৩২১তম অধ্যায়
গৃহস্থের মোক্ষধৰ্ম্ম—ধৰ্ম্মধ্বজ-সুলভাসংবাদ
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! কোন্ ব্যক্তি গার্হস্থ্যধর্ম্ম পরিত্যাগ না করিয়া মোক্ষতত্ত্ব প্রাপ্ত হইয়াছিলেন? লিঙ্গশরীর ও সুলশরীর কিরূপে পরিত্যাগ করিতে হয় এবং মোক্ষ কাহাকে বলে, তৎসমুদয় আমার নিকট কীৰ্ত্তন করুন।”
ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! এই উপলক্ষে আমি ধৰ্ম্মধ্বজ সুলভাসংবাদ নামক পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। সত্যযুগে মিথিলানগরে ধৰ্ম্মধ্বজনামে জনকবংশসম্ভূত। সন্ন্যাসধর্ম্মতত্ত্বজ্ঞ এক সিদ্ধ নরপতি ছিলেন। বেদ, মোক্ষশাস্ত্র ও দণ্ডনীতিবিষয়ে তাঁহার সম্পূর্ণ পাণ্ডিত্য ছিল। তিনি ইন্দ্রিয়সমূহকে বশীভূত করিয়া সুনিয়মে এই পৃথিবী শাসন করিয়াছিলেন। বেদজ্ঞ পণ্ডিত ও অন্যান্য ব্যক্তিরা তাঁহার সাধুতার বিষয় শ্রবণ করিয়া তাঁহার ন্যায় সাধু হইতে বাঞ্ছা করিতেন।
“ঐ সময় সুলভানামে এক সন্ন্যাসিনী যোগধর্ম্ম অবলম্বন পূৰ্ব্বক একাকিনী সমুদয় পৃথিবী পরিভ্রমণ করিতেন। তিনি একদা নানাস্থানে পর্য্যটন করিতে করিতে ত্রিদণ্ডধারী [বাকদণ্ড—বাক্যসংযম, মনোদণ্ড—মনঃসংযম, কায়দণ্ড শরীরসংযম] মহাত্মাদিগের মুখে জনকবংশোদ্ভব রাজা ধর্ম্মধ্বজের বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া, তিনি যথার্থ মোক্ষধর্ম্মাবলম্বী কি না, তদ্বিষয়ে সংশয়াপন্ন হইলেন এবং আত্মসন্দেহ দূর করিবার নিমিত্ত রাজর্ষি ধৰ্ম্মধ্বজের সহিত সাক্ষাৎ করিতে কৃতসঙ্কল্প হইয়া যোগবলে পূর্ব্বরূপ পরিত্যাগ ও অতি মনোহর রূপ ধারণপূর্ব্বক অস্ত্রের ন্যায় দ্রুতবেগে নিমেষমধ্যে বিবিধ জনপরিপূর্ণ রমণীয় বিদেহনগরে গমন করিয়া ভিক্ষাগ্রহণের ছলে মিথিলাধিপতির সহিত সাক্ষাৎকার করিলেন। রাজা ধৰ্ম্মধ্বজ তাঁহার অসামান্য রূপলাবণ্য নিরীক্ষণ করিয়া বিস্ময়াবিষ্টচিত্তে ইনি কে, কাহার কন্যা ও কোথা হইতে আগমন করিলেন, এইরূপ চিন্তা করিতে লাগিলেন এবং অবিলম্বে তাঁহাকে স্বাগতজিজ্ঞাসা করিয়া পাদ্য ও আসন প্রদানপূৰ্ব্বক উৎকৃষ্ট ভক্ষ্য ও পানীয়দ্বারা তাঁহার তৃপ্তিসাধন করিলেন।
যোগসংযতদেহ ধৰ্ম্মধ্বজের সুলভাসম্ভাষণ
“তখন সেই সন্ন্যাসিনী সুলভা রাজা যথার্থ মোক্ষধৰ্ম্মবেত্তা কি না, এই সংশয় অপনোদন করিবার মানসে বেদার্থজ্ঞ পণ্ডিত ও মন্ত্রিগণে পরিবেষ্টিত নরপতিকেই উহা জিজ্ঞাসা করিতে বাসনা করিয়া স্বীয় বুদ্ধিদ্বারা তাঁতাহার বুদ্ধিতে ও নেত্ৰদ্বারা তাঁহার নেত্রে। প্রবেশপূৰ্ব্বক যোগবলে তাঁহাকে বশীভূত ও রুদ্ধ করিলেন। ঐ সময় তাঁহাদের উভয়েরই বাহ্যশরীর কার্য্যক্রম [শবের ন্যায় নিশ্চেষ্ট] হইয়া রহিল।
“অনন্তর বিদেহরাজ সুলভার অভিপ্রায় পরিজ্ঞাত হইয়া লিঙ্গদেহ আশ্রয়পূৰ্ব্বক হাস্যমুখে তঁহাকে কহিলেন, ‘দেবি! তোমার বাসস্থান কোথায়? তুমি কাহার কন্যা? কোথা হইতে আগমন করিলে এবং কোথায় বা গমন করিবে? কেহই জিজ্ঞাসা না করিয়া অন্যের শাস্ত্রজ্ঞান, বয়ঃক্রম ও জাতির বিষয় পরিজ্ঞাত হইতে পারে না। এক্ষণে মৎসন্নিধানে আমার শাস্ত্রজ্ঞানাদির বিষয় বিদিত হওয়া তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য। আমি এখন রাজ্যাদি হইতে বিমুক্ত হইয়াছি। অতঃপর তোমার নিকট স্বীয় তত্ত্বজ্ঞানপ্রাপ্তির বিষয় কীৰ্ত্তন করিয়া তোমার সম্মান রক্ষা করা আমার অবশ্য কৰ্ত্তব্য।
আত্মপরিচয়প্রসঙ্গে ধৰ্মধ্বজের যোগকথা
