প্রেমেন্দ্র মিত্রের শ্রেষ্ঠ গল্প
আগ্রা যখন টলমল
উপন্যাস
সংযোজন
পরিশিষ্ট

৩২. পানামা থেকে বার হওয়া

গানাদো আর কয়ার পানামা থেকে বার হওয়া বুঝি অসম্ভব!

বারবার ভাগ্যের অবিশ্বাস্য বিরোধিতা দেখে অন্তত তাই মনে হয়। তা না হলে একান্ত অনুকূল ঘটনা সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে দাঁড়ায় কেন।

জাহাজঘাটায় নামবার পর অচেনা দাস ব্যবসায়ীর হাতে না পড়ে কাপিতান সানসেদোর উপস্থিত বুদ্ধি ও তৎপরতায় রক্ষা পাওয়া আর তারপরে ডন মোরালেস-এর মতো উদার সহৃদয় মানুষের কাছে আশ্রয় পাওয়া আশাতীত সৌভাগ্য সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই সৌভাগ্যই ডন মোরালেস-এর দেশ ও রাজভক্তির গোঁড়ামির দরুন অমন বিপজ্জনক হয়ে উঠবে আগে তো ভাবতে পারা যায়নি!

এটুকু বলা যায় যে, গানাদো এমন তেজি ও সাচ্চা কথার মানুষ না হলে সে বিপদ অবশ্য ঘটত না। মোরালেস-এর কাছে নিজের যথার্থ মনোভাব গোপন রাখলে তিনি পানামার নতুন শাসনকর্তাকে দিয়ে গানাদোর ক্রীতদাসত্বের কলঙ্কমোচনের ব্যবস্থা বোধহয় করতে পারতেন। কিন্তু আর যেভাবেই হোক অতখানি মিথ্যা পরিচয়ের মূল্যে নিজেদের মুক্তি কিনতে রাজি হওয়া গানাদোর পক্ষে সম্ভব নয়।

মোরালেস-এর আশ্রয় এক রাত্রের মধ্যে ছেড়ে যাওয়ার কঠিন ও বিপজ্জনক সংকল্পই তাই তিনি নিয়েছেন।

সে সংকল্প সফল হওয়ার ব্যাপারে ভাগ্যের অপ্রত্যাশিত সাহায্যই যেন পাওয়া গেছে। কাপিন সানসেদো ফেলিপিলিওর কাছে যা শুনেছিলেন, তা বেশ একটু ভীত ও ভাবিত করবার মতোই! নগরে আর এক-রাত্রের বেশি নিরাপদ আশ্রয় যার নেই, সেই গানাদোকে ধরবার জন্যে পানামা থেকে যাওয়া আসার সমস্ত পথে কড়া জাগ্রত পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে জানলে শঙ্কিত বিহ্বল হওয়ারই কথা।

সে শঙ্কা-বিহ্বলতা আশ্চর্যভাবে কেটে গিয়েছে প্রায় তৎক্ষণাৎ।

ফেলিপিলিওর সঙ্গে নগর থেকে বন্দরে যাবার পথের বাঁকে যাকে দেখে কাপিন সানসেদো চমকে উঠেছিলেন, আশঙ্কার জায়গায় আশার সঞ্চার করবার মূল সে-ই।

প্রথম চমকে ওঠবার পর উচ্ছ্বসিত উত্তেজিতভাবে কাপিন সানসেদো তার সঙ্গে যে আলাপ করেছেন তাতে কয়েক মূহূর্তের মধ্যেই একটা দুর্বোধ রহস্যের ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে আর সেই সঙ্গে সবচেয়ে কঠিন সমস্যার আশাতীত সমাধান হাতের মুঠোয় এসে গেছে বলে মনে হয়েছে।

অসম্ভব যার দরুন এক মুহূর্তে সম্ভব হয়ে ওঠে কে সে জন?

