি গুণ বেশি। এদেশে এসে আমি ট্যাক্সি চড়ারই সাহস পাই না। হঠাৎ আমার মাথায় এরকম উটকো খেয়াল আসছে কেন?
ছেলেবেলায় ‘ওভারকোট’ নামে কার যেন একটা গল্প পড়েছিলুম, খুব সম্ভবত নিকোলাই গোগোল-এর। আমারও কি সেই রকম কিছু হল নাকি? ওভারকোটের আগেকার মালিকের ভূত ভর করছে আমার ওপর? নইলে এরকম বড়লোকি হুজুগ মনে আসছে কেন? দশ টাকা দিয়ে ওভারকোট কিনে শেষ পর্যন্ত কি আমি সর্বস্বান্ত হব, না জেলে যাব?
ঝাঁ করে একটা বাসে চেপে চলে এলুম গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল স্টেশনের কাছে। এখান থেকে আবার অন্য ট্রেন ধরতে হবে। কিন্তু বেশ খিদে পেয়েছে, একটা কিছু না খেলে চলে না। স্টেশনের সামনেই ঠ্যালাগাড়িতে নানারকম মুখরোচক খাবার বিক্রি করে। মাইওনেজ সহযোগে কয়েকটি চিংড়ি মাছের বড়া ও এক কাপ কফি খেলুম। এক ডলার ষাট সেন্ট দিতে হবে। দুটি ডলারের নোট বাড়িয়ে দিতে দোকানের মালিকানি জিগ্যেস করল, তুমি খুচরো দিতে পারো?
আমি বললুম, হ্যাঁ, পারি।
বলেই হাত ঢুকিয়ে দিলুম ওভারকোটের চার নম্বর পকেটে। খুচরোগুলো তুলে আনবার পরই আমি একটা বিষম খেলুম।
তখন মনে পড়ল, এই পয়সাগুলো আমার নয়। ওভারকোটের আগের মালিকের। এ পয়সা কি আমার নেওয়া উচিত? আগের মালিক কি এরকম রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঠ্যালাগাড়ির দোকানের খাবার খাওয়া অনুমোদন করত?আমি কি ওভারকোটটার অপমান করছি?
ধুত, এসব কুসংস্কারের কোনও মানে হয় না ভেবে সে-দোকানের দাম চুকিয়ে দিয়ে চলে এলুম। কিন্তু মনের মধ্যে খচখচ করতে লাগল। খুচরো পয়সাগুলো বোধহয় আমার ফেরত দেওয়া উচিত। লাল পাথরের দুল জোড়া নিয়েই বা আমি কী করব? কিন্তু এসব ফেরত দেবই বা কাকে? পকেটে যে কাগজপত্রগুলো পাওয়া গেছে, সেগুলো অতি সাধারণ, কয়েকটা হোটেলের চেক অর্থাৎ বিল।
জিনিসগুলো একমাত্র ফেরত দেওয়া যায় যে-দোকান থেকে আমি কোটটি কিনেছি, সে দোকানের মালিককে। আমি শুধু কোটটাই কিনেছি, তার সঙ্গে এক জোড়া দুল আর কিছু খুচরো পয়সা তো ফাউ হিসেবে আমার প্রাপ্য নয়। কিন্তু এইটথ স্ট্রিটের সেই দোকানে আবার যেতে আসতেই আমার যা খরচ পড়বে, তাতে কোটটির দাম বেশ বেড়ে যাবে। তা ছাড়া এই সামান্য জিনিস ফেরত দিতে গেলে দোকানের মালিক যদি আমার প্রতি একটা হুংকার দেয়? তিনশো ডলারের ওভারকোট মাত্র দশ ডলারে যারা বিক্রি করে, তারা সামান্য কিছু খুচরো আর দুটো ঝুটো পাথরের দুল ফেরত নিতে রীতিমতন অপমানিত বোধ করতে পারেন।
কলকাতা হলে কোনও সমস্যাই ছিল না। কোনও ভিখিরিকে দিয়ে দিতুম পয়সাগুলো, আর রাস্তায় যেসব ছেলেমেয়েরা শুয়ে থাকে, তাদের মাথার কাছে দুল দুটো ফেলে দিয়ে বিবেকের দায় থেকে মুক্ত হতে পারতুম। কিন্তু ওদের খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
বেজার মুখ করে স্টেশনে ঢুকে আমার নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মে গিয়ে একটা ট্রেনে চেপে বসলুম। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ঠিক করেছিলুম, কোনও ফাঁকা জায়গা দেখে ট্রেনের জানলা দিয়ে দুল জোড়া ছুঁড়ে ফেলে দেব। ট্রেনে উঠবার পর বুঝতে পারলুম সেটা সম্ভব নয়। এয়ার কনডিশন্ড ট্রেন, সব জানলাই পুরো কাঁচ দিয়ে ঢাকা, শীতকালে কেউ জানলা খোলার কথা কল্পনাও করে না।
ট্রেনটা মোটামুটি ফাঁকাই ছিল, দুটি স্টেশন যাওয়ার পর একজন লোক ঠিক আমার মুখোমুখি আসনটিতে এসে বসল। বছর চল্লিশেক বয়েস, বেশ হাসিখুশি মানুষটি।
কয়েকবার আমার আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে লোকটি উজ্জ্বল গলায় বলল, হাউডি!
