৩২. প্ৰত্নকথা

প্ৰত্নকথা

সৃষ্টির উৎস হয়েছিল মহাসময়ের যে ঊষাকালে, প্রত্নকথাগুলিতে তারই প্রতীকী বিবৃতি পাওয়া যায়। বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের তাত্ত্বিক কারণ অনুসন্ধানের ফলেও কিছু কিছু প্ৰত্নকথা উদ্ভূত হয়েছিল। সৃষ্টি ও সংরক্ষণের জন্য দেবতারা যে সমস্ত যজ্ঞ অনুষ্ঠান করেছিলেন, সমাজের প্রতি দায়িত্বসম্পন্ন মানুষ সৃষ্টিকে সংরক্ষণ করার জন্য সেই সমস্ত শাস্ত্ৰ নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানই পুনরায় যজ্ঞের মধ্যে প্রবর্তন করে। প্ৰত্নকথাগুলির মধ্যে এই ইঙ্গিত রয়েছে যে, প্রত্নপৌরাণিক সময়ে পার্থিব জীবন ছিল বিঘ্ন-সঙ্কুল, তাই দেবতারা নানা যজ্ঞের দ্বারা সমস্ত অমঙ্গলকে দূর করতেন। অনুরূপ বিপদের আশঙ্কার সম্মুখীন হয়ে মানুষও প্রাচীন দৈব যজ্ঞগুলি পুনরায় নুতন করে অনুষ্ঠান করে। সংহিতাগুলিকে দেবতাদের কার্যাবলী সংক্ষিপ্তভাবে বিবৃত হয়েছে যেহেতু তৎকালীন সমাজে সেই সমস্তই ছিল সর্বজনগোচর। ঋগ্বেদের ধর্মবোধও বিবিধ ক্রিয়াকার্যকে দেবতাদের কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।

বেদের ধর্ম স্পষ্টতই বহু দেববাদী; ক্ষমতার ক্রম অনুযায়ী বিন্যস্ত এইসব দেবতাদের প্রত্যেকেই কখনও না কখনও শ্রেষ্ঠ দেবরূপে বন্দিত হয়েছেন। বৈদিক জনগণ ইন্দো-ইয়োরোপীয় ঐতিহ্য থেকে কয়েকজন দেবতাকে আহরণ করে সঙ্গে এনেছিলেন; ভারতে উপনীত হওয়ার পথে নানা জনগোষ্ঠী থেকেও কিছু কিছু দেবতাকে সংগ্রহ করেছিলেন এবং এই উপমহাদেশে বসতি স্থাপনের পরে এখানকার প্ৰাগাৰ্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের ফলে আরও কিছু দেবতাকে সৃষ্টিও করেছিলেন। যেহেতু প্ৰথম দুটি স্তরে তাদের জীবন ছিল মূলত পশুচারী, তাই ঐতিহ্যগত অধিকাংশ দেবতাই পশুপালনের সঙ্গে সম্পর্কিত আকাশদেবতা ও সূর্যদেবেরই বিভিন্ন রূপ। পিতৃভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরে মধ্যবতী স্তর ছিল নিরস্তর সংগ্ৰাম ঔ পরিক্রমার কর্মবহুল। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তারা তখনও পশুচারী; কিন্তু তখন ধন আহরণের আর একটি নতুন উপায় অর্থাৎ লুণ্ঠন তাদের জীবনযাপনের অঙ্গ হয়ে পড়েছে। যাত্রাপথে যত কৌম ও গোষ্ঠীকে তারা পর্যুদস্ত করেছিলেন, তাঁদের ধন আত্মসাৎ করেই নুতন ভূমি অন্বেষণে তাঁরা অগ্রসর হয়েছিলেন। ভারতবর্ষে বসতি স্থাপনের পরে প্রাগাৰ্য কৃষিচারীদের কৃষিকর্মের প্রভাবে ধীরে ধীরে আর্যরা কৃষিজীবী হয়ে উঠলেন এবং পশুপালন হ’ল তাদের ধন ও খাদ্য সংগ্রহের পরিপূরক উৎস। যাস্ক যে ত্ৰিবিধ দেবতার কল্পনা করেছিলেন, তার সঙ্গে উপরোক্ত আলোচনার মোটামুটি একটা ঐক্য রয়েছে। আপাতত বলা যেতে পারে যে, আকাশদেবতা ও প্রাচীনতর। সৌরদেবগণ বৈদিক আৰ্যদের সামূহিক জীবনের সেই স্তরে আবির্ভূত হয়েছিলেন যখন তারা পিতৃভূমি ত্যাগ করে নিশ্চিন্তে পশুপালনের জীবনে অভ্যস্ত। তার কিছু পরে কিছু বর্ষণ ও বজ্রের দেবতা উদ্ভূত হয়েছিলেন নিরন্তর সংঘৰ্যমুখর সেই জীবনে, যখন দীর্ঘতম যাত্রাপথে তারা ইয়োরোপীয় ভূখণ্ড থেকে মধ্য প্রাচ্যের অভিমুখে অগ্রসর হয়েছিলেন। চূড়ান্ত পর্যায়ে আবির্ভূত হলেন শস্যের ও পাতালের অধিষ্ঠাতা দেবগণ, যদিও প্রাচীনতর পর্যায়েও কোন না কোন আকারে তাঁদের উপস্থিতি আভাসিত হয়েছিল; বিশেষত অন্তিম সংস্কার ও পরলোক বিষয়ক দেবতারা প্ৰাচীনতর পর্যায়ে উপস্থিত থাকলেও কৃষিজীবী রূপে আর্যদের প্রতিষ্ঠা লাভের পরেই তারা নতুন এক তাৎপর্য নিয়ে অভিনব সজীবতার সঙ্গে আবির্ভূত হয়েছিলেন। একথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, বৈদিক দেব-সঙ্ঘে অধিকাংশ প্ৰাচীনতর দেবতাদের অবস্থান সুরক্ষিত হলেও তাদের মধ্যে গৌরবের আসনগুলি প্রায়শই বিবর্তিত ও পরিবর্তিত হয়েছিল। কৃষিজীবী জনতারূপে তারা বিশেষভাবে শস্য সমৃদ্ধি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন বলেই শস্যের ও পাতালের দেবতা এবং পিতৃলোকের অধিষ্ঠাতা দেবতাদের প্রয়োজন ছিল সর্বাধিক কেননা তারা কৃষির জন্য উপযোগী ভূমির উর্বরতাকে নিশ্চিত করতে উৎসুক ছিলেন। সব প্রাচীন সভ্যতাকেই ভূমির উর্বরতা বিধান করে ভূমির অধিষ্ঠাতা দেবতা, পরলোকগত আত্মারাও পাতালের অধিষ্ঠাতা দেবতারা। অগ্নির সঙ্গেও এদের একটি প্রত্যক্ষ যোগ থাকে। পশুচারী আদিযুগে তাই দৌঃ ও সূর্যই প্ৰধান দেবতা, পথপরিক্রমা এবং যুদ্ধের যুগে ইন্দ্ৰ, বায়ুবাতাঃ পর্জন্য এঁরাই প্ৰধান এবং স্থিতিশীল কৃষিজীবী যুগে অগ্নি, নির্ধতি, ভূমি, প্ৰজাপতি, যম ও পাতালবাসী কিছু দেবতা প্রাধান্য লাভ করে। কৃষিজীবী স্তরে আর্যরা নির্দিষ্ট সময়মত বৃষ্টি এবং আবহাওয়াজনিত বিপত্তি নিবারণের জন্যে সচেষ্ট ছিলেন। বিশেষভাবে উদ্ভিদজগতের অধিষ্ঠাতা দেবতা, সৌর ও বর্ষণের দেবতাদের প্রয়োজনও তাদের পক্ষে এখনও ছিল অপরিহার্য; এরা শুধুমাত্র অঙ্কুরোদগমের পক্ষে প্রয়োজনীয় উত্তােপই দান করবেন না; মেঘ ও বৃষ্টি সৃষ্টি করে পরোক্ষভাবে বৃষ্টিপাত নিয়ন্ত্রণও করবেন ।

