একটু বেশি রাত অবধিই সুব্রত রয়ে গেল। ক্যাটারার খাবার দিয়ে গেলে তা ভাগ করে খেল তিনজনই। যাওয়ার সময় সুব্রত বলল, গোপীদা, আপনার কি কোনও অস্ত্রশস্ত্র চাই?
গোপীনাথ অবাক হয়ে বলে, অস্ত্র। অস্ত্র দিয়ে কী হবে?
আত্মরক্ষার্থে যদি লাগে।
দুর বোকা। আত্মরক্ষার্থে অস্ত্র লাগে না, বুদ্ধি লাগে।
তবু ভেবে দেখুন আমি একটা পিস্তল দিতে পারি।
কোথায় পাবি?
কলকাতায় পথেঘাটে পাওয়া যায়।
গোপীনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, স্বাভাবিক। অস্ত্র আজকাল সব দেশেই আকছার পাওয়া যাচ্ছে।
আপনার চাই কি না বলুন।
গোপীনাথ মাথা নেড়ে বলল, না। ইন ফ্যাক্ট একটা পিস্তল এ বাড়িতেই আছে। সেটার কথা আমার মনে ছিল না।
এ বাড়িতে?
হ্যাঁ। তবে সেটা আমার নয়। বোধহয় সুধাকর দত্ত ওটা রেখে গেছে ইচ্ছে করেই।
তা হলে তো হয়েই গেল।
গোপীনাথ মাথা নেড়ে বলল, হল না। অস্ত্র হাতে পেলেই মানুষের একটা হননেচ্ছা জাগে। অস্ত্র জিনিসটার এদিকটার কথা কেউ ভাবে না।
তবু অস্ত্রটা হাতের কাছে রাখবেন। দরকার হলে ব্যবহারও করবেন।
আরও মানুষ মারতে বলছিস?
আরও মানে! আপনি তো এখনও একটাকেও মারেননি।
আজই মেরেছি।
না মারেননি। লোকটা পড়ে মারা গেছে। আপনি কিছুই করেননি।
একটা ধাক্কা দিয়েছিলাম।
ওটা ভুলে যান। ধাক্কা না দিলে ও আপনাকে চালুনির মতো শতছিদ্র করে দিত।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে গোপীনাথ বলল, তা দিত।
তা হলে। খামোখা সিমপ্যাথির অপচয় করবেন না।
গোপীনাথ চুপ করে রইল।
টেবিল পরিষ্কার করে সোনালি এসে সোফায় বসতেই হঠাৎ সুব্রত বলল, সোনালিদি, একটা কথা।
কী বলুন তো!
আমি কি আপনাকে বউদি বলে ডাকতে পারি?
সোনালি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, না।
সুব্রত হাসল, আচ্ছা, ডাকব না। বারবার মুখে বউদি ডাকটা এসে যায়। অতি কষ্টে সামলাই।
গোপীনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে বলল, তোর মতো গবেট দুটো হয় না। সেই বাঙালির বস্তাপচা সেন্টিমেন্ট আর সম্পর্ক মেনে চলিস এখনও। ওরে পাগলা, দুনিয়া অনেক এগিয়ে গেছে।
গুড নাইট গোপীদা। গুড নাইট সোনালিদি।
সুব্রত চলে যাওয়ার পর দরজাটা বন্ধ করে গোপীনাথ এসে সোনালির মুখোমুখি সোফায় বসে বলল, কী একটা সিদ্ধান্ত নিলে বলো তো! আমার দুশ্চিন্তা বাড়ল বই কমল না।
সোনালি মৃদু কঠিন গলায় বলল, চুপ করো। আমাকে ভাবতে দাও।
কী ভাবছ?
অনেক কিছু। কিন্তু সাজাতে পারছি না। এলোমলো।
গোপীনাথ সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে সোনালিকে সমর্থন করে বলল, ওটাই কঠিন, কিন্তু সাজানোটাই আসল। না সাজালে চিন্তা শুধু উদ্বেগ বাড়িয়ে তোলে। আই ক্যান হেলপ।
তোমাকে হেল্প করতে হবে না। শুয়ে ঘুমোও গে।
তুমি?
আমি রাত জাগব।
পাগল নাকি। তুমি জাগবে কেন? জাগব আমি। আমার মনটা আজ ভাল নেই। প্রাণ বাঁচাতে প্রাণের ঝুঁকি নিয়েই জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে লোকটাকে ধাক্কা দিয়েছিলাম। মরে যাবে ভাবিনি। এখন খারাপ লাগছে।
কেন খারাপ লাগবে? তুমি কোনও অন্যায় করোনি। এমনকী ওর মৃত্যুর জন্যও তুমি দায়ী নও। লোকটা মরেছে নিজের দোষে এবং ভুলে।
যাই বলল, আমার মন মানছে না। এ খেলাটা যতদিন চলবে ততদিন হয় মরো না-হয় মারো’ ব্যাপারটাই বহাল থাকবে মনে হচ্ছে। খেলাটা তাড়াতাড়ি শেষ হওয়া দরকার।
কীভাবে হবে?
আমি তো আর ওদের নিকেশ করতে পারব না। বোধহয় ওরাই মারবে আমাকে। সেটা তাড়াতাড়ি ঘটে যাক।
সোনালি ব্রুকুটি করে বলল, তাই নাকি? হাল ছেড়ে দিলে?
ছাড়িনি। হয়তো ছাড়তাম। কিন্তু তুমি এসে একটু হিসেবের গোলমাল করে দিয়েছ। ভাবতে হচ্ছে।
একটু বিষ মেশানো গলায় সোনালি বলল, আমি বুঝি তোমার গলগ্রহ? আমাকে নিয়ে ভেবো না। আমার জন্যে চিন্তা না হয় আমিই করব।
গোপীনাথ মাথা নেড়ে বলল, ওটা হল থিয়োরি। প্র্যাকটিক্যাল অন্যরকম। যে খেলাটা শুরু হয়েছে আমি সে খেলাটা একটু খেলেছি। কিন্তু তুমি আনাড়ি। তোমার খুব সাহস আছে। কিন্তু এ খেলায় সাহসের চেয়েও বেশি কিছুর দরকার হবে।
সেটা কী?
ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আর বুদ্ধি।
আমি কি নির্বোধ বলে তোমার মনে হয়?
না, তুমি বুদ্ধিমতী। কিন্তু সেই বুদ্ধি অন্য কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। বুদ্ধিটাকে এই বাঁচামরার লড়াইতে প্রয়োগ করার জন্য আবার খানিকটা এক্সারসাইজ দরকার। সময় নেবে। তাই বলি, প্রথম কয়েকটা দিন আমার পরামর্শ নাও। তাতে দু’জনেরই মঙ্গল।
কী করতে বলছ?
আজ বিশ্রাম নাও। প্রথম দিকেই যদি রাত জেগে ক্লান্ত হয়ে পড়ো তা হলে কাল আর মাথা কাজ করবে না।
আমি ঘুমোব আর তুমি জেগে থাকবে?
না, তাও নয়। আমি প্রথম রাতটা একটু চারদিকে চোখ রাখি। তোমাকে শেষরাতে ডেকে দেব। তখন তোমার পালা। তুমি টায়ার্ডও।
সোনালি বাস্তবিকই ক্লান্ত। একদিনে তার অভিজ্ঞতা অনেক হয়েছে। সে উঠল, ঠিক ডেকে দেবে?
দেব।
কোথায় ঘুমোব?
দুটো বেডরুম আছে। পাশেরটাতে শুয়ে থাকো।
বলেই চমকে উঠে গোপীনাথ বলল, না না, দাঁড়াও।
সোনালি অবাক হয়ে বলে, কী হল?
আমার বুদ্ধি মাঝে মাঝে ফেল করছে। এ বাড়ির দুটো দিকে রং করার জন্য ভারা বাঁধা হয়েছে। ওই বেডরুমটার গায়ে ভারা আছে। এদিকেরটায় নেই। তুমি আমার বেডরুমে শোও।
সোনালি একটা হাই তুলল। তারপর চলে গেল।
ঘড়িতে সাড়ে এগারোটা বাজে। আজ রাতে আর ঘটনা ঘটতে পারে বলে মনে হল গোপীনাথের, সে উঠে ফ্ল্যাটের সমস্ত বাতি নিভিয়ে দিল। টর্চ হাতে জানালাগুলোর আশেপাশে নিঃশব্দে ঘুরে বেড়াল। কেউ কোথাও নেই। দারোয়ানদের ওপর কড়া পুলিশি হুকুম জারি হয়েছে, বাইরের উটকো লোককে চট করে ঢুকতে দেবে না। ঢুকলেও যে-ফ্ল্যাটে যেতে চাইবে দারোয়ান সঙ্গে করে সেই ফ্ল্যাটের লোকের সঙ্গে মোকাবেলা করে দেবে। সেদিক দিয়ে খানিকটা নিশ্চিন্ত। তবু গোপীনাথ জানে, নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলে পৃথিবীতে কিছু নেই। ওই সামনের বাড়ির ছাত থেকে টেলিস্কোপিক রাইফেলের পাল্লার মধ্যেই সে রয়েছে।
দিন দুই আগে সে গোটা চারেক ইংরেজি থ্রিলার কিনেছে। এসব সে কোনওকালে পড়ে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, বুদ্ধিতে ধার দিতে এগুলো কিছু পড়া দরকার।
একটা টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে সে বসে গেল পড়তে।
রাত সাড়ে বারোটায় টেলিফোন বেজে উঠতেই ধক করে উঠল তার বুক। এই অসময়ে কে চায় তাকে?
সে রিসিভার তুলে নিয়েও খানিকক্ষণ অপেক্ষা করল।
মৃদুস্বরে বলল, হ্যালো।
ভয় পেলেন নাকি?
চেনা গলা। গোপীনাথ হেসে বলল, অনেকদিন বাদে যে?
হ্যাঁ। একটু ঘুরপাক খেতে হচ্ছিল। কী খবর?
ভাল নয়।
জানি। আজ আপনার ওপর একটা অ্যাটেম্পট হয়েছে তো।
হ্যাঁ। জানলেন কী করে?
আমার দুটো অপদার্থ শাকরেদ আপনার ওপর এখনও নজর রাখছে।
হ্যাঁ তারা অপদার্থই বটে। বিপদের সময়ে কাজে লাগে না।
নজর রাখাটাই কাজ। আর রক্ষা করা? সেই নিরাপত্তা কে কাকে দিতে পারে বলুন। তবে ওরা দুরবিন দিয়ে পুরো ঘটনাই দেখেছে।
দেখেছে! কী আশ্চর্য!
পালা করে ওরা আপনার ফ্ল্যাটটা নজরে রাখে।
তারা থাকে কোথায়?
কাছাকাছি একাট হাইরাইজে। সেখানে একটা ফ্ল্যাট নেওয়া হয়েছে।
ও বাবা। বেশ কোমর বেঁধে নেমেছেন দেখছি।
আপনি বেশ কৃতিত্বের সঙ্গেই লোকটাকে এলিমিনেট করেছেন শুনেছি। কংগ্রাচুলেশনস।
লোকটা কে?
তা জানি না। চেহারার বিবরণ থেকে বুঝতে পারছি ও ডিউক।
সে কে?
আপনি চিনবেন না। আন্ডারওয়ার্ল্ডের লোক।
পাজি।
ভয়ংকর। অসম্ভব সাহসীও। আপনি জোর বেঁচে গেছেন।
কিন্তু কতদিন?
যতদিন পারা যায়। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ।
অ্যাডভারসারিদের যত দেখছি তত মনে হচ্ছে আমার চান্স কম।
কম হলেও আছে। হাফ চান্স থেকেও কি গোল হয় না?
গোপীনাথ হাসল, বেশ বলেন আপনি। স্ত্রী
কে সঙ্গে রেখে কিন্তু ভাল কাজ করেননি।
গোপীনাথ বিষণ্ণ হয়ে বলে, জানি। কিন্তু শুনল না।
কেন? ইজ শি ইন লাভ উইথ ইউ ফর দি সেকেন্ড টাইম?
না। দেয়ার ওয়াজ নট ইভন এ ফাস্ট টাইম।
তা হলে?
কেউ ওকে বুঝিয়েছে আমার বিপদের দিনে ওর পাশে থাকা উচিত। সর্ট অফ আত্মত্যাগ।
কে বুঝিয়েছে? সুব্রত?
আপনি কি অন্তর্যামী নাকি মশাই?
সর্ট অফ। আজকাল সে-ই অন্তর্যামী যে ওয়েল ইনফর্মড। আমার নেটওয়ার্ক খুব ভাল।
তাই দেখছি। হ্যাঁ, কাণ্ডটা সুব্রতই করেছে।
শুনুন মশাই, আপনি একজনকে এলিমিনেট করেছেন মাত্র। বাট দেয়ার আর মোর পিপল আফটার ইউ।
অনুমান করছি।
ডোন্ট ডাই লাইক এ হিরো। র্যাদার ফাইট লাইক এ কাওয়ার্ড। বাট ডোন্ট ডাই।
বাঁচা-মরা কি আমার হাতে?
খানিকটা। এবং অনেকটা। আপনি বিশ্রাম নিতে পারেন। আমার লোকেরা আজ সারারাত আপনার ফ্ল্যাটের বাইরেটা স্ক্যান করবে। সন্দেহজনক কিছু দেখলেই আপনাকে রিং করবে ফোনে।
আর দে রিলায়েবল?
মোর অর লেস।
বাড়ির ভিতরে যদি কেউ ঢুকে থাকে?
ইয়েস দেয়ার ইজ এ পসিবিলিটি। ইউজ দা গান ইফ নিড বি।
আমি জীবনে বন্দুক পিস্তল চালাইনি। ও পারব না।
সব কিছুই একদিন শুরু করতে হয়।
আমি পারব না।
তা হলে জেগে থাকুন। আপনার ওপরতলায় একজন ভদ্রলোক থাকেন। ইউ সেন। চেনেন?
