৩২ম অধ্যায়
শিবিরে বিশ্রামাবসরে কর্ণের সচাতুরী আশ্বাস
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! স্পষ্টই বোধ হইতেছে, অর্জ্জুন স্বচ্ছন্দে আমাদের সমুদয় যোধগণকে নিহত করিয়াছে। ঐ বীর সংগ্রামে অস্ত্র ধারণ করিলে যমও উহার নিকট পরিত্রাণ লাভ করিতে পারেন না। যে বীরবর একাকী দিব্যশরাসন ধারণপূর্ব্বক সুভদ্রাহরণ, অগ্নির তৃপ্তিসম্পাদন, এই পৃথিবী পরাজয়পূর্ব্বক সমুদয় ভূপালের নিকট কর গ্রহণ, নিবাতকবচগণের বিনাশসাধন, ভরতগণের পরিত্রাণ এবং কিরাতরূপী দেবাদিদেব মহাদেবের সহিত ঘোরতর সংগ্রাম ও তাঁহার সন্তোষ উৎপাদন করিয়াছিল, সেই অর্জ্জুন পরাক্রমদ্বারা নৃপতিগণকে পরাজিত করিয়াছে। যাহা হউক, এক্ষণে সেই অনিন্দনীয় বীরগণ ও আমার পুত্র দুৰ্য্যোধন কি করিল, তাহা আমার নিকট কীৰ্ত্তন কর।”
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! বর্ম্ম ও আয়ুধবিবর্জ্জিত, হত, আহত ও বিধ্বস্ত বাহনগণে পরিবেষ্টিত মহামানী কৌরবগণ এইরূপে অরাতিশরে বর্ম্ম ও অস্ত্রবিবর্জ্জিত, বাহনবিহীন, হতসৈন্য, একান্ত সমাহত ও নির্জ্জিত হইয়া শিবিরে অবস্থানপূর্ব্বক ভগ্নদন্ত বিষবিহীন বিষধরের ন্যায় দীনস্বরে পুনরায় মন্ত্রণা করিতে লাগিলেন। কর্ণ ক্রুদ্ধ-আশীবিষের ন্যায় নিশ্বাসপরিত্যাগ ও পরে করনিপীড়নপূর্ব্বক দুর্য্যোধনের প্রতি কটাক্ষ করিয়া কহিলেন, ‘হে মহারাজ! অর্জ্জুন দৃঢ়, কার্য্যদক্ষ ও ধৈৰ্য্যশালী, বিশেষতঃ বাসুদেব যথাসময়ে উহাকে প্রতিবোধিত করিয়া থাকেন। ধনঞ্জয় অদ্য সহসা শস্ত্র বর্ষণপূর্ব্বক আমাদিগকে বঞ্চিত করিয়াছে, কিন্তু কল্য আমি তাঁহার সমুদয় সঙ্কল্প ধ্বংস করিব।’ দুৰ্য্যোধন কর্ণের এই বাক্য শ্রবণপূর্ব্বক ‘তথাস্তু’ বলিয়া ভূপালগণকে স্ব স্ব নির্দ্দিষ্ট স্থানে গমন করিতে আদেশ করিলে তাঁহারা স্ব স্ব আবাসে প্রস্থান করিলেন।
“অনন্তর তাঁহারা সেই রজনী সুখে অতিবাহিত করিয়া প্রাতঃকালে প্রফুল্লচিত্তে যুদ্ধার্থ নির্গত হইলেন এবং দেখিলেন, ধর্ম্মরাজ যত্নপূর্ব্বক বৃহস্পতি ও শুক্রের সম্মত দুর্জয় ব্যূহ নির্ম্মাণ করিয়াছেন। তখন অরাতিঘাতন দুৰ্য্যোধন যুদ্ধে পুরন্দরের ন্যায়, বলে মরুদগণের ন্যায় ও বীর্য্যে কার্ত্তবীর্য্যের ন্যায়, শত্রুনিসূদন, বৃষভস্কন্ধ সূতপুত্রকে স্মরণ করিতে লাগিলেন। ঐ সময় সমুদয় সৈন্যগণও কর্ণের প্রতি অনুরক্ত হইয়া তাঁহাকেই প্রাণসঙ্কটকালীন বন্ধুর ন্যায় বিবেচনা করিল।”