পশুপালক জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত আকাশের দেবতারা ছিলেন মূলত নিস্ক্রিয়। সম্ভবত, এই পর্যায়েও কোন ধরনের পিতৃদেবী-পূজা বৈদিক আৰ্যদের ধর্মচৰ্যার অঙ্গ ছিল, কিন্তু এই সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান সামান্য। শুধু কিছু পরোক্ষ প্রমাণই রয়েছে। একই ভাবে মাতৃকাদেবী এবং পাতাল ও শস্য অধিষ্ঠাতা দেবতাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমরা অনায়াসে কিছু সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ করতে পারি। যদিও তা শেষ পর্যন্ত অনুমাননির্ভরই। যাযাবর জীবনের বৃষ্টি ও বজ্রের দেবতারা পূর্ব-প্রতিষ্ঠিত দেব-সঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে আক্রমণকারী আর্যদের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতায় প্রত্নপৌরাণিক রূপান্তরের ছায়াপথ ঘটেছে তাদের উপর। ভূমির উর্বরতা পশু প্ৰজনন ও সন্তান-বৃদ্ধির পরিপোষক উর্বরতাবিধায়ক দেবতারা এবং সেই সঙ্গে মাতৃকাদেবী ও পাতাল ও শস্য অধিষ্ঠাতা দেবতারা, ও আঞ্চলিক জীবনের অভিভাবক দেবতারা একত্র সম্মিলিত হয়ে বৈদিক দেব-সঙ্ঘকে সম্পূর্ণতা দান করেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঋগ্বেদে নৈসৰ্গিক উপাদানসমূহের উপর দেবত্ব আরোপিত হয়েছে প্রত্নপৌরাণিক পদ্ধতিতে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেবগোষ্ঠীর মতো বৈদিক দেবতাদের মধ্যেও ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর উপদেবতাদের অস্তিত্বও লক্ষ করা যায়—যেমন অন্সরা, গন্ধৰ্ব, যক্ষ প্রভৃতি। নৈসৰ্গিক উপাদানের উপর দেবত্ব আরোপিত করে বৈদিক আৰ্যরা যাদের সৃষ্টি করেছিলেন, তারাই ঋগ্বেদের দেবগোষ্ঠীর প্রাচীনতর স্তর; পরবর্তীকালে বিভিন্ন পর্যায়ে বিচিত্র চরিত্র ও ভূমিকাযুক্ত দেবতাদের সৃষ্টি হয়। কিন্তু যজ্ঞানুষ্ঠানের অনিবার্য পরিবর্তনশীল প্রয়োজনে দেবতাদের নিরস্তর উত্থান ও বিলয় ঘটেছে। বস্তুত জনসাধারণের সামাজিক অর্থনৈতিক ও অস্তিত্বের নিগূঢ় স্তরে অনুভূত প্রয়োজনের প্রেরণাতেই দেবতাদের সৃষ্টি। ঋগ্বেদের শেষ পর্যায়ে এমন কিছু দেবতার উৎপত্তি ঘটেছিল যাঁরা কোন প্রকৃত ধর্মচৰ্যা বা আচার অনুষ্ঠানের সঙ্গে সুনির্দিষ্টভাবে যুক্ত ছিলেন না; বিমূর্ত আদর্শায়িত রূপেই শুধু যাঁরা আত্মপ্ৰকাশ করেছিলেন। যদিও যজ্ঞের সঙ্গে সম্পূর্ণত সম্পর্কহীন কোন দেবতা ঋগ্বেদে পাওয়া যায় না, তথাপি ঋগ্বেদ রচনার শেষ পর্যায়ে অনুষ্ঠানের উপর গুরুত্ব আরোপিত না হয়ে নিতান্ত বিমূর্ত ধারণার উপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হতে শুরু করে।

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর বিখ্যাত তাত্ত্বিক ও নিরুত্তকার যাস্ক বৈদিক দেবতাদের বাসস্থান অনুযায়ী তিনটি ভাগে বিন্যস্ত করেছিলেন—পৃথিবী নিবাসী, অন্তরীক্ষ নিবাসী ও দ্যুলোক নিবাসী। তবে মনে হয় যে, যাস্কেরও অগোচরে এই শ্রেণীবিন্যাসের পশ্চাতে বৰ্ণভেদগত ধ্যান ধারণাও সক্রিয় ছিল। সামূহিক আৰ্যমান ব্রাহ্মণ, ক্ষত্ৰিয়, বৈশ্য–এই ত্রিবর্ণের ভিন্নমুখী ভুমীকা অনুযায়ী দেবতাদেরও শ্রেণীবিন্যাস কল্পনা করেছিল। ব্ৰাহ্মণ-শ্রেণী সমাজের উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে প্ৰত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন না, যাজকতান্ত্রিক গ্ৰন্থরচনা ও যজ্ঞকেন্দ্ৰিক অনুষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন তারা। তাই, সমাজের প্রতি তাদের অবদান ছিল মুখ্যত আধ্যাত্মিক। সমগ্ৰ গোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষা পুরণে ব্রাহ্মণদের দ্বারা অনুষ্ঠিত মহান আধ্যাত্মিক গুণসম্পন্ন ও সর্বত , কল্যাণকর “তপঃ” সৃষ্টি ও স্থিতির প্রতিভূ হয়ে উঠল; এবং ব্রাহ্মণ বর্ণটিও দেবতাদের পার্থিব প্রতিরূপ হয়ে উঠলেন।

ঋগ্বেদে যে সমস্ত দেবতা প্ৰাচীনতম স্তরের প্রতিভূ এবং ইন্দো-ইয়োরোপীয় দেবগোষ্ঠীর প্রভাবজাত, তাদের মধ্যে রয়েছেন—দৌঃ, সূৰ্য, মিত্র, বরুণ, সবিতা, ঊষা, যম, ভগ, অংশ, দক্ষ, অর্যামা, বিবস্বান, মার্তন্ড, অশ্বীরা, অদিতি প্রভৃতি। ইন্দোইয়োরোপীয় আকাশের দেবতাদের মধ্যে দৌঃ-ই প্ৰাচীনতম এবং সর্বত্রই পশুপালক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক; কেননা সভ্যতার ঊষাকালে সেই গোষ্ঠীভুক্ত মানুষ আকাশের অনন্ত বিস্তার ও সর্বব্যাপিতা অবলোকন করে গভীর বিস্ময় ও আতঙ্কে নিমগ্ন হত। পৃথিবী আকাশদেবের পত্নীরূপে পরিকল্পিত। সৌরদেবগণ যে আদিত্য বা অদিতি-পুত্র রূপে কল্পিত হয়েছেন তারও মূলে আছে ইন্দো-ইয়োরোপীয় ঐতিহ্য। তাদের মধ্যে মুখ্যতম হলেন সূর্যদেব, ইনি স্বাস্থ্য, দীর্ঘায়ু ও উর্বরতা দানের জন্য বন্দিত হয়েছেন। এছাড়াও সাধারণ মানুষ সৌরদেবতাদের নিকট প্রার্থনা করত ঐশ্বর্য, সমৃদ্ধি, শস্য, আরোগ্য, পরমায়ু, জ্ঞান ও আত্মিক উন্মেষ। প্ৰথম পর্যায়ে বরুণও ছিলেন আকাশেরই দেবতা; পরবর্তী স্তরে তিনি হলেন নৈশ আকাশের অধিষ্ঠাতা, নক্ষত্রপুঞ্জ যার চোখ। এই স্তর পর্যন্ত প্রত্ন-পৌরাণিক স্বরাপের চেয়েও তার নৈতিকতার দিকের প্রবলতর অভিব্যক্তি পাওয়া যায়। নক্ষত্ররূপ চক্ষু দ্বারা মানুষের গোপন পাপ তিনি নির্নিমেষ দৃষ্টিতে অবলোকন করেন এবং প্রয়োজনমত শাস্তিবিধানও করেন। মানুষের আচার আচরণের প্রতি এই তীক্ষ দৃষ্টিপাত এবং বিচারক ও শাস্তিদাতার ভূমিকায় বরুণদেব ভীতি ও সভ্রম উৎপাদন করেন; বস্তুত তিনিই একমাত্র দেবতা যাঁর ভাবমূর্তিতে একটি নৈতিক মাত্ৰা যুক্ত হয়েছে। পরবর্তীকালে তিনি সৌরদেবমণ্ডলী অর্থাৎ আদিত্যগণের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েন। গ্রিকদেবতাদের মধ্যে তার প্রতিরূপ পাই উরােনস-এ এবং নীতিবিদ বিচারকের ভূমিকায় প্রাচীন পারসিক পরম দেবতা অহরমজদার সঙ্গেও তিনি তুলনীয়। প্রায়শ মিত্রদেবের সঙ্গে দ্বৈরথারূপে মিত্রবরুণ দিন ও রাত্রির আকাশের অধিষ্ঠাতা। পরবর্তী পর্যায়ে তীর ভূমিকা ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে পড়ায় তিনিই প্ৰথম কল্পিত এবং পরে সাধারণভাবে সমুদ্রের অধিদেবতা হয়ে উঠেন। বরুণদেবের শারীরিক বর্ণনা অস্পষ্ট ছিল বলেই তার ভূমিকার এই কৌতুহলজনক রূপান্তর সম্ভবপর হয়ে উঠেছিল। যথাক্রমে রাত্রিকালীন আকাশ, অস্তায়মান সূৰ্য দৈব জলরাশির অধিরক্ষক এবং সমুদ্রের অধিষ্ঠাতা রূপে তার বিবর্তন ক্রমে সম্পূর্ণ হয়েছিল। পশুপালক সমাজের স্বাভাবিক দেবতা থেকে কৃষিনির্ভর সমাজের দেবতায় রূপান্তরিত হওয়ার ইতিহাসই এর মধ্যে বিধৃত আছে। পরিবর্তিত সামাজিক অবস্থায় কৃষিজীবী আৰ্যদের পক্ষে আর্থিকভাবে কল্যাণপ্ৰসু ভূমিকা নিয়েই বরুণ আপনি ক্ষমতা অটুট রেখেছিলেন; আর্যদের কল্পনায় দৈব জলরাশির রক্ষক রূপে উপযুক্ত ঋতুতে তিনি ছিলেন বৃষ্টিপাতের নিয়ন্তা। তেমনই পরবর্তী বাণিজ্যিক উদ্যোগের যুগে সমুদ্রযাত্রী বণিকদের কল্পনায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন সপ্তসমুদ্রের অধিপতি।