না। কাউকেই চিনি না।
তার ফোন নম্বরটা দিচ্ছি, টুকে নিন।
কেন?
দরজায় কেউ নক করলে আগে তাকে ফোন করবেন।
একে কবে প্ল্যান্ট করলেন এখানে?
আজই।
এত তাড়াতাড়ি?
ফ্ল্যাটটা খালি ছিল। ইউ সেন করিতকর্মা লোক।
ফোন করলে তিনি কী করবেন?
করবেন কিছু। নম্বরটা নিন।
নিচ্ছি।
ফোন নম্বরটা টুকে নিয়ে গোপীনাথ বলল, ধন্যবাদ।
ধন্যবাদের কিছু নেই। আপনি কারেজিয়াস ম্যান।
এটা কমপ্লিমেন্ট, না ঠাট্টা?
কোনটা মনে হয়?
ঠাট্টা।
শুনুন মশাই, আজ যা কাণ্ড ঘটেছে তাতে আপনার জায়গায় আমি থাকলেও ন্যাজ গুটিয়ে পালাতাম। অত্যধিক সাহস আছে বলেই আপনি এখনও পালাননি।
আমার পালানোর জায়গা নেই।
পালাতে চাইলে জায়গাও হয়ে যেত।
একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
করুন না।
আপনি আমার শত্রু না বন্ধু?
সুধাকর হেসে উঠল। বলল, কী মনে হয়?
কখনও শত্ৰু, কখনও বন্ধু। ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।
পারবেন। কিছুদিন অপেক্ষা করুন।
আপনি ভিকিজ মব-এর একটা শাখার প্রধান, ঠিক তো?
ঠিক।
ভিকিজ মব যে মারাত্মক গুণ্ডার দল তা সবাই জানে।
জানারই কথা।
তা হলে তো আপনি ভাল লোক নন।
সুধাকর আবার হাসল, ভাল বলে দাবি করিনি তো।
আবার আপনি ইন্টারপোলের এজেন্ট বলেও শুনি। কোনটা ঠিক?
হয়তো দুটোই ঠিক। হয়তো দুটোই ভুয়ো। আমাকে নিয়ে ভাবছেন কেন?
আপনি এখন কোথা থেকে কথা বলছেন?
রোম থেকে।
রোম?
হ্যাঁ। রোম এবং আদ্রেঁর ফ্ল্যাট থেকে।
মাই গড! আরে ফ্ল্যাট থেকে?
হ্যাঁ। আদ্রেঁর ব্যক্তিগত ডায়েরিটা খুঁজছি।
সর্বনাশ! সেটা যে আমার ভীষণ দরকার।
জানি। আদ্রেঁর পেপার্সে ডায়েরিটার রেফারে আছে।
সেটা পেয়েছেন?
এখনও নয়। ঝামেলা আছে।
কীসের ঝামেলা?
আদ্রেঁর ফ্ল্যাটে ঠিক এই মুহূর্তে দুটো লাশ পড়ে আছে। সদ্য খুন হওয়া, গা ভাল করে ঠান্ডা হয়নি।
বলেন কী?
এই নিয়ে আদ্রেঁর ফ্ল্যাটে গত দশ দিনে চারটে খুন হল।
কেন এসব হচ্ছে?
লোকে হয়তো ডায়েরিটাকে গুপ্তধনের মর্যাদা দিচ্ছে আর প্রাণ বাজি রেখে সেটা খুঁজতে আসছে।
খুনগুলো করছে কারা?
সিকিউরিটি এজেন্টরা। তারা অবশ্য খুন করছে বাধ্য হয়েই। নইলে তাদেরই খুন হতে হয়।
সিকিউরিটি এজেন্ট? সরকারি কি?
তাও বলতে পারেন।
তারা কি আপনার লোক?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুধাকর বলল, দুঃখের বিষয় তারা আমারই লোক। নিহতরা সকলেই মাফিয়া।
৩২.
সুধাকর দত্ত লোকটা অভদ্রও বটে। জরুরি কথার মাঝখানেই হঠাৎ বলে উঠল, মশাই, আর কথা নয়। দরজায় নক শুনতে পাচ্ছি। গুডবাই।
বলেই ফোনটা কট করে কেটে দিল।
গোপীনাথও ফোনটা রাখল। আদ্রেঁর ডায়েরি বিষয়ে তার আরও খানিকটা জানার ছিল। ঘটনার যা গতি ও প্রকৃতি তাতে ডায়েরিটা এখনই দরকার। সুধাকর যা বলছে তাতে মনে হয়, দুনিয়াসুদ্ধ লোক ডায়েরিটার কথা জানে এবং সবাই প্রাণ বাজি রেখে নেমে পড়েছে সেটা হাতিয়ে নিতে। ডায়েরিটা পাওয়া না গেলে আদ্রেঁর অসমাপ্ত কাজ সম্পূর্ণ করা বোধহয় কঠিন হবে।
ইউ সেন লোকটা কে তাও বুঝতে পারছে না গোপীনাথ। সে ফোনটা তুলে নম্বরটা ডায়াল করল। একবার রিং হতে না হতেই কে যেন ফোনটা তুলে নিল। একটা অত্যন্ত ভারী ও গম্ভীর গলা বলল, বলুন।
আপনি কি ইউ সেন?
হ্যাঁ।
পুরো নামটা কী?
উমাপদ সেন।
আমার বিপদ ঘটলে আপনাকে টেলিফোন করার হুকুম হয়েছে।
আপনার কি এখন কোনও বিপদ ঘটেছে?
না। আমি শুধু ব্যাপারটা যাচাই করছিলাম।
ও
আপনি কি সুধাকর দত্তর লোক?
তাও বলতে পারে।
কী করেন?
এই টুকটাক।
তার মানে, বলতে চান না?
লোকটা চুপ করে রইল।
গোপীনাথ বলল, আমার জানা দরকার আমি বিপদে পড়লে আমাকে রক্ষা করার মতো যথেষ্ট দক্ষতা আপনার আছে কি না।
উমাপদ বলল, গ্যারান্টি দেওয়া যায় না। তবে যোগ্যতা বা দক্ষতার ব্যাপারে চিন্তা করবেন না। আমি প্রফেশনাল।
আপনার প্রফেশনটা কী সেটাই জানতে চাইছি।
ধরুন সিকিউরিটি গার্ড।
আপনি কি ব্ল্যাক ক্যাট বা কম্যান্ডো ট্রেনিং নিয়েছেন?
তার চেয়েও বেশি। ট্রেনিং নিয়ে ভাববেন না।
আপনার সঙ্গে আমার দেখা হওয়া দরকার। যদি আমার ফ্ল্যাটে চলে আসেন তা হলে উই মে হ্যাভ কফি টুগেদার। কথাও হবে।
সেটা খুব ওয়াইজ ডিসিশন হবে না মিস্টার বোস।
কেন?
কারণ ইউ আর আন্ডার অবজার্ভেশন। আমাকে আপনার সঙ্গে দেখা গেলে দি ক্যাট উইল বি আউট অফ দি ব্যাগ। দেখা করার দরকার নেই। আমি আপনাকে চিনি।
কিন্তু আমি আপনাকে চিনি না।
তার দরকার নেই। আমাকে চিনে গেলে আপনার বরং অসুবিধেই হবে।
সুধাকর দত্ত সম্পর্কে আমাকে কিছু বলবেন?
কী জানতে চান?
লোকটা আসলে কে?
উনি নিশ্চয়ই আপনাকে বলেছেন।
যা বলেছেন তা থেকে কিছুই বোঝা যায় না।
বুঝবার দরকার নেই। উনি তো আপনাকে সাহায্যই করছেন।
তা করছেন। কিন্তু সেটা তো স্বার্থের খাতিরে শত্রুও করে।
শত্রুতা করার আগেই শত্রু বলে ধরে নিচ্ছেন কেন?
আমাকে তো উনি বিনা স্বার্থে রক্ষা করছেন না।
না। স্বার্থ তো থাকতেই পারে। স্বার্থ ছাড়া দুনিয়ায় কিছুই ঘটে না।
আপনি সুধাকর সম্পর্কে আরও একটু স্পেসিফিক হতে পারেন কি?
আমি সামান্যই জানি ওঁকে।
গোপীনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, না মশাই, আপনার সঙ্গে কথা বলা মানে একটা টেপ রেকর্ডারের সঙ্গে কথা বলা। যা শেখানো হয়েছে তা ছাড়া আর কিছুই বলবেন না তো!
কথা কম না বললে এই পেশায় টিকে থাকা কঠিন।
আমার ভয় হচ্ছে আমাকে কেন্দ্র করে আরও কিছু খুনখারাপি হবে। আপনি কি জানেন যে, আজ আমার হাতেও…
জানি, জানি। আপনাকে বলতে হবে না। আপনি এখন রেস্ট নিন। গুড নাইট। আর শুনুন ফ্ল্যাটের সব বাতি নিভিয়ে রাখবেন প্লিজ।
এ লোকটাও অভদ্রের মতো কথার মাঝখানে ফোন কেটে দিল।
গোপীনাথ অন্ধকারে বসে তার ঘড়ি দেখল। জ্বলজ্বলে ডায়ালে রাত সাড়ে তিনটে বাজে।
টর্চ নিয়ে সে উঠল। শোয়ার ঘরের দরজা খোলা রেখেই সোনালি ঘুমিয়েছে। এরকমটা হওয়ার কথা নয়। আইনত এবং বিধিমতো তারা এখন সম্পর্কহীন দু’জন যুবক-যুবতী। সোনালির এ কাজটা উচিত হয়নি। আবার হয়তো অন্যদিক দিয়ে দরজা খোলা রাখার দরকার ছিল। বিপদ ঘটলে পরস্পরের কাছে দ্রুত পৌঁছোনোর সুবিধে। দ্বিধাগ্রস্ত পায়ে দরজার ফ্রেমে দাঁড়িয়ে অনিচ্ছুক হাতে টর্চটা বিছানায় ফেলল সে। কিন্তু বিছানায় সোনালি নেই।
অবাক হয়ে গোপীনাথ টর্চটা এধারে ওধারে ঘুরিয়ে ফেলে দেখল। বাথরুমের দরজা সামান্য ফাঁক এবং ভিতরে অন্ধকার।
অনুচ্চ কণ্ঠে গোপীনাথ ডাকল, সোনালি!
কোনও জবাব নেই।
গোপীনাথের বুকটা বিনা কারণেই ধক করে উঠল। কোথায় গেল সোনালি। সে ঘরটা আর একবার ভাল করে দেখে পাশের শোয়ার ঘরে যাওয়ার দরজাটা খুলে টর্চ ফোকাস করতেই সোনালিকে দেখতে পেল। একটা কালো চাপা প্যান্ট আর কালচে কামিজ পরা সোনালি জানালা দিয়ে একটু ঝুঁকে বাইরে কিছু দেখছে।
সোনালি, কী করছ?
সোনালি শরীরের উর্ধ্বাংশ ভিতরে নিয়ে এসে তার দিকে চেয়ে বলল, ঘুম আসেনি। চারদিকটা দেখছি।
গোপীনাথ উদ্বেগের গলায় বলল, ডু ইউ নো দ্যাট ইউ আর কমপ্লিটলি এক্সপোজড টু আউটার ডেনজারস?
কীভাবে?
আশেপাশে হাইরাইজের অভাব নেই। ইচ্ছে করলেই টেলিস্কোপিক রাইফেলে ছিঁড়ে ফেলতে পারে তোমাকে।
কিছু হবে না। অত চিন্তা কোরো না তো।
এ ঘরে এসো সোনালি। ঘুমোও।
আমার ঘুমের কোটা ফুরিয়েছে। এবার তুমি ঘুমোও।
আর তুমি?
আমি পাহারা দেব। গোপীনাথ হতাশায় মাথা নেড়ে বলে, তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না। বড্ড হেডস্ট্রং তো তুমি। বলেছি না, ঠিকমতো না ঘুমোলে তুমি পাহারাটাও ঠিকমতো দিতে পারবে না। অসময়ে ঘুম পেয়ে যাবে। ক্লান্ত লাগবে, দুর্বল লাগবে।
ঘুম না এলে কী করব?
ইউ আর এ প্রবলেম। এমনিতেই আমার সমস্যার অভাব নেই। তার ওপর তুমি!
সোনালি বলল, ফোনে তুমি দু’জনের সঙ্গে কথা বলেছ। একটা কল এসেছিল রোম থেকে। আর একটা কল তুমি করেছ। লোকটা কে?
গোপীনাথ একটু অসন্তোষের গলায় বলল, আড়ি পেতেছিলে নাকি?
আড়ি পাততে হয়নি। স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল।
ও
কফি খাবে?
খাব। কিন্তু তোমাকে কষ্ট করতে হবে না।
কষ্টের কী?
বাকি রাতটা কি জেগেই কাটাবে?
আজ রাতে আমার ঘুম আসবে না।
এরকম করলে কাল তুমি বরং বাড়ি ফিরে যাও। তোমার জন্য আমার বাড়তি টেনশন হচ্ছে।
আমি বাড়ি যাব না।
এটা আমার ওপর জুলুম করা হচ্ছে। লেট মি ফাইট মাই ওন ওয়ার।
তুমি তো একা লড়াই করছ না। তোমাকে অন্যের সাহায্য নিতে হচ্ছে। তা
হচ্ছে। কিন্তু তুমি তো সাহায্যকারী নও। বরং বাধা সৃষ্টি করছ।
বিপ্লবীর জুতো যদি কেউ সেলাই করে দেয় তা হলে সেও বিপ্লবে সাহায্যই করে।
তার মানে?
আই ক্যান হেলপ ইন স্মল ওয়েজ।
কীভাবে?