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! সেনাগণ কর্ণের প্রতি অনুরক্ত হইলে দুৰ্য্যোধন কি করিল? সৈন্যগণের অবহারানন্তর পুনর্ব্বার যুদ্ধারম্ভ হইলে আমার পুত্র কি সূৰ্য্যদর্শনোৎসুক শীতার্ত্ত পুরুষের ন্যায় কর্ণকে দর্শন করিয়াছিল? হে সঞ্জয়! উভয়পক্ষে সংগ্রাম আরম্ভ হইলে সূতপুত্র কিরূপে যুদ্ধ করিল? পাণ্ডবেরাই বা কিরূপে তাহার সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইল? মহাবাহু কর্ণ একাকী সৃঞ্জয় ও পার্থগণকে নিহত করিতে পারে। ঐ মহাবীর সংগ্রামকালে ভয়ঙ্কর অস্ত্রজাল এবং ইন্দ্র ও বিষ্ণুর তুল্য ভুজবল ধারণ করিয়া থাকে। দুৰ্য্যোধন কর্ণকে আশ্রয় করিয়া সংগ্রামে যত্নশীল হইয়াছিল, মহারথ কর্ণও দুর্য্যোধনকে পীড়িত ও পাণ্ডবগণকে পরাক্রান্ত দেখিয়া প্রাণপণে সংগ্রাম করিয়াছিল। দুর্ব্বুদ্ধি দুর্য্যোধন কর্ণকে আশ্রয় করিয়াই বাসুদেবসমবেত সপুত্র, পাণ্ডবগণকে জয় করিতে উৎসাহিত হইয়াছিল; কিন্তু কি দুঃখের বিষয়, কর্ণ কোপাবিষ্ট হইয়া পাণ্ডুপুত্রগণকে পরাভূত করিতে পারিল না; অতএব দৈবই শ্রেষ্ঠ বলিয়া প্রতিয়মান হইতেছে। হায়! – এক্ষণে দ্যূতক্রীড়ার চরম ফল উৎপন্ন হইয়াছে। আমি দুৰ্য্যোধনের দুর্নীতিজনিত শল্যভূত [শল্যাঘাতজনিত বেদনায় পরিণত] দুর্ব্বিষহ যন্ত্রণা ভোগ করিতেছি। হে সঞ্জয়! সূতনন্দন নীতিমান্, পরাক্রান্ত ও দুর্য্যোধনের অনুগত। তথাপি এই মহাযুদ্ধে আমার পুত্রগণকে নির্জ্জিত ও নিহত শ্রবণ করিতে হইল। হায়! পাণ্ডবগণকে নিবারণ করে, এমন আর কেহই নাই। তাহারা আমাদের সৈন্যগণকে স্ত্রীলোকের ন্যায় জ্ঞান করিয়া অনায়াসে তাহাদের মধ্যে প্রবেশ করিতেছে; অতএব দৈবই বলবা।”
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! আপনি পূর্ব্বে দ্যূতক্রীড়া প্রভৃতি যে সকল ধর্ম্মিষ্ঠ কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন, এক্ষণে তাহা চিন্তা করুন। অতীত কাৰ্য্যের অনুশোচন নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর। উহা চিন্তার সহিত বিনষ্ট হয়। আপনি পূর্ব্বে সঙ্গত ও অসঙ্গত বিষয়ের পরীক্ষা করেন নাই; সুতরাং এক্ষণে আপনার রাজ্যপ্রাপ্তি নিতান্ত দুর্ল্লভ হইয়াছে। পাণ্ডবগণ বারংবার আপনাকে যুদ্ধ করিতে নিষেধ করিয়াছিলেন; কিন্তু আপনি মোহবশতঃ তাঁহাদের হিতবাক্যে কর্ণপাতও করেন নাই। বিশেষতঃ আপনি তাঁহাদের ঘোরতর অনিষ্টাচরণ করিয়াছেন, তন্নিমিত্তই এক্ষণে এই ঘোরতর সংগ্রাম উপস্থিত হইয়াছে। হে মহারাজ! যাহা হইবার হইয়াছে; তাহার নিমিত্ত আর অনুতাপ করা কৰ্ত্তব্য নহে। এক্ষণে যেরূপে ভয়ঙ্কর জনক্ষয় উপস্থিত হইল, তাহা শ্রবণ করুন।
