৩২৮তম অধ্যায়
শুকের সংসারত্যাগ—হিমালয়ে গমন
ভীষ্ম কহিলেন, “হে ধৰ্ম্মরাজ! রাজর্ষি জনক এই কথা কহিলে, মহাত্মা শুকদেব আত্মসাক্ষাৎকারলাভে কৃতকার্য্য হইয়া হিমালয় পর্ব্বত লক্ষ্য করিয়া বায়ুবেগে উত্তরাভিমুখে প্রস্থান করিলেন। ঐ সময় দেবর্ষি নারদও ঐ পর্ব্বত সন্দর্শন করিতে গিয়াছিলেন। ঐ পর্ব্বত অপ্সরা, সিদ্ধ, চারণ ও কিন্নরগণের আবাসভূমি এবং ভ্রমর, পানিকপোত [পানকাক—গাঙচিল], খঞ্জন [ঘুঘু], জীবজীবক [চকোর পক্ষী], বিচিত্রবর্ণ ময়ূর, রাজহংস ও কোকিলগণের কলরবে পরিপূর্ণ। বিহগরাজ গরুড় প্রতিনিয়ত উহাতে বাস করিয়া থাকেন। ইন্দ্রাদি দিকপাল-চতুষ্টয়। জগতের হিতসাধনার্থ দেবতা ও ঋষিগণের সহিত সৰ্ব্বদা উহাতে আগমন করেন। পূৰ্ব্বে ভগবান্ বিষ্ণু পুত্রকামনায় ঐ স্থানে ঘোরতর তপানুষ্ঠান করিয়াছিলেন। ঐ পৰ্ব্বতে মহাবীর কাৰ্ত্তিকেয় ত্রিলোক তৃণতুল্য বোধ করিয়া এই বলিয়া ভূতলে শক্তি নিক্ষেপ করিয়াছিলেন যে, যদি এই ত্রিলোকমধ্যে কেহ আমা অপেক্ষা সমধিক বলবান্, ব্রাহ্মণপ্রিয় ও ব্রহ্মনিষ্ঠ থাকেন, তাহা হইলে তিনি এই মন্নিক্ষিপ্ত[আমার নিক্ষিপ্ত]শক্তি উদ্ধৃত বা কম্পিত করুন।
“কুমার এই বলিয়া শক্তি নিক্ষেপ করিলে ত্রিলোকমধ্যে সকলেই ঐ শক্তি উদ্ধারের চিন্তায় মহাব্যাকুল হইয়া উঠিল। তখন ভগবান্ নারায়ণ দেব, অসুর ও রাক্ষস প্রভৃতি সমুদয়কে সংক্ষুব্ধ সন্দর্শন করিয়া কৰ্ত্তব্য-বিষয় বিবেচনা করিতে লাগিলেন এবং পরিশেষে কার্ত্তিকেয়ের অহঙ্কার সহ্য করিতে না পারিয়া বামহস্তে সেই প্রজ্বলিতশক্তি ধারণপূর্ব্বক বিকশিত করিতে আরম্ভ করিলেন। শক্তি বিকম্পিত হইবামাত্র পর্ব্বতবন-সমাকীর্ণ সমুদয় পৃথিবী কম্পিত হইয়া উঠিল। ভগবান বিষ্ণু ঐ শক্তি সমুদ্ধত করিতে সমর্থ ছিলেন; কিন্তু ঐ সময় কার্ত্তিকেয়ের গৌরবরক্ষার্থ উহা উদ্ধৃত না করিয়া কেবল কম্পিত করিয়াছিলেন। অনন্তর তিনি প্রহ্লাদকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “দৈত্যরাজ! কার্ত্তিকেয়ের পরাক্রম অবলোকন কর। এই শক্তি উদ্ধার করা কাহারও সাধ্যায়ত্ত নহে।” ভগবান নারায়ণ এই কথা কহিলে, প্রহ্লাদ তাঁহার তাদৃশ বাক্য সহ্য করিতে না পারিয়া ঐ শক্তি উদ্ধার করিতে কৃতনিশ্চয় হইয়া গ্রহণ করিয়াছিলেন; কিন্তু কোনক্রমেই উহা কম্পিত করিতে পারেন নাই; প্রত্যুত ভীষণস্বরে চীৎকার করিতে করিতে তথায় মুচ্ছ্রিত হইয়া পড়িয়াছিলেন।