‘পরাশর গোত্রসম্ভূত সন্ন্যাসধর্ম্মাবলম্বী বৃদ্ধ মহাত্মা পঞ্চশিখ আমার গুরু। সেই মহাত্মা হইতেই আমি মোক্ষতত্ত্ব প্রাপ্ত হইয়াছি। তাঁহার তুল্য বক্তা আর কেহই নাই। তিনি মোক্ষের হেতুস্বরূপ। আমি তাঁহার প্রসাদেই সাঙ্খ্যজ্ঞান, যোগ ও নিষ্কাম যাগযজ্ঞাদি এই বিবিধ মোক্ষধৰ্ম্মের যথার্থ তত্ত্ব অবগত হইয়া সংশয়বিহীন হইয়াছি। পূৰ্ব্বে সেই সাঙ্খ্যতত্ত্বজ্ঞ মহাত্মা বর্ষাকালে চারিমাস আমার আলয়ে বাস করিয়া আমাকে ঐ ত্রিবিধ মোক্ষতত্ত্ব শ্রবণ করাইয়াছিলেন, কিন্তু রাজ্যে অবস্থান করিতে নিষেধ করেন নাই। আমি তাঁহার উপদেশানুসারে বিষয়রাগবিহীন হইয়া সেই ত্রিবিধ মোক্ষতত্ত্ব অবলম্বনপূৰ্ব্বক পরব্রহ্মে মনঃসমাধান করিয়া কালহরণ করিতেছি।
‘বৈরাগ্যই মোক্ষলাভের শ্রেষ্ঠ উপায়। জ্ঞান হইতে বৈরাগ্যের উৎপত্তি হইয়া থাকে। জ্ঞানদ্বারা যোগাভ্যাস ও যোগাভ্যাসদ্বারা আত্মজ্ঞান উৎপন্ন হয়। আত্মজ্ঞানপ্রভাবেই মনুষ্য যোগাভ্যাসনিরত হইয়া সুখদুঃখাদি পরিত্যাগ ও মৃত্যুকে অতিক্রমপূৰ্ব্বক পরমপদলাভ করিতে পারেন। আমি সেই আত্মজ্ঞানলাভ করিয়া মোহ হইতে বিমুক্ত, নিঃসঙ্গ ও সুখদুঃখাদিবিহীন হইয়াছি। সলিলসিক্ত ক্ষেত্র যেমন বীজ হইতে অঙ্কুর উৎপাদন করে, ভজ্জিত [ভাজা—নীরস] বীজ যেমন সলিলসিক্ত ভূমিতে নিক্ষিপ্ত হইয়াও অঙ্কুরোৎপাদনে অসমর্থ হয়, তদ্রূপ ভগবান্ পঞ্চশিখের অনুগ্রহে আমার বিষয়জ্ঞানরূপ বীজ বিষয়ে অবস্থিত হইয়াও অঙ্কুরিত হইতেছে না। আমি স্ত্রীর প্রতি অনুরাগ ও শত্রুর প্রতি ক্ৰোধ করি না।
যে ব্যক্তি আমার দক্ষিণহস্তে চন্দন লেপন ও যে ব্যক্তি কুঠারদ্বারা আমার বাম হস্ত ছেদন করে, আমি তাহাদের উভয়কেই তুল্য জ্ঞান করিয়া থাকি। যখন আমি লোষ্ট্রকাঞ্চনে সমজ্ঞান, মুক্তসঙ্গ ও পুরুষার্থে অনুরক্ত হইয়া রাজ্যে অবস্থান করিয়াও সুখে কাল হরণ করিতেছি, তখন আমাকে অন্যান্য ত্রিদণ্ড ধারী সন্ন্যাসীদিগের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলিয়া নির্দ্দেশ করা যাইতে পারে।
‘মোক্ষবিৎ পণ্ডিতেরা মোক্ষকে ত্রিবিধ বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন। কেহ কেহ সমধিক জ্ঞানযুক্ত কৰ্ম্মকে এবং কেহ কেহ সমধিক কর্ম্মযুক্ত জ্ঞানকে মোক্ষের সাধন বলিয়া নিরূপণ করেন; কিন্তু মহাত্মা পঞ্চশিখ ঐ উভয় মত পরিত্যাগপূৰ্ব্বক কেবল বিশুদ্ধ জ্ঞানকেই মুক্তিলাভের কারণ বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছেন। সন্ন্যাসীদিগেরও যখন যম, নিয়ম, কাম, দ্বেষ, পরিগ্রহ, মান, দম্ভ ও স্নেহ বিদ্যমান থাকে, তখন তাঁহাদিগের সহিত গৃহস্থদিগের প্রভেদ কি? ত্রিদণ্ডাদি ধারণ করিলেই মোক্ষলাভ হয়, আর ছত্রাদি ধারণ করিলেই মোক্ষলাভ হয় না, ইহার বিনিগমনা [সঙ্গতি—তর্করহিত মীমাংসা] কি? ইহলোকে সকলেই স্বার্থসাধনের উপযোগী দ্রব্য গ্রহণ করিতে অভিলাষ করে। যে ব্যক্তি গৃহধৰ্ম্মের দোষ দর্শনপূর্ব্বক উহা পরিত্যাগ করিয়া অন্য আশ্রম গ্রহণ করে, তাহাকেও একের পরিত্যাগ ও অন্যের গ্রহণনিবন্ধন সঙ্গত্যাগী বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায় না। যখন ভিক্ষুকেরাও রাজাদিগের ন্যায় নিগ্রহ-অনুগ্রহরূপ আধিপত্য প্রকাশ করেন, তখন ভিক্ষুকদিগেরই যে মোক্ষলাভ হইবে, তাহার প্রমাণ কি? অতএব আমার মতে যে ব্যক্তি তত্ত্বজ্ঞান লাভ করিয়াছে, তাহার রাজ্যাধিপত্য বিদ্যমান থাকিলেও সে সমুদয় পাপ হইতে বিমুক্ত হইয়া দেহস্থ পরমাত্মাতে অবস্থান করিতে পারে।
‘কটু-কষায় ফলমূল ভক্ষণ, মস্তকমুণ্ডন এবং ত্রিদণ্ড ও কমণ্ডলু ধারণ কেবল সন্ন্যাসধৰ্ম্মের চিহ্নমাত্র। কেবল ঐ সমুদয় চিহ্ন থাকিলেই মোক্ষলাভ হইতে পারে না। যদি ত্রিদণ্ডাদি চিহ্নসমুদয় বিদ্যমান থাকিলেও মোক্ষলাভ জ্ঞানসাপেক্ষ হয়, তাহা হইলে ঐ সমুদয় চিহ্ন ধারণ করিবার প্রয়োজন কি? অথবা দুঃখশৈথিল্যের নিমিত্ত যদি ত্রিদণ্ড ধারণ করা কর্ত্তব্য বলিয়া বোধ হয়, তাহা হইলে দুঃখনিবারণের নিমিত্ত ছত্রাদি-গ্রহণও দোষাবহ হইতে পারে না। নিঃস্ব হইলেই মোক্ষলাভ হয় এবং ধন থাকিলে মোক্ষলাভ হয় না, এ কথা নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর। মনুষ্য নির্দ্ধন হউক বা ধনবান হউক, তত্ত্বজ্ঞানসম্পন্ন হইলেই মুক্তিলাভ করিতে পারে, সন্দেহ নাই। আমি এই নিমিত্তই বন্ধনের আয়তনস্বরূপ ধৰ্ম্মার্থকামসঙ্কুল রাজ্যে অবস্থান করিয়াই মোক্ষধৰ্ম্মরূপ প্রস্তরে শাণিত ত্যাগরূপ অসিদ্বারা ঐশ্বর্য্য-পাশ ও স্নেহরূপবন্ধন ছেদন করিয়াছি।