এমন কেউ যাকে পানামার ওই বাজারের রাস্তায় দেখবার কথা কাপিতান সানসেদো কল্পনাও করেননি। পরস্পরের প্রথম উচ্ছ্বসিত ব্যাকুল সম্ভাষণের পর বিশ্বাসও করতে পারেননি তার কথা।

যার ব্যাকুল আবেদনে সাড়া দিতে গিয়েও বিফল হয়ে বেশ একটু বেদনা নিয়ে সেভিল থেকে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন, চপল চঞ্চল খেয়ালি হলেও তাঁর একান্ত আদরের ভাগিনেয়ী সেই আনার দেখা যে হঠাৎ সুদূর পানামার এই বিশেষ সময়টিতে পেতে পারেন, তা কাপিন সানসেদো সত্যি কেমন করে কল্পনা করবেন! গানাদোর জন্যে সমস্ত পানামায় কড়া নজর রাখার ব্যবস্থা যে আনারই কাজ তা বিশ্বাস করাও তাঁর পক্ষে সহজ নয়।

আনা তাঁকে সমস্ত বৃত্তান্ত সবিস্তারে এর পর জানিয়েছে। সব কিছু শোনবার পর স্তম্ভিত হয়েই তিনি কিছুক্ষণ কোনও কথা বলতে পারেননি। আনা তাঁকে যে অবিশ্বাস্য বিবরণ শুনিয়েছে তা ভাল করে ধারণা করতেই যেন তাঁর অনেকখানি সময় লেগেছে।

তিয়ো সানসেদোর কাছে কোনও কথাই আনা এবার গোপন করেনি। কাপিন সানসেদোর অধীন মেক্সিকো থেকে স্পেনে ফেরবার সেই জাহাজেই সমস্ত কাহিনীর সূত্রপাত! সেই জাহাজে গানাদোকে দেখে দুর্বার এক আকর্ষণ অনুভব করেছিল আনা। সব বিচার বুদ্ধি সংযম ভাসিয়ে দেবার মতো আকর্ষণ। সেনর দাস হিসাবে গানাদোর যেটুকু পরিচয় তখন সে জানে তাতে তাঁকে মূর রক্ত মেশানো কোনও খানদানি হিড্যালগোই মনে করেছিল। হৃদয়ের প্রচণ্ড ক্ষুধায় জর্জর ভাগ্য-বঞ্চিত এক যুবতী। অপদার্থ নিষ্ঠুর দায়িত্বহীন এক পাষণ্ডের সঙ্গে বিয়ে হবার পর স্বামীর সঙ্গটুকুও আনা পায়নি। আনাকে বিয়ে করেই তার স্বামী লুঠতরাজ আর অবাধ উচ্চুঙ্খল জীবনের লোভে পাড়ি দিয়েছিল মেক্সিকোতে। সেখান থেকে তার নানা কুকীর্তি ও পরে মৃত্যুর উড়ো খবর আনার কাছে পৌঁছেছিল। মামা কাপিন সানসেদোর সাহায্য নিয়ে পরম দুঃসাহসভরে আনা মেক্সিকো পর্যন্ত গিয়েছিল স্বামীর খোঁজ করতে। স্বামীর মৃত্যুর খবর পাকা জেনে কাপিন সানসেদোর জাহাজে স্পেনে ফেরার পথে ওই সাক্ষাৎ। আনা যেমন করে তোক গানাদোকে জয় করতে চেয়েছিল! ছলাকলা চাতুরী কিছুই প্রয়োগ করতে সে দ্বিধা করেনি। গানাদোর কাছে কোনও উৎসাহ পায়নি, কিন্তু তার আত্মসংযমের বর্ম শেষ পর্যন্ত ভেদ করতে পারবেই এ আত্মবিশ্বাস আনার ছিল। গানাদোর সংযমের বর্ম ভেদ করবার জন্যে সে ফন্দি যে করেছিল, তা সত্যিই চতুর।

সোরাবিয়ার সঙ্গে গানাদোর সেই স্মরণীয় জুয়া খেলার দিনই সে না জানার ভান করে কাপিন সানসেদোর ঘরে ঢুকে পড়ে গানাদোর সঙ্গে পরিচিত হয়ে আলাপ করবার সুযোগ নেয়। হাওয়া বন্ধ হয়ে তাদের পালতোলা জাহাজ তখন মাঝদরিয়ায় অচল হয়ে আছে। সবার হাতেই অঢেল সময়। সময় কাটানোই দায়। গানাদোর সঙ্গে সোরাবিয়ার জুয়া খেলার ব্যবস্থাটা সেই জন্যেই সম্ভব হয়েছিল।