“ভগবান্ বৃষভধ্বজ ঐ পৰ্ব্বতের উত্তর দিকে আশ্রম নির্ম্মাণপূৰ্ব্বক বহু কাল তপস্যা করিয়াছিলেন। তাঁহার আশ্রমস্থান অদ্যাপি প্রজ্বলিত হুতাশনে পরিবেষ্টিত ও আদিতপর্ব্বত নামে বিখ্যাত রহিয়াছে। তথায় পাপাত্মা মনুষ্যদিগের গমন করা দূরে থাকুক, যক্ষ, রাক্ষস ও দানবগণও সে স্থলে গমন করিতে সমর্থ নহে। ঐ আশ্রম দশ যোজন বিস্তীর্ণ ও অগ্নিস্ফুলিঙ্গে সমাবৃত। ভগবান্ হুতাশন মহাদেবের বিঘ্নবিনাশার্থ মূর্ত্তিমান হইয়া স্বয়ং তথায় অবস্থান করেন। ভগবান্ ভূপতিত ঐ স্থানে নিয়ম অবলম্বনপূর্ব্বক সহস্র বৎসর একপদে দণ্ডায়মান থাকিয়া তপঃপ্রভাবে দেবগণকে নিতান্ত সন্তপ্ত করিয়াছিলেন।
মিথিলা প্রত্যাবৃত্ত শুকের পিতার সহিত সাক্ষাৎকার
“পরাশর পুত্র মহাতপস্বী বেদব্যাস সেই পৰ্ব্বতপ্রধান হিমালয়ের পূর্ব্বদিকে এক নির্জ্জন স্থানে অবস্থানপূৰ্ব্বক সুমন্তু, বৈশম্পায়ন, জৈমিনি ও পৈলকে অধ্যয়ন করাইতেছিলেন। দিবাকরের ন্যায় তেজঃপুঞ্জকলেবর মহাত্মা শুকদেব আকাশমার্গ হইতেই তাঁহার সেই রমণীয় আশ্রম অবলোকন করিয়া তথায় গমন করিলেন। মহর্ষি বেদব্যাস প্রজ্বলিত হুতাশনের ন্যায়, শাসন-নির্ম্মুক্ত শরষষ্টির ন্যায়, অন্যের সুদুঃসহ যোগযুক্ত পুত্রকে সমাগত সন্দর্শন করিয়া যারপরনাই আহ্লাদিত হইলেন। তখন ধর্ম্মাত্মা শুকদেব প্রথমে পিতার নিকট গমনপূৰ্ব্বক তাঁহার চরণবন্দনা এবং পরিশেষে মহা আহ্লাদে সতীর্থদিগকে আলিঙ্গন করিয়া পিতার নিকট জনকরাজের বৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত নিবেদন করিলেন।
“শুকদেব আগমন করিলে পর, মহর্ষি বেদব্যাস শিষ্যদিগের সহিত তাঁহাকে বেদাধ্যয়ন করাইয়া সেই হিমালয়-পৰ্ব্বতেই কালযাপন করিতে লাগিলেন। ক্রমে শিষ্যগণের সাঙ্গবেদাধ্যয়ন সমাপন হইল। বেদাধ্যয়ন সমাপ্ত হইলে একদা শিষ্যগণ দ্বৈপায়নের চতুর্দ্দিকে অবস্থানপূর্ব্বক কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘গুরো! আপনার প্রসাদে আমাদিগের যথেষ্ট তেজঃ ও যশোলাভ হইয়াছে। এক্ষণে আপনার নিকট আমাদের আর একমাত্র প্রার্থনা আছে, আপনি অনুগ্রহ করিয়া উহা পূর্ণ করুন। তখন মহর্ষি কহিলেন, বৎসগণ! এক্ষণে আমাকে তোমাদিগের কি