স্থূলদর্শী ধৰ্ম্মধ্বজের গার্হস্থ্য যোগযুক্তি
‘হে দেবি! পূর্ব্বে আমি তোমাকে সন্ন্যাসিনী জ্ঞান করিয়া পরম সমাদর করিয়াছিলাম; কিন্তু এক্ষণে তোমার বয়ঃক্রম ও রূপলাবণ্যদর্শনে তোমার যোগ-বিষয়ে আমার সংশয় উপস্থিত হইয়াছে। আর আমি মুক্ত কি না, ইহা পরিজ্ঞাত হইবার নিমিত্ত তুমি যে আমার দেহ রুদ্ধ করিয়াছ, ইহা তোমার ত্ৰিদণ্ডধারণের নিতান্ত অননুরূপ হইয়াছে। বিষয়ভোগনিরত যোগীর ত্রিদণ্ড ধারণ করা নিতান্ত নিষ্ফল। তুমি দণ্ডধারিণী হইয়াও যোগধর্ম্ম রক্ষা করিতেছ না। এক্ষণে আমি স্পষ্টই তোমাকে যোগ হইতে পরিভ্রষ্ট বলিয়া অবগত হইতেছি। তুমি স্বীয় বুদ্ধিদ্বারা আমার দেহে প্রবিষ্ট হওয়াতে তোমার ব্যভিচারদোষ সপ্রমাণ হইতেছে। তুমি কাহার সাহায্যে আমার রাজ্য ও পুরমধ্যে প্রবেশ করিলে এবং কাহার সাহায্যেই বা আমার হৃদয়ে প্রবিষ্ট হইলে? দেখ, প্রথমতঃ, তুমি বর্ণশ্রেষ্ঠা ব্রাহ্মণী; কিন্তু আমি ক্ষত্রিয়; সুতরাং আমাদিগের উভয়ের সহযোগ হইলে বর্ণসঙ্কর হইবার সম্ভাবনা। দ্বিতীয়তঃ, তুমি ভিক্ষুকী, আমি গৃহস্থ; সুতরাং আমরা পরস্পর মিলিত হইলে আশ্রমসঙ্কর করা হইবে। তৃতীয়তঃ, তুমি আমার সগোত্রা কি না, তাহা আমি অবগত নহি এবং তুমিও আমার গোত্রাদির বিষয় সবিশেষ জ্ঞাত নহ; যদি তুমি আমার সগোত্রা হও, তাহা হইলে গোত্ৰসঙ্কর-দোষ উপস্থিত হইবে। চতুর্থতঃ, যদি তোমার স্বামী জীবিত থাকিয়া দেশান্তরে অবস্থান করেন, তাহা হইলে তুমি পরভাৰ্য্যা ও অগম্যা; আমি তোমাকে গ্রহণ করিলে ধৰ্ম্মসঙ্কর করা হইবে। এক্ষণে তুমি কি কোন কার্য্যসাধনের অনুরোধে বা অজ্ঞানতাপ্রভাবে অথবা বিপরীত জ্ঞাননিবন্ধন এই অকার্য্য অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইতেছ?
‘তুমি স্বদোষনিবন্ধন এইরূপ স্বাতন্ত্র্য অবলম্বন করাতে তোমার শাস্ত্রাধ্যয়ন বৃথা হইল। এক্ষণে তোমার বিলক্ষণ দুরভিসন্ধি লক্ষিত হইতেছে। তুমি জয়লাভার্থী হইয়া কেবল আমাকে নয়, আমার সভাস্থ মহাত্মাদিগকেও পরাজয় করিতে বাসনা করিয়াছ। তুমি আমার সভাস্থ পূজ্যগণের প্রতি দৃষ্টিপাত করাতে বোধ হইতেছে যে, আত্মপক্ষের উন্নতি ও মৎপক্ষীয় অপকার্য্যসাধনই তোমার উদ্দেশ্য। তুমি আমার উন্নতি-দর্শনে ঈর্ষান্বিত ও যোগৈশ্বর্য্যদর্পে দর্পিত হইয়া প্রীতিলাভ বাসনায় আমার বুদ্ধির সহিত স্বীয় বুদ্ধির ঐক্য করিয়াছ। কিন্তু আমি তোমার প্রতি অনুরক্ত নহি; সুতরাং তোমার কিছুমাত্র প্রীতিলাভের সম্ভাবনা নাই। স্ত্রীপুরুষ পরস্পর অনুরক্ত হইয়া মিলিত হইলে উহাদের মিলন অমৃততুল্য হয়; কিন্তু উহাদের মধ্যে একজন বিরক্ত ও একজন অনুরক্ত হইলে ঐ মিলন বিষতুল্য হইয়া উঠে। যাহা হউক, এক্ষণে আর তুমি আমাকে স্পর্শ করিও না, আমাকে সাধু বলিয়া স্থির কর এবং আপনার সন্ন্যাসধৰ্ম্মপ্রতিপালনে প্রবৃত্ত হও।
‘আমি জীবন্মুক্ত কি না, তুমি তাহা জানিতে পারিলে। এক্ষণে যদি তুমি স্বকার্য্য বা অন্য কোন মহীপতির কার্য্যসাধনার্থ প্রচ্ছন্নভাবে সমাগত হইয়া থাক, তাহা হইলে আমার নিকট ব্যক্ত কর। রাজা, ব্রাহ্মণ বা গুণবতী স্ত্রীর নিকট কপটতা কাহারও বিধেয় নহে। যে ব্যক্তি উহাদের নিকট কপটতা প্রকাশ করে, তাহাকে নিশ্চয়ই বিনষ্ট হইতে হয়। নরপতিদিগের ঐশ্বর্য্য, ব্ৰহ্মবেত্তাদিগের ব্রহ্মজ্ঞান এবং স্ত্রীজাতিদিগের রূপ ও যৌবন অতি উৎকৃষ্ট বল। ঐরূপ বলসম্পন্ন ব্যক্তিদিগের নিকট সরল ব্যবহার করাই কৰ্ত্তব্য। অতএব তুমি কপটতা পরিত্যাগ করিয়া আপনার জাতি, শাস্ত্রজ্ঞান, ব্যবহার, হৃদগত ভাব, স্বভাব ও আগমন-প্রয়োজন যথার্থরূপে কীৰ্ত্তন কর।’