তার তিয়ো অর্থাৎ মামা সানসেদোর ঘরে ঢুকে আনা কৌতুকে উজ্জ্বল মুখে একটা ষড়যন্ত্রের কথা বলেছিল সেদিন। সত্যিই ষড়যন্ত্র কিছু নয়, আসলে অচল জাহাজের জীবনের একঘেয়েমি কাটাবার জন্যে গোপন একটা নাটকীয় মজার ব্যবস্থা।

মজার ব্যবস্থাটা এই—সেদিন মাঝরাতে পাহারার ঘড়ি বাজাবার পর আধঘণ্টা ধরে জাহাজের কাবালিয়েরো মানে ভদ্রবংশের সবাইকে বেমালুম লুকিয়ে থাকবার চেষ্টা করতে হবে। আধঘণ্টা পর্যন্ত ধরা না পড়ে লুকিয়ে থাকতে পারাটাই হবে পরম বাহাদুরি। কাপিন সানসেদো আর আনা হবে সমস্ত ব্যাপারটার দর্শক। ও বিচারক। আর খোঁজাখুঁজি করবে মাঝিমাল্লারা। ধরা পড়লে কাবালিয়েরোদের গুনোগার দিতে হবে আর সেই গুনোগার যে খুঁজে পেয়েছে সে পাবে বকশিশ হিসেবে।

ব্যাপারটাকে ষড়যন্ত্র বলার একটা জুতসই কৈফিয়তও দিয়েছিল আনা। কোনও কাজকর্ম না থাকায় সমুদ্রে যেন শিকড় গেঁথে জমে যাওয়া জাহাজে মাঝিমাল্লারা ক্রমশ ধৈর্য হারিয়ে অস্থির হয়ে পড়ছে। জুয়াতেও তাদের. আর মন ভরছে না। এরকম অবস্থায় আর এক-আধ দিন কাটাতে হলে হয়তো মাথায় কোনও কুবুদ্ধির পোকা ঢুকে তারা বেয়াড়া হয়ে উঠতে পারে। তাদের চাগিয়ে তোলবার জন্যে তাই এই ধরনের একটু মজার উত্তেজনা হয়তো দরকার।

গানাদো নীরবেই আনার কথা শুনেছিলেন। মতামত কিছু দেননি।

কাপিন সানসেদোর কিন্তু আনার যুক্তিটা মনে ধরেছিল। তিনি মজার ব্যাপারটায় সায় দিয়েছিলেন। সত্যিই ব্যাপারটা যে এক রকমের ষড়যন্ত্র আর তাতে আনার আসল উদ্দেশ্য যে ভিন্ন, তা স্নেহান্ধ কাপিন সানসেদো আর কেমন করে জানবেন!

আনার আসল উদ্দেশ্য যে কী তা গানাদো সেই রাত্রেই বুঝতে পেরেছিলেন। তার আগে জাহাজের ওপর বেশ নাটকীয় উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে সত্যিই। তখনকার দিনে বাঁদর খেলাবার ড়ুগড়ুগির আকারের বালি রাখা কাঁচের পাত্র দিয়ে সময়ের মাপ হত। মাঝখানের সরু ফুটো দিয়ে ঘড়ি-গেলাসের একদিকের বালি সব আর-একদিকে গিয়ে ঝরে পড়তে সময় লাগত আধঘণ্টা। আধ ঘণ্টা অন্তর ঘড়ি বাজিয়ে সময় জানানো হত তাই।

সেদিন মাঝরাতে প্রহর জানানো ঘণ্টা বাজবার পর জাহাজের ওপরে একটা হুল্লোড় শুরু হয়ে গিয়েছিল। মাঝিমাল্লারা কাপিনের অনুমতি আর প্রশ্রয় পেয়ে সমস্ত জাহাজ তোলপাড় করে তুলেছিল কাবালিয়েরোদের খোঁজে।

গানাদো বাদে পুরুষ কাবালিয়েরো তো মাত্র চারজন। সালাজার, কিনেরো মায় সোরাবিয়াকে নিয়ে একে একে ধরা পড়েছিল সবাই। শুধু সেনর দাস নামে পরিচিত গানাদোরই খোঁজ পাওয়া যায়নি।