আই ক্যান মেক দি কফি।
মাই গড। ইউ আর ইমপসিবল।
সোনালি রঙ্গরসিকতার মেয়ে নয়। সে সিরিয়াস টাইপের। এরকম কথাবার্তা সে সহ্যও করতে পারে না। তবু এখন সয়ে নিল।
দশ মিনিট বাদে দু’কাপ কফি নিয়ে দুটো যুযুধান বেড়ালের মতো বাইরের ঘরে মুখোমুখি বসল তারা। ঘরে একটা ফুট লাইট জ্বলছে মাত্র। তার আলোর আভায় দু’জনে দু’জনকে আবছা দেখতে পাচ্ছে মাত্র।
গোপীনাথ হঠাৎ নরম গলায় বলল, গো হোম সোনালি। কাল সকালেই লিভ মি অ্যালোন।
যাব কি যাব না সেই সিদ্ধান্ত আমিই নেব। তোমার হুকুমে নয়।
ইউ আর নট বিয়িং অফ এনি হেলপ।
সেটা তোমার
সোনালি কথাটা শেষ করার আগেই ঝনঝন করে কাঁচ ভাঙার বিকট শব্দের সঙ্গে তীব্র শিস দেওয়ার শব্দ তুলে একটা বুলেট ঘরের ভিতর ছুটে এল।
চেয়ার সমেত উলটে পড়ল গোপীনাথ। কয়েক সেকেন্ডের বিহুলতা থেকে সে চকিত পায়ে উঠে দাঁড়াল।
সোনালি!
সোনালি জায়গায় নেই। কফির কাপটা রয়েছে শুধু।
গোপীনাথের বাঁ দিকটা রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। না, সম্পূর্ণ বেঁচে যায়নি সে। বাঁ কাধ ফুঁড়ে বুলেটটা গেছে। সামনে থেকে পিছনের দিকে। সামান্য কৌণিক হেরফেরে তার গলার নলি ছিঁড়ে বেরিয়ে যেতে পারত।
আশ্চর্য এই, গোপীনাথের ভয় যেন আরও কমে গেল। মাথা যেন আরও শীতল হয়ে কম্পিউটারের মতো কাজ করতে লাগল। প্রথমেই সে ফুটলাইটটা নিভিয়ে দিল। বাঁ দিকের জামা ক্রমে ভিজে যাচ্ছে আরও। গোপীনাথ বাঁ হাতটা তুলল। তুলতে পারছে এখনও। হাড় ভাঙেনি। ক্ষত শুধু কাঁধের পেশিতেই বলে মনে হচ্ছে।
সোনালি।
অন্ধকারে সোনালি চকিত পায়ে এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়াল।
কোথায় গিয়েছিলে?
জানালায়। ওই হলুদ বাড়িটার ছাদ থেকে গুলি চালিয়েছে।
দেখেছ?
হ্যাঁ। একটা লোক। তার হাতে রাইফেল। আবছা।
দেখেও জানালায় দাঁড়িয়ে ছিলে?
বাড়িটা চিনে রাখার দরকার ছিল। এখন চুপ করো।
গোপীনাথ একটা শ্বাস ফেলল।
হঠাৎ সোনালি বলল, তোমার কী হয়েছে বলো তো।
নাথিং মাচ।
তার মানে? তোমার জামা…মাই গড! কী হয়েছে? গুলি লেগেছে নাকি?
চেঁচামেচি কোরো না। সামান্য চোট।
সামান্য। সামান্য। ইউ আর ব্লিডিং লাইক হেল। কোথায় লেগেছে?
কাঁধের চামড়া ঘষে চলে গেছে। সিরিয়াস নয়।
সোনালি দৌড়ে শোয়ার ঘরে গিয়ে অ্যান্টিসেপ্টিক ওষুধ আর ব্যান্ডেজ নিয়ে এল। বলল, ড্রেসিং করতে হলে বাতি জ্বালতেই হবে। আমি উন্ডটাও দেখতে চাই।
অবসন্ন গোপীনাথ জামাটা খুলে ফেলে সেটা দিয়েই ক্ষতস্থান চাপা দিয়ে বলল, যা খুশি করো। আজ রাতে আর হামলা হবে বলে মনে হয় না।
বাতি জ্বেলে অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে সোনালি তার ক্ষতস্থানে ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ বাঁধল। বলল, ডিপ হয়ে কেটেছে। ডাক্তার ডাকতেই হবে।
কাল সকালে দেখা যাবে।
চলো, শুয়ে থাকবে।
গোপীনাথ উঠতে যাচ্ছিল। ফোন বেজে উঠতেই ফোনটা ধরল।
ভারী গম্ভীর গলাটা বলল, সরি মিস্টার বোস। এই অ্যাটাকটার জন্য কিছু করার ছিল।
জানি। আমি কিছু মনে করিনি।
আমি কি আসব? আর ইউ ফিট?
গুলিটা কাঁধে লেগে বেরিয়ে গেছে। চিন্তা করবেন না, আমার স্ত্রী আমাকে অ্যাটেন্ড করছেন।
সরি মিস্টার বোস।
ডোন্ট বদার। এরকম তো হতেই পারে।
একটা কথা বলব?
বলুন।
ইউ আর অ্যান এক্সট্রিমলি কারেজিয়াস ম্যান।
গোপীনাথ একটু হাসল। বলল, মরিয়ার সাহস। ওটাও তেমন ইম্পর্ট্যান্ট কিছু নয়।
কাল সকাল আটটায় একজন ডাক্তার আপনাকে দেখতে আসবেন। ডা. বিনয় দাশগুপ্ত। খুব নামকরা ডাক্তার।
এত তাড়াতাড়ি ডাক্তার ঠিক করে ফেললেন?
করাই ছিল। আপনার যে-কোনও ইভেনচুয়ালিটির জন্য। পেন কিলার বা কিছু লাগবে?
না। সহ্য করা যাবে।
বাই দেন।
বাই।
সোনালি তাকে দাঁড় করিয়ে বলল, আমার কাঁধে ভর দেবে?
দরকার নেই। সব ঠিক আছে।
অনেকটা রক্ত গেছে। তোমার দুর্বল লাগার কথা।
লাগছে না। আমার হয়তো বাড়তি রক্ত আছে।
তাকে শোয়ার ঘরে এনে শোয়াল সোনালি। জানালার পরদাগুলো ভাল করে টেনে দিয়ে বলল, কাঁচের জানলা খুব বাজে জিনিস।
হ্যাঁ। ফুটলাইট জ্বালানো আমার উচিত হয়নি। ওই আলোতে আমাদের দেখতে পেয়েছে।
এখন তুমি ঘুমোও দয়া করে।
আর তুমি?
আমাকে নিয়ে ভেবো না।
ভাবতে চাইছে কে? ভাবিয়ে তুলছ বলেই ভাবছি।
শোনো, আমি তোমার স্ত্রী নই।
নও-ই তো। হঠাৎ কথাটা উঠছে কেন?
ফোনে কাকে যেন বললে, আমার স্ত্রী আমাকে অ্যাটেন্ড করছেন। কেন বললে।
আত্মরক্ষার্থে বলা। ঘরে বয়সের একজন স্ত্রীলোক, তার একটা লজিক্যাল কারণ থাকবে ত।
সেইজন্যই বললে?
হ্যাঁ।
সত্যি কথাটাই বললে পারতে। ওরা বোধহয় সবই জানে।
তাও ঠিক।
এবার ঘুমোও। ঘুমের ওষুধ খাবে?
না। আমার ঘুম আসবে এমনিতেই। টেনশন নেই।
তুমি খুব ঠান্ডা রক্তের মানুষ।
কেন বলো তো?
গুলি খেলে, অথচ নির্বিকার।
মে বি আই অ্যাম ইকুয়ালি ডেনজারাস।
৩৩.
সুপ্রভাত রোজমারি।
জো। তোমার কী খবর? কই কারখানা দেখতে এলে না তো।
একটা ছোট্ট বাধা হয়েছে।
রোজমারি একটু নিশ্চিন্ত হল। জো তার দলবল নিয়ে কারখানা দেখতে আসুক এটা সে চাইছে না মনেপ্রাণে। সে একটা খাস মোচন করে বলল, তাই বলল। কীসের বাধা?
আমার একজন সঙ্গী মারা গেছে।
একটু অবাক হয়ে রোজমারি বলে, তাই বুঝি? কী করে মারা গেল?
খুব ভাল জানি না। তবে যতদূর মনে হচ্ছে তার হন্তা স্বয়ং গোপীনাথ বসু।
জীবনে এমন অবাক কমই হয়েছে রোজমারি। বলল, গোপীনাথ বসু খুন করেছে?
হ্যাঁ, তাও আবার একজন পেশাদার খুনিকে।
কীভাবে?
আমার কথা রেকর্ড করছ না তো!
না না! কী যে বলো।
তা হলে বলতে পারি। ডিউক একজন পেশাদার খুনি। হাই রেটিং। সে পৃথিবীর সব বড় বড় শহরে খুন করে এসেছে। এ ব্যাপারে তার প্রতিভা ছিল প্রবাদের মতো। তার ব্যর্থতার কথা শোনাই যায় না।
রোজমারি আর একটা স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল। গোপীনাথ অন্তত একটা খুনিকে সরিয়েছে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।
তারপর বলো।
গোপীনাথের ডেরাটা আমরা খুঁজে বের করেছি। দেখলাম গোপীনাথ যেন বিপদকে নেমন্তন্নের চিঠি দিয়ে বসে আছে। তার বাড়ির দু’দিকে রং করার জন্য বাঁশের সিঁড়ি তৈরি হয়েছে। ডিউক বলল, তার নিউ ইয়র্কে ফিরে যাওয়ার তাড়া আছে, গতকাল বিকেলের প্লেন ধরবে। তাই সে দুপুরেই কাজ হাসিল করবে বলে বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল। গুলিও চালিয়েছিল। আমরা দুরবিন দিয়ে দেখেছি। কিন্তু গোপীনাথ দৌড়ে এসে ওকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়।
ব্যস?
হ্যাঁ, ব্যস। খুব সাদামাটা ব্যাপার না?
এত প্রতিভাবান খুনিকে এনেও হল না?
না, কিন্তু শোনো রোজমারি গোপীনাথকে মারতে আমরা শুধু আসিনি। আরও লোক এসেছে। কাল মধ্যরাতে তার ওপর আরও একটা অ্যাটাক হয়। এবার সে বেঁচে যায়নি।
সর্বনাশ! কী হয়েছে লোকটার? মারা গেছে?
না। লোকটার বেড়ালের প্রাণ। আহত বটে, তবে বেঁচে আছে।
সত্যি কথা বলো।
সত্যিই বলছি। তুমি কি বিশ্বাস করবে যে, রাতে গুলি খেয়েও লোকটা আজ ভোর পাঁচটায় কাছাকাছি একটা বাড়ির ছাদে গিয়ে উঠেছিল?
কেন?
ওই বাড়ি থেকে তাকে গুলি করা হয়। টেলিস্কোপিক রাইফেলে। ছাদে সম্ভবত একটা বুলেটের খোল ছাড়া কিছু পায়নি সে।
জো, এটা কারা করেছে?
তা জানি না, আমরা বিদেশি। এদেশে এত তাড়াতাড়ি তথ্য সংগ্রহ করা অসম্ভব। আরও কথা আছে।
কী কথা জো?
গোপীনাথ বসুর সঙ্গে একজন মহিলা আছেন। খুব সুন্দরী। সে কে জানো?
না তো!
কে হতে পারে?
কী করে বলব?
আমরা জানতে চাই মহিলাটি কি ওর নিরাপত্তারক্ষী?
এসব আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন জো? আমি তো এখনও গোপীনাথের কলকাতার ঠিকানাটাও জানি না।
ঠিকানা জানলেও লাভ নেই। তুমি গোপীনাথকে বাঁচাতে পারবে না। সে এখন ঘোর বিপদে। কাল মধ্যরাতে যে বা যারা তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় তারাও পেশাদার।
জো তোমাকে একটা কথা বলব?
বলো।
তোমরা আর চেষ্টা কোরো না। গোপীনাথকে ছেড়ে দাও।
রোজামারি, মানুষ মেরে কি আমার আনন্দ হয় বলে তোমার ধারণা? তা নয়। আমরা যাদের হয়ে কাজ করি তাদের হুকুম তামিল করা ছাড়া আমাদের অন্য উপায় নেই।
তুমি কি এতটাই খারাপ হয়ে গেছ জো?
কোনটা খারাপ, কোনটা ভাল, সেটাই তো এখন বিতর্কের বিষয়। পুরনো সব ধারণাকে নতুন করে নেড়েচেড়ে দেখা হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে সারভাইভ্যালের শর্ত পূরণ করতে গেলে আমাদের পুরনো ধারণা বর্জন করতেই হবে। এটা হল বৌদ্ধিক যুগ, বুদ্ধি যার যত বেশি সে তত ভাল ভাবে বাঁচে। নৈতিকতার কানাকড়ি দাম নেই।
বক্তৃতা দিয়ো না জো। তুমি যা বলছ তা তুমি নিজেও বিশ্বাস করো না।
আগে করতাম না। আজকাল আমার মগজধোলাই হয়ে গেছে। শোনো রোজমারি, আমার ইচ্ছে-অনিচ্ছের কোনও দাম নেই। যে কাজের ভার আমাদের দেওয়া হয়েছে, তা শেষ করতেই হবে। নইলে বিপদ।
তার মানে তুমি আবার চেষ্টা করবে?
এখনই নয়। কারণ ডিউকের আকস্মিক মৃত্যুতে আমাদের কর্মসূচি ওলটপালট হয়ে গেছে।
কীরকম?
