৩২৬তম অধ্যায়
পিতার আদেশে শুকের জনক-সমীপে গমন
ভীষ্ম কহিলেন, “হে ধৰ্ম্মরাজ! এইরূপে মহাত্মা শুকদেবের অন্তঃকরণে মোক্ষাভিলাষ বদ্ধমূল হইলে, তিনি তদ্বিষয় চিন্তা করিতে করিতে স্বীয় পিতার নিকট গমনপূর্ব্বক তাঁহাকে অভিবাদন করিয়া বিনীতভাবে কহিলেন, “পিতঃ! আপনি মোক্ষধৰ্ম্মকুশল; অতএব যাহাতে আমার চিত্ত প্রশান্ত হয়, আপনি তদ্বিষয়ক উপদেশ প্রদান করেন।
“শুকদেব এই কথা কহিলে মহর্ষি বেদব্যাস তাঁহার বাক্যশ্রবণে পরম পরিতুষ্ট হইয়া তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘বৎস! তুমি মোক্ষ ও অন্যান্য ধর্ম্মসমুদয় অধ্যয়ন কর।’ তখন ধর্ম্মাত্মা শুকদেব পিতার আজ্ঞানুসারে তাঁহার নিকট নিখিল যোগশাস্ত্র ও কপিল-মত অধ্যয়ন করিলেন। কিয়দ্দিন পরে বেদব্যাস পুত্রকে মোক্ষধৰ্ম্মবিশারদ ও ব্রহ্মতুল্য প্রভাবশালী দেখিয়া কহিলেন, ‘বৎস! তুমি মিথিলাধিপতি জনকের নিকট গমন কর। তিনি তোমাকে মোক্ষশাস্ত্রের উপদেশ প্রদান করিবেন। তুমি গমনকালে স্বীয় প্রভাববলে অন্তরীক্ষপথ অবলম্বন না করিয়া সামান্য মনুষ্যের ন্যায় অতি বিনীতভাবে তথায় গমন করিবে। পথিমধ্যে কিছুমাত্র সুখ বা স্বসম্পর্কীয় লোকের অন্বেষণ করিও না। তাহা করিলে তোমাকে সঙ্গপাশে বদ্ধ হইতে হইবে। মিথিলাধিপতি আমাদের যজমান মনে করিয়া তাঁহার নিকট কিছুমাত্র অহঙ্কার প্রকাশ করিও না; সর্ব্বদাই তাঁহার বশবর্ত্তী হইয়া অবস্থান করিবে; তাহা হইলেই তিনি তোমার সমুদয় সংশয় ছেদন করিয়া দিবেন। তিনি ধর্ম্মপরায়ণ, মোক্ষশাস্ত্রবিশারদ ও আমার যজমান। তিনি যাহা আজ্ঞা করিবেন, তুমি অসন্দিগ্ধচিত্তে তাহারই অনুষ্ঠান করিবে।
“মহাত্মা বেদব্যাস এইরূপ উপদেশ প্রদান করিলে ধর্ম্মাত্মা শুকদেব মিথিলানগরে যাত্রা করিলেন। ঐ মহাত্মা অন্তরীক্ষপথে সসাগরা পৃথিবী অতিক্রম করিতে সমর্থ ছিলেন; কিন্তু পিতৃআজ্ঞা নিবন্ধন আকাশমার্গ অবলম্বন না করিয়া ভূতলে পাদচারে গমন করিতে লাগিলেন এবং ক্রমে ক্রমে পর্ব্বত, নদী, তীর্থ, সরোবর, বিবিধ শ্বাপদাকীর্ণ অটবী, ইলাবৃতবর্ষ, হরিবর্ষ ও কিম্পূরুষবর্ষ [স্বনামখ্যাত প্রদেশ] অতিক্রমপূৰ্ব্বক ভারতবর্ষে উপস্থিত হইয়া চীন ও হূণ-সেবিত বিবিধ জনপদ সন্দর্শন করিতে করিতে, আর্য্যবর্ত্তে আগমন করিলেন। তিনি ক্রমশঃ যত পথ অতিক্রম করিতে লাগিলেন, ততই রমণীয় পত্তন, সমৃদ্ধিশালী নগর, বিচিত্র বসন, সুবিস্তীর্ণ অতি মনোহর উদ্যান ও উৎকৃষ্ট উৎকৃষ্ট রত্নসমুদয় তাঁহার দৃষ্টিপথে পতিত হইতে লাগিল; কিন্তু কিছুতেই তাহার চিত্ত সমাকৃষ্ট হইল না। পরিশেষে তিনি অতি সত্বর ধর্ম্মাত্মা জনকের রক্ষিত বিদেহরাজ্যে সমুপস্থিত হইলেন। ঐ রাজ্য বহুতর গ্রামে বিভূষিত। সকল গ্রাম নানাবিধ অন্ন, পানীয় ও ভোজনদ্রব্যে পরিব্যাপ্ত, গোকুলসম্পন্ন সমৃদ্ধিশালী ঘোষপল্লী-সুশোভিত, রাশি রাশি ধান্য ও গোধূমে সঙ্কীর্ণ, হংস ও সারস প্রভৃতি বিবিধ জলচর পক্ষীতে সমাকীর্ণ এবং রূপলাবণ্যসম্পন্ন অসংখ্য পদ্মিনী কামিনীজনে পরিপূর্ণ।