তন্নতন্ন করে জাহাজের সব জায়গা খুঁজে দেখা হয়েছে। সোরাবিয়া ও সালাজারের মতো কাবালিয়েরোদের মধ্যে যারা ধরা পড়েছিল তারাও গানাদোর তল্লাশে মাঝিমাল্লাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে! জাহাজের ওপর একটা ইঁদুর লুকোবার জায়গাও বুঝি তারা না দেখে ছাড়েনি।

জাহাজ বলতে এখনকার বিশ-পঁচিশ হাজার টনের সমুদ্রে ভাসানো শহর তো নয়। ওজনে সত্তর-আশি টন আর লম্বায় বড়জোর হাত ষাটেক পালতোলা জাহাজ আজ যা আমাদের কাছে সামান্য সুলুপ মাত্র।

এ জাহাজ থেকে মানুষটা অমন অদৃশ্য হল কী করে?

কাপিন সানসেদো পর্যন্ত একটু চিন্তিত হয়ে উঠেছেন। উদ্বেগ যদি কিছু হয়ে থাকে আনার মুখে অন্তত তা ফুটে ওঠেনি।

ঘড়ি-গেলাসের বালি আবার সব নীচের খোপে ঝরে পড়েছে। মাঝরাতের পর ঘড়ি বাজানো হয়েছে আর আধঘণ্টা কেটে যাবার।

হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠেছে জাহাজের মাঝিমাল্লা সবাই।

নিস্পন্দ জাহাজ কি এবার তাহলে নড়বে? আকাশের স্তব্ধ হাওয়া কি আবার বইতে শুরু করেছে? নইলে জাহাজের পাল হঠাৎ দুলে উঠবে কেন?

সকলে উৎসুক আগ্রহে ওপরে তাকিয়ে দেখেছে। কৃষ্ণপক্ষের বিলম্বিত ভাঙা চাঁদের আলোয় ভুতুড়ে ওড়নার মতো জাহাজের ঝোলা পালগুলো অস্পষ্টভাবে তখন দেখা যাচ্ছে। তার মধ্যে হঠাৎ একটা ছোট পাল অমন দুলে উঠেছে কেন? ওটা তো যাকে বলে ফোর-টপ-সেল। শুধু ওই পালটিই দুলে ওঠবার কারণ কী?

রহস্যটা পরিষ্কার হয়ে গেছে পরের মুহূর্তে। ফোর-টপ-সেল-এর দড়ি বেয়ে একটা ভুতুড়ে ছায়াকেই যেন নামতে দেখা গেছে। ডেকের ওপর এসে দাঁড়াবার পর চেনা গেছে যে, সে সেনর দাস ছাড়া আর কেউ নয়। ব্যবহারের গুণে আর জুয়ায় অসামান্য বাহাদুরির দরুন গানাদো আগে থেকেই মাঝিমাল্লাদের প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন, এখন তাঁর এই নতুন কৃতিত্বে খুশি হয়ে সবাই তাঁকে ঘিরে ধরেছে। অমন একটা লুকোবার জায়গা তিনি যে বেছে নিয়েছেন এইটেই তাঁর বাহাদুরি।

চারিদিকে ভিড় করে গানাদোর তারিফ যারা করেছে তাদের মধ্যে জাহাজের দু-তিন জনকে শুধু দেখা যায়নি। পুরুষদের মধ্যে দেখা যায়নি সোরাবিয়া আর ফ্রানসিসকান পাদরিবাবাকে, আর লুকোচুরির এ নাটকীয় খেলা যার মাথা থেকে বার হয়েছে, সেই আনাই সেখানে অনুপস্থিত।

এমন সময় কোথায় গেল আনা? সারাদিনের উৎসাহ-উত্তেজনায় হয়তো অতিরিক্ত ক্লান্ত হয়েই আনা আর অপেক্ষা করতে না পেরে তার কামরায় ঘুমোতে গেছে মনে করে কাপিতান তার খোঁজ আর করেননি। করলে রীতিমত স্তম্ভিত হতেন। জাহাজে কামরা বলতে মাত্র আড়াইটি বলা যায়। একটিতে সরকারি কাগজপত্র আর মেক্সিকো থেকে সম্রাটের জন্য পাঠানো সোনা-দানার সম্পদ নিয়ে কাপিন সানসেদো থাকেন, আর একটিতে প্রৌঢ়া পরিচারিকাকে নিয়ে সেনোরা আনা। স্বয়ং কর্টেজ যাকে নিরাপদে পৌঁছে দেবার জন্যে চিঠি দিয়েছেন সেই সেনর দাসের জন্যে কাপিন সানসেদো যে জায়গার ব্যবস্থাটুকু করতে পেরেছেন তাকে। সেকালের হিসেবেও কামরা বলা যায় না। প্রায় কুঁজো হয়ে ঢুকে কোনওরকমে একটু গড়াবার সেটা একটা গুহা-গোছের খুপরি মাত্র।

