৩২০তম অধ্যায়
মৃত্যু-জরাজয়প্রসঙ্গে দেহের অনিত্যতাকথন
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! অণিমাদি ঐশ্বর্য্য, ধন, দীর্ঘ আয়ু, বিপুল তপস্যা, যজ্ঞাদি কৰ্ম্ম, অধ্যয়ন ও রসায়নপ্রয়োগ এই সমুদয়ের মধ্যে কোন্ উপায়দ্বারা জরামৃত্যু অতিক্রম করা যায়?”
ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! আমি এই উপলক্ষে পঞ্চশিখ জনকসংবাদ নামক পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। একদা বিদেহরাজ জনক ধর্ম্মার্থ-সংশয়বিহীন বেদবিদ্ মহর্ষি পঞ্চশিখকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘ভগবন্! তপস্যা, বুদ্ধি, পুণ্যকর্ম্ম ও শাস্ত্রজ্ঞান এই সমুদয়ের মধ্যে কোন্ উপায়দ্বারা মনুষ্য জরামৃত্যু অতিক্রম করিতে পারে, তাহা আমার নিকট কীৰ্ত্তন করুন। মহারাজ জনক এইরূপ জিজ্ঞাসা করিলে, সৰ্ব্ববেত্তা মহর্ষি পঞ্চশিখ তাঁহাকে কহিলেন, মহারাজ! কেবল জীবন্মুক্ত যোগীরাই জরামরণ অতিক্রম করিতে পারেন, তদ্ভিন্ন আর কাহারই মাস ও দিবারাত্রির ন্যায় জ্বরা ও মৃত্যুকে অতিক্রম করিবার ক্ষমতা নাই।
‘মূঢ়স্বভাব মানবগণ চিরকাল অনিত্য সংসারপথ আশ্রয় করিয়া সৰ্ব্বদা জরামৃত্যুরূপ জলজন্তুতে পরিব্যাপ্ত প্লববিহীন কালসাগরে প্রবাহিত ও নিমগ্ন হইতেছে; কিন্তু কোন ব্যক্তি তাহাদিগের সাহায্য করিতেছে না। ইহলোকে কাহারও সহিত কাহারও সম্বন্ধ নাই। পথিমধ্যে গমন করিতে করিতে যেমন অপরাপর পথিকদিগের সহিত মিলিত হয়, তদ্রূপ ইহলোকে স্ত্রীপুত্র ও বন্ধু-বান্ধবগণের সহিত মিলন হইয়া থাকে। কেহই কাহারও সহিত চিরকাল বাস করিতে সমর্থ হয় না। মেঘজাল যেমন বায়ুসঞ্চালিত হইয়া গর্জ্জন করিতে করিতে এক স্থান হইতে স্থানান্তরে ধাবমান হয়, তদ্রূপ প্রাণীগণ কালপ্রেরিত হইয়া বারংবার শোকসূচক শব্দ করিতে করিতে এক স্থান হইতে অন্য স্থানে গমন করিতেছে। জরা ও মৃত্যু বৃকের ন্যায় কি দুৰ্ব্বল, কি বলবান, কি মহৎ, কি নীচ সকলকেই গ্রাস করিতেছে, এই নিমিত্তই নিত্যস্বরূপ জীবাত্মা অনিত্য ভূতগণের উৎপত্তিতে আনন্দ ও বিনাশে শোক অনুভব করেন না। তুমি কে? কোথা হইতে আগমন করিয়াছ? কাহার সহিত তোমার কি সম্বন্ধ আছে? তুমি কোথায় অবস্থান করিতেছ ও কোথায় গমন করিবে? এই সকল চিন্তা করিয়া শোক পরিত্যাগ করা তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য। তুমি কি নিমিত্ত অনুতাপ করিতেছ? কেহই কাহার প্রতিনিধি হইয়া স্বর্গ বা নরকভোগ করে না; অতএব শাস্ত্রানুসারে দান ও যজ্ঞানুষ্ঠান করা মনুষ্যমাত্রেরই অবশ্য কর্ত্তব্য কৰ্ম্ম।”