সুলভার সূক্ষ্ম যোগযুক্তি
“মিথিলাধিপতি জনক এইরূপ অসুখকর অযুক্ত বাক্যবিন্যাসদ্বারা চারুদর্শনা সুলভাকে তিরস্কার করিলে তিনি তখন কিছুমাত্র বিরক্ত হইলেন না। প্রত্যুত অতি সুমধুরবাক্যে তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘মহারাজ! বক্তব্য বাক্য অষ্টাদশ দোষশূন্য ও অষ্টাদশ গুণযুক্ত হওয়া আবশ্যক। সৌক্ষ্ম্য, সাঙ্খ্য, ক্রম, নির্ণয় ও প্রয়োজন এই পঞ্চাঙ্গযুক্ত পদসমুদয়কেই বাক্য বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। তন্মধ্যে যাহা সংশয়সূচক, তাহার নাম সৌক্ষ্ম্য, যাহার দ্বারা গুণদোষ সংখ্যা করা যায়, তাহার নাম সাঙ্খ্য; যদ্বারা পৌৰ্ব্বাপৌর্ব্বক্রম [ক্রমসন্ধান অগ্রপশ্চাক্রমে কোন্টি অগ্রে, কোন্টি পরে, তাহার ক্রমনির্ণয়] নিরূপিত হয়, তাহার নাম ক্রম; পূৰ্ব্বপক্ষের পর বিচারান্তে যাহা সিদ্ধান্ত হয়, তাহার নাম নির্ণয় এবং ঔৎসুক্য ও দ্বেষনিবন্ধন কর্ত্তৃব্যাকৰ্ত্তব্যে যে প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি জন্মে, তাহার নাম প্রয়োজন। জনসমাজে যেসকল বাক্য প্রয়োগ করিতে হইবে, তৎসমুদয় সার্থক, প্রসিদ্ধপদযুক্ত, প্রসারগুণসম্পন্ন, সংক্ষিপ্ত, মধুর ও অসন্দিগ্ধ হওয়া আবশ্যক; শ্রুতিকটু, অশ্লীলপদযুক্ত, অমূলক, ত্রিবর্গবিরুদ্ধ, অসংস্কৃত, অসঙ্গতপদসম্পন্ন, ব্যাকরণাদিদোষযুক্ত, ক্রমবিবর্জ্জিত, অন্যপদ সাপেক্ষ, লক্ষণাযুক্ত, অনর্থক বা যুক্তিশুন্য হওয়া কদাপি বিধেয় নহে।
‘হে মহারাজ আমি কাম, ক্রোধ, লোভ, ভয়, দৈন্য, দর্প, লজ্জা, দয়া বা অভিমানবশতঃ আপনাকে প্রত্যুত্তর প্রদান করিতেছি না। আপনাকে উত্তর প্রদান করা উচিত বিবেচনা করিয়াই উহাতে প্রবৃত্ত হইতেছি। বক্তা ও শ্রোতা উভয়ে সমান হইলেই অর্থ সুপ্রকাশিত হয়। বক্তা শ্রোতাকে লক্ষ্য না করিয়া গর্ব্বিতভাবে আপনার অনুকূল উৎকৃষ্ট বাক্য প্রয়োগ করিলে তাহাতে কখনই শ্রোতার প্রীতি জন্মে না। আর যে ব্যক্তি স্বার্থ পরিত্যাগ করিয়া কেবল শ্রোতার অনুকূল বাক্য প্রয়োগ করে, তাহার সে বাক্যে অবশ্যই লোকের আশঙ্কা উপস্থিত হয়। সুতরাং ঐরূপ বাক্যেকেও দোষযুক্ত বলিতে হইবে; কিন্তু যিনি আপনার ও শ্রোতার অবিরুদ্ধে বাক্যবিন্যাস করেন, তাঁহাকেই যথার্থ সদ্বক্তা এবং তাঁহার বাক্যকেই যথার্থ অর্থযুক্ত বাক্য বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। আপনি ইতিপূর্ব্বে আমাকে ‘তুমি কে, কাহার কন্যা এবং কোথা হইতে বা এখানে সমাগত হইয়াছ’ বলিয়া যে প্রশ্ন করিয়াছেন, এক্ষণে আমি তাহার প্রত্যুত্তর প্রদান করিতেছি, অবহিতচিত্তে শ্রবণ করুন।
‘যেমন জতু[লাক্ষা—দাহ্যবস্তু] ও কাষ্ঠ এবং ধূলি ও জলবিন্দু পরস্পর সংশ্লিষ্ট থাকে, সেরূপ শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ ও পাঁচ ইন্দ্রিয় আত্মার সহিত সংশ্লিষ্ট হইয়া রহিয়াছে। কেহই চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয়গণের প্রতি অভিজ্ঞানার্থ কোনরূপ প্রশ্ন উপস্থিত করে না; উহারাও আপনাদিগের স্বরূপ জ্ঞাত হইতে সমর্থ হয় না। চক্ষু আপনাকে দেখিতে পায় না এবং শ্রোতাও আপনাকে শ্রবণ করিতে পারে না। উহাদের মধ্যে এক ইন্দ্রিয় কখনই অন্য ইন্দ্রিয়ের কার্য্যসম্পাদনে সমর্থ হয় না। উহারা পরস্পর একত্র হইলেও পরস্পর সংশ্লিষ্ট ধূলি ও সলিলের ন্যায় পরস্পরকে জ্ঞাত হইতে পারে না। ঐ সমস্ত ইন্দ্রিয় স্ব স্ব কার্য্য সাধন করিবার নিমিত্ত বাহ্য গুণসমুদয়ের সাহায্য অপেক্ষা করিয়া থাকে। রূপ, চক্ষু ও প্রকাশ এই তিনটি দর্শনের হেতু বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। শ্রবণাদি ক্রিয়ারও এইরূপ তিন-তিনটি হেতু বিদ্যমান আছে।