অর্জ্জুনবধে কর্ণের সুদৃঢ় সংকল্প
“রজনী প্রভাত হইলে মহাবাহু কর্ণ দুৰ্য্যোধনসমীপে সমুপস্থিত হইয়া কহিলেন, ‘হে মহারাজ! আজ আমি মহাবীর অর্জ্জুনের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইব। অদ্য হয় আমিই তাহাকে সংহার করিব, না হয় সেই আমাকে বিনাশ করিবে। আমাদের উভয়ের কাৰ্য্যবাহুল্যপ্রযুক্ত কখনই যুদ্ধে পরস্পরের সমাগম হয় নাই। হে কুরুরাজ! এক্ষণে আমি স্বীয় বুদ্ধিবিবেচনানুসারে যাহা কহিতেছি, তাহা শ্রবণ কর। আমি অর্জ্জুনকে বিনাশ না করিয়া রণস্থল হইতে কদাচ প্রতিনিবৃত্ত হইব না। আমাদের প্রধান প্রধান বীরগণ নিহত হইয়াছেন এবং আমিও শত্রুদত্ত শক্তিহীন হইয়াছি; এক্ষণে আমি সমরাঙ্গনে সমুপস্থিত হইলে ধনঞ্জয় অবশ্যই আমার অভিমুখীন হইবে। তখন তুমি তাহার ও আমার দিব্যাস্ত্রসমুদয় দেখিতে পাইবে। সব্যসাচী অর্জ্জুন প্রতিযোদ্ধার কাৰ্য্যবিনাশ, লঘুহস্ততা, দূরপাতিত্ব, কৌশল, অস্ত্রপাত, বল, শৌর্য্য, বিজ্ঞান, নিমিত্তজ্ঞান ও বিক্রম বিষয়ে কখনই আমার তুল্য নহে। হে মহারাজ! আমার এই শরাসন সামান্য নহে, পূর্ব্বে বিশ্বকর্ম্মা ইন্দ্রের প্রিয় চকীর্ষু [হিতেচ্ছ্ব] হইয়া তাঁহার নিমিত্ত বিজয়নামে যে প্রসিদ্ধ শরাসন নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন, যদ্দ্বারা দেবরাজ দৈত্যগণকে পরাজিত করিয়াছেন, যাহার নির্ঘোষে দানবগণ দশদি শূন্যপ্ৰায় অবলোকন করিয়াছিল, সুররাজ সেই শরাসন পরশুরামকে প্রদান করেন; ভার্গবও প্রসন্ন হইয়া সেই দিব্যচাপ আমাকে প্রদান করিয়াছেন। দেবরাজ ঐ কার্ম্মদ্বারা সমাগত দৈত্যগণের সহিত যেরূপ যুদ্ধ করিয়াছিলেন, আমিও সেইরূপে জয়শীল মহাবাহু অর্জ্জুনের সহিত সংগ্রাম করিব। এই আমার পরশুরামদত্ত ভীষণ শরাসন অর্জ্জুনের গাণ্ডীব হইতে শ্রেষ্ঠ; ইহাদ্বারা ভার্গব একবিংশতিবার পৃথিবী জয় করিয়াছিলেন। তিনি ইহার দিব্যকাৰ্য্যসমুদয় কীৰ্ত্তনপূর্ব্বক ইহা আমাকে প্রদান করিয়াছেন। হে দুৰ্য্যোধন! অদ্য আমি এই শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়া জয়শীল অর্জ্জুনকে নিপাতিত করিয়া তোমাকে বান্ধবগণের সহিত আনন্দিত করিব। অদ্য এই গিরিকানন সুশোভিতা সসাগরা সদ্বীপা মেদিনী তোমার ও তোমার পুত্রপৌত্রাদির ভোগাৰ্থে কল্পিত হইবে। ধর্ম্মানুরক্ত আত্মজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষে সিদ্ধিলাভ যেমন অসাধ্য নহে, তদ্রূপ তোমার প্রিয়ানুষ্ঠান করা আমার পক্ষে অসাধ্য নহে। পাদপের অগ্নিসংস্পর্শ যেরূপ অসহ্য হইয়া উঠে, আমিও অর্জ্জুনের তদ্রূপ অসহ্য হইব সন্দেহ নাই।’