কাপিন সানসেদো তাঁর আদরের সোব্রিনার খোঁজ করলে তাকে তার নিজের কামরায় পেতেন না, সেই রাত্রে নিজের গুহার মতো খুপরি কামরায় ঢুকে কেন যে গানাদো হঠাৎ চমকে নিস্পন্দ হয়ে গিয়েছিলেন তা-ও পারতেন না কল্পনা করতে।

সেই রাত্রে ওই সংকীর্ণ কামরার মধ্যে কী? ঘটেছিল আনা সেইটুকুই শুধু পানামার বাজারের রাস্তায় কাপিন সানচেদোকে সবিস্তারে বলতে পারেনি। এইটুকু শুধু বুঝতে দিয়েছে যে, গানাদোর কাছে তার পক্ষে কল্পনাতীত কঠিন প্রত্যাখ্যান পেয়ে দলিতা ফণিনীর চেয়ে সে হিংস্র হয়ে উঠেছে তারপর। তার দেহ-মনের এ দুঃসহ বহ্নি-জ্বালার কুমন্ত্রণায় ইন্ধন জুগিয়েছে সোরাবিয়া। সাধারণ অবস্থায় যাকে ঘৃণার চোখেই দেখত সেই সোরাবিয়ার সঙ্গেই সে হাত মিলিয়েছে গানাদোর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবার জন্যে।

দু-এক দিনের মধ্যেই ঝড় তুফান হয়ে আবার তাদের জাহাজ সচল হয়েছে। স্পেনের বন্দরে পৌঁছোবার আগেই কিন্তু গানাদোর চরম সর্বনাশ হয়ে গেছে আনা। আর সোরাবিয়ার মিলিত শয়তানিতে। গানাদো কর্টেজের স্বাক্ষরিত তাঁর দাসত্ব থেকে মুক্তির সনদ খুঁজে পাননি। কাপিন সানসেদো খুঁজে পাননি তাঁর কাছে সেনর দাস সম্বন্ধে লেখা কর্টেজের চিঠি।

সেভিল বন্দরে পৌঁছোবার জন্যে স্পেনের দক্ষিণের গুয়াদালকুইভির-এর নদীমুখে পৌঁছোবার আগেই সোরাবিয়া তার শয়তানির মোক্ষম চাল চলেছে। গানাদো সম্ভ্রান্ত কাবালিয়েরোর ছদ্মবেশে পলাতক একজন ক্রীতদাস বলে ঘোষণা করে অবিলম্বে তাকে বন্দি করা হোক বলে দাবি করেছে কাপিন সানসেদোর কাছে। হাতে অকাট্য প্রমাণ যা ছিল তা রহস্যজনকভাবে খোয়া গেছে, তবু কাপিন সানসেদো বৃথাই গানাদোর হয়ে এ মিথ্যা অভিযোগ খণ্ডন করবার চেষ্টা করেছেন। কোনও উপায় আর নেই জেনে সেভিল-এ জাহাজ লাগবার আগেই রাতের অন্ধকারে গুয়াদালকুইভির-এর জলে নিঃশব্দে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছেন গানাদো।

অপমানের জ্বালায় উন্মত্ত হয়ে গিয়েছিল আনা। একটু প্রকৃতিস্থ হবার পর নিজের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করবার জন্যে কী নিদারুণ মূল্য তাকে দিতে হয়েছে বুঝতে পেরে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছে বিহ্বল-বেদনায়। তার নীচ পৈশাচিক চক্রান্তের মন্ত্রী ও সহায় সোরাবিয়ার সঙ্গে যে সে তখন বিবাহের বাঁধনে বাঁধা।