‘পদার্থজ্ঞানবিষয়ে মনকেও একটি প্রধান কারণ বলিয়া গণনা করিতে হইবে। উহা সতত সদসদ্বিচার করিয়া থাকে। পঞ্চকৰ্ম্মেন্দ্রিয়, পঞ্চতন্মাত্র ও মন এই একাদশটিকে গুণ বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। বুদ্ধি দ্বাদশ গুণ; উহা বিষয়জ্ঞানসময়ে সংশয় উপস্থিত হইলে তাহা নিরাকৃত করিয়া দেয়। সত্ত্ব ত্রয়োদশ গুণ; উহার কার্য্যদ্বারা মনুষ্যগণের বিশুদ্ধভাবের তারতম্য অনুমিত হইয়া থাকে। অহঙ্কার চতুর্দ্দশ গুণ; উহাদ্বারাই মনুষ্যের আত্মপরবিবেচনা হইয়া থাকে। বাসনা পঞ্চদশ গুণ; ঐ বাসনামধ্যে সমগ্র বিশ্ব ব্যাপ্ত রহিয়াছে। অবিদ্যা ষোড়শ গুণ। মায়া সপ্তদশ ও প্রকাশ অষ্টাদশ গুণ। সুখাসুখ, জরামৃত্যু, লাভালাভ ও প্রিয়াপ্রিয়াত্মক দ্বন্দ্বযোগ ঊনবিংশ গুণ বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকে। কাল বিংশ গুণ। এই কালপ্রভাবেই প্রাণীগণের জন্ম ও মৃত্যু হইতেছে। এতদ্ভিন্ন পঞ্চমহাভূত এবং সম্ভাব, অসদ্ভাব, শুক্ৰবল ও বিধি এই দশটিকেও গুণ বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। অতএব সমুদয় গুণ ত্রিংশৎপ্রকার হইল। এই সমস্ত গুণ যাহাতে অবস্থান করে, তাহারই নাম শরীর। কেহ কেহ প্রকৃতিকে, কেহ কেহ পরমাত্মাকে, কেহ কেহ ঈশ্বর ও পরমাত্মা উভয়কে, আর কেহ কেহ ঈশ্বর ও মায়াশক্তি এবং জীব ও অবিদ্যা এই চারিটিকে ঐ সমস্ত গুণের কারণ বলিয়া নির্দ্দেশ করেন। অব্যক্ত প্রকৃতি ঐ সমস্ত গুণের সাহায্যে ব্যক্তভাব প্রাপ্ত হইয়া থাকে।
‘হে মহারাজ। সমুদয় প্রাণীই শুক্ৰশোণিত হইতে উৎপন্ন হয়। শুক্ৰশোণিতের সহযোগকে কলল [ভ্রূণ] বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। কলল হইতে বুদ্বুদ্ জন্মে। বুদ্বুদ্ হইতে মাংসপেশী, মাংসপেশী হইতে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হইতে নখ ও রোমসমুদয় উৎপন্ন হইয়া থাকে। গর্ভমধ্যে শুক্ৰশোণিতের সহযোগের পর নবম মাস উত্তীর্ণ হইলে ঐ গর্ভস্থ দেহী ভূমিষ্ঠ হয়। ভূমিষ্ঠ হইবামাত্র উহার চিহ্নানুসারে উহাকে স্ত্রী বা পুরুষনামে নির্দ্দিষ্ট করা যায়। ঐ সময় উহার পাণিতল, নখ ও অঙ্গুলিদল রক্তবর্ণ হইয়া থাকে। কিন্তু কিয়দ্দিবস পরে কৌমারাবস্থা উপস্থিত হইলে উহার সেই রূপ তিরোহিত হইয়া যায়। পরে কৌমারাবস্থা অতিক্রান্ত হইলে যৌবনকাল উপস্থিত হয় এবং পরিশেষে বৃদ্ধাবস্থা আসিয়া উহাকে আক্রমণ করে। প্রাণীর যে অবস্থা একবার অতিক্রান্ত হয়, তাহা আর পুনরায় প্রাদুর্ভূত হয় না। যেমন প্রদীপশিখার হ্রাসবৃদ্ধি ক্রমে ক্রমে হয় বলিয়া কেহ উহা অনুভব করিতে পারে না, সেইরূপ মনুষ্যের কৌমারাদি অবস্থার আবির্ভাব ও তিরোভাব অতি অল্পে অল্পে হয় বলিয়া অনুমান করা যায় না। উৎকৃষ্ট অশ্ব যেমন এক স্থান হইতে স্থানান্তরে ধাবমান হয়, সেইরূপ জীবের দেহ এক অবস্থা হইতে অবস্থান্তর প্রাপ্ত হইয়া থাকে।
‘এইরূপ যখন মনুষ্যের দেহের অবস্থা প্রতিনিয়ত পরিবর্ত্তিত হইতেছে, তখন এই দেহ যে কাহার এবং কোন্ স্থান হইতে উপস্থিত হইল, তাহা কিরূপে নির্ণয় করা যাইতে পারে? ফলতঃ আপনার দেহের সহিত প্রাণীগণের কিছুমাত্র সম্বন্ধ নাই। যেমন অয়স্কান্তমণি ও কাষ্ঠ হইতে অগ্নি উৎপন্ন হয়, সেইরূপ শব্দস্পর্শাদি গুণসমুদয় হইতে প্রাণীগণ সঞ্জাত হইয়া থাকে। আপনি আপনাকে যেরূপ জ্ঞান করেন, অন্যকে সেইরূপ জ্ঞান করা আপনার কর্ত্তব্য। যদি আপনি আপনাকে ও অন্যকে তুল্যজ্ঞান করিয়া থাকেন, তাহা হইলে কি নিমিত্ত আমাকে “তুমি কে ও কাহার ভাৰ্য্যা” বলিয়া জিজ্ঞাসা করিতেছেন? যখন আপনি স্বার্থপরার্থজ্ঞানশূন্য হইয়া থাকেন, তখন আমাকে “তুমি কাহার ও কোন স্থান হইতে আগমন করিতেছ” এইরূপ প্রশ্ন করা আপনার নিতান্ত অকর্ত্তব্য।
