৩২৩তম অধ্যায়
কৰ্ম্মানুরূপ ফলভোগ
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! দান, যজ্ঞ, তপস্যা ও গুরুশুশ্রুষা করিলে কিরূপ ফললাভ হয়, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”
ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! যাহারা অনর্থকারিণী বুদ্ধি আশ্রয় করিয়া বিবিধ পাপাচরণে প্রবৃত্ত হয়, তাহারা নিশ্চয়ই অশেষ যন্ত্রণা ভোগ করে। পাপকৰ্ম্মনিরত ব্যক্তিদিগকে পরজন্মে দরিদ্র হইয়া অশেষবিধ দুর্ভিক্ষক্লেশ, ভয় ও মরণতুল্য অবস্থা প্রাপ্ত হইতে হয়। কিন্তু সৎকর্ম্মানুষ্ঠানপরতন্ত্র [উত্তমকৰ্ম্মাচরণে একান্ত নিরত] পুণ্যবান্ ব্যক্তিরা পরজন্মে শ্রদ্ধাবান, জিতেন্দ্রিয় ও ধনবান্ হইয়া স্বচ্ছন্দে অনুপম উৎসব ও স্বর্গসুখ অনুভব করিয়া থাকেন। পাপাত্মা নাস্তিকদিগকে ব্যাঘ্র, হস্তী ও সর্প প্রভৃতি হিংস্র-জন্তুপরিপূর্ণ, তস্করগণে সমাকীর্ণ, দুর্গম পথে পরিভ্রমণ করিতে হয়। দেবাতিথিপ্রিয় [শস্যশূন্য—আগড়া], বদান্য, যজ্ঞশীল সাধুগণ শুদ্ধচিত্ত মহাত্মাদিগের পথ অবলম্বন করিয়া থাকেন। ধান্যের মধ্যে যেমন তুচ্ছ ধান্য ও পক্ষীর মধ্যে যেমন দুর্গন্ধ কীট নিতান্ত নিকৃষ্ট, তদ্রূপ মনুষ্যমধ্যে অধার্ম্মিক ব্যক্তি সকলেরই অশ্রদ্ধেয়, সন্দেহ নাই। মানবগণ গমন, শয়ন বা অন্যান্য যে-কোন কাৰ্য্যে ব্যাপৃত হউক না কেন, সকল অবস্থাতেই পুণ্যপাপজনিত অদৃষ্টের বশবর্ত্তী হইয়া থাকে। পূৰ্ব্বে যে ব্যক্তি যেরূপ কার্য্যের অনুষ্ঠান করে, পরে তাহাকে তদনুরূপ ফল ভোগ করিতে হয়। কাল সৰ্ব্বদাই ভূতসমুদয়কে আকর্ষণ করিতেছে। জন্মান্তরীণ কৰ্ম্মফল অপ্রার্থিত হইয়াও ফল-পুষ্পের ন্যায় যথাকালে সমুৎপন্ন হইয়া থাকে। মান-অপমান, লাভ-অলাভ এবং ক্ষয় ও অক্ষয় এই সমুদয় প্রতিনিয়ত মানবগণকে আশ্রয় করিতেছে; কেহই উহাদিগকে নিবারণ করিতে সমর্থ হয় না।
“মনুষ্যগণ গর্ভবাসকালেও প্রাক্তন সুখদুঃখ প্রাপ্ত হইয়া থাকে। কি বাল্য, কি যৌবন, কি বার্দ্ধক্য, লোকে যে অবস্থায় যেরূপ কার্য্যের অনুষ্ঠান করে, তাহাকে পরজন্মে সেই অবস্থায় তদনুরূপ ফল ভোগ করিতে হয়। সহস্র সহস্ৰ ধেনু একত্র সমবেত থাকিলেও বৎস যেমন অন্যান্য ধেনুগণকে পরিত্যাগপূৰ্ব্বক স্বীয় জননীর নিকট উপস্থিত হয়, তদ্রূপ জন্মান্তরীণ কৰ্ম্মফল ভূমণ্ডলস্থিত সহস্র সহস্র লোকের মধ্যে কৰ্ত্তাকেই প্রাপ্ত হইয়া থাকে। মলিন বস্ত্র যেমন সলিলদ্বারা পরিষ্কৃত হয়, তদ্রূপ মহাত্মারা উপবাসাদিদ্বারা পাপবিমুক্ত হইয়া পরিণামে অত্যন্ত সুখ অনুভব করিয়া থাকেন। যাঁহারা দীর্ঘকাল তপানুষ্ঠানপূর্ব্বক নিষ্পাপ হইতে পারেন, তাহাদিগের সমুদয় মনোরথ পরিপূর্ণ হয়। যেমন পক্ষিগণের আকাশমার্গে ও মৎস্যগণের সলিলমধ্যে গতি নিরূপণ করা যায় না, তদ্রূপ পুণ্যবাদিগের গতি নিরূপণ করা নিতান্ত দুঃসাধ্য। অন্যের কথা শুনিয়া অধৰ্ম্মপথ অবলম্বন করা কাহারও কৰ্ত্তব্য নহে, প্রত্যুত আপনার হিতকর সৎকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করাই সৰ্ব্বতোভাবে শ্রেয়ঃ।”