একদিক দিয়ে দেখলে দেখি সমগ্র ঋগ্বেদীয় কাব্যের ভাবকেন্দ্রে রয়েছে সূর্য ও সৌরদেবগণের বন্দনা। সূৰ্যরূপে আদিত্য আলো, স্বাস্থ্য ও সমৃদ্ধির উৎস, সবিতারূপে ধীশক্তির প্রেরয়িতা ও অজ্ঞানরাপ অন্ধকারের মোচনকারী। মিত্ররূপে আদিত্যের বন্ধুত্বের ভূমিকা লক্ষণীয়। এছাড়া রয়েছে, ভগ, অর্যমা, অংশ ও দক্ষের মধ্যে আদিত্যদের অধস্ফুট ভাবমূর্তি। সম্ভবত, ভারতবর্ষে আগমনের পূর্বে আৰ্য দেবগোষ্ঠীর মধ্যে তাদের স্পষ্টতর ইন্দ্ৰিয়গ্রাহ্যরূপ অটুট ছিল। দাম্পত্যজীবনের শান্তি ও জন্মপ্রক্রিয়া ছাড়াও পত্নী এবং মাতাররূপে মহিলাদের ভূমিকার সঙ্গে ভগদেবের নিবিড় সম্পর্ক ছিল। দক্ষের ভূমিকা খুব স্পষ্ট নয়, হয়ত বা কারুজীবীর ইষ্টদেবতা ছিলেন তিনি। তেমনি অংশ দেবতারূপে সম্পূর্ণ ছায়াবৃত–ভগা, দক্ষ ও অর্যামার সঙ্গে সামূহিকভাবেই শুধু তাকে বন্দনা করা হয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণকারী দেবতা রূপে তখনি অর্যামার উদ্ভব ঘটেছিল যখন অনার্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে অনুপ্ৰবেশ করে আর্যরা বসতি স্থাপন করেছিলেন। সৌরদেবতাদের আদিমাতারূপে অদিতিকে পাওয়া যায়। বিষ্ণুর তিনটি পদক্ষেপের বর্ণনা অত্যন্ত শুরুত্বপূর্ণ হলেও পর্বতনিবাসী দেবতারূপে ঋগ্বেদে তিনি নিতান্তই গৌণ দেবতা, কেননা তার উদ্দেশে মাত্র তিনটি সূক্ত নিবেদিত। তবে তীর মধ্যে সূর্যের ত্ৰিবিধ গতির প্রকাশ ঘটছে। ধাতা ও বিবস্বান সৌরদেবরূপে অত্যন্ত অস্পষ্ট; তবে সম্ভবত ধাতা সূর্যদেবের সৃজনশীল দিক এবং বিবস্বান তার উজ্জ্বল জ্যোতিষ্করূপে প্রকাশের প্রতীক। অন্যদিকে মার্তােন্ড সম্ভবত অস্তায়মান সূর্যের প্ৰতিনিধি। যাই হোক, আর্যদের সৌর দেবমণ্ডলীর মধ্যে আদিত্যরাই প্ৰাচীনতম গোষ্ঠী; ভারতবর্ষে প্রবেশ করার সময় এদের অধিকাংশই আর্যমানসে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন। স্পষ্টতই আদিত্যের বিভিন্ন রূপের মধ্যে মাস ও ঋতুভেদে এবং উদয় থেকে অস্ত পর্যন্ত সূর্যের বিভিন্ন অবস্থানের অভিব্যক্তি ঘটেছে। পূষা নিতান্ত পরোক্ষভাবে সৌরদেবমণ্ডলীর সঙ্গে সম্পূক্ত; আর্যরা যখন যাযাবর জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিল, ভূমির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না থাকার ফলে বৃদ্ধি ও প্রাচুর্যের জন্য উর্বরতার অন্য স্থায়ী উপাদান অর্থাৎ সূর্যের উত্তাপের উপরই তাদের নির্ভর করতে হত। আৰ্যসভ্যতার যাযাবর পশুপালকস্তরে গো-সম্পদের রক্ষকরূপেও পূষার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পূষাকে ‘অঘৃণি’ অর্থাৎ জ্বলন্ত বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে, তাতেই সূর্যের সঙ্গে তার নিবিঢ় সম্পর্ক আভাসিত। অবয়বগত আনুষঙ্গিক অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের জন্যও পূষা বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। কেননা, তিনি রথের পরিবর্তে ছাগবাহন, তার চুল বেণীবদ্ধ, করম্ভ অর্থাৎ যবচুর্ণমিশ্র তার খাদ্য। এতে মনে হয় যে, ভারত বর্ষে উপনীত হওয়ার পথে আর্যরা খুব সম্ভবত মোঙ্গোলিয়ার মধ্যে দিয়ে যখন এসেছিলেন সেই সময়ে মোঙ্গোলীয় আচার ব্যবহার, পোষাক পরিচ্ছদ ও খাদ্যাভাসযুক্ত বিশিষ্ট কোনো দেবতার কল্পনা তারা পথে সংগ্রহ করেছিলেন। সুদীর্ঘ তৃণে আচ্ছন্ন দুৰ্গম ভূমিতে পথভ্ৰষ্ট গো-সম্পদের পুনরুদ্ধার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল ব’লেই গোসম্পদের পুনরুদ্ধারকারী দেবতারূপে পূষার আবির্ভাব বিশেষ তাৎপৰ্যপূর্ণ। কালক্রমে তিনি পথিক মানুষ ও বিচরণশীল পশুর পথপ্রদর্শক দেবতার ভূমিকাও গ্রহণ করেন এবং শেষ পর্যন্ত তা-মৃত্যুলোক পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। মরণোত্তর লোকে প্ৰয়াত আত্মা যাতে পথভ্রষ্ট না হয় তার জন্যও পূষার কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে।

ঊষা ঋগ্বেদে সবচেয়ে সুললিত বৰ্ণনায় সমৃদ্ধ কিছু সূক্তের উদ্দিষ্ট দেবী। প্রতিটি প্রভাতই স্বভাবত অতিসূক্ষ্ম ক্ষণস্থায়ী সৌন্দর্যের আভাস আনে। দেবী ঊষা তাই ঋষিকবিদের বর্ণনায় পরমা সুন্দরী, সজীব ও চিরতরুণী; রক্ত পরিচ্ছেদে তাঁর যৌবন সঞ্জীবক ও দ্যুতিময়। জীবজগৎকে প্রতিদিন সকালে তিনি নিদ্রা থেকে জাগরিত করে দৈনন্দিন কর্তব্যে প্রেরণা জোগান। ঊষা নিজের চিরতারুণ্য অক্ষুন্ন রেখেও মানুষকে দিনে দিনে বার্ধকের অভিমুখে প্রেরণ করেন। ঊষাকে সূর্যের মাতা, কন্যা বা পত্নীরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। দেবীর সক্রিয় ভূমিকা অপেক্ষা তার কাব্যিক ভাবমূর্তি সূক্তগুলিতে অধিক অভিব্যক্ত। নূতনতর তৃণভূমির সন্ধানে সতত বিচরণশীল পশুপালক জনগোষ্ঠীর জন্য নিসর্গদৃশ্য স্বাভাবিকভাবেই ছিল এক পরিবর্তনশীল উপাদান; একমাত্র স্থায়ী উপাদান হ’ল আকাশ, বায়ু ও সৌরদেবমণ্ডলী। তাই মনে হয় যে, আৰ্যদের সামূহিক জীবনের প্রাচীনতর পর্যায়েই ঊষাসুক্তিগুলি রচিত হয়েছিল; সম্ভবত ভারতবর্ষে উপনীত হওয়ার সময় আর্যরা এই সব রচনা সঙ্গে নিয়েই এসেছিলেন। প্রাথমিক স্তরে ঊষা সূক্তগুলির কোনো যজ্ঞীয় বিনিয়োগ ছিল না।

সোমদেব চন্দ্র রূপে অন্তরীক্ষে বিরাজিত এবং উজ্জ্বল ও জ্যোতিষ্মান রূপ ছাড়া তাঁর দেবত্ব নিতান্তই অস্পষ্ট রয়ে গেছে। উদ্ভিদ সোম বৰ্ণনায় কোনো দেবত্ব আরোপ করা সম্ভব নয়। যদিও ঋগ্বেদের নবম মণ্ডলে সোমরসের মাদকতাই যেন উদ্ভিজ্জ সোমের উপর দেবত্ব আরোপ করেছে। এখানে সোম থেকে রস নিষ্কাশনের যে বর্ণনা সােমপায়ীর দীপ্ত কল্পনা তাকে এক তুরীয় লোকে নিয়ে গেছে।

যম প্রেতলোকে মৃত ব্যক্তিদের আত্মার হিতকারী অভিভাবক। তিনি মৃত ব্যক্তিদের দেবতা; পরবর্তী সাহিত্যে মৃত্যুর ভয়ঙ্কর অধিদেবতা রূপে যমের যে ভাবমূর্তি, তা ঋগ্বেদে পাওয়া যায় না। মানুষের মধ্যে তিনিই প্রথম মৃত্যুলোকে প্রয়াণ করেছিলেন। বস্তুত ঋগ্বেদে তার প্রসন্ন ও আনন্দময় অভিব্যক্তিই বিশেষভাবে লক্ষণীয়। পার্থিব জীবনের দীর্ঘায়িত প্রতিরূপে হিসাবেই পরলোক কল্পিত হয়েছে, তবে তৎসম্পর্কিত কাহিনীগুলিতে এই কল্পনার প্রকাশ অস্পষ্ট ও পারম্পর্যহীন, কেননা ঋগ্বেদের সর্বত্রই পার্থিব জীবনই একান্তভাবে আকাঙ্ক্ষিত। যাই হােক, তখনও পর্যন্ত পরলোক, যন্ত্রণার ক্ষেত্র নয় এবং যমদেব প্ৰয়াতদের সদয় সত্বাধিকারী ও তাদেরই পূর্বপুরুষ। যম যমীর সংলাপমূলক বিখ্যাত সংবাদসূক্তটি (১০ : ১০) সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ক-যমী তার যমজ ভ্ৰাতা যমকে প্ৰণয় নিবেদন করছেন এবং যম তা প্ৰত্যাখ্যান করছেন। দশম মণ্ডল রচনার সময়ে অজাচারের বিরুদ্ধে সামাজিক বিধিনিষেধ যেহেতু অত্যন্ত কঠোর হয়ে পড়েছিল তাই যম ও যমীর দীর্ঘ বাদানুবাদের অতি সামান্য অংশই সংরক্ষিত হয়েছে। পৃথিবীর সর্বত্র প্রচলিত এই জাতীয় প্রত্নকথাগুলির সঙ্গে তুলনায় আমরা বুঝতে পারি যে, আদিম মানুষের মধ্যে অজাচার মানব জাতির সৃষ্টির আবশ্যিক পূর্বশর্ত রূপেই বিবেচিত হত।