‘যে মহীপাল শত্ৰু, মিত্র ও মধ্যস্থের প্রতি সমুচিত ব্যবহার করিয়া থাকেন এবং সন্ধি ও বিগ্রহে যাঁহার সম্যক্ আসক্তি রহিয়াছে, তাঁহাকে কিরূপে মোক্ষপদাবলম্বী বলিয়া নির্দ্দেশ করা যাইতে পারে? যে ব্যক্তি ত্রিবর্গের তত্ত্ব সবিশেষ অবগত না হইয়া উহাতে আসক্ত থাকে, তাহাকে কখনই মোক্ষপথের পথিক বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায় না। অতএব আপনি মোক্ষের অনুপযুক্ত হইয়াও আপনাকে মুক্ত বলিয়া যে অভিমান করেন, তদ্বিষয়ে আপনাকে নিবারণ করা আপনার সুহৃগণের অবশ্য কর্ত্তব্য। কুপথ্যশীলের ঔষধের ন্যায় বিষয়াসক্ত ব্যক্তির মোক্ষলাভে যত্ন নিতান্ত নিরর্থক। যে ব্যক্তি স্ত্রী প্রভৃতি সংসর্গের বিষয়সমুদয় আত্মা হইতে অভিন্ন বলিয়া দর্শন করে, সেই ব্যক্তিকেই যথার্থ মুক্ত বলিয়া কীৰ্ত্তন করা যায়।
‘এক্ষণে আমি শয়ন, উপভোগ, ভোজন ও আচ্ছাদনবিষয়ক কতকগুলি সূক্ষ্ম সঙ্গস্থানের বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। যে রাজা এই সসাগরা পৃথিবী শাসন করেন, তাঁহাকে প্রতিনিয়ত একমাত্র পুরমধ্যে অবস্থান করিতে হয়। রাত্রিযোগে আবার তিনি সেই পুরমধ্যস্থ একমাত্র নির্দ্দিষ্ট গৃহের একাংশে খট্বার উপর শয়ন করেন। তৎকালে সেই খাট্বারও সমুদয় অংশে তাঁহার অধিকার থাকে না। অতএব যখন নরপতির একমাত্র শয্যার অর্ধাংশই আবশ্যক হইল, তখন এই বিশাল ব্ৰহ্মাণ্ড অধিকার করা তাঁহার নিতান্ত নিষ্ফল। ভোজন, উপভোগ ও আচ্ছাদনবিষয়েও রাজার এইরূপ অতি অল্পমাত্র দ্রব্যের আবশ্যক হইয়া থাকে।
‘আর দেখুন, রাজাকে সতত পরাধীন থাকিতে হয়। যখন রাজাকে অল্পমাত্র বিষয়ে আসক্ত হইতে এবং সন্ধি, বিগ্রহ, স্ত্রীসম্ভোগ, ক্রীড়া, বিহার, অমাত্যের সহিত মন্ত্রণা ও গুণদোষ বিচার করিয়া নিগ্রহ ও অনুগ্রহ করিতে হয়, তখন তাঁহার স্বাধীনতা কোথায়? যে সময় রাজা অন্যকে কোন কার্য্য করিতে আজ্ঞা করেন, তিনি নিদ্রায় আক্রান্ত হইয়াও কাৰ্য্যার্থিগণের অনুরোধে সুখে শয়ন করিতে পারেন না। কোন বিশেষ কার্য্য উপস্থিত হইলেই তাঁহাকে গাত্রোত্থান করিতে হয়। রাজপুরুষগণ রাজাকে স্নান, স্পর্শ, ভোজন, পান, অগ্নিতে আহুতি প্রদান, যজ্ঞানুষ্ঠান, বাক্যপ্রয়োগ ও শ্রবণ করিতে অনুরোধ করিয়া তাঁহাকে ঐ সমুদয় কাৰ্য্যের অধীন করিয়া থাকে। অথিগণ সৰ্ব্বদা রাজার নিকট উপস্থিত হইয়া ধন প্রার্থনা করে, কিন্তু তিনি ঐশ্বর্য্যের অধীন হইয়াও তাহাদিগকে দান করিতে পারেন না। দান করিলে কোষক্ষয় এবং দান না করিলে অন্যের সহিত শত্রুতা হইয়া থাকে; এই নিমিত্ত রাজাকে অনেক সময় ইতিকৰ্ত্তব্যবিমূঢ় হইয়া বিরক্তভাবে অবস্থান করিতে হয়। কি ধনবান, কি জ্ঞানী, কি বলশালী, কি নির্ভয়, কি নিত্য-উপাসনানিরত সকলের নিকটই রাজাকে ভীত হইতে হয়। উহারা অনায়াসেই রাজার অনিষ্ট করিতে পারে।
‘আর দেখুন, মনুষ্যমাত্রেই স্ব স্ব গৃহে আধিপত্য স্থাপনপূৰ্ব্বক নিগ্রহ ও অনুগ্রহবিধান করিতেছে, অতএব সকল ব্যক্তিই রাজার তুল্য। রাজাদিগের ন্যায় সকলেরই পুত্র, কলত্র, আত্মা, কোষ, মিত্র ও অর্থসংগ্রহ আছে। দেশ উচ্ছিন্ন, পুর দগ্ধ ও প্রধান হস্তী মৃত হইলে নরপতি ক্ষতিগ্রস্ত অন্যান্য লোকের ন্যায় অনুতাপ করেন এবং সৰ্ব্বদা ইচ্ছা, দ্বেষ ও ভয়জনিত মানসিক দুঃখ ও শিরোরোগাদিতে সমাক্রান্ত হয়েন। বিশেষতঃ তাঁহাদিগকে দিনসংখ্যা নিরূপণপূর্ব্বক শঙ্কিতচিত্তে শত্ৰুসঙ্কুল রাজ্য পালন করিতে হয়। অতএব দুঃখসঙ্কুল, তৃণাগ্নি ও ফেনবুদবুদের ন্যায় ক্ষণবিনশ্বর, অসার রাজ্যভার গ্রহণ করা নিতান্ত মূখর্ত্তার কার্য্য। উহা গ্রহণ করিলে কখনই শান্তিলাভের সম্ভাবনা নাই। আপনি আপনার পুর, রাজ্য, বল, কোষ ও অমাত্যগণ বিদ্যমান আছে বলিয়া যে গর্ব্ব