গানাদোর দাসত্ব থেকে মুক্তির সনদই শুধু চুরি করেনি সোরাবিয়া, স্পেনের দরবারে তার সম্বন্ধে লেখা কর্টেজ-এর উচ্ছ্বসিত চিঠিটিও হাত করেছে সেই সঙ্গে। সেই চিঠির ওপর একটু জালিয়াতির বিদ্যে খাটিয়ে তাই দিয়ে অসাধ্য সাধন করাও সম্ভব হয়েছে সোরাবিয়ার পক্ষে। সুদূর সাগরপারে টেনচটিক্লন বিজয়ে কর্টেজকে কল্পনাতীত সাহায্য করার স্বীকৃতি হিসেবে সামান্য সোরাবিয়া এক মুহূর্তে হয়ে গেছে। মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস।

নিজের অপরাধের গ্লানিতে অনুশোচনায় তখন দগ্ধ হচ্ছে আনা। সোরাবিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্কটা দাঁড়িয়েছে চরম ঘৃণা ও বিদ্বেষের। যে অন্যায় সে করেছে তার প্রতিকার করবার জন্যে আনা তখন ব্যাকুল। সেই জন্যেই কাপিন সানসেদোকে সে আকুলভাবে খুঁজেছে। চেয়েছে গানাদোর কাছে অকপটে নিজের সব কথা জানাতে।

নিষ্ঠুর কৌতুকে তার ভাগ্য আশা দিয়েও সে সুযোগ ছিনিয়ে নিয়েছে। শেষ পর্যন্ত আনা মরিয়া হয়ে টোলেডোর রাজদরবারেই গিয়ে উপস্থিত হয়েছে সব অপরাধ স্বীকার করে সোরাবিয়ার অবিশ্বাস্য জালিয়াতি প্রকাশ করে দেবার সংকল্প নিয়ে। সেখানেই মেক্সিকো বিজয়ী কর্টেজ-এর সঙ্গে তার দেখা। কর্টেজ নিজে তখন কর্ডোভায় এক প্রতারকের যথার্থ পরিচয় হঠাৎ স্মরণ করতে পেরে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে টোলেডোতে এসেছেন সে পাষণ্ডের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে।

রাজদরবারে আনার অপরাধী হিসেবে আত্মসমর্পণের দরকার হয়নি। মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস রূপী সোরাবিয়ার জালিয়াতি ধরিয়ে দিয়ে কর্টেজ তার বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করিয়েছেন আর সেই সঙ্গে গানাদোর দাসত্ব থেকে মুক্তির সনদ নতুন করে রাজ-দপ্তর থেকে বার করিয়ে আনার হাতেই দিয়েছেন গানাদোর কাছে পৌঁছে দেবার জন্যে।

সেই সনদ নিয়ে আনা একাই পানামায় এসেছে পরম দুঃসাহসে। একদিন যেখানে গানাদোর দেখা পেয়েছিল আবার সেখানে হয়তো পেতে পারে এই তার আশা। সে আশা এ পর্যন্ত সফল হয়নি। তবু ধৈর্য ধরে ভেতরের কী যেন এক দুর্বোধ আশ্বাসে আনা পানামাতেই অপেক্ষা করেছে এতদিন।

অন্তরের আশ্বাস যে তার মিথ্যা নয়, কাপিন সানসেদোর সঙ্গে অপ্রত্যাশিত এই সাক্ষাতেই তার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

সমস্ত সমস্যা মিটে গিয়ে সব মুশকিল এবার আসান হবে ধরে নেওয়া উচিত। আনার কাছে গানাদোর দাসত্বমোচনের ফারমান। তার জোরে গানাদো নির্ভয়ে কয়াকে নিয়ে পানামা যোজকের মাঝখানের পর্বতপ্রাচীর ডিঙিয়ে আতলান্তিকের উপকূলের প্রথম-বন্দর নোমব্রে দে দিয়স থেকে ইউরোপের দিকে যখন খুশি পাড়ি দিতে পারবেন।

কিন্তু তা সম্ভব হয় কই? আশাতীত সৌভাগ্যরূপে যা দেখা দেয়, নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে তাই চরম দুর্ভাগ্য হয়ে দাঁড়ায় দু-দণ্ড না যেতে যেতে। তা না হলে বুক ফুলিয়ে নির্ভয়ে প্রকাশ্যে যাঁর রওনা হবার কথা সেই গানাদোকে সে রাত্রেই চোরের মতো কয়াকে নিয়ে পানামা ছাড়বার চেষ্টা করতে হয় কেন!