অশ্বীরা যমজ দেবতা। এই দুই ভ্ৰাতা নাসত্য ও দস্ৰ নামেও পরিচিত। এই নাসত্য নামটি খ্রিস্টপূর্ব চতুর্দশ শতকের মিতান্নি ও হিট্রাইটদের সন্ধির সমকালীন কেননা তৎকালীন বোঘাজকোঈ থেকে প্রাপ্ত সেই বিখ্যাত সন্ধিপত্রে মিত্র বরুণ ও ইন্দ্রের সঙ্গে নাসত্যের নামও উল্লিখিত হয়েছে। গ্রিক প্ৰত্নকথাতেও এই যমজ দেবতার প্রতিরূপ লক্ষ করি ক্যাস্টর ও পলিডেউকিস-এর মধ্যে; আবার রোমান প্রত্নকথায় তারা ক্যাস্টর ও পোলাক্স নামে বিখ্যাত। উত্তর ইয়োরোপের পুরাণে এরা দিবো দিওয়ালি বা দিবো সুনেলেই নামে পরিচিত। আদিত্যদের মধ্যে একমাত্র অস্বীরাই বিভিন্ন সংকট, অসুস্থতা, অগ্নিকাণ্ড ও জলনিমজ্জন-এর মতো আপৎকালীন পরিস্থিতিতে শারীরিকভাবে মানুষের সহায়তা করে থাকেন। তাদের রোগ নিরাময় করার ক্ষমতা প্রত্যক্ষগোচর; অন্যান্য সৌরদেবরা সাধারণত উদ্যমহীন, শুধুমাত্র অস্বীরা প্রবলভাবে সক্রিয়। তঁরা সূর্য এবং মধুকে রথে বহন করে নিয়ে আসেন। অশ্বীদের পরিচয়বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে যাস্ক বলেছেন যে, বিভিন্ন বিদ্বজনের কাছে এই যুগলদেবতা দিন ও রাত্রি, আকাশ ও পৃথিবী, সূর্য ও চন্দ্রের প্রতিনিধি; আবার যাস্ক বলেছেন যে, ঐতিহাসিক প্রস্থানের কাছে তারা পুণ্যকৃৎ নৃপতি; অর্থাৎ জনকল্যাণকারী ঐতিহাসিক রাজাদেরই দেবত্বে উপনীত রূপ। তাদের মানবিক পরিচয় স্পষ্ট হওয়ার জন্যহ সম্ভবত পরবর্তী প্ৰত্নকথাগুলিতে দেবভোগ্য সোম থেকে তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। বুৎপত্তিগত অর্থ (অশ্বের অধিকারী) বিশ্লেষণ করে মনে হয়, আর্যদের মধ্যে তারা ছিলেন প্ৰাচীনতম অশ্বারোহী।

অন্তরীক্ষের অধিষ্ঠাতা দেবতাদের মধ্যে ইন্দ্ৰই প্ৰধান; বিভিন্ন যুদ্ধবিগ্রহে বীরত্বে প্রদর্শনের দ্বারা তিনি স্পষ্টতই ক্ষত্ৰিয় সেনাপতির দেবরূপ। অন্তরীক্ষ বিষয়ক দেবতাদের মধ্যে তার সহায়ক–বায়ুবাতঃ, পর্জন্য, রুদ্র ও মরুৎগণ। তাদের প্ৰত্যেকেই যোদ্ধা, শক্র-ধবংসকারী বিজয়ী; তারা ক্ষমতাশালী ও বীর, ভীতি-উৎপাদক ও পৌরুষদীপ্ত। বীরত্বের জন্য এই সব দেবতা প্ৰশংসিত; সেই সঙ্গে জয়লাভের জন্যও তাদের নিকট প্রার্থনা জানানো হয়। বায়ুবাতাঃ ও পর্জন্য যথাক্রম বাতাস, ঝড় ও বাজপাতের দেবায়িত রূপ। বৈদিক বায়ু দেবতার মধ্যে একদিকে যেমন আছে প্ৰাণধারণের অপরিহার্য উপাদান বায়ু, অন্যদিকে তেমনি প্রবল ঝঞ্ঝাবাতের শক্তিও। প্রকৃতপক্ষে বায়ুবাতাঃ শব্দবন্ধে এই দুটি বৈশিষ্ট্যের স্পষ্ট অভিব্যক্তি দেখা যায়; প্রথমটি বায়ু দ্বিতীয়টি বাত্যা বা ঝড়ের বাতাস। মৃ-ধাতু নিম্পন্ন মরুৎ শব্দের মধ্যে রয়েছে ভয়ংকরের দ্যোতনা। মৃত আত্মার সঙ্গে মরুৎগণ সম্পর্কিত; বীজ ও বিদ্যুৎ এদের অন্ত্র হওয়াতে এঁরা ঝড়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। সিংহের ন্যায় গর্জনশীল মরুৎগণ উত্তরদেশের অধিবাসী, পৃষভী মৃগ তাদের বাহন এবং তীক্ষ ও দংশন-উন্মুখ বৃষ্টিধারা যেন তাদের লৌহনির্মিত দন্তরাজি। অরণ্যের বৃক্ষশ্রেণী যখন তাদের প্রবল আঘাতে উন্মলিত ও ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, মনে হয় যেন পরাক্রান্ত সৈন্যবাহিনীর আক্রমণে শত্ৰুপক্ষ সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। রুদ্র ও পৃগ্নি মরুদগণের পিতা ও মাতা এবং ইন্দ্র তাদের ভ্ৰাতা। যজুর্বোেদর পর্যায় থেকে মরুৎদের ভীতিপ্ৰদ বৈশিষ্ট্য স্পষ্টতর হয়ে ওঠে। তুলনামূলকভাবে বায়ুদেবরূপে পর্জন্যের ভাবমূর্তি কতকটা অস্পষ্ট; মৌসুমি বায়ুজনিত বৃষ্টিপাতের অগ্রদূতরূপে তার সামান্য কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আপঃ দেবতার ভাবমূর্তির পশ্চাতে রয়েছে আকাশে প্রচ্ছন্ন একটি কাল্পনিক জলাধার। আপঃ বা জলরাশিকে কখনো কখনো উচ্চতম স্বৰ্গে নিবদ্ধ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। কখনো বা অন্তরীক্ষে প্রচ্ছন্ন বলা হয়েছে। এই সব উৎস থেকে জীবন ও পরিপুষ্টিদায়ক সজীব বৃষ্টিধারারূপে অবতরণ করে তা শস্যে পুষ্টিসঞ্চার করে।

ঋগ্বেদে রুদ্র একজন গৌণ দেবতা যার উদ্দেশ্যে মাত্র তিনটি সূক্ত নিবেদিত। যদিও রুদ্রের ক্ষতিকর বাণবর্ষণের কথা বলা হয়েছে, তবু সাধারণভাবে তিনি অন্যান্য ঋগ্বেদীয় দেবতার মতই কল্যাণপ্ৰদ-আকৃতি ও বৈশিষ্ট্যর দিক দিয়ে অন্যদের থেকে কিছুমাত্র পৃথক নন। রথে আরূঢ় এই দেবতাটির গলায় সোনার হার এবং হাতে তীর-ধনুক। কিন্তু বিপজ্জনক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা তার মধ্যে রয়েছে বলেই যজমানের সন্তান, আত্মীয় ও গোসম্পদের ক্ষতি না করার জন্য প্রায়ই তার নিকট আর্ত, করুণ মিনতি ও প্রার্থনা জানানো হয় এবং সেই সঙ্গে যজমানের শক্ৰদের ধবংস করার জন্যও অনুরোধ জানানো হয়। তার ভাবমূর্তির মধ্যে কৌমজীবনের পৃষ্ঠপোষক দেবতার রূপ প্রচ্ছন্ন, প্ৰতিবেশীদের অকল্যাণের বিনিময়ে, প্রয়োজনবোধে অনৈতিকভাবে যিনি নিজ কীেম ও গোষ্ঠীর কল্যানসাধনে প্ৰয়াসী হচ্ছেন। তার কল্পনার মধ্যে যে দ্বৈধতা রয়েছে তার উপর ভিত্তি করেই পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে এবং মহাকাব্য ও পুরাণের যুগে রুদ্র-শিব দেবভাবনার উৎপত্তি; প্রাচীনতর দেবকল্পনায় যে বৈশিষ্ট্য ও সেই সঙ্গে অপূর্ণত রয়েছে, পরবর্তী প্রত্নকথাগুলিতে তা ক্রমে সম্পূর্ণ হয়ে উঠেছিল। প্রাচীনতম রুদ্র ও পৃশ্নির সন্তানরূপে পরবর্তী রুদ্রগণের জন্ম। এরা নির্মম ও শক্তিশালী। যে মৌসুমিবায়ুজনিত বৃষ্টিপাতের সঙ্গে আর্যরা ভারতবর্ষে উপনীত হওয়ার পরেই প্ৰথম পরিচিত হয়েছিলেন, এই রুদ্রদের গোষ্ঠী তারই প্ৰতিভূ। ঝড়ের মেঘের মতো রক্তবর্ণ রুদ্র ও চর্মনির্মিত. জলাধার বা পৃগ্নি প্রকৃতপক্ষে মৌসুমিমেঘাবৃত বর্ষাকালীন আকাশের দ্যোতনা নিয়ে আসে। এটা স্পষ্ট যে, বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে সম্পর্কিত প্ৰায় সমস্ত দেবতাই মৌসুমি-বায়ু সৃষ্ট ঝটিকা-বিক্ষুব্ধ আকাশের রক্তাভ দুতি এবং বৃক্ষ উৎপাটনকারী ভয়ংকর ঝড়ে আন্দোলিত মেঘপুঞ্জের প্রতিনিধি। রুদ্র শব্দের বুৎপত্তিতেও রক্তিমাভার পরিচয় মেলে। সন্দেহ নেই, এইসব দেবকল্পনায় প্রকৃতি একটি অবয়বগত ভিত্তি নির্মাণ করেছিল আর আক্রমণকারী আর্য সৈন্যবাহিনীর পরাক্রম প্রত্নপৌরাণিক ভাবমূর্তি নির্মাণে সাহায্য করেছিল। তাই মৌসুমিবায়ুর বিভিন্ন রাপকে বায়ুবাতাঃ, পার্জন্য, রুদ্র, মাতিরিশ্বা কিংবা মরুদগণরাপে শক্তিশালী, অন্ত্রযুক্ত ও বিজয়ীরাপে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রত্নকথার প্রয়োজনে সৈন্যবাহিনীর জন্যে যে সেনাপতি প্রয়োজন, ইন্দ্র-কল্পনায় তারই অভিব্যক্তি।