করেন, তাহা নিতান্ত নিরর্থক। বিশেষ বিবেচনা করিয়া দেখিলে সকলেরই ঐ সমুদয় বিদ্যমান আছে। মিত্র, অমাত্য, পুর, রাষ্ট্র, দণ্ড, কোষ ও রাজা রাজ্যের এই সাতটি অঙ্গই ত্রিদণ্ডের ন্যায় পরস্পর পরস্পরকে আশ্রয় করিয়া অবস্থান করে। ইহাদের মধ্যে কেহই কাহারও অপেক্ষা অধিক ক্ষমতাশালী নহে। যখন যে অঙ্গদ্বারা কার্য্যসিদ্ধি হয়, সেই সময় সেই অঙ্গকেই প্রধান বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। মিত্রাদি সাত অঙ্গ এবং প্রভাব, উৎসাহ ও মন্ত্রজ শক্তি এই দশবর্গই একত্র মিলিত হইয়া রাজ্য ভোগ করে। যে রাজা উৎসাহশালী ও ক্ষাত্রধৰ্ম্মে অনুরক্ত হয়েন, তিনিই প্রজাগণের নিকট দশাংশমাত্র কর গ্রহণ করিয়া সন্তুষ্ট হইয়া থাকেন, অন্যান্য ভূপতিগণ কখনই উহাতে সন্তোষ লাভ করেন না। কোন রাজ্যই ভূপতিশূন্য নাই এবং কেহই অদ্বিতীয় রাজা নহেন, অতএব “আমার রাজ্য” ও “আমি রাজা” বলিয়া গৰ্ব্ব করা নিতান্ত মূর্খতার কার্য্য। রাজা অহষ্কৃত হইলে রাজ্য অতি বিশৃঙ্খল হইয়া উঠে। বিশৃঙ্খল রাজ্যে ধৰ্ম্ম থাকিবার সম্ভাবনা নাই এবং ধৰ্ম্ম না থাকিলে কখনই মোক্ষলাভ হয় না। রাজা নিয়ম হইতে কিছুমাত্র বিচলিত না হইয়া, রাজধৰ্ম্ম রক্ষা করিতে পারিলে তাঁহার পৃথিবীদানসহকৃত অশ্বমেধের ফল অপেক্ষা সমধিক ফললাভ হয় বটে, কিন্তু সম্পূর্ণরূপে রাজধৰ্ম্ম রক্ষা করা কোন রাজার পক্ষেই সহজ নহে। রাজাদিগের এইরূপ সহস্র সহস্র কষ্টের বিষয় উল্লেখ করিতে পারি।
‘যাহা হউক, আপনি আমাকে আপনার দেহ সংস্পর্শ করিতে নিষেধ করিয়া নিতান্ত বালকতা প্রকাশ করিয়াছেন। স্বীয় দেহের সহিতও আমার সংস্পর্শ নাই। সুতরাং অন্য শরীর সংস্পর্শ করা কিরূপে সম্ভবপর হইবে? আপনি পঞ্চশিখের প্রমুখাৎ উপায়, উপনিষদ, উপাসঙ্গ ও নিশ্চয়ের সহিত সমুদয় মোক্ষধৰ্ম্ম শ্রবণ করিয়াছেন; অতএব আমাকে বর্ণসঙ্করকারিণী বলিয়া বৃথা তিরস্কার করা আপনার কদাপি কৰ্ত্তব্য নহে। যদি আপনি কামাদি রিপুবর্গ পরাজয়পূৰ্ব্বক সঙ্গরহিত হইয়া থাকেন, তাহা হইলে ছত্রাদির সহিত আপনার সম্পর্ক রহিয়াছে কেন? এক্ষণে স্পষ্টই বোধ হইতেছে যে, আপনি কখনই বেদশাস্ত্র শ্রবণ করেন নাই; আর যদিও শ্রবণ করিয়া থাকেন, তাহাতে আপনার কোন ফলোদয় হয় নাই; অথবা আপনি বেদ মনে করিয়া উহার তুল্য অন্য কোন শাস্ত্র শ্রবণ করিয়া থাকিবেন। ফলতঃ আপনার তত্ত্বজ্ঞানের লেশমাত্র নাই। আপনি কেবল লৌকিক জ্ঞানে নিমগ্ন রহিয়াছেন। আপনি প্রাকৃত ব্যক্তির ন্যায় স্পর্শ ও অবরোধদ্বারা রুদ্ধ হইয়াছেন।
‘আমি সত্ত্বগুণবলে আপনার শরীরমধ্যে প্রবেশ করিয়াছি। যদি আপনি জীবন্মুক্ত হয়েন, তাহা হইলে আমার প্রবেশনিবন্ধন আপনার কি অপকার হইয়াছে? বনমধ্যে শূন্যগৃহে অবস্থান করা সন্ন্যাসীদিগের প্রধান ধৰ্ম্ম। আমি সেই ধৰ্ম্মানুসারে আপনার এই বোধশূন্য শরীরে অবস্থান করিতেছি; ইহাতে আমার দোষ কি? আমি হস্ত, পদ, ঊরু বা অন্য কোন অবয়বদ্বারা আপনাকে স্পর্শ করি নাই। আপনি মহদ্বংশসম্ভূত, লজ্জাশীল ও দীর্ঘদর্শী; অতএব আমি যে গোপনে আপনার শরীরে প্রবেশ করিয়াছি, ইহা সভামধ্যে কীৰ্ত্তন করা আপনার কদাপি কৰ্তব্য নহে। এই সমুদয় ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য গুরুলোক যেমন আপনার পূজ্য, তদ্রূপ আপনিও তাঁহাদিগের মাননীয়। এইরূপে আপনারা পরস্পর পরস্পরের গৌরব রক্ষা করিয়া থাকেন; অতএব এক্ষণে বাচ্যাবাচ্য বিবেচনা করিয়া সভামধ্যে স্ত্রীপুরুষসংযোগবিষয় ব্যক্ত করা আপনার কখনই কৰ্ত্তব্য নহে। আমি পদ্মপত্রস্থিত সলিলের ন্যায় নির্লিপ্তভাবে আপনার শরীরমধ্যে অবস্থান করিতেছি। যদি ইহাতেও আপনার স্পর্শজ্ঞান জন্মিয়া থাকে, তাহা হইলে পঞ্চশিখের প্রসাদে যে আপনার জ্ঞানবিষয় সংসর্গবিহীন হইয়াছে, তাহা কি বিশ্বাসযোগ্য হইবে?