পুলিশ ডিউককে ট্রেস করতে করতে আমাদের খুঁজে বের করবেই। তারপর আমরা পড়ে যাব সাংঘাতিক জটিলতায়। সুতরাং ডিউক মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে বিকেলেরই একটা ফ্লাইট ধরে কলকাতা থেকে পালিয়েছি।
কোথায় পালালে?
আপাতত আমস্টারডামে।
এত তাড়াতাড়ি?
এসব কাজে সময় একটা মস্ত বড় জিনিস।
রোজমারি গভীর একটা শ্বাস ফেলে বলল, তুমি তা হলে কলকাতায় নেই।
না রোজমারি। খুনটা করার পরই আমাদের বিকেলের ফ্লাইট ধরার কথা ছিল। আমরা সেই ফ্লাইটটাই ধরেছি। তবে আমাকে আবার খুব শিগগিরই দেখতে পাবে কলকাতায়।
তুমি ফিরে আসবে!
আসতেই হবে। তবে অন্য নামে, অন্য পাসপোর্টে। সঙ্গে থাকবে আর একজন খুনি, যদি ততদিনে গোপীনাথ আর কারও হাতে খুন হয়ে যায়।
খুন হলে?
তাও আসব। তোমার কারখানার বিষয়ে আমাদের কৌতূহল তো শেষ হয়নি।
শোনো জো ক্লাইন, তোমাদের ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে, আমাদের কারখানাটা বিক্রিই করে দিতে হবে। অনেক খদ্দের ঘোরাঘুরি করছে। বেচে দিয়ে আমি আর মনোজ ফের জার্মানিতেই ফিরে যাব।
সেটা বোকার মতো কাজ হবে রোজমারি। তোমার ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যালয় যে একদিন কোটি কোটি ডলার রোজগার করবে এটা তোমার জানা উচিত।
আমার টাকার দরকার নেই। দরকার শান্তিতে বেঁচে থাকার।
তাই কি রোজমারি? তুমি কি শান্তি সত্যিই ভালবাসো?
রোজমারি একটু চুপ করে থেকে বলল, তুমি নিশ্চয়ই আমার অতীত নিয়ে ফের কথা শুরু করবে না।
না। তবে রোজমারি সম্পর্কে আমার একটা পরিষ্কার ধারণা আর হিসেবনিকেশ আছে। সেটা ভুলে যেয়ো না।
কী চাও জো?
চাই, অদূর ভবিষ্যতে আমি গেলে আমাকে সাহায্য কোরো।
তুমি কবে আসবে?
হয়তো পরশু বা তার পরের দিন।
এত তাড়াতাড়ি?
এ কাজে দেরি করা সম্ভব নয়।
ফোন রেখে দিল জো। রোজমারি কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে হঠাৎ ফের ফোনটা তুলে নিল।
মনোজ।
বলো
সোনালি কি আজ অফিসে এসেছে?
না। কেন বলো তো!
কোনও খবর দিয়েছে?
হ্যাঁ, ফোন করে জানিয়েছে কী যেন জরুরি কাজ, আসতে পারবে না।
তোমার ঘরে কেউ আছে?
হ্যাঁ।
আধঘণ্টা পর আমি যাচ্ছি তোমার ঘরে। ফ্রি থেকো।
ঠিক আছে।
আধঘণ্টা চুপচাপ বসে রইল রোজমারি। ভাবল আর ভাবল। তারপর উঠে ধীর পায়ে করিডর পেরিয়ে লন এবং লন পেরিয়ে মেন বিল্ডিং-এ ঢুকে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠল। সরাসরি মনোজের ঘরে না গিয়ে সে গিয়ে ঢুকল সোনালির ঘরে।
সাজানো ছোট্ট অফিসঘর। কম্পিউটার থেকে শুরু করে সব কিছুই খুব পরিচ্ছন্ন হাতে গুছিয়ে রাখা। রোজমারি সোনালির টেবিলটা একটু ঘটল।
সোনালির চেয়ারে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল রোজমারি। বাঙালিরা খুব রোম্যান্টিক জাত। এরা সহজে সম্পর্ক কেটে ফেলতে পারে না। মূল্যবোধ বা আবেগ একটু বেশিই বোধহয়। সোনালি না হলে কেনই বা গোপীনাথকে সঙ্গ দিচ্ছে? জো ক্লাইন গোপীনাথের যে সুন্দরী সঙ্গিনীর কথা বলেছিল তা যে সোনালি ছাড়া কেউ নয়, এ ব্যাপারে তার সন্দেহ নেই। ব্যাপারটা তার খারাপ লাগছে না। এরকমও হয় তা হলে। রোজমারি আপন মনেই। একটু হাসল।
তারপর উঠে পাশের দরজা দিয়ে মনোজের ঘরে ঢুকল সে।
মনোজ তার জন্যই অপেক্ষা করছিল। বলল, কী ব্যাপার?
গোপীনাথের ওপর কাল দু-দু’বার হামলা হয়েছে। দু’বারই রাইফেল চালানো হয় তার ঘরে। সে চোট পেয়েছে।
মনোজ অবাক হয়ে বলল, কী করে জানলে?
জানলাম। সূত্র বলা যাবে না।
মাথা নেড়ে মনোজ বলল, গোপীনাথ ইজ এ লস্ট কেস।
হাল ছেড়ে দিচ্ছ কেন? গোপীনাথ ইজ এ গুড সারভাইভার।
মনোজ মাথা নেড়ে বলে, ওটা কোনও ভরসার কথা নয়।
শোনো, আমার খবর আছে, সোনালি এখন গোপীনাথের কাছে রয়েছে।
বটে! বলে মনোজ খুব বিস্ময় প্রকাশ করল।
গোপীনাথকে বাঁচানোর একটা চেষ্টা আমাদের করতেই হবে।
কীভাবে?
তুমি ওর ঠিকানাটা সুব্রতর কাছ থেকে আদায় করো। তারপর চলল, তার সঙ্গে কথা বলি। সবাই মিলে একটা কিছু ঠিক করা যাবে।
কিন্তু তার আগে প্রশ্ন, গোপীনাথ পুলিশের সাহায্য নিচ্ছে না কেন?
বুদ্ধিমান বলেই নিচ্ছে না। পুলিশ তার প্রোটেকশনের কোনও ব্যবস্থা করতে পারবে বলে তোমার মনে হয়? তুমি সুব্রতকে ডাকো।
মনোজ কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থেকে ফোন তুলে সুব্রতকে ডাকল।
সুব্রতর এসে হাজির হতে পাঁচ মিনিটও লাগল না।
বলুন স্যার।
সুব্রত, বিনা ভূমিকায় বলছি, তুমি কি গোপীনাথের ওপর লেটেস্ট হামলার কথা জানো?
সুব্রত গম্ভীর হয়ে বলল, জানি। কাল দুপুরে এবং মধ্যরাতে দু’বার অ্যাটাক হয়েছে।
গোপীনাথ ইজ এ স্টাবোর্ন পার্সন। আমরা তার সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই।
সুব্রত কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ইট ডিপেন্ডস অন হিম। উনি চাইলেই সেটা সম্ভব।
মনোজ ফোনটা দেখিয়ে দিয়ে বলল, টক টু হিম, প্লিজ!
রোজমারি বাধা দিয়ে বলল, না, আমাদের সামনে নয়। আপনি বরং সোনালির ঘরে যান। ওখান থেকে ফোনটা করুন।
সুব্রত গেল। দু’মিনিট বাদে ফিরে এসে বলল, ইটস ও কে স্যার। এখন তিনটে বাজে। আমাদের চারটের মধ্যে পৌঁছুতে হবে।
.
গোপীনাথের ফ্ল্যাটের সব জানালায় মোটা পরদা টানা। ঘরগুলো প্রায় অন্ধকার। ব্যবস্থাটা করেছে সোনালি। পরদাগুলো ছিল একটা ডিভানের খোলের মধ্যে। সেগুলো বের করে পেলমেটের রডে ভরে এত বড় ফ্ল্যাটে সব কটা জানালা ঢাকা দিতে প্রচণ্ড পরিশ্রম গেছে। তার। শুধু তাই নয়, অবাধ্য ও চঞ্চলমতি গোপীনাথকে সামলাতেও হিমশিম খেয়েছে সে। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই গোপীনাথ চুপিসারে বেরিয়ে যায়। সোনালি সাড়ে ছ’টায় উঠে তাকে খুঁজে না পেয়ে ভীষণ ঘাবড়ে দারোয়ানের কাছে গিয়ে খোঁজ নেয়। তারা জানায় গোপীনাথ ভোর পাঁচটা নাগাদ বেরিয়ে গেছে। সোনালির তখন রাগে হাত-পা নিশপিশ করছিল লোকটার আক্কেল দেখে। যখন চারদিক থেকে টেলিস্কোপিক রাইফেল আর খুনির চোখ ওকে তাক করছে তখন পাগলটা এমন ন্যালাখ্যাপার মতো বেরিয়ে যায় কোন সাহসে?
যাই হোক, দুশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়ে সাড়ে সাতটা নাগাদ গোপীনাথ ফিরল। হাতে বাজারের থলি।
সোনালি রাগে ফেটে পড়ল, কোথায় গিয়েছিলে তুমি?
শান্ত গলায় গোপীনাথ বলল, ক্যাটারারের রান্না বড্ড একঘেয়ে লাগছে। বড্ড রিচও। ভাবছি আজ থেকে আমরা রান্না করে খাব।
চোখ কপালে তুলে সোনালি বলল, সেইজন্য তুমি বাজারে গিয়েছিলে? কেন, বাজার তো আমিও করতে পারতাম।
গোপীনাথ তখন পকেট থেকে একটা কার্তুজের খোল বের করে হাতের তেলোয় মেলে ধরল সোনালির চোখের সামনে। বলল, এটার জন্যও।
কী ওটা?
কার্তুজের খোল। ওই হলুদ বাড়িটার ছাদে পেলাম।
সোনালি বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল। তারপর বলল, তুমি একা গিয়ে ওবাড়ির ছাদে উঠেছিলে?
গোপীনাথ হেসে বলল, ইজি। ওটা একটা থার্ড গ্রেড ভাড়াটে বাড়ি। উঠে গেলাম, কেউ বাধা দিল না।
ধন্যি তোমাকে।
ঘণ্টাখানেক তাদের কথা বন্ধ ছিল। কথা চালু হল, বেলা ন’টায় দু’কাপ গরম কফি সহযোগে। খুব সতর্কতার সঙ্গে।
ব্যথাটা কেমন আছে?
নেই তেমন।
ডাক্তার আসবে। তৈরি থেকো।
হ্যাঁ। আমি আজ রান্না করব।
বাঃ। খুব আহ্লাদ দেখছি।
কিছু করতে ইচ্ছে করছে।
করার অনেক কিছু আছে।
কী করব বলল তো।
সোনালি হাই তুলে বলল, ঘুমোও।
ঘুমোব। এখন ঘুমোব কেন?
তোমার বিশ্রাম দরকার। অনেক ধকল গেছে।
দুর। এসব ঘটনা আমি গায়ে মাখছি না।
যখন ডোরবেল বাজল, অর্থাৎ আরও আধঘণ্টা পর, তখন দরজাটা খুলতে একটু দেরি হল তাদের। কারণ ঘনবদ্ধ আলিঙ্গন ও চুম্বন থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হতে পারছিল না কিছুতেই।
৩৪.
ডোরবেল বেজেই যাচ্ছিল। কিন্তু তারা তবু কেউ উঠল না।
সোনালি গোপীনাথের কপাল থেকে কয়েক গুছি চুল হাত দিয়ে সরিয়ে বলল, ডোরবেল বাজছে, কানে যাচ্ছে না বুঝি?
বাজুক।
সোনালি হাসল, যদি জরুরি দরকারে কেউ এসে থাকে?
ফিরে যাক।
কাছাকাছি, বড্ড কাছাকাছি তাদের মুখ, পরস্পরের শ্বাস মিশে যাচ্ছে পরস্পরের সঙ্গে।
গোপীনাথ রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, বলতে গেলে এটাই আমাদের প্রথম প্রেম। তাই না?
তোমার প্রথম, কিন্তু আমার নয়। আমি সেই কবেই তোমাকে ভালবেসে মরেছিলাম। বিয়ের রাতে।
একটু লজ্জা পেয়ে গোপীনাথ বলল, আমি তখন বাডিং সায়েন্টিস্ট। মাথায় যে কত দুশ্চিন্তা। বিয়েটাকে তখন মনে হয়েছিল একটা বাড়তি দায়িত্ব। তোমার মনে আছে বিয়ের পর বউভাতের রাতেই আমাকে জেনেভার প্লেন ধরতে হয়েছিল?
থাকবে না? যা রাগ হয়েছিল।
তখন ওরকমই ছিল আমার জীবন এবং মনোভাবও। হাইলি কম্পিটিটিভ দুনিয়া আর সেই সঙ্গে আমার জেদ। কিন্তু এখন আমি অন্যরকম লোক, না?
মনে তো হচ্ছে।
ডোরবেল থেমে গেছে। দু’জনে দু’জনের দিকে পলকহীন চেয়ে বসে রইল। দুনিয়া মুছে গেছে। বিপদ-আপদ, জীবন-মৃত্যুর প্রশ্নও থেমে আছে একটু দূরে।
এবার ডোরবেল নয়, টেলিফোন বাজল। টেলিফোনটাকেও উপেক্ষা করল তারা। সোনালির ঠোঁট থেকে ঠোঁট সরিয়ে গোপীনাথ বলল, কারা এমন বেরসিক বলো তো!
সোনালি অলস বিহুল গলায় বলল, ওরা কাজের লোক।
আমাদের কি আজ আর কিছু করা উচিত?
সোনালি হাসল। তারপর গোপীনাথের দু’খানা হাতের বন্ধন থেকে নিজেকে নরমভাবে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, আমি তো আর পালিয়ে যাচ্ছি না। দাঁড়াও, দেখি কার এত জরুরি দরকার।
টেলিফোন কানে তুলতেই একটা মোলায়েম গলা বলল, এনজয়িং দি লাইফ?