হিতসাধন করিতে হইবে, তাহা অচিরাৎ প্রকাশ কর। মহাত্মা দ্বৈপায়ন এই কথা কহিলে শিষ্যগণ যারপরনাই আহ্লাদিত হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁহাকে প্রণাম করিয়া কহিলেন, ‘ভগবন্! আপনি প্রীত হওয়াতেই আমরা কৃতার্থ হইয়াছি। এক্ষণে আমাদিগের এই বর-প্রার্থনা যে, আপনার কোন শিষ্য যেন আমাদিগের তুল্য খ্যাতিলাভ করিতে না পারে। আমরা চারি জন এবং গুরুপুত্র আপনার এই পাঁচ শিষ্য ভিন্ন ইহলোকে যেন আর কেহ বেদপ্রতিষ্ঠাতা না হয়।’
শুকাদি শিষ্যগণের প্রতি ব্যাসের বেদপ্রচারাজ্ঞা
শিষ্যগণ এইরূপ প্রার্থনা করিলে মহর্ষি বেদব্যাস তাঁহাদিগের বাক্যে সম্মত হইয়া তাঁহাদিগকে কহিলেন, ‘বৎসগণ! ব্রাহ্মণ, বেদশুশ্রূষু এবং ব্রহ্মলোকগমনে একান্ত যত্নশীল ব্যক্তিকে বেদোপদেশ প্রদান করা অবশ্য কর্ত্তব্য; অতএব তোমরা প্রযত্নসহকারে উত্তমরূপে বেদবিস্তার কর। শিষ্য, ব্রতপরায়ণ ও পুণ্যাত্মা ব্যক্তি ভিন্ন আর কাহাকেও বেদোপদেশ প্রদান করা কর্ত্তব্য নহে; শিষ্যের চরিত্র পরীক্ষা না করিয়া বিদ্যা দান করা নিতান্ত অনুচিত। অগ্নিতে দাহন [আগুনে পোড়ান] শিলাঘর্ষণ [রাসায়নিক প্রস্তর দ্বারা মার্জ্জন] ও ছেদন [কৰ্ত্তন]
দ্বারা যেমন বিশুদ্ধ সুবর্ণের পরীক্ষা করিতে হয়, তদ্রূপ কুল ও গুণাদির সবিশেষ পর্য্যালোচনা দ্বারা শিষ্যকে পরীক্ষা করা উচিত। তোমরা কখন শিষ্যকে অনুচিত বা ভয়াবহ কাৰ্য্যে নিয়োগ করিও না। তোমাদিগের স্ব স্ব বুদ্ধি, বিদ্যা ও অধ্যয়ন সফল হইবে। তোমরা সকলেই অতি দুর্গম স্থান হইতে সমুত্তীর্ণ হও এবং তোমাদিগের মঙ্গললাভ হউক। ব্রাহ্মণকে অগ্রবর্ত্তী করিয়া চারি বর্ণকেই বেদ শ্রবণ করাইতে পারা যায়। বেদাধ্যয়ন করাই সর্ব্বাপেক্ষা প্রধান কার্য্য। দেবগণকে স্তব করিবার নিমিত্ত ভগবান্ প্রজাপতি বেদের সৃষ্টি করিয়াছেন। যে ব্যক্তি
মোহবশতঃ বেদপারদর্শী ব্রাহ্মণকে নিন্দা করে, তাহাকে সেই নিন্দানিবন্ধন নিশ্চয়ই পরাভূত হইতে হয়। যে ব্যক্তি ধৰ্ম্মানুসারে প্রশ্ন এবং যে ব্যক্তি ধর্ম্মানুসারে তাহার প্রত্যুত্তর প্রদান না করে, তাহারা উভয়েই অধর্ম্মভাগী ও নিন্দনীয় হইয়া থাকে। এই আমি তোমাদিগের নিকট বেদাধ্যাপনাবিধি কীৰ্ত্তন করিলাম। এক্ষণে তোমরা ইহা বিস্মৃত না হইয়া শিষ্যদিগের হিতানুষ্ঠানে নিরত হও।’