‘এক্ষণে স্পষ্টই বোধ হইতেছে, আপনি গার্হস্থ্যধৰ্ম্ম হইতে পরিভ্রষ্ট অথচ মোক্ষলাভে অসমর্থ হইয়া মুমুক্ষুনাম ধারণপূৰ্ব্বক গার্হস্থ্য ও মোক্ষ এই উভয়ের মধ্যস্থলে অবস্থান করিতেছেন। মুক্তের সহিত যুক্ত এবং প্রকৃতির সহিত পুরুষের সংযোগ হইলে কি কখন বর্ণসঙ্কর হইয়া থাকে? যাহারা আত্মাকে দেহ হইতে অভিন্ন বলিয়া জ্ঞান এবং বর্ণ ও আশ্রমের ধর্ম্মসমুদয় ভিন্ন ভিন্ন রূপে সংদর্শন করে, তাহাদিগেরই বর্ণসঙ্করজ্ঞান জন্মিয়া থাকে। আমার দেহই আপনার দেহ হইতে পৃথক্; কিন্তু আত্মা কখনই আপনার আত্মা হইতে পৃথক্ নহে। ইহা যখন আমি সুস্পষ্টরূপে বুঝিতে পারিয়াছি, তখন আমার বুদ্ধি যে আপনাতে অবস্থান করিতেছে না, তদ্বিষয়ে আমার কিছুমাত্র সংশয় নাই। হস্ত ও হস্তস্থিত কুণ্ড, কুণ্ড ও কুণ্ডস্থিত দুগ্ধ এবং দুগ্ধ ও দুগ্ধস্থিত মক্ষিকা যেমন একত্ৰ থাকিয়াও কদাপি পরস্পর মিশ্রভাব প্রাপ্ত হয় না, তদ্রূপ বর্ণ ও আশ্রমের ধর্ম্মসমুদয় ব্রহ্মনিষ্ঠ ব্যক্তিতে মিলিত হইয়াও উহা পৃথরূপে অবস্থান করে।
“হে মহারাজ! আমি ব্রাহ্মণী, বৈশ্যা বা শূদ্রা নহি। আমি আপনার সজাতি ও বিশুদ্ধবংশসম্ভূত। আমার পূর্ব্বপুরুষদিগের যজ্ঞস্থলে দেবরাজ ইন্দ্র, দ্রোণ, শতশৃঙ্গ ও চক্ৰদ্বার প্রভৃতি পর্ব্বতসমুদয়কে সমভিব্যাহারে লইয়া সমাগত হইয়াছিলেন। আপনি রাজর্ষিপ্রধানের নাম শ্রবণ করিয়া থাকিবেন। আমি তাঁহারই বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছি; আমার নাম সুলভা; গুরুজনেরা আমার পাণিগ্রহণের উপযুক্ত পাত্র না পাইয়া আমাকে নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচর্য্যবিষয়ে উপদেশ প্রদান করেন। আমি তাঁহাদের উপদেশানুসারে মুনিব্রত অবলম্বন করিয়া একাকিনী ইতস্ততঃ বিচরণ করিতেছি। আমি কপট সন্ন্যাসিনী বা পরস্বাপহারিণী নহি। ধৰ্ম্মসঙ্কর করাও আমার অভিপ্রেত নহে। আমি ব্রত অবলম্বন করিয়া স্বধর্ম্মানুসারে অবস্থান করিতেছি; কখনই প্রতিজ্ঞাপালনে পরাঙ্মুখ হই না এবং বিশেষ বিবেচনা না করিয়াও বাক্যপ্রয়োগ করি না। এক্ষণে আমি সবিশেষ বিচার না করিয়া আপনার নিকট আগমন করি নাই। আপনি মোক্ষধৰ্ম্মে সুনিপুণ, ইহা শ্রবণ করিয়া ধৰ্ম্মজিজ্ঞাসার্থ আপনার নিকট সমাগত হইয়াছি। এক্ষণে অপক্ষপাতচিত্তে কহিতেছি যে, যে ব্যক্তি বিতণ্ডাপরায়ণ হয়, সে কখনই মোক্ষলাভে সমর্থ হয় না; আর যে ব্যক্তি বিতণ্ডা পরিত্যাগপূৰ্ব্বক একমাত্র ব্রহ্মে নিমগ্ন হয়, তাহার মুক্তিলাভ হইয়া থাকে। নগরমধ্যে শূন্য গৃহ প্রাপ্ত হইলে ভিক্ষুক যেমন তথায় যামিনীযাপন করে, তদ্রূপ আজ আমি আপনার শরীরমধ্যে রজনী অতিবাহিত করিব। আপনি আমার যথেষ্ট সমাদর করিয়াছেন। আমি আপনার বাক্যে পরম পরিতুষ্ট হইয়াছি। এক্ষণে আপনার শরীরমধ্যে অবস্থানপূর্ব্বক এই যামিনীযাপন করিয়া কল্য এ স্থান হইতে প্রস্থান করিব।
“হে ধৰ্ম্মরাজ! মনস্বিনী সুলভ এইরূপ সার্থক ও হেতুগর্ভ বাক্যপ্রয়োগ করিলে, মহারাজ ধৰ্ম্মরাজ তাহার কিছুমাত্র প্রত্যুত্তর প্রদান করিতে না পারিয়া মৌনভাবে অবস্থান করিতে লাগিলেন।”