সামান্য হাসিরও শব্দ হল। গা জ্বলে গেল সোনালির। বলল, কে বলুন তো আপনি!
একবার পরিচয় হয়েছিল। আমার নাম সুধাকর দত্ত।
সোনালি একটু থমকে গিয়েছিল। বলল, ও। কী ব্যাপার?
কেমন আছেন বলুন।
ভালই।
আপনি বেশ বুদ্ধিমতী। ঘরের জানালাগুলো মোটা পরদায় ঢেকে দিয়ে ভাল কাজ করেছেন। গোপীনাথবাবু এতটা কেয়ারফুল নন।
উনি তো ভাবনাচিন্তা বেশি করেন।
আপনাদের কি তা হলে ভাব হয়ে গেল? কংগ্রাচুলেশনস।
ধন্যবাদ।
গোপীনাথবাবুকে বলবেন, ডায়েরিটা উদ্ধার করা গেছে।
আপনি ওঁর সঙ্গেই কথা বলুন না।
দিন তা হলে, ইফ হি ইজ নট টেরিবলি বিজি ওয়াইপিং লিপস্টিক ফ্রম হিজ লিপস।
একটু রাঙা হয়ে সোনালি বলল, আমি লিপস্টিক মাখি না। আপনি খুব অসভ্য লোক।
বলেই টেলিফোনটা গোপীনাথের বাড়ানো হাতে ধরিয়ে দিয়ে সোনালি চাপা গলায় বলল, কী সব বলছে, এ মা।
গোপীনাথ একটু হাসল। বলল, আমার বউকে লজ্জায় ফেলছেন কেন?
হঠাৎ ও পাশে সুধাকরের গলাটা একটু বিষণ্ণ শোনাল, লজ্জাটা যে এখনও দুনিয়ার আনাচেকানাচে একটু আধটু রয়ে গেছে সেটা ভাবলে বড্ড খুশি হই, বুঝলেন? এই বেহায়া নির্লজ্জ পৃথিবী যত বে-আবরু হচ্ছে তত আমাদের মতো বুড়ো মানুষরা মুষড়ে পড়ছি।
আপনি আবার বুড়ো হলেন কবে?
হচ্ছি মশাই, হচ্ছি। অভিজ্ঞতারও তো একটা বয়স আছে।
বুঝেছি। আপনি এঁচোড়ে পাকছেন।
যা বলেছেন। কিলিয়েই কাঁঠাল পাকানো হচ্ছে। এনিওয়ে, ডায়েরিটা উদ্ধার হয়েছে।
আঃ বাঁচা গেল। কোথায় পাওয়া গেল?
লম্বা ইতিহাস। অত শুনে কাজ নেই। শুধু বলে রাখি, সাতটা খুন এবং গোটা দুই জখমের পর ডায়েরিটা উদ্ধার হয়েছে একটা ব্যাঙ্কের লকার থেকে। সেটাও সহজে হয়নি। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তবে হয়েছে।
জিনিসটা কবে পাব?
পাবেন কী করে? আধঘণ্টা ধরে ডোরবেল বাজিয়ে এসেছি একটু আগে। অন্য লোক হলে ধরে নিত আপনারা ঘরে নেই। কিন্তু আমার সন্দেহ হচ্ছিল যে, আপনারা দুটি বিচ্ছিন্ন স্বামী-স্ত্রী বা প্রেমিক-প্রেমিকা হয়তো বহুদিন পর পুনর্মিলিত হওয়ায়
একটা গলা খাঁকারি দিয়ে থামল সুধাকর।
গোপীনাথ একটু হেসে বলল, মোটেই তা নয় দাতাসাহেব। আসলে আপনার চরেরাই আপনাকে জানিয়েছে যে, আমরা ঘরেই আছি।
কীভাবে জানবে? ঘরে যে মোটা পরদা ফেলা।
আপনার অসাধ্য কিছুই নেই। হয়তো কোনও খুদে মাইক্রোফোন কোথাও সেঁটে রেখে গেছেন। দেখতে না পেলেও শব্দ শুনতে পাচ্ছেন।
আপনি বুদ্ধিমান।
সে তো বটেই। কোথা থেকে কথা বলছেন?
সেন সাহেবের ঘর থেকে।
এঃ, তা হলে তো আমাদের স্বামী-স্ত্রীর ডায়ালগ সবই শুনতে পেয়েছেন। ক্লি
য়ার অ্যান্ড লাউড।
প্রাইভেসি বলে আর কিছু রাখলেন না। আমার স্ত্রী লজ্জায় পড়বেন।
আমি আপনাদের শ্রদ্ধা করতে শুরু করেছি। ইউ আর এ গুড কাপল। আপনাদের রিকনসিলিয়েশনটা দারুণ লেগেছে।
গোপীনাথ একটু দেখে নিল সোনালি কোথায় আছে। সোনালি এখন রান্নাঘরে, হয়তো চা করছে। সে গলাটা একটু নামিয়ে বলল, রিকনসিলিয়েশনটা ভাল হল কি না কে বলবে দাতাসাহেব? বহু বছর পর আমরা মিলেমিশে গেলাম বটে, কিন্তু তার দায়িত্ব কতটা? যেভাবে ঘাতকরা উঠেপড়ে লেগেছে তাতে যে-কোনওদিন আমি শেষ হয়ে যেতে পারি। যদি তাই হয়, তা হলে এই মিলনটা সোনালির কাছে দুঃসহ হয়ে থাকবে। হৃদয়বৃত্তির প্রশংসা করছিলেন, কিন্তু এই নির্দয় পৃথিবীতে হৃদয়বৃত্তি একটা বাড়তি অসুবিধে ছাড়া তো কিছুই নয়।
ইউ আর রাইট। তবে একটা কথা আছে।
কী কথা?
জীবন অতীব ক্ষণস্থায়ী। কে কবে কীভাবে মারা যাবে তার ঠিক নেই। এই ক্ষণস্থায়ী আয়ুষ্কালের মধ্যে যদি সামান্য কয়েকটি মুহূর্তও আপনি জীবনের কাছে পেয়ে থাকেন, তাই বা কম কী? আমাদের জীবনে কয়েকটাই মাত্র গোন্ডেন মোমেন্টস আসে, বাদবাকি জীবনটা কাটে তার স্মৃতি রোমন্থন করে। তাই না?
তা বটে।
আচ্ছা, আজ অপরাহ্নে আমরা এত হাইলি ফিলজফিক্যাল হয়ে উঠলাম কেন বলুন তো!
তাই দেখছি।
ওটাই হল বয়সের দোষ। আমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছি।
আপনি কি ত্রিশ পেরিয়েছেন?
আমি চল্লিশের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছি। দেখতে আমাকে একটু ছোকরা ছোকরা লাগে বটে, কিন্তু আই অ্যাম কোয়াইট ওল্ড।
ইউ আর নট এ গুড লায়ার।
আচ্ছা মশাই, নিতান্ত দরাদরিই যদি করতে চান, তা হলে না হয় আরও পাঁচ বছর হেঁটে দিচ্ছি। মে বি আই অ্যাম থার্টি ফাইভ।
বত্রিশের বেশি এক দিনও নয়।
সুধাকর একটু হাসল। তারপর বলল, ও কে দেন। লেট ইট বি থার্টি টু। বাট স্টিল আই অ্যাম ওল্ড।
গোপীনাথ স্মিত একটু হেসে বলল, আমার স্ত্রী সম্ভবত চা করছেন। উড ইউ লাইক টু জয়েন দি টি পার্টি?
নেমন্তন্নের জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু উপায় নেই। আপনার সঙ্গে আমাকে যত না দেখা যায় ততই ভাল।
কিন্তু ডায়েরিটা। সেটা কবে পাব?
ডায়েরিটা ফটোকপি করা হচ্ছে।
ও। আমার জানার ছিল, ওতে সত্যিই কোনও ভাইটাল ক্লু আছে কি না।
আমি সায়েন্টিস্ট হলে বলতে পারতাম। তবে অনেক হিজিবিজি আছে, আপনি হয়তো বুঝবেন। আমি লাইনটা কেটে দিচ্ছি। কারণ আপনার ফ্ল্যাটে এখনই অতিথি সমাগম হবে।
পুলিশ নাকি? আজ সকালে তো তারা এসে ঘরময় সার্চ করেছে। ফটোও তুলেছে। জেরায় জেরায় জেরবার করেছে আমাদের। বলে গেছে আবার আসবে।
পুলিশের তো আসারই কথা। তবে এখন পুলিশ নয়, আসছেন রোজমারি আর মনোজ। সঙ্গে সুব্রত। একটা কথা বলে রাখি।
কী কথা?
দে আর বিয়িং শ্যাডোড। কেউ ওঁদের এখানে অনুসরণ করছে।
কে ওদের পিছনে আছে?
সুধাকর উদাস গলায় বলল, কেউ হবে। তবে রোজমারি সম্পর্কে আপনি একটু সাবধান থাকবেন।
কী ধরনের সাবধান?
ভদ্রমহিলা নিজে ততটা খারাপ নন। কিন্তু শি কিপস এ ব্যাড কম্প্যানি। এ ভিকটিম অফ সারকামস্ট্যান্সেস। হয়তো ব্ল্যাকমেলেরও শিকার।
আপনি এত জানলেন কী করে?
আই কিপ এ ট্যাগ অন হার।
আমি ওঁদের কী বলব? ওঁরা হয়তো একটা চাকরি অফার করবেন।
তাও জানি।
চাকরিটা আমি নেব বলে ঠিক করেছি।
কেন নেবেন? ওঁ
দের ল্যাবটা আমার কাজে লাগবে।
ল্যাবটা হয়তো আপনার উপযুক্ত হবে না।
তা হলে?
স্কিপ দি অফার।
তা হলে কাজ এগোবে কী করে?
অন্য উপায় আছে। আপনি কখনও লুলু বলে কারও নাম শুনেছেন?
গোপীনাথ একটু অবাক হয়ে বলল, হ্যাঁ।
নামটা মনে রাখবেন।
কেন বলুন তো!
দরকার আছে। কিন্তু আর নয়। দে আর অলমোস্ট অ্যাট ইয়োর ডোর।
সুধাকর ফোনটা কেটে দেওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ডোরবেল বেজে উঠল। চায়ের ট্রে নিয়ে রান্নাঘর থেকে আসছিল সোনালি। বলল, দাঁড়াও, আমি খুলব। কে না কে, কে জানে বাবা। হঠাৎ তুমি সামনে যেয়ো না।
গোপীনাথ সোনালির ভয় দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল, খুব বীরাঙ্গনা হয়েছ বুঝি। ভয় নেই, রোজমারি আর মনোজ। তোমার বস।
আমার বস কেউ নেই। চাকরিটা আমি ছেড়ে দিয়েছি।
অবাক গোপীনাথ বলল, কবে ছাড়লে?
মনে মনে ছেড়েছি। কনসার্নটা আমার ভাল লাগছে না। ওরা তোমাকে কাজে লাগাতে চায়।
গোপীনাথ মৃদু হেসে বলে, তা হলে এখন তুমি বেকার?
তা আর হলাম কই? একজনের দেখভাল তো করতে হচ্ছে। আপাতত এটাই চাকরি। গোপীনাথ গিয়ে দরজাটা খুলে দিল। সামনেই সুব্রত। মুখে হাসি, গোপীদা, মনোজবাবু আর রোজমারি এসেছেন দেখা করতে।
পরিচয় আর কুশল বিনিময় করতে করতেই গোপীনাথ দু’জনকে খুঁটিয়ে লক্ষ করছিল। মনোজ, যে খুব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নয় তা তার মুখের নার্ভাস হাসি দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। রোজমারি গড়পরতা জার্মান মেয়েদের মতোই মজবুত গড়নের। মোটামুটি দেখতে ভালই। কিন্তু একটু চাপা উদ্বেগে ভুগছে।
রোজমারি সোনালির হাত ধরে পরিষ্কার বাংলায় বলল, পুনর্মিলন সুখের হোক। আমি ভাবতেই পারিনি কখনও যে, এরকমও হয়। আমি বাঙালি বা ভারতীয় হয়ে জন্মালে বেশ হত।
সোনালি লজ্জায় রাঙা হল।
রোজমারি জার্মান মেয়ে। ভ্যানতারা জানে না। সোজাসুজি গোপীনাথের দিকে চেয়ে বলল, আপনি কি আমাদের অফারটা নিচ্ছেন মিস্টার বোস?
গোপীনাথ মৃদু হেসে বলল, আপনি আমার ঘরখানা ভাল করে লক্ষ করেছেন কি?
না তো! কেন?
ভাল করে দেখুন। মেঝের চলটা উঠে গেছে, দেওয়াল থেকে খসে পড়েছে চাপড়া। কেন জানেন? এ ঘরে অটোমেটিক রাইফেল দিয়ে ঝাকে ঝাকে গুলি চালানো হয়েছে আমাকে মারার জন্য।
রোজমারি সবই দেখল। তারপর বলল, ঈশ্বর! আপনি কি তখন ঘরে ছিলেন?
গোপীনাথ অম্লানবদনে মিথ্যে কথা বলল, না ম্যাডাম। থাকলে এতক্ষণে আমি মর্গে শুয়ে আছি।
খুব বেঁচে গেছেন আপনি।
গোপীনাথ মাথা নেড়ে বলল, বাঁচিনি। এর পরেও আমার ওপর অ্যাটাক হয়েছে। বাঁ কাধটা জখম। বুঝেছেন?