শল্যকে সারথি করিতে কর্ণের কামনা
“হে মহারাজ! আমি ধনঞ্জয় অপেক্ষা যে যে অংশে হীন, তৎসমুদয় আমার স্বীকার করা অবশ্য কর্ত্তব্য। অর্জ্জুনের শরাসনজ্যা দিব্য, তূণীরদ্বয় অক্ষয়, সারথি বাসুদেব, কাঞ্চনভূষণ দিব্যরথ অগ্নিদত্ত ও অচ্ছেদ্য, অশ্বসকল মনের তুল্য বেগশালী এবং ধ্বজ বিস্ময়কর ও দ্যুতিমান্ বানরে লাঞ্ছিত। আমার এতাদৃশ কিছুই নাই। আমার কেবল একমাত্র বিজয়াশ্য দিব্যকার্ম্মুক ধনঞ্জয়ের অর্জ্জিত গাণ্ডীবশরাসন অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। হে কুরুরাজ। পূর্ব্বোক্ত দ্রব্যসমুদয় না থাকাতে আমি অর্জ্জুন অপেক্ষা হীন হইয়াও তাহার সহিত সংগ্রাম করিতে বাসনা করিতেছি। কিন্তু দুঃসহবীৰ্য্য মদ্ররাজকে আমার সারথি হইতে হইবে। মহাবীর শল্য কৃষ্ণের সদৃশ; উনি যদি আমার সারথ্য স্বীকার করেন, তাহা হইলে তোমার নিশ্চয়ই জয়লাভ হইবে। অতএব দুঃসহবীৰ্য্য শল্যই আমার সারথি হউন। শকটসমুদয় আমার নারাচনিকর বহন এবং উৎকৃষ্ট অশ্বসংযোজিত রথসকল আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আগমন করুক। হে মহারাজ! এইরূপ হইলে আমি ধনঞ্জয় অপেক্ষা সমধিক গুণসম্পন্ন হইব। মহাবীর শল্য কৃষ্ণ অপেক্ষা সমধিক গুণসম্পন্ন এবং আমিও অর্জ্জুন অপেক্ষা সমধিক গুণবান্। কৃষ্ণ যেমন অশ্ববিজ্ঞান অবগত আছেন, শল্যও সেইরূপ। বিশেষতঃ শল্য অপেক্ষা ভুজবীৰ্য্যসম্পন্ন আর কেহই নাই এবং আমার তুল্য অস্ত্ৰযুদ্ধ করিতে আর কেহই সমর্থ নহেন। অতএব শল্য আমার সারথি হইলে আমার রথ অর্জ্জুনের রথ অপেক্ষা উৎকৃষ্ট হইবে। তাহা হইলে আমি নিঃসন্দেহেই ধনঞ্জয়কে পরাজিত করিব। এক্ষণে অবিলম্বে আমার এই অভিলাষ পূর্ণ কর। ইহা সম্পাদিত হইলে আমি সংগ্রামে যেরূপ কার্য্যানুষ্ঠান করিব, তাহা দেখিতেই পাইবে। তখন দেবগণও আমার সম্মুখীন হইতে পারিবেন না। আমি পাণ্ডবগণকে অবশ্যই পরাজিত করিব। সামান্য মনুষ্য পাণ্ডবগণের কথা দুরে থাকুক, তৎকালে দেবাসুরগণও আমার হস্ত হইতে পরিত্রাণ প্রাপ্ত হইবে না।’
“হে মহারাজ! রাজা দুৰ্য্যোধন কর্ণকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া হৃষ্টান্তঃকরণে তাঁহাকে অৰ্চনা করিয়া কহিলেন, ‘হে রাধেয়! তুমি যেরূপ কহিলে, আমি তাহাই অনুষ্ঠান করিব। এক্ষণে তূণীর ও অস্বসংযুক্ত রথসমুদয় তোমার অনুগমন করিবে। শকটসমুদয় তোমর, নারাচ ও শর সকল বহন করুক। আমরাও তোমার অনুগমন করিব।”