“মহাত্মা শুকদেব সেই সমৃদ্ধজনসেবিত বিদেহরাজ্যে প্রবেশ করিয়া ক্রমে ক্রমে মিথিলার অতি রমণীয় উপবনে সমুপস্থিত হইলেন। ঐ উপবনে অসংখ্য হস্তী, অশ্ব, রথ ও বিবিধ স্ত্রী-পুরুষ দর্শন করিয়া তাঁহার কিছুমাত্র চিত্তবিকার জন্মিল না। পরিশেষে তিনি সেই তপোবন অতিক্রম করিয়া মোক্ষবিষয় চিন্তা করিতে করিতে মিথিলানগরে সমুপস্থিত হইয়া নির্ভীকচিত্তে উহার প্রথম কক্ষায় প্রবিষ্ট হইলেন। প্রবেশ করিবামাত্র দ্বারপালগণ অতি কঠোর বাক্যে তাঁহাকে নিবারণ করিল। তিনি তাহাদিগের বাক্যে কিছুমাত্র ব্যথিত না হইয়া স্বচ্ছন্দে সেই আতপতাপিত [রৌদ্রতপ্ত] প্রদেশে অবস্থান করিতে লাগিলেন। ঐ সময়, ক্ষুধা, পিপাসা, রৌদ্র ও পথশ্রম জন্য তাঁহার কিছুমাত্র ক্লেশ হইল না। অনন্তর ঐ দ্বারপালদিগের মধ্যে এক ব্যক্তি মহাত্মা শুকদেবকে মধ্যাহ্নকালীন সূর্য্যের ন্যায় অবস্থান করিতে দেখিয়া, কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁহার যথাসাধ্য পূজা করিয়া দ্বিতীয় কক্ষায় প্রবেশ করাইল। তিনি তথায় উপবিষ্ট হইয়া মোক্ষবিষয়ে অনুধ্যান করিতে লাগিলেন। কি সুশীতল ছায়া, কি প্রচণ্ড রৌদ্র উভয়েই তাঁহার সমান জ্ঞান ছিল।
শুকের সংযমপরীক্ষায় নারীনিয়োগ
“মহাত্মা শুকদেব এইরূপে দ্বিতীয় কক্ষায় প্রবিষ্ট ও সমাসীন হইলে মুহূর্ত্তকালমধ্যে রাজমন্ত্রী কৃতাঞ্জলিপুর্টে তথায় সমাগত হইয়া তাঁহাকে সমভিব্যাহারে লইয়া তৃতীয় কক্ষায় কেলিসরোবর [জলক্রীড়া করিবার উপযোগী জলাশয়] সম্পন্ন, পুষ্পিতপাদপসমাকীর্ণ [পুষ্পযুক্ত বৃক্ষসমূহে শোভিত], অমরাবতী-সদৃশ [স্বর্গপুরীতুল্য] অতিরমণীয় প্রমদাবনে [প্রমোদবনে] প্রবেশ করিলেন এবং অবিলম্বে তাঁহাকে আসন প্রদান করিতে আদেশ করিয়া তথা হইতে বহির্গত হইলেন। মন্ত্রির প্রস্থান করিলে নিবিড়-নিতম্বিনী [স্থূল নিতম্বযুক্ত], সূক্ষ্মরক্তাম্বরধারিণী [লালরঙের মিহি কাপড়পরা], তরুণবয়স্কা পঞ্চাশৎ বারবিলাসিনী [পঞ্চাশজন বেশ্যা] তথায় আগমনপূৰ্ব্বক, ভক্তিসহকারে শুকদেবকে পাদ্যাদি প্রদান করিয়া অনতিবিলম্বে সুস্বাদু অন্ন প্রদান করিল। ঐ বারবিলাসিনীরা সকলেই প্রিয়দর্শন, উজ্জ্বলসুবর্ণালঙ্কারভূষিত, আলাপকুশল, নৃত্যগীতে সুনিপুণ, হৃদয়জ্ঞ ও কামোপযোগী ব্যবহারে দক্ষ; সকলেই ঈযৎ-হাস্যবদনে কথা কহিয়া থাকে। অনন্তর ধর্ম্মাত্মা শুকদেবের আহার সমাপ্ত হইলে ঐ সকল বারবিলাসিনী তাঁহাকে সমভিব্যাহারে লইয়া হাস্য, গীত ও নানাবিধ ক্রীড়া করিতে করিতে ক্রমে ক্রমে সেই প্রমদাবনের সমুদয় শোভ প্রদর্শন করাইতে লাগিল; কিন্তু জিতেন্দ্রিয়, ক্রোধবিজয়ী, বিশুদ্ধাত্মা দ্বৈপায়নতনয় কিছুতেই হৃষ্ট বা বিরক্ত হইলেন না।
“অনন্তর সন্ধ্যাকাল সমুপস্থিত হইলে বারবনিতাগণ শুকদেবকে মহামূল্য আস্তরণ-সমাস্তীর্ণ, রত্নজালভূষিত দিব্য শয়নীয় ও আসুন প্রদান করিল। তখন ধর্ম্মাত্মা শুকদেব পাদপ্রক্ষালনপূর্ব্বক ধ্যাননিরত হইয়া পূৰ্ব্বরাত্রি অতিবাহিত করিলেন। পরে মধ্যরাত্রে নিদ্রাসুখ অনুভব করিয়া শেষরাত্রে গাত্রোত্থানপুৰ্ব্বক শৌচক্রিয়া সমাধান করিয়া পুনরায় ধ্যানে নিমগ্ন হইলেন। তাঁহার ধ্যানসময়েও বারবনিতাগণ তাঁহার চতুর্দ্দিক পরিবেষ্টন করিয়াছিল; কিন্তু কোনক্রমেই তাঁহার মন বিচলিত করিতে পারে নাই।
“হে ধৰ্ম্মরাজ! মহাত্মা শুকদেব এইরূপে জনকরাজভবনে এক দিবারাত্রি অতিবাহিত করিলেন।”