হ্যাঁ। কিন্তু
শুনুন ম্যাডাম, আমার জীবন এতই অনিশ্চিত যে, আমার কাছাকাছি কারও থাকা উচিত নয়। এই মুহূর্তেই যদি বাইরে থেকে কেউ গুলি চালায়, তা হলে আমাদের যে কারও বিপদ হতে পারে।
মনোজের মুখটা একটু ফ্যাকাশে দেখাল। সে বলল, তা হলে তো
গোপীনাথ বলল, আই অ্যাম লিভিং ডেনজারাসলি। শুধু সেই কারণেই আপনাদের লোভনীয় অফার নিতে পারছি না। নিলে আপনাদেরও বিপদ।
রোজমারি বলল, কিন্তু আমরা যদি আপনাকে অন্য কোথাও রাখি, কোনও নিরাপদ জায়গায়?
গোপীনাথ মাথা নেড়ে বলল, নিরাপদ জায়গা বলতে কিছু নেই। এমনকী আপনারা যে এসেছেন, আপনাদের পিছু পিছুও কেউ এসেছে।
রোজমারি অবাক হয়ে বলে, সে কী কথা! আমাদের পিছু কেউ নেয়নি তো।
মনোজ বলে উঠল, অসম্ভব।
কিন্তু সুব্রত হঠাৎ বলল, অসম্ভব না-ও হতে পারে।
মনোজ বলল, কেন বলো তো! তুমি কাউকে দেখেছ?
মনে হচ্ছে, আমরা যখন অফিস থেকে রওনা হই, তখন একটা নীল মারুতি আমাদের পিছনে ছিল।
কী করে বুঝলে?
ওভারহেড মিররে দেখেছি। তখন কিছু মনে হয়নি। নীল মারুতিটাকে নামবার সময়েও দেখেছি যেন। একটু দূরে থেমে গেল।
মনোজ বলল, লেট আস চেক। চলো।
চলুন। বলে সুব্রত আর মনোজ বেরিয়ে গেল।
রোজমারি একটু উৎকণ্ঠার সঙ্গে বলল, কেউ আমাদের পিছু নিয়েছে কি না তা আপনি কী করে জানলেন?
ইনটুইশন।
ইনটুইশন। শুধু ইনটুইশন?
গোপীনাথ হাসল, না। শুধু ইনটুইশন নয়। ইনফর্মারও।
৩৫.
নীল মারুতির অভাব নেই কলকাতায়। বাড়ির সামনের রাস্তায় এসে মনোজ আর সুব্রত একটু হাঁটতেই একটা নীল মারুতি দেখতে পেল। লক্ষ করল, ভিতরে কেউ নেই।
এটাই কি সুব্রত?
আমি শিয়োর নই। নম্বর প্লেটটা তো দেখে রাখিনি।
তা হলে?
সুব্রত গাড়ির বনেটে হাত রেখে তাপ অনুভব করে ঘাড় নেড়ে বলল, এটা নয় স্যার।
কী করে জানলে?
এটা হলে বনেট গরম থাকত। এটার বনেট ঠান্ডা, তার মানে অনেকক্ষণ পার্ক করা আছে।
কোয়াইট ইন্টেলিজেন্ট ডিডাকশন। চলো, আর একটু এগিয়ে দেখি।
তারা আরও একটু এগোতেই একটা মোড়। ডানধারে আর একটা সরু রাস্তা। সুব্রত থমকে বলল, স্যার!
হ্যাঁ, বলো।
ওই যে।
ডানধারে একটু ভিতরে একটা নীল মারুতি পার্ক করা।
এটাই যে তা কী করে বুঝলে?
বনেটের ওপর বড় করে একটা দুই লেখা আছে, চারধারে একটা সার্কল। সম্ভবত কোনও মোটর র্যালিতে পার্টিসিপেট করেছিল। মনে হচ্ছে ওভারহেড মিররে এটা দেখেছি, কিন্তু মনে পড়ছিল না।
গুড, চলো, লেট আস চেক।
ড্রাইভার তার সিটে বসে আছে, দেখতে পাচ্ছেন? বসে খবরের কাগজ পড়ছে।
মনোজ ভ্রু কুঁচকে বলল, লেট আস টক টু হিম।
কী বলবেন?
জিজ্ঞেস করব কার গাড়ি, এখানে কী করছে।
সুব্রত হাসল, এসব প্রশ্ন করার অধিকার কি আমাদের আছে? হি মে রি-অ্যাক্ট।
মনোজ হঠাৎ যেন সংবিৎ ফিরে পেয়ে বলল, তাই তো। তা হলে কী করা যাবে।
লাইসেন্স নম্বরটা মুখস্থ করে নিয়েছি। গাড়িটা কার তা হয়তো ট্রেস করা যাবে।
কীভাবে?
আমার এক আত্মীয় পুলিশে কাজ করেন। বিগ শট।
তা হলে কি আমরা ফিরে যাব?
না স্যার। ড্রাইভারকে একটু ক্রস করা যাক। জবাব না দিলেও ক্ষতি নেই। মতলবটা বোঝা যাবে।
মনোজ একটু দ্বিধা করছিল। কিন্তু সুব্রত বেশ গটগট করে এগিয়ে গেল দেখে সেও এগোল।
ড্রাইভারের জানালায় উঁকি দিয়ে সুব্রত হাসিমুখে বলল, গাড়িটা কি আপনার?
ড্রাইভার বেশ একজন শক্তপোক্ত লোক। চোখের দৃষ্টি কঠিন ও স্থির। মোটা গোঁফ, হাতে লোহার বালা, হাস্যহীন মুখ। বয়স পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ হবে। একটু অবাঙালি টানে বলল, কেন, কী দরকার?
আপনি আমাদের ফলো করে এখানে এসেছেন। কেন তা জানতে পারি?
লোকটা খবরের কাগজটা পাশে রেখে বলল, কে কাকে ফলো করেছে? ঝামেলা পাকাতে চান নাকি?
ঝামেলা আপনিই পাকিয়ে তুলছেন। আপনি কি জানেন যে আপনাকে পুলিশে দেওয়া যায়?
লোকটা ঠান্ডা গলায় বলল, এটা আপনার বাবার রাস্তা? হাল্লা মাচালে বহুৎ ঝঞ্ঝাট হয়ে যাবে। কেটে পড়ুন। ফলোটলো আমি করিনি, আপনাকে চিনিও না। যান, ভাগুন।
মনোজ একটু পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল। সে একটু ভাবের জগতের মানুষ। বিজ্ঞান চিন্তা তার বাস্তববোধকে অনেকখানিই খেয়ে ফেলেছে। তবু কর্তব্যবোধবশে সে এবার এগিয়ে এসে বলল, গাড়িটা কার?
লোকটা মনোজের দিকে তাকিয়ে বলল, তা দিয়ে কী দরকার?
বলবেন না?
কেন বলব?
আপনারা তো ক্রিমিন্যাল।
ক্রিমিন্যাল! বলে লোকটা আচমকা দরজাটা খুলে ফেলল এবং দরজার ধাক্কাতেই মনোজকে ছিটকে ফেলে নেমে এল গাড়ি থেকে। নামতেই বোঝা গেল নোকটা প্রায় ছ’ফুট লম্বা, চওড়া কাঁধ এবং মোটা কবজি। বেরিয়ে এসেই মনোজকে একটা লাথি কষিয়েই সুব্রতকে ধরে ফেলল জামার বুকের কাছটায়। তারপর বাঁ হাতে চটাস করে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে বলল, শালা, মামদোবাজির আর জায়গা পাওনি।
মনোজ দরজার ধাক্কা আর লাথি দুটোতেই অকর্মণ্য হয়ে পড়েছিল। জীবনে এরকম মার সে খায়নি। ভোম্বলের মতো পথেই বসে সে হা করে সুব্রতর মার-খাওয়া দেখছিল। লোকটার সঙ্গে গায়ের জোরে সুব্রতর এঁটে ওঠার কথাও নয়। এক-আধবার হাত-পা চালানোর চেষ্টা করে আর একটা চড় খেয়ে সে নেতিয়ে পড়ল।
ভাগ শালা চুহা কোথাকার!
মনোজ উঠে দাঁড়াল। সুব্রত পড়েনি কিন্তু বোমকে গেছে খুব। মনোজ বলল, এনাফ ইজ এনাফ, লেট আস কুইট।
ইয়েস স্যার।
লোকটা জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাদের দিকে চেয়ে ছিল, যেন খেয়ে ফেলবে। এর সঙ্গে আর বেশিক্ষণ সময় কাটানোটা যে উচিত হবে না, সেটা বুঝে দু’জনেই যখন পৃষ্ঠ প্রদর্শন করতে যাচ্ছে তখনই একটা নাটকীয় ঘটনা ঘটল।
গলির মুখ থেকে একটা লোক এগিয়ে এল। বেশ লম্বাচওড়া চেহারা। এসে তাদের অগ্রাহ্য করে সোজা এসে ড্রাইভারটাকে চুলের মুঠি ধরে একটা ঝাঁকুনি দিল, তারপর ডানহাতে বিদ্যুচ্চমকের মতো একটা ঘুসি মারল চোয়ালে।
পরম তৃপ্তির সঙ্গে দৃশ্যটা দেখে মনোজ বলে উঠল, বাঃ, চমৎকার মিস্টার দত্ত। এতক্ষণ যে কোথায় ছিলেন!
ড্রাইভারের অচৈতন্য দেহটাকে বনেটের ওপর উপুড় করে ফেলে মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাদের দিকে তাকাল সুধাকর। তারপর বলল, কে আপনাদের অ্যাডভেঞ্চারটা করতে বলেছে বলুন তো! কাজের কাজ তো হলই না, উপরন্তু ভন্ডুল হয়ে গেল আমার প্ল্যান।
মনোজ থতমত খেয়ে বলল, এ লোকটা আমাদের ফলো করছিল।
সেটা আমি জানি। এ লোকটা আজ্ঞাবহ মাত্র, তার বেশি কিছু নয়। কী যে সব কাণ্ড করেন!
মনোজ অপ্রতিভ হয়ে বলে, আজ্ঞে, আমরা তো জানতাম না। হিট অফ দি মোমেন্টে ব্যাপারটা হয়ে গেছে। কিন্তু কী ব্যাপার বলুন তো!
ব্যাপার গুরুতর। সুব্রতবাবু ড্রাইভারের সিটের দরজাটা খুলুন। ভিড় জমে যাচ্ছে। এফেক্টটাকে মিনিমাইজ করতে হবে।
বাস্তবিকই ভিড় জমে যাচ্ছে, অন্তত গোটা দশ-বারো লোক দাঁড়িয়ে গেছে।
দু-চারজন এসে জিজ্ঞেসও করল, কী হয়েছে দাদা? ছিনতাই পার্টি নাকি?… ডাকাতির কেস?… আপনারা কি সাদা পোশাকের পুলিশ নাকি?
সুধাকর অবশ্য এসব প্রশ্নের জবাব দিল না। ড্রাইভারের সিটে হতচৈতন্য লোকটাকে বসিয়ে দিল। লোকটা ঘাড় লটকে কেতরে রইল।
সুধাকর মনোজের দিকে চেয়ে বলল, এ গাড়ির আসল সওয়ারি কি আর আসবে এখানে? কাণ্ড দেখে সরে পড়বে।
কিন্তু লাইসেন্স নম্বর?
এই না হলে বুদ্ধি? লাইসেন্স নম্বর ধরে ক্রিমিনালদের খুঁজে বের করা যায় কখনও? হয়তো দেখা যাবে, গাড়িটা হয় চোরাই, না হয় ভাড়া করা। যাকগে, যা ঘটে গেছে তার জন্য ভেবে লাভ নেই। লেট আস ক্লিয়ার আউট।
সেই ভাল। নইলে পুলিশের হুজ্জত হতে পারে। বলে মনোজ সুধাকরের পিছু নিল। সঙ্গে সুব্রত।
মিস্টার দত্ত আপনি হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হলেন বলুন তো! মোক্ষম সময়েই এসে পড়েছিলেন বটে। কিন্তু হঠাৎ এখানে এমন সময়ে একজন ইন্টারপোল এজেন্টের তো হাজির হওয়ার কথা নয়।
সুধাকর হাসল, এ জায়গায় আপনারই কি এ সময়ে হাজির হওয়ার কথা! আপনার তো থাকার কথা অফিসে।
ওঃ হ্যাঁ, তাও বটে। আমি এসেছিলাম একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট রাখতে।
সবই জানি।
জানেন?
না জানার কিছু নেই। গোপীনাথ বসু আপনাদের চাকরিটা নেবেন না, তার কারণ তিনি আজ অথবা কাল ভোরে আমার সঙ্গে কলকাতা ছাড়ছেন।
কোথায় যাচ্ছেন?
ডেস্টিনেশন আমস্টারডাম।
আজ রাতেই?
সম্ভব হলে।
মনোজ একটু গুম হয়ে থেকে বলল, উনি কি ইন্টারপোলের হাতে বন্দি?
তাও বলতে পারেন।
মনোজ নিঃশব্দে হাঁটতে লাগল। আর কথা বাড়াল।
গোপীনাথের বাড়ির সদরের সামনে এসে সুধাকর বলল, গুড বাই।
বাই।
সুধাকর পার্ক করা নীল মারুতিটা দেখিয়ে বলল, ওটা আমার গাড়ি।
সুধাকর গিয়ে গাড়িতে উঠল। তারপর স্টার্ট দিয়ে ভোঁ করে বেরিয়ে গেল।
মনোজ সুব্রতর দিকে চেয়ে বলল, গোটা ব্যাপারটা একটা জিগশ পাজলের মতো। তুমি কিছু বুঝতে পারলে সুব্রত?
না, স্যার।
দু’জনে উপরে উঠে এসে গোপীনাথের ফ্ল্যাটের ডোরবেল বাজাতেই দরজা খুলে দিল রোজমারি। চোখ-মুখ খানিকটা বিস্মিত।
মনোজ ঘরে ঢুকে দেখল, ঘর ফাঁকা।
গোপীনাথ আর মিসেস বোস কোথায় গেলেন?