ঋগ্বেদের এক-চতুর্থাংশের চেয়েও বেশি সূক্ত ইন্দ্রের প্রতি নিবেদিত; বৈদিক দেবসঙ্ঘে তার অসামান্য গুরুত্বই এতে প্রমাণিত হচ্ছে। অবয়ব সংস্থানের দিক দিয়ে ইন্দ্ৰ উজ্জ্বল, তারুণ্যদীপ্ত, সুদর্শন, সুগঠিত হনু-যুক্ত; তিনি ‘সহসঃ সূনুঃ” অর্থাৎ স্বয়ং শৌর্যের সন্তান; হরি নামক সুন্দর অশ্বসমূহ দ্বারা বাহিত রথে তিনি আরোহন করেন। তার অসংখ্য ও বিচিত্র বীরত্বপূর্ণ কার্যকলাপের মধ্যে অধিকাংশই যুদ্ধবিগ্ৰহ সংক্রান্ত। অন্য যে কোনো প্ৰধান বৈদিক দেবতার মতো ইন্দ্ৰকেও বিশ্বস্রষ্টা রাপে প্ৰশংসা করা হয়েছে। তিনি গোসম্পদ দান করেন; পৃথিবীকে পরিপূর্ণ করেন খাদ্যসম্ভারে। ভারতের আদিম অধিবাসী অর্থাৎ অসুর’ নামে পরিচিত সিন্ধুউপত্যকার প্রাগাৰ্য জনতার সঙ্গে বহু সংগ্রামে বিজয়ী হয়েই ইন্দ্ৰ তার বিক্রমের সমস্ত ক্রিয়াকলাপ সম্ভব করে তোলেন। ইন্দ্রের যুদ্ধজয়ের কাহিনী অস্পষ্ট ও নির্বিশেষ নয়; যে সমস্ত শত্রুর সঙ্গে ইন্দ্ৰ যুদ্ধে জয়ী হয়েছিলেন, তাদের সুনির্দিষ্ট ইতিহাসম্মত নাম পাওয়া যায়। এতে বোঝা যাচ্ছে যে, ইন্দ্রের প্রাচীনতম ভাবমূর্তির পশ্চাতে প্ৰকৃত একটা ঐতিহাসিক ভিত্তি ছিল; আক্রমণকারী আর্যবাহিনীর সেনাপতিরূপে প্ৰাগাৰ্যদের সঙ্গে দীর্ঘকাল ব্যাপী অসংখ্য যুদ্ধে তিনি সাফল্য অর্জন করেছিলেন। ইন্দ্ৰ শক্ৰদের সম্পূর্ণরূপে পর্যুদস্ত করে ও তাদের শক্তির কেন্দ্রগুলিকে ধবংস করেও ঐসব জনগোষ্ঠীর প্রধানদের বন্দী করেন, তাদের গোধন ও সম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে নিজের অনুচরদের মধ্যে বিতরণ করেছিলেন। সেই কৃষ্টিনেতারূপে ইন্দ্ৰ আৰ্য জনগোষ্ঠীর আনুগত্য অর্জন করেন, পশুপালক যাযাবর আর্যদের তিনি কৃষিজীবীরূপে বিজিতের বাসভূমিতে বসতি স্থাপন করতে সাহায্য করেছিলেন।

ইন্দ্ৰ যে বজ্র নামক অস্ত্ৰ ব্যবহার করতেন, তা লৌহনিমিত কোনও অস্ত্ৰ ব’লেই মনে হয় এবং সেই কারণেই তা সেই ব্ৰঞ্জের যুগে অপ্রতিরোধ্য ছিল। ১৪৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ব্যাবিলনের পতনের পরে লোহা ব্যবহারের গোপন বিদ্যা ব্যাবিলনবাসীদের মধ্য থেকে প্রতিবেশী জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। আর্যদের মধ্যে ইন্দ্ৰই কেবলমাত্ৰ বজ্রাস্ত্ৰ ব্যবহার করেছিলেন এবং ব্ৰঞ্জ ব্যবহারকারী সিন্ধুউপত্যকার অধিবাসীদের কাছে সেই অস্ত্রকে প্রতিরোধ করার মতো কোন উপায় ছিল না। দীর্ঘকাল ব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অগ্নিবায়ু মরুদগণ, বিষ্ণু ও বৃহস্পতি ইন্দ্রকে সাহায্য করেছিলেন। গ্রিক প্রত্নকথার জেউস ও হেরার সঙ্গে ঋগ্বেদের ইন্দ্র ও ইন্দ্ৰাণী তুলনীয়। ইন্দ্রের সবচেয়ে শক্তিশালী শত্রুরূপে বৃত্ৰ উপস্থাপিত, অবশ্য বিজয়লব্ধ সম্পত্তি অর্থাৎ বৃষ্টি, আলোক, সম্পদ বা গোধন অনুযায়ী বিভিন্ন সময়ে তাকে অনাবৃষ্টি বা অন্ধকারের অসুর কিংবা মানবদেহধারী শক্রর নিধনকারী রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। বাস্তবিকভাবে ইন্দ্র সম্ভবত পরাজিত গোষ্ঠীপতির গোধন ও সম্পত্তি অধিকার করেছিলেন; হয়তো বা কখনো কখনো তিনি শক্ৰদের জলাধার ও বাঁধ ধবংস করে সঞ্চিত জলরাশিকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন। ইন্দ্রের অন্যান্য শক্ৰদের মধ্যে রয়েছে অহি (বুৎপত্তিগত অর্থ অনুযায়ী সম্ভবত বৃত্রেরই নামান্তর কিংবা ইন্দো-ইয়োরোপীয় বুৎপত্তি থেকে গ্রিক ‘অফিস্‌’ অর্থাৎ সৰ্পের নাম), পিপ্রু, উরণ, শুষ্ণ প্রভৃতি। এরা সম্ভবত ভারতের আদিম জনগোষ্ঠীগুলির নেতা, প্রত্যেকেই ইন্দ্রের দ্বারা পরাভূত বা নিহত। বহু যুদ্ধের বিজয়ী বীর রূপে ইন্দ্ৰ ‘শতক্ৰতু’ বিশেষণে অভিনন্দিত হলেও তার সর্বাধিক গৌরব নিহিত রয়েছে ‘বৃত্ৰহন’ পরিচয়ে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, অবেস্তায় ইন্দ্র ও বেরেথ্রগ্ন শব্দদুটি পৃথক ব্যক্তির পরিচয় বহন করছে। অন্যদিকে ‘মঘবা’ শব্দের মধ্যে এই তথ্য প্রচ্ছন্ন যে, ইন্দ্ৰই প্ৰধান সম্পদদাতা।

ইন্দ্রের সঙ্গে প্রীতিপ্ৰদ, উত্তেজক ও রমণীয় মাদকতা-উৎপাদক পানীয় সোমের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। এই পানীয় ও তার উৎসকে কেন্দ্র করে যে রহস্য ঘনীভূত হয়ে উঠেছিল এবং সোমপানের ফলশ্রুতিরূপে শত্রুজয়ের যে ঐতিহ্য পরিস্ফুট হয়ে গিয়েছিল তারই প্রভাবে পরবর্তী যুগে সোমযাগ এমন বিকশিত হয় এবং আনুষ্ঠানিকভাবে পানীয় গ্রহণের রীতিও প্রচলিত হয়ে যায়। ঋগ্বেদীয় যুগের সঙ্গে ইন্দ্রের প্রাধান্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পরবর্তী সাহিত্যে ইন্দ্রের গৌরব মান হওয়ার কারণ, ভারতভূমিতে আর্যদের চূড়ান্ত বিজয়লাভের সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে আর্য জনগোষ্ঠীর জন্য সম্পদ, ভূমি ও গোধন অর্জন করার ঐতিহাসিক ভূমিকাও শেষ হয়ে গিয়েছিল।