আমি বললুম, হ্যাল্লো!
–মনে হচ্ছে আজ রাত্তিরে আবার বরফ পড়বে, তাই না?
–তাই তো মনে হচ্ছে।
–আজ খেলায় কারা জিতেছে বলতে পারো?
–আমি ঠিক বলতে পারছি না।
এইরকম খাজুরে আলাপ কিছুক্ষণ চলল। এর আগে কোনও পুরুষ মানুষ ট্রেনে আমার সঙ্গে যেচে কথা বলেনি। নিউ ইয়র্কের নাগরিকদের স্বভাবই হল ঠোঁট বন্ধ করে রাখা। ট্রেনে উঠেই তারা মুখের সামনে একটা কাগজ মেলে ধরে অথবা চোখ বন্ধ করে থাকে। কথাবার্তা কদাচিৎ শোনা যায়।
আজ এই লোকটি যে আমার প্রতি মনোযোগ দিয়েছে, তা নিশ্চয়ই আমার ওভারকোটের জন্য। সাধারণত ট্রেনে উঠে সকলেই ওভারকোটটা খুলে ভাঁজ করে পাশে রাখে, আমি অন্যমনস্কভাবে সেটা গায়েই পরে আছি।
এটা টিউব ট্রেন নয়, মফস্বলে যাওয়ার ট্রেন। এতে চেকার ওঠে। একটু বাদেই চেকার মহাশয় এসে টিকিট দেখতে চাইলেন। আমার রিটার্ন টিকিট কাটা ছিল সেটা বার করে দিলুম।
চেকার একগাল হেসে বললেন, তুমি ভুল ট্রেনে উঠেছ। এটা তো অন্য দিকে যাচ্ছে।
আমি আকাশ থেকে পড়লুম। এরকম ভুল তো আমার হয় না। টিপে টিপে পয়সা খরচ করতে। হচ্ছে, এরকম ভুল মানেই তো গচ্চা। সঙ্গে-সঙ্গে উঠে দাঁড়ালুম, যত দূরে যাব ততই ক্ষতি।
চেকার খুব সহৃদয়ভাবে আমাকে বলল, তা হলে এই ভাড়াটা দিয়ে দাও।
ট্রেনটি আবার এক্সপ্রেস, পরপর চারটি স্টেশন ছেড়ে গিয়ে তারপর থামল। বেশ সুন্দর, নির্জন একটা স্টেশন। কিন্তু স্টেশনটিকে দেখেই আমার গা জ্বলে গেল। এখানে আমায় কে এনেছে, নিশ্চয়ই এই ওভারকোটের মালিকের ভূত আমাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে এসেছে। এখানে তার কে ছিল? প্রেমিকা? যার জন্য এই দুল কিনেছিল সাহেবটি?
ওভারব্রিজ পেরিয়ে অন্যদিকে গিয়ে টিকিট কাটতে হবে। দুপুর বেলা টিকিটের দাম সস্তা থাকে, কিন্তু এখন সন্ধে ছ’টা, এখন টিকিটের দাম বেশি। উপায় নেই, ফিরতে তো হবেই।
ফেরার ট্রেন আসতে কুড়ি মিনিট দেরি, বসলুম গিয়ে টিকিট ঘর সংলগ্ন ওয়েটিং রুমে। আমিই একমাত্র যাত্রী এখানকার। টিকিট বিক্ৰয়িত্রী রমণীটি দু-তিনবার কৌতূহলী চোখে তাকাল আমার
দিকে। ওভারকোটটা ওর চেনা-চেনা লাগছে নিশ্চয়ই। এই মেয়েটিই আমার পূর্বসুরির প্রেমিকা ছিল নাকি?
ট্রেন আসার শব্দ পেয়ে উঠে দাঁড়ালুম। বেপরোয়াভাবে দুল দুটো আর কাগজপত্রগুলো বেঞ্চের ওপর ফেলে রেখে ছুটে গিয়ে উঠে পড়লুম ট্রেনে। প্রতি মুহূর্তে ভয় হচ্ছিল, মেয়েটি বুঝি ছুটে আসবে আমায় ধরতে। ট্রেন ছাড়ার পর আমার যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল।
ভুল ট্রেন ভাড়ার গচ্চা গেল প্রায় সতেরো ডলার। অর্থাৎ এখন ওভারকোটটার দাম পড়ল সাতাশ ডলার। অনেকটা ভদ্রমতন দাম, এরপর আর আগেকার মালিককে নিয়ে মাথা ঘামাবার কোনও মানে হয় না।