রোজমারি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, মিনিট দশেক আগে একটা টেলিফোন এল। গোপীনাথ কল পেয়েই সোনালির সঙ্গে গোপনে কিছু কথা বললেন। তারপর আমাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে দু’জনেই বেরিয়ে গেলেন।
কতক্ষণের জন্য?
বললেন তো মিনিট পনেরোর জন্য। সুব্রতর জন্য একটা মেসেজ রেখে গেছেন। বলে গেছেন, সুব্রত এলেই যেন একবার ল্যান্ডিং-এ গিয়ে মিস্টার সেনের জন্য অপেক্ষা করে।
সুব্রত কিছুই বুঝল না। মিস্টার সেন কে তাও সে জানে না। সে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। হঠাৎ তার মনে হল, এই ঘরে নিপুণভাবে একটা রঙ্গমঞ্চ সাজানো হয়েছে। একটা কিছু ঘটবে। সে এখানে অনভিপ্রেত।
সুব্রত ঢোক গিলে বলল, ও হ্যাঁ, হ্যাঁ। মিস্টার সেন তো! ঠিক আছে।
বলে সে দরজা খুলে বেরিয়ে এল। লিফটের জন্য না দাঁড়িয়ে সে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভেঙে নামতে লাগল।
ঘরের মধ্যে মনোজ একটু অস্বস্তি নিয়ে সোফায় বসল।
রোজমারি বলল, তোমার কী হয়েছে?
কিছু হয়নি তো।
আয়নায় নিজেকে দেখলেই বুঝতে পারবে। তোমার কোট আর জামায় ময়লা লেগে রয়েছে। গালে ধুলোর ছাপ। চুল এলোমেলো। মুখ দেখে মনে হচ্ছে, তুমি ব্যথা চাপছ।
মনোজ ম্লান হেসে বলল, উই হ্যাভ এ স্মল এনকাউন্টার।
মারপিট?
হ্যাঁ।
ঈশ্বর! কার সঙ্গে?
একটা লোক। গুন্ডা।
মারপিট করতে গেলে কেন?
ওই লোকটা, যে গাড়িটা চালাচ্ছিল সেটাই আমাদের ফলো করে।
ঈশ্বর! সুব্রত যে নীল মারুতির কথা বলছিল?
হ্যাঁ।
কী হচ্ছে বলো তো এসব?
আমি বুঝতে পারছি না রোজমারি।
আমরা কি বিপদের মধ্যে জড়িয়ে যাচ্ছি?
হতে পারে।
কিছুদিন আগে আমাকে যখন কেউ ভুল দিনে জন্মদিনের গোলাপ পাঠিয়েছিল তখন থেকেই আমি কেমন অস্বস্তিতে আছি। কিছু একটা হবে। কিন্তু কেন হবে মনোজ? আমি কী করেছি?
তা তো জানি না। শোনো, গোপীনাথ চাকরিটা নেবে না। সুধাকর দত্ত ওকে নিয়ে আজই আমস্টারডাম রওনা হচ্ছে।
সুধাকর! তাকে তুমি পেলে কোথায়?
বলব।
ডোরবেল বাজতেই রোজমারি গিয়ে দরজা খুলে দিল। তারপর হঠাৎ একটা আর্তনাদের মতো শব্দ করে পিছিয়ে এল ঘরের মধ্যে। মনোজ চমকে চেয়ে দেখল, দরজায় দু’জন লোক দাঁড়ানো। দু’জনেই বিদেশি চেহারার। দু’জনের একজনকে অবশ্য আবছা চেনে মনোজ। লোকটা লুলু, তাদের সিকিউরিটির কর্তা। অন্যজন অচেনা। দু’জনেরই হাতে দুটো পিস্তল জাতীয় জিনিস, নিম্নমুখী হয়ে ঝুলছে।
রোজমারি চেঁচিয়ে উঠল, কী চাও তোমরা?
অচেনা লোকটা রোজমারির দিকে চেয়ে একটু হাসল। তারপর দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বলল, কাজটা শেষ করতে এসেছি রোজমারি।
তোমাদের হাতে বন্দুক কেন জো? লুলু?
জো নামে লোকটা বলল, এটাই কাজ।
তোমার সঙ্গে লুলু কেন?
লুলু আমার বন্ধু। লুলু তোমারও বন্ধু। লুলুর সঙ্গে তোমার মধুর সম্পর্কের কথা তোমার স্বামী না জানলেও আমি জানি রোজমারি।
বাজে কথা বোলো না জো।
জো হাসল, বাজে কথা আমি বলি না। আমার কাছে তোমাদের ঘনিষ্ঠতার ভিডিয়ো ক্যাসেটও আছে। একবার ভেবেছিলাম, ওটা দিয়ে তোমাকে ব্ল্যাকমেল করি। কিন্তু দুনিয়া এখন অনেক প্রগতিশীল, অনেক পারমিসিভ। আজকাল স্বামীরা স্ত্রীর ছোটখাটো অবৈধ প্রেম ক্ষমা করে দেয়। তোমার স্বামী তো একটি ভেড়া বই কিছু নয়।
তুমি কি এইজন্য আমাদের ফলো করে এসেছ?
দুর বোকা! তোমাদের জন্য এত পরিশ্রম করব কেন? গোপীনাথ কোথায়? ডাকো।
উনি এখন নেই।
জো আর লুলু চমকে উঠে বলল, মানে? কোথায় গেল?
একটু বাইরে গেছে। এখনই এসে পড়বে। কিন্তু তোমরা কি তাকে খুন করবে জো?
জো অবাক হয়ে বলল, আমরা। আমরা কেন খুন করব?
তা হলে?
ওঁকে খুন করবে তুমি এবং তোমার স্বামী।
কী বলছ জো?
জো ঘড়ি দেখে বলল, গোপীনাথ কোথায় গেছে রোজমারি? সত্য বলে।
লুলু ফ্ল্যাটটা খুঁজে এসে বলল, নেই।
তারপর দরজা খুলে বোধহয় চারদিকটা দেখে এসে বলল, বাইরে বেরোতে পারেনি। আমার লোক নজর রাখছে। অন্য কোনও ফ্ল্যাটে যেতে পারে।
জো বিরক্ত হয়ে বলল, তোমার এটা দ্বিতীয় ভুল লুলু।
৩৬.
জো এবং লুলু পরস্পরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। জো-র চোখে আগুন ঝরছে, লুলুর চোখে ভয়। সিঁটিয়ে থাকা স্থবিরের মতো রোজমারি দৃশ্যটা দেখল। মনোজের অবস্থা তার চেয়ে কিছুমাত্র ভাল নয়। তবু সে-ই প্রথম কথা বলল। পরিষ্কার জার্মান ভাষায় বলল, এসব কী হচ্ছে?
জো ক্লাইন তার দু’খানা রক্ত-জল-করা চোখে মনোজের দিকে চেয়ে জার্মান ভাষায় বলল, একটা নাটক। শেষ দৃশ্য। এই দৃশ্যে প্রধান অভিনেতা আর অভিনেত্রী আপনি আর রোজমারি। কখনও খুনটুন করেছেন মিস্টার সেন?
মনোজ কাপছিল। মাথা নেড়ে বলল, না।
আপনি চিরকাল খুব নিরাপদ জীবন যাপন করে এসেছেন, তাই না?
হ্যাঁ।
খুন করাটা কোনও ব্যাপারই নয়। বিশেষ করে নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য যদি করতে হয়।
তার মানে? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
বুঝিয়ে দিচ্ছি। গোপীনাথ যেখানেই থাক এ বাড়ি থেকে বেরোতে পারেনি। সে আসবে। আপনাদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র থাকবে। গোপীনাথ বসু ঘরে ঢোকামাত্র দু’জনেই গুলি চালাবেন। আমাদের হাতে যে আগ্নেয়াস্ত্র দেখছেন তা অত্যন্ত শক্তিশালী স্বয়ংক্রিয় পিস্তল। চালানো খুব সোজা।
আমরা গোপীনাথকে মারব কেন?
গোপীনাথকে মারবেন আমি আদেশ করছি বলে। মারতেই হবে, কারণ আপনাদের পিছনে আমরা দুটো পিস্তল আপনাদের দিকে তাক করে অপেক্ষা করব। আপনারা যদি গুলি না চালান সে ক্ষেত্রে কাজটা আমাদেরই করতে হবে। তবে তখন আমরা শুধু গোপীনাথকেই মারব না, আপনাদেরও মারব। বুঝেছেন?
আপনি কে?
আমার নাম জো ক্লাইন। রোজমারির প্রাক্তন স্বামী।
ওঃ হ্যাঁ, আপনার কথা শুনেছি বটে। আপনি মার্কিন সরকারের গুপ্তচর ছিলেন।
ছিলাম। এখন নই।
আপনি এ কাজ কেন করছেন?
স্বার্থে করছি মিস্টার সেন। আমরা সামান্য আজ্ঞাবহ মাত্র। কাজ করে টাকা পাই।
শুধু টাকার জন্য?
জো ক্লাইন মাথা নেড়ে বলল, শুধু টাকা নয় মিস্টার সেন। নিউ ইয়র্কে আমার একটি সরল সোজা বউ আছে। আর আছে ফুটফুটে দুটো বাচ্চা। আমি যাদের আজ্ঞাবহ তাদের হয়ে যদি কাজটা না করি তা হলে তারা প্রথমেই খতম করবে আমার পরিবারটিকে। আমাদের আনুগত্যটাও বাধ্যতামূলক। একরকম পণবন্দি। বুঝেছেন?
মনোজ অবিশ্বাসের গলায় বলল, সত্যি?
এর চেয়ে কঠোর সত্য আর নেই।
খুনটা আমাদের দিয়ে করাতে চান কেন?
কারণ আমরা এখানকার পুলিশি ঝামেলায় জড়াতে চাই না। কোনও চিহ্নও ফেলে যেতে চাই না।
কিন্তু আমরা! আমাদের তো পুলিশে ধরবে!
সেটা আপনাদের শিরঃপীড়ার বিষয়। কিন্তু পুলিশি ঝামেলার চেয়েও আপনার অনেক বেশি দরকার বেঁচে থাকা। তাই নয় কি?
লুলুর সঙ্গে আপনার কী সম্পর্ক?
জো একটু হাসল, পাপীর সঙ্গে পাপীর বন্ধুত্ব একটু তাড়াতাড়ি হয়। মিস্টার সেন, লুলু, আপনি এবং আমি, আমাদের তিনজনের একটা জায়গায় খুব মিল। আমরা তিনজনেই রোজমারির প্রাক্তন বা বর্তমান প্রেমিক।
মনোজ একবার রোজমারির দিকে তাকাল, কিছু বলল না। তবে তার মুখে একটা বিস্বাদের ভাব ফুটে উঠল। একটু বেদনাও।
রোজমারি লুলুর দিকে যে চোখে চেয়ে ছিল তা প্রেমপূর্ণ নয়। ঘেন্নায় ভরা। চাপা গলায় সে শুধু একবার বলল, কুকুর।
লুলুর সুন্দর মুখখানা নির্বিকার রইল। সে শুধু ঠান্ডা গলায় বলল, তোমাকে আমি কুত্তি বলতে পারতাম, কিন্তু বলছি না। তার কারণ এটা ব্যক্তিগত সম্পর্কের জট ছাড়ানোর সময় নয়, রোজমারি। আমাদের হাতে অনেক বেশি জরুরি কাজ আছে।
রোজমারি হঠাৎ বলল, আমরা তোমাদের আজ্ঞাবহ নই। আমরা ভদ্র ও আইন মোতাবেক জীবনযাপন করি। তোমাদের হুকুমে আমরা নিরপরাধ একজন মানুষকে খুন করতে পারব না। আমরা চলে যাচ্ছি। দয়া করে বাধা দিয়ো না। চলো মনোজ।
মনোজের হাত ধরে একটা টান মেরে দাঁড় করিয়ে দিলে রোজমারি।
পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে জো বলল, এখনও তুমি ততটা স্বাধীন নও রোজমারি।
তার মানে?
তোমার অতীত আমি ভুলে যাইনি। ভিয়েনায় গডার্ড নামে একটা লোককে তুমি খুন করেছিলে। ভুলে গেছ? তোমাকে বাঁচাতে খুনের দায়টা আমাকে নিজের কাঁধে নিতে হয়েছিল। বানাতে হয়েছিল আষাঢ়ে গল্প। গল্প বানানোর কাজটা বা অপরাধের দৃশ্য সাজানোর ব্যাপারে আমি অতিশয় দক্ষ। আর সেইজন্যই পুলিশকে ব্যাপারটা বিশ্বাস করাতে পেরেছিলাম। নইলে এতদিনে জেল খেটে তুমি বুড়ি হয়ে যেতে কিংবা মৃত্যুদণ্ডের কবলে পড়তে পারতে।
আমি ভুলিনি৷ ব্ল্যাকমেল করতে চাও, জো? সুবিধে হবে না। আমি যে-কোনও পরিণতির জন্য তৈরি। কিন্তু তোমার হুকুমে গোপীনাথকে মারা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
জো মনোজের দিকে চেয়ে বলল, আপনারও কি তাই মত মিস্টার সেন? আশা করি, আপনি এই মহিলার মতো অবিবেচক নন। তার কারণ আমার হুকুম তামিল না করলে আপনাদের দুজনকে খুন করা ছাড়া আমাদের উপায় নেই।
কেন নেই? আমরা তো চলেই যাচ্ছি। কথা দিচ্ছি, পুলিশকে কিছু বলব না।
জো হাসল, এই কারবারে কথার কোনও দাম নেই। কথা নিতান্তই মূল্যহীন শব্দ মাত্র।
মনোজ রোজমারির হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলল, রোজমারি যা বলছে আমি তা সমর্থন করছি।
আপনার নিজস্ব কোনও বক্তব্য নেই?