প্রাচীনতর পরিবারিক মণ্ডলগুলিতে ইন্দ্ৰসূক্তসমূহের সুস্পষ্ট কাব্যিক সৌরভ। রয়েছে; অধিকাংশই সাধারণভাবে যুদ্ধগীতি এবং এদের মধ্যে আমরা যেন অস্ত্রের ঝনৎকার ও বিজয়ীর সিংহনাদ ধ্বনিত হতে শুনি। প্ৰাগাৰ্য গোষ্ঠীপতির ঐন্দ্ৰজালিক ক্ষমতা বা ‘মায়া’ অধিগত বলে তারা আর্যদের প্রতি তাচ্ছিল্য প্ৰদৰ্শন করে, কিন্তু ইন্দ্র ও তার অনুচরদের নিকট এরা অসহায়। বহিরাগত আৰ্যদের শেষ্ঠতর অস্ত্র ও বীরত্বের নিকট প্ৰাগাৰ্য জন-গোষ্ঠী পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়। অধিকাংশ সূক্তই ইন্দ্রের বীরত্বের গৌরবজনক কাহিনী সামূহিক প্রত্নস্মৃতি থেকে তুলে এনে দেবতার আহ্বানসূচক স্ত্রোত্র রূপে প্ৰযুক্ত হয়–যাতে দেবতা সন্তুষ্ট হয়ে জনগোষ্ঠীর সাম্প্রতিক প্রয়োজন অর্থাৎ সময়মত বর্ষণ, প্রভূত পরিমাণ উত্তম শস্য, গোধন ও মানুষের উর্বরতা, বিজয়, ঐশ্বর্য ও দীর্ঘজীবন দান করতে পারেন। ঋগ্বেদের ইন্দ্র সর্বদা নায়াপথে চলেন নি, যুদ্ধজয়ের প্রয়োজনে বহুবার তিনি ছিলনার আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু নীতিবোধ কখনওই কৃষ্টি-নেতার চরিত্রের মূল বৈশিষ্ট্য নয়, বিজয় অর্জনই তার লক্ষ্য এবং সেখানেই তার যথার্থ গৌরব। কেননা আৰ্যজনগোষ্ঠীর পক্ষে তখনকার সংগ্রাম জীবনমরণের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই জনগোষ্ঠী তাদের ইন্দো-ইয়োরোপীয় আদি বাসভূমি থেকে দীর্ঘকালব্যাপী ভ্রমণের পথে বহুদূরে উপনীত হয়েছিলেন এবং দৃঢ় ও নিরাপদ বসতি স্থাপন তাদের পক্ষে অত্যাবশ্যক হয়ে উঠেছিল। ইন্দ্রের জয় তাদের শান্তি ও ঐশ্বর্যাকে সুনিশ্চিত করেছিল বলে বৈদিকে দেবগোষ্ঠীতে তাঁর প্রাধান্য তর্কাতীত।

পৃথিবীস্থান দেবতার কেন্দ্ৰবিন্দুতে রয়েছেন অগ্নি। ঋগ্বেদের সূচনা ও সমাপ্তি হয়েছে। অগ্নিবিষয়ক সূক্ত দিয়ে-গুরুত্বের দিক দিয়ে তিনি ইন্দ্রের ঠিক পরেই। প্ৰধানত তিনি দূতের ভূমিকা পালন করেন; যজ্ঞানুষ্ঠানে দেবতাদের তিনি আহ্বান করে আনেন এবং তাঁদের উদ্দেশে নিবেদিত অর্ঘ্য ও আহুতি বহন করে নিয়ে যান। অগ্নি উজ্জ্বল, পিঙ্গল বা রক্তবর্ণ, প্ৰাণপ্ৰাচুর্যেপূর্ণ, সক্রিয় ও চিরতরুণ। তিনি পুরোহিত এবং সম্পদদাতাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ (রত্নধাতম) খাদ্য ও ধনের অধিকারী (বাজস্বৎ, অন্নবৎ, বসুমৎ)। যেহেতু তিনি ইন্দ্রের শ্রেষ্ঠ মিত্র, দাতা শ্রেষ্ঠ বিশেষণটিতে সম্ভববত তাঁর দহনকর্ম, যুদ্ধনীতি সংশ্লিষ্ট কার্যাবলী সূচিত হচ্ছে। অর্থাৎ বহিরাগত আৰ্যরা যখন প্ৰাগাৰ্য ভূমি আত্মসাৎ করে তখন অগ্নিসংযোগের দ্বারা শুধু যে তারা জমিতে অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন তা নয়, অগ্নিদহনে আরণ্যভূমি এবং উষর ক্ষেত্ৰকে কৃষির উপযোগী করে তোলেন। অতএব অগ্নিই প্ৰকারাস্তরে আর্যদের ধনদাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ। শতপথ ব্ৰাহ্মাণের একটা বিবৃতি অনুযায়ী আৰ্যবসতি স্থাপয়িতাদের প্রথম প্ৰজন্ম অগ্নিকে আকষির্ত ভূমিতে বহন করে নিয়ে গিয়েছিলেন; অনার্যদের ভূমির অধিকার করার পূর্ব আক্রমণকারী আর্যরা বনভূমিতে অগ্নিসংযোগ করতেন। এভাবে নুতন ভূমি অধিকার করে তারা গোসম্পদ ও ধন লাভ করতেন। এইজন্য সংহিতা ও ব্রাহ্মাণ সাহিত্যের সর্বত্র অর্থাৎ আর্যজনগোষ্ঠীর বিজয় ও বিস্তারের প্রথম পর্বে অগ্নি তাদের প্রধান ধনদাতা দেবতা। আবার অগ্নি রাত্রে যেহেতু জুলন্ত প্রাচীর রূপে গোধনের নিরাপত্তা বিধান করতেন, সেহেতু এই উজ্জ্বল ও তারুণ্যদীপ্ত দেবতা আর্যদের যাযাবর জীবনে পশুসম্পদের সঙ্গে প্ৰত্যক্ষভাবেই সম্পর্কিত ছিলেনকৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা শুরু হওয়ার পরও অগ্নির সঙ্গে আৰ্যগোষ্ঠীর এই সম্পর্ক অক্ষুন্ন ছিল, তাই অগ্নি সুদীর্ঘকাল ধরে মুখ্য দেবতা থেকেছেন।

অগ্নির অন্যতম প্ৰধান বৈশিষ্ট্য হ’ল এই যে, তিনি দ্বিজ কেননা ইন্ধনের মধ্যে প্ৰছন্ন অগ্নি শুষ্ক দারুঘর্ষণ ক্রিয়ার দ্বারা দ্বিতীয় জন্ম পরিগ্রহ করেন। এই পরিচয় তাঁকে ব্ৰাহ্মাণের সমতুল্য অর্থাৎ দ্বিজ করেছে বলে দেবসমাজে তিনি কুলীন ও উচ্চতম স্তরের অন্তর্ভুক্ত এবং এই জন্যই প্রায় সমস্ত মণ্ডলই অগ্নিসূক্ত দিয়েই শুরু হয়েছে। দশটি অঙ্গুলি অগ্নির দশমাতা রূপে কল্পিত।

আগ্ৰীসূক্তগুলি সম্ভবত অত্যন্ত প্রাচীন মন্ত্রসংগ্ৰহ, তবে এদের মৌলিক তাৎপর্যের বহুলাংশেই আমাদের নিকট অজ্ঞাত। পশুযাগে আবৃত্ত এবং গীত এই আগ্ৰীসূক্তগুলিতে প্রধান যজ্ঞানুষ্ঠান আরম্ভ হওয়ার সময় অগ্নিকে সুসমিন্ধ, পাবক, তনুনপাৎ, নবীশংস, ইলা, বহিঃ, দ্বারো দেব্যাঃ, ঊষাসনক্তা, দৈবেী হােতামৌ ইত্যাদি নাম দিয়ে স্তব করা হয়েছে। এই সব বিশেষণের সূত্রাকারে বহু প্রয়োগ সম্ভবত অতিপ্রাচীনকালেই আরম্ভ হয়েছিল; অগ্নি তখন মানুষের রক্ষাকর্তা ও শুভার্থীদের অগ্রগণ্য ছিলেন। এই অগ্নি মানুষকে প্রথম যজ্ঞানুষ্ঠানের মাধ্যমে দেবতাদের সন্নিকটে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং দিবারাত্র তিনি সকল মানুষের সঙ্গে থাকতেন। দৈব্যৌ হােতারৌ’ বা দৈব পুরোহিত রূপে অগ্নির বর্ণনা সম্ভবত অগ্নিচর্যার দুজন প্রাচীনতম পুরোহিত অর্থাৎ অথর্ব ও অঙ্গিরার দিকে ইঙ্গিত করছে। স্পষ্টতই অথর্ব ও অঙ্গিরাকে পরবর্তী ব্যাখ্যায় যথাক্রমে মঙ্গল ও অমঙ্গলের সঙ্গে সম্পূক্ত করে। এদের যে দুরকমের (শুভ ও অশুভ) ইন্দ্ৰজালের পুরোহিতরূপে উপস্থাপিত করা হয়েছে, তার সূত্রপাত হয়েছিল সুপ্রাচীনকালে যখন অগ্নিচৰ্যার শামান বা জাদু পুরোহিতরা পশুচারী জনগোষ্ঠীর মাংসের অর্ঘ্যযুক্ত প্ৰাথমিক যজ্ঞানুষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন। যজীৱীয় পশু বলিদানের অব্যবহিত পূর্বে অগ্নির দ্ব্যর্থবোধক বিশেষণগুলি সহ যে আগ্ৰী সুক্তিগুলি প্ৰযুক্ত হত, তাতে সম্ভবত প্রাচীনতম পর্যায়ের মাংসাকুতি দানের স্মৃতি প্রচ্ছন্ন রয়ে গেছে। পরবর্তী যুগে কৃষিজীবী সভ্যতার প্রবর্তনের পর নিরামিষ হব্যের প্ৰচলন হয়।