না। আমি যে ব্যক্তিত্বহীন তা তো আপনি জানেন।
খুবই দুঃখের ব্যাপার।
রোজমারি মনজের হাত ধরে টেনে দরজার দিকে এক পা এগোতেই জো ক্লাইন মৃদু স্বরে বলল, একসময়ে তোমাকে ভালবাসতাম রোজমারি, সেই ভালবাসার দোহাই, আত্মহত্যা কোরো না।
রোজমারি জোর দিকে চেয়ে দৃঢ় গলায় বলল, জো, তুমি আমাদের জন্য যে ব্যবস্থা করেছ, তাতেও আমরা তো মরবই। তোমার কথামতো গোপীনাথকে যদি মারি সে ক্ষেত্রে আমরা রেহাই পাব না। পুলিশ ধরবে, বিচার হবে, শাস্তি হবে। নষ্ট হবে আমাদের সব সুনাম। ওভাবে মরার চেয়ে তোমার হাতে যদি গুলি খেয়ে মরি তাতে ক্ষতি কী? এখন মরলেও বিবেক পরিষ্কার থাকবে এই কথা ভেবে যে, একজন নির্দোষ লোককে মারতে হয়নি।
খুব ধীরে ধীরে হস্তধৃত আগ্নেয়াস্ত্রটি তুলে আনছিল জো। বলল, তোমাদের কে আগে মরতে চাও?
রোজমারি বলল, আমি চাই।
মনোজ বলল, না, আমি।
রোজমারি মনোজকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে বলল, প্রহসনের দরকার নেই জো। তুমি পাকা খুনি। দু’জনকেই একসঙ্গে মারো। কে দু’সেকেন্ড আগে গেল, কে দু’ সেকেন্ড পরে, তাতে কী আসে যায়?
জো তার পিস্তলটা তুলে ধরে চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে থেকে বলল, তোমাদের দু’জনকে মারাটা আমার প্রোগ্রাম নয়। আমার মূল কাজ গোপীনাথকে সরিয়ে দেওয়া। তোমরা মাঝখানে এসে গেছ বলেই সিদ্ধান্তটা নিতে হচ্ছে। কিন্তু এখনই নয়। পিছিয়ে গিয়ে সোফায় বসে থাকো। আগে গোপীনাথ, তারপর তোমরা।
দরজায় একটা নক হতেই লুলু গিয়ে দরজাটা খুলল। একটা লোক চাপা জরুরি গলায় বলল, আসছে।
লুলু বলল, ঠিক আছে।
দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে লুলু জোর দিকে চেয়ে বলল, তৈরি হও।
জো রোজমারির দিকে চেয়ে বলল, ডোরবেল বাজলে দরজাটা খুলে দিতে পারবে কি?
না জো। আমি বরং চেঁচাব। চেঁচিয়ে গোপীনাথকে সাবধান করে দেব।
জো লুলুর দিকে চেয়ে বলল, তা হলে দু’জনকে শোয়ার ঘরে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দাও। নইলে কাজ পণ্ড হতে পারে।
লুলু অত্যন্ত দ্রুত এগিয়ে এসে প্রায় হ্যাচকা টানে দু’জনকে দাঁড় করিয়ে দিল। তারপর অত্যন্ত কঠিন হাতে দু’জনকে ধাক্কা দিয়ে নিয়ে শোয়ার ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।
জো গিয়ে দরজাটা খুলে একটু ফাঁক করে রাখল। তারপর পিছিয়ে এসে দু’দিকের দেওয়ালের আড়ালে সরে দাঁড়াল দু’জন। হাতে উদ্যত পিস্তল।
দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে গেল। তারপর খুব বিনীত কণ্ঠে জার্মান ভাষায় শোনা গেল, শুভ সন্ধ্যা। ভিতরে আসতে পারি?
জো একটা দাতে দাঁত চাপল। তারপর আড়াল থেকে বেরিয়ে লোকটার মুখোমুখি হয়ে হাঁ করে চেয়ে রইল।
বিস্মিত জো?
খুবই।
সুধাকর দত্ত ঘরে ঢুকে চারদিকে চেয়ে দেখল।
ও দুটি বুঝি শোয়ার ঘরে?
হা দাতা। কিন্তু তুমি এখানে কেন?
সুধাকর লুলুর দিকে চেয়ে বলল, এই বুঝি লুলু?
হা দাতা। কিন্তু তুমি কী চাও?
সুধাকর দু’জনের দিকে পর্যায়ক্রমে চেয়ে বলল, আমি বড্ড পরিশ্রান্ত। কয়েক দিনের বিশ্রাম চাই। আমার কী ইচ্ছে করে জানো? এই শীতের মরসুমে রাঁচি বা হাজারিবাগের কোনও জঙ্গলে নদীর ধারে নির্জন কোনও বাংলোয় কয়েকটা দিন হাঁফ ছেড়ে আসি। কিন্তু কপাল এমনই যে, সেই অবসর কখনওই পাওয়া যায় না।
জো পিস্তল নামিয়ে বলল, গোপীনাথ কোথায় দাতা?
সুধাকর সামনের সোফায় বসে নিরুদ্বেগ গলায় বলল, কাছেই রয়েছে। দরজার বাইরেই।
জো একটা পা বাড়াতেই সুধাকর বলল, নিজের অতীতের সব ট্রেনিং কি ভুলে গেছ জো?
কেন?
দরজার বাইরেটা তোমার পক্ষে নিরাপদ না-ও হতে পারে।
জো সুধাকরের দিকে চেয়ে বলল, আমাকে কি ফাঁদে ফেলেছ?
সুধাকর মাথা নেড়ে বলল, না। কী লাভ তাতে?
জো পিস্তলটা শক্ত হাতে চেপে ধরে বলল, আমি জানতে চাই বাইরে পুলিশ আছে কি।
নেই।
তা হলে কে আছে?
ভিকিজ মব।
কী চাও দাতা? আমাকে মারবে না জেলে দেবে?
সুধাকর দুটো পা ছড়িয়ে দিয়ে আরাম করে বসে বলল, আমাকে কী ভাবো তুমি? আমি কি কোনও অবতার না মেসায়া? আমি দুনিয়ার পাপ বিমোচন করতে এসেছি নাকি? ওটা আমার কাজ নয়।
তা হলে আমার কাজে বাধা দিচ্ছ কেন? বাইরে তোমার এজেন্টরাই বা মোতায়েন রয়েছে কেন?
তোমাকে বাড়তি পরিশ্রম থেকে বাঁচাতে।
জো বলল, তার মানে?
গোপীনাথকে মারার দরকার নেই জো। তুমি ফিরে যাও।
জো বিবর্ণ মুখে বলল, দাতা, তুমি কী বলছ জানো? এ কাজটা যদি সমাধা না করতে পারি তা হলে নিউ ইয়র্কে আমার বউ আর দুটো বাচ্চা সাফ হয়ে যাবে। একবার ব্যর্থ হয়েছিলাম বলে আমাকে তারা হুমকি দিয়ে রেখেছে।
সুধাকর একবার আড়মোড়া ভেঙে হাই তুলে বল, জানি।
জানো?
জানি জো।
আমি জানতে চাই তুমি গোপীনাথকে আড়াল করছ কি না। করলে তোমার সঙ্গে অনেকগুলো গ্যাংলিডারের সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী। আমি সামান্য একজন আজ্ঞাবহ, ভাড়াটে খুনি মাত্র। কিন্তু তারা তো তা নয়।
শোনো জো, ওসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।
ভাবব না। কিন্তু আমার কী হবে দাতা?
তোমার বউ আর বাচ্চাকে ইতিমধ্যেই নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
তার মানে?
সুধাকর তার পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে জোর হাতে দিয়ে বলল, এই নম্বরে নিউ ইয়র্কে ফোন করলেই তুমি তোমার বউয়ের গলা পাবে। ফোনটা করো।
জো চিন্তিতভাবে ফোনের দিকে এগিয়ে গেল। তারপর ডায়াল করল। মিনিট চারেক বাদে ফোন রেখে সে সুধাকরের দিকে ফিরে বলল, কাল সন্ধেবেলা কয়েকজন বন্দুকধারী আমার বউ আর বাচ্চাদের তুলে এনেছে। তারা আছে হারলেমের একটা বাড়িতে। তুলে আনবার সময় কয়েকজন বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। সামান্য ধস্তাধস্তিও হয়। তবে গুলি চলেনি। এসব কী হচ্ছে দাতা?
অভিনব কিছু নয় জো। তোমার সংগঠনের লোকেরা তোমার বউ আর বাচ্চাদের ওপর নজর রাখছিল। তুমি এই মিশনে ব্যর্থ হলে তারা শোধ নিত। তুমি ভাল লোক নও জো। কিন্তু তোমার ভিতরে কিছু ভাল এলিমেন্ট ছিল। তোমার ওপর আমার বিন্দুমাত্র করুণা থাকত না, যদি না জানতাম যে তুমি পরিস্থিতির চাপে পড়ে এবং নিতান্ত প্রাণের ভয়ে মাফিয়াদের হয়ে কাজ করতে নেমেছ। তোমার সবচেয়ে দুর্বলতা তোমার পরিবার। বউ আর বাচ্চা। তুমি আদ্যন্ত একজন পারিবারিক মানুষ। পরিবার নিয়ে সুখে থাকা ছাড়া তোমার আর কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। এই পরিবারমুখী মনোভাবটা আজকাল হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ গুরা তোমার এই সবচেয়ে দুর্বলতার জায়গাটিকেই আঘাত করেছে। তুমি নিজের পরিবারকে বাঁচাতে যে-কোনও কাজ করতে প্রস্তুত, যদিও তোমার বিবেক তা চায় না। শুধু এই কারণেই তোমার পরিবারকে আমি নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে দিয়েছি।
জো হাসল, ধন্যবাদ। কিন্তু এ নিরাপত্তা কতদিন? ওরা একদিন আমার নাগাল পাবেই।
সুধাকর মাথা নেড়ে বলল, বিশ্বের পরিস্থিতি দ্রুত পালটে যাচ্ছে জো। নিউ ইয়র্কের ব্রংকস এলাকায় গত পরশু থেকে গ্যাংওয়ার শুরু হয়েছে। তোমার অর্গানাইজেশনের দু’জন বস খুন হয়ে গেছে। চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলার মধ্যে ফানুমি নামে একটা লোক সংগঠনের হাল ধরেছিল পরশু মধ্যরাতে। ফানুমি গতকাল নিউ ইয়র্ক ছেড়ে কোনওরকমে পালিয়ে যায়। সংগঠন আপাতত তিন টুকরো।
তা হলে আমার কী হবে?
সুধাকর মৃদু হেসে বলল, সেটা চিন্তার বিষয়।
চিন্তাটা কে করবে দাতা? আমি তো চিরকাল রোবটের মতো কাজ করে গেছি। অগ্রপশ্চাৎ ভাবিনি। পশুর জীবন বোধহয় একেই বলে। বাঁচো আর মায়েরা। এ ছাড়া কিছুই শিখিনি। পরিবারটাকে ভালবাসি। কিন্তু তাদের সঙ্গেই বা বছরে কটা দিন কাটাতে পারি?
নতুন একটা জীবন শুরু করো জো।
অসম্ভব! এরা তা করতে দেবে না আমাকে।
পালাও জো। অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাও। চাষবাস করো। ভদ্রজীবনে ফিরে এসো। তোমার বয়স চল্লিশের কোঠায়। এখনও সময় আছে।
লুলু এতক্ষণ একটা প্রস্তরমূর্তির মতো দাঁড়িয়ে ছিল। একটাও কথা বলেনি৷ ঝুলন্ত হাতে একটা পিস্তল নিম্নমুখী হয়ে আছে। আচমকাই সে একজন দক্ষ অ্যাক্রোব্যাটের মতো দাঁড়ানোর ওপরেই একটা ডিগবাজি খেয়ে জানালার দিকে সরে গিয়ে সটান মেঝের ওপর শুয়ে পড়ল। জাদুকরের মতো ডান হাতটা ঝটিতি উঠে এল ওপরে। পরপর দুটো গুলি চালাল সে। সোডার বোতলের ছিপি খোলার মতো দুটো শব্দ হল শুধু। যাকে লক্ষ্য করে সে গুলি চালিয়েছিল সে সুধাকর। সোফা সমেত সুধাকর উলটে পড়ে গিয়েছিল মেঝেয়।
খুব ধীরে উঠে দাঁড়াল লুলু। ইংরেজিতে বলল, হি ইজ ফিনিশড।
জো তার দিকে তাকিয়ে বলল, এ কাজ করলে কেন লুলু?
সেন্টিমেন্টাল ব্যাপারটা আমার সহ্য হয় না জো। ও তোমাকে নরম করে ফেলছিল। দাতা আমার বন্ধু ছিল।
লুলু পিস্তলটা জো এর দিকে স্থির রেখে বলল, খুব ধীরে পিস্তলটা মেঝেয় ফেলে দাও জো।
কেন?
তোমার কাজ শেষ হয়েছে। এখন আমার পালা।
জো ঈষৎ লাল হয়ে বলল, তুমি আমাকে হুকুম করছ? ভয় দেখাচ্ছ?
ভয় দেখাচ্ছি না। তোমাকে ফাঁকা ভয় দেখাব তেমন বোকা নই। পিস্তলটা ফেলে দাও জো।
জো পিস্তলটা ফেলে দিয়ে বলল, তুমি আকাট বোকা। দাতাকে মেরে চূড়ান্ত আহাম্মকের মতো কাজ করেছ। বাইরে ওর লোকেরা আছে। তাদের তুমি চেনো না, আমি চিনি। ভিকিজ মব। তাদের হাত থেকে তুমি কীভাবে রেহাই পাবে?
লুলু অনুত্তেজিত গলায় বলল, সুধাকর দত্