অগ্নি যেহেতু রাত্ৰিতে সূর্যের প্রতীকী বিকল্প, তাই অনিবাৰ্যভাবেই তিনি আলোক ও অশুভ প্রতিরোধের সঙ্গে সম্পর্কিত। মমতার পুত্র অন্ধ ঋষি দীর্ঘতমাকে তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। রাত্রিকালে প্ৰজ্বলিত অগ্নিরূপে তিনি দানব বিনাশকারী বা রক্ষোহয়। তবে অগ্নির স্বভাবে ভয়ংকর দিকও যথেষ্ট ছিল; তাই তাকে ক্ৰব্যাৎ বা শব-ভুক রূপেও বৰ্ণনা করা হয়েছে। কারণ শবদাহে অগ্নি শবকে গ্ৰাস করেন এমন মনে হয়। সমগ্ৰ বৈদিক সাহিত্যে অগ্নির প্রসন্ন ও ক্রুর এই দুটি আপাতবিরোধী বৈশিষ্ট্যের মধ্যে স্পষ্ট একটি ভেদরেখা টানা হয়েছে। মৃত্যুর বা মৃতদেহ-দহনের সঙ্গে তাঁর সম্বন্ধের ফলে তিনি পিতৃলোকে আহুতি বহন করে নিয়ে যান; তখন স্বাহা’ শব্দের পরিবর্তে ‘স্বধা’ শব্দটি তার উদ্দেশ্যে প্ৰযুক্ত হয়। উজ্জ্বল আলোকদীপ্ত দেবতারূপে অগ্নিকে বৃহস্পতি ও ব্ৰহ্মাণস্পতির সমতুল্য বলে গণ্য করা হয়; এরা তার সঙ্গে পুরোহিতের দায়িত্ব ভাগ করে নেন। অগ্নি যখন উচ্চতম স্বর্গে বিরাজ করেন তখন তাকে মাতিরিশ্বা বলে বর্ণনা করা হয়; আকাশে তিনি বিদ্যুৎ, পৃথিবীতে সমিধ সমূহে তিনি তনুনপাৎ এবং জলমধ্যে তিনি বাড়বাগ্নি। পরবর্তী সাহিত্যে অগ্নি ধীরে ধীরে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলি হারিয়ে ফেলেন এবং ক্রমশ রুদ্রের সঙ্গে তার একাত্মতা এসে যায়। বস্তুত, ঋগ্বেদের পর্যায়েই তার সর্বাধিক সক্রিয় অবস্থা অক্ষুন্ন ছিল; কিন্তু তারপর থেকে ক্ৰমে ক্ৰমে তিনি প্রত্নপৌরাণিক স্তরের পূর্ববতী নৈসৰ্গিক উপাদানের অবস্থানে প্ৰত্যাবর্তন করেন। আর্যগণ যখন নিশ্চিত নিরাপত্তার প্রয়োজনে প্রাচীর-বেষ্টিত নগরী নির্মাণে পারঙ্গম হয়ে উঠলেন, মানুষের প্রথম মিত্র ও রক্ষকরূপে অগ্নির মৌলিক মৰ্যাদা ধিরে ধিরে মান হয়ে গেল। অবশ্য প্ৰভুকথাগুলির মধ্যে অগ্নির আবিষ্কারজনিত প্ৰাথমিক ভীতি ও বিস্ময়ও অমরতা পেয়ে গেছে। প্রতিদিন নতুনভাবে জন্ম নেওয়ার ফলে রক্তিম অগ্নি দেবতাদের মধ্যে তরুণতম ও সবচেয়ে সুদৰ্শন রাপে পরিচিত।

অগ্নির পরেই পৃথিবীবাসী দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সোমদেব। সম্পূর্ণ নবম মণ্ডলে শুধুমাত্র একজনই দেবতা : সোম। এক ধরনের বিশিষ্ট উদ্ভিজ নিষ্কাশন করে তার রস সংগ্ৰহ করা হত; বৈদিক আৰ্যদের সবচেয়ে প্ৰিয় উত্তেজক পানীয় ছিল এই সোমরস। এই রসাপানের তৃপ্তি ও উন্মাদনাতেই ক্ৰমে ক্রমে তার উপর দেবত্ব আরোপিত হয়েছিল। সোমসূক্তগুলি প্ৰাথমিক অবস্থায় প্রথম আটটি মণ্ডলের অন্তর্ভুক্ত ছিল; কিন্তু সোমচৰ্যার শুরুত্ব ও জটিলতা ক্রমশ বধিত হওয়ার ফলে পুরোহিতরা সোমযাগে প্রয়োগের সুবিধার্থে সমস্ত সোমসূক্ত একত্রে পৃথকভাবে সংকলন করে আনুষ্ঠানিক যজ্ঞে প্রযোজ্য স্তব ও প্রার্থনার একটি পুস্তিকা প্ৰণয়ন করেন। নিঃসন্দেহে ঋগ্বেদ-সংহিতার শেষ পর্যায়ে এই সম্পাদকীয় প্রচেষ্টাটি হয়েছিল; দশম মণ্ডলে যেহেতু কোনো সোমসূক্ত নেই, আমরা স্বভাবতই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, দশম মণ্ডল রচিত হওয়ার সময় কিংবা পরবর্তীকালে সোমমণ্ডলটি সংকলিত হয়েছিল। অবেস্তায় যে ‘হওম’-এর উল্লেখ আছে তাকে সোমযাগের ইন্দোইরানীয় প্রতিরূপ বলেই গ্ৰহণ করা হয়। ঋগ্বেদ-সংহিতার শেষ পর্যায়ে বহু নতুন যজ্ঞ আবিষ্কৃত হওয়ার সঙ্গে সোমযোগও ক্রমান্বয়ে বিস্তারিত এবং গ্রন্থিল হয়ে উঠল—অনেক পুরোহিত এর সঙ্গে যুক্ত হলেন, অসংখ্য অনুপুঙ্খ দেখা দিল এবং দ্বাদশবর্ষব্যাপী সত্রে তা পরিণতি লাভ করল। বস্তুত সংহিতা ও ব্রাহ্মণ যুগের মধ্যবর্তীকালে সোমদেবের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। সোম ইন্দ্রের মিত্র এবং অন্যান্য দেবতাদের মতোই তার নামের সঙ্গে অস্পষ্ট কিছু বীরত্বপূর্ণ কাহিনী সংযোজিত হয়েছে, তবে সোমসূক্তের সর্বাধিক কাব্যগুণমণ্ডিত অংশে পানোন্মত্ত পুরোহিতদের অবস্থা বিশদ বর্ণনায় বিবৃত। ইন্দ্রের এই মাদক পানীয়ের প্রতি আসক্তি যেহেতু কিংবদন্তীতে পরিণত সেহেতু সোমের স্বাভাবিক মিত্ররূপে তিনি সেই সেনাপতির ভাবমূর্তিকে স্পষ্ট করে তুলেছেন, জয়লাভ করার উপযোগী শক্তি অর্জন – যার জন্য যিনি যুদ্ধক্ষেত্রে যাত্রা করার পূর্বে উত্তেজক পানীয় আকণ্ঠ পান করে নিতেন। অনুরূপভাবে অগ্নি সোমের সঙ্গে দু’ভাবে অন্বিত হয়েছেন; প্রসন্ন মূর্তিতে তিনি ইন্দ্রের মাধ্যমে এবং ভয়ঙ্কর মূর্তিতে তিনি পিতৃগণের মাধ্যমে সোমের সঙ্গে যুক্ত। তাই সোমকে পিতৃমৎ এবং পিতৃগণকে সোমবৎ বলা হয়ে থাকে। সোমদেবের সঙ্গে অশ্বীদের কৌতুহলজনক দ্বৈত সম্পর্ক রয়েছে। দশম মণ্ডলের অন্তর্গত সূৰ্যসূক্তে যে কাহিনীর আভাস রয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে যে, সূৰ্যার পিতা সবিতা প্ৰথম সোমদেবকেই কন্যাদান করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অশ্বীরাই সূর্যাকে সঙ্গে করে রথে পতিগৃহে নিয়ে যান অথবা হয়ত সূর্যাকে তাঁরাই লাভ করেন। একদা সোমপানে বঞ্চিত হয়েছিলেন বলেই তাঁরা যেন সোমের জন্য নির্দিষ্ট বন্ধুকে গ্ৰহণ করে প্রতিশোধ নিলেন। এই প্রত্নপৌরাণিক বিবাহ-কাহিনীতে সোম যেন প্রার্থিব উদ্ভিদ ও আকাশবিহারী চন্দ্রের রূপে তার অবস্থানের মধ্যবিন্দুতে বিরাজ করছেন। বস্তুত সূর্য ও চন্দ্রের বিবাহ বিষয়ক সুপ্রাচীন ইন্দো-ইয়োরোপীয় প্রত্নকথার পরিপ্রেক্ষিতেই প্ৰাণ্ডক্ত কাহিনীর তাৎপৰ্য স্পষ্ট হয়ে উঠে।

যজ্ঞের অনুষ্ঠানচর্যার ইতিহাসের পরবর্তী স্তরে আমরা এক ধরনের যান্ত্রিক প্রবণতা লক্ষ্য করি; স্তোত্রে আহুত যে কোনো বস্তুই সেই সূক্তের দেবতারূপে গৃহীত হয়েছিল। কলা বাহুল্য, সংহিতা সংকলনের সম্পাদকীয় প্রক্রিয়ার চুড়ান্ত পর্যায়েই এই বৈশিষ্ট্য পরিস্ফুট হয় যখন প্রত্যেকটি সূক্ত—এমন কি প্রত্যেকটি মন্ত্রের জন্য নির্দিষ্ট ঋষি, ছন্দ ও দেবতা নির্দেশিত হত। যে সমস্ত ক্ষেত্রে স্পষ্টভাবে কোনো দেবতা নির্দেশিত হয় নি, সম্পাদকরা যান্ত্রিকভাবে ঋকে উল্লিখিত প্ৰাণহীন বস্তুর উপরও দেবত্ব আরোপ করতেন। এই চুড়ান্ত কৃত্ৰিম আনুষ্ঠানিকতার যুগে দেবতার বিশেষণগুলিও মধ্যে মধ্যে যে স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব অর্জন করে দেবতাররূপে পরিগণিত হয়েছিল। যাস্কের মতে এইরূপ যাজ্ঞিক পক্ষের চিন্তাধারায় পরিপুষ্ট হয়ে যখন অসংখ্য উপবিভাগে বিন্যস্ত হচ্ছিল তখন যেন কোন কিছুরই দেবতা হয়ে ওঠার বা দেবতারূপে পরিগণিত হওয়ার আর বাধা রইল না। যজ্ঞে বলি-প্রদত্ত অশ্ব, বৃষ এবং অন্যান্য জন্তুতে যেমন দেবত্ব আরোপিত হয়েছিল, তেমনি নতুন প্রবণতার বিচিত্র অভিব্যক্তি “অজ একপাদ’ বা ‘অহির্বুধ্ন্য’রূপ কল্পনার মধ্যে দেখা গেল।

ঋগ্বেদের সময়কার দেবগোষ্ঠী যখন সংসার দিক দিয়ে প্রায় নিয়ন্ত্রণাতীত হয়ে উঠল তখন বিশ্বে দেবাঃ নামে নতুন একটি ধারণার জন্ম হল; এদের উদ্দেশে বহু সূক্তও গ্রথিত হল। প্রাথমিক স্তরে প্রাগুক্ত শব্দবন্ধটি যদিও সমগ্র দেবসঙঘকেই সামূহিকভাবে নির্দেশ করেছে, পরবর্তীকালে তা নিজস্ব স্বতন্ত্র অস্তিত্বে প্রতিষ্ঠিত হযে একটি নতুন ও অস্পষ্ট সাংকেতিক রূপ পরিগ্রহ করে-তার মধ্যে নতুন এক অস্পষ্ট অধ্যাত্ম ব্যঞ্জনাও অনুভূত হয়। অন্যান্য ভূস্থান দেবতাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যও সুস্পষ্টভাবে পরিস্ফুট হয়েছে। অবশ্য পৃথিবী এবং সিন্ধু, বিপাশ্‌, শুতুদ্রী, ইলা, ভারতী ও সরস্বতীর মতো নদীদের পরিচয়ও সংশয়ের উর্ধ্বে নয়। দেবতাদের দ্বারা গৃহীত হওয়ার পর আহুতির অবস্থাকে ইলা বলে অভিহিত করা হয়েছে; তবে সব্যস্বতী নদী হ’লেও ভারতী নিশ্চিতভাবে বিমূর্ত। ভারতী সম্ভবত ভারতের আর্যবসতিসমূহের কিংবা ভরতকৌমের নাম; তেমনি যে সরস্বতী নদীর তীরে প্রথম আৰ্যবসতিগুলি গড়ে উঠেছিল, তারই সমুন্নত নাম সরস্বতী। যখন যজ্ঞানুষ্ঠান প্রকৃতপক্ষে দেবতাদের প্রাধান্যই আত্মসাৎ করে নিচ্ছিল, সেই সময় যজ্ঞের গৌণ উপকরণ ও অংশসমূহে দেবত্ব আরোপিত হচ্ছিল। ফলে যুপ, ক্ষুর কিংবা গ্রাবাণৌ (শিলনোড়া) যে দেবত্ব মণ্ডিত হয়ে উঠল তাদের মধ্যে যথার্থ দেবতার পরিচয় না থাকলেও নিশ্চিতভাবে যজ্ঞচর্যার গৌরবের লক্ষণটুকুই ফুটে উঠেছিল। বিশঃ, প্ৰজা, অর্থাৎ জনসাধারণ ও কৃষকগণ তখন এক নামহীন জনগোষ্ঠীরূপে বিদ্যমান ছিল; ফলে তাদের আদর্শায়িত উপস্থাপনা যে সব পৃথিবী-নিবাসী দেবতাদের মধ্যে ঘটেছিল তার কোনও স্পষ্ট অবয়ব ফুটে ওঠেনি।

ঋগ্বেদে রচনা ও সংকলনের অন্তিম পর্যায়ে অর্ধবিমূর্ত দেবতাদের একটি নতুন গৌষ্ঠীর উৎপত্তি হয়। এদের মধ্যে প্রজাপতি, ব্ৰহ্মা, বৃহস্পতি, ব্ৰহ্মণস্পতি, হিরণ্যগৰ্ভ ও বিশ্বকর্মার নামই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য; সাধারণভাবে এরা তখন যজ্ঞ এবং পুরোহিতদের কার্যাবলীর বিমূর্ত সৃজনশীল ক্ষমতার প্রতীক। লক্ষণীয়, যে এইসব দেবতাদের প্রতি নিবেদিত অধিকাংশ সূক্তে মানুষের উপর দেবত্ব আরোপের কোনো স্পষ্ট ইঙ্গিত নেই বা যজ্ঞে বিনিয়োগের জন্য কোন নির্দেশও নেই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যদিও বিনিয়োগের উল্লেখ রয়েছে, নিশ্চিতভাবেই সেইগুলি সংহিতা-যুগের শেষ পর্যায়ে আবিষ্কৃত যজ্ঞানুষ্ঠানগুলির সঙ্গেই সম্পূক্ত। বিমূর্ত দেবতাদের প্রতি সূক্তসমূহ যেহেতু মূলত সংহিতাযুগের অস্তিম পর্যায়েই পাওয়া যায়, এতে সম্ভবত এই ইঙ্গিতই রয়েছে যে এইসব সূক্তের মধ্যে প্রচ্ছন্ন একেশ্বরবাদী প্রবণতা আর্য ও প্রাগার্য গোষ্ঠীগুলির পারস্পরিক সংমিশ্রণেরই বিলম্বিত ফলশ্রুতি।

পৃথিবীর ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার আচরণের মধ্যে পিতৃপুরুষদের উপাসনা একটি সর্বজনগ্রাহ্য উপাদান; তা নিশ্চিতভাবে আর্যদের মধ্যেও প্রচলিত ছিল। দশম মণ্ডলে ‘পিতরঃ’ এর উদ্দেশে কয়েকটি সূক্ত রচিত হওয়ায় আমরা প্ৰমাণ পাচ্ছি যে সংহিতার শেষ পর্যায়ে এইসব রচনা প্রথম প্রকাশ্য স্বীকৃতি লাভ করে। এর কারণ সম্ভবত এই যে বিষয়টি মূলত গাৰ্হস্থ্য জীবনের সঙ্গে জড়িত এবং আক্রমণকারীরা বসতি বিস্তার করে দৃঢ়ভিত্তি অর্জন করার পরই সামূহিক পিতৃ-উপাসনার সূত্রপাত হয়।

অনৈসৰ্গিক অস্তিত্বের মধ্যে সবচেয়ে স্পষ্ট বিভাজন রয়েছে দেবতা ও অসুরদের মধ্যে। যে সমস্ত প্ৰাগাৰ্য গোষ্ঠীপতি ও তাদের অনুচররা আর্যদের আক্রমণ প্ৰতিহত করেও শেষ পর্যন্ত পর্যুদস্ত হয়েছিল, তাদেরই অসুর রাজা ও অসুর গোষ্ঠীপতিরূপে চিত্রিত করা হয়েছে। প্ৰত্যেকটি প্ৰত্বপৌরাণিক উপাখ্যানেই বিজয়ী আক্রমণকারীদের শত্ৰুপক্ষকে এভাবে মসীলিপ্ত করা হয়েছে। আদিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে আত্মা সম্বন্ধে বিশ্বাস খুবই সাধারণ। প্রাচীন মানুষের বিশ্ববীক্ষায় জীবিত মানুষের পৃথিবী প্রায়ই মৃত পূর্বপুরুষদের আত্মার দ্বারা আক্রান্ত অথবা লালিত হয়ে থাকে। বৈদিক আর্যদের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয় নি।

আর্যরা প্রকৃতপক্ষে অনাৰ্যগোষ্ঠীভুক্ত শক্ৰদেয় অমরতা দান করেছেন। দীর্ঘকালব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধকে অতিজাগতিক তাৎপর্যে আধ্যাত্মিকতায় উত্তীর্ণ করে কল্যাণ ও অকল্যাণের মধ্যে সংঘর্ষ রাপে উপস্থাপিত করা হয়েছিল। প্ৰাগাৰ্য গোষ্ঠীপতিদের প্রথম প্ৰজন্মকে সম্ভবত আর্যদের বিজয় লাভের এক শতাব্দী বা আরও কিছুকাল পরে মায়া শক্তিধারী অশুভ বাহিনীরূপে চিহ্নিত করা হল, পরবর্তীকালেও আর্যদের যে কোনো ধরনের বিপদের জন্য তাদেরই দায়ী করা হত। কালক্রমে এইসব শত্ৰু অন্তরীক্ষাচারী বা পাতালনিবাসী অদৃশ্য শক্তিরূপে চিহ্নিত হ’ল। আঞ্চলিক বা পারিবারিক প্রত্নকথা ও আখ্যান অনুযায়ী এদের নাম, চরিত্র ও ক্রিয়াকলাপ হ’ল ভিন্ন ভিন্ন। এইসব আর্যশক্ৰগণ যথাসময়ে অসুর, রক্ষঃ (পরবর্তীকালে এরাই রাক্ষস) যক্ষ ও পিশাচ রূপে পরিচিত হ’ল; উল্লেখ্য যে, এরা সর্বদাই যুথবদ্ধ (গণ), তবে প্রত্নপৌরাণিক বিশ্বকল্পনায় ভাল ও মন্দের মধ্যে দ্বিমেরু কোনও বিষম বিভাজন নেই; বহু দেবতার চরিত্র ও কার্যাবলী বিশ্লেষণ করেও আমরা তাই দেখি। প্রেত ও পিশাচশক্তি সমন্বিত হয়ে যেমন রুদ্র ও মরুদগণে পরিণত হয়েছে, তেমনি বিপরীত ক্রমে এরাই অসুর, রক্ষ প্রভৃতিতে বিবর্তিত হয়েছে। বস্তুত মূলগতভাবে এরা পরস্পর ভিন্ন নয়, শুভশক্তির দিকে প্রবণতা থাকলে একই শক্তি দেবতা হয়ে ওঠে। কিন্তু ভারসাম্য বিপরীত দিকে ঝুঁকে পড়লেই জন্ম নেয় অসুরেরা। প্রকৃতপক্ষে অসুর কল্পনার মধ্যেই ঐতিহাসিক সত্য অধিক মাত্রায় প্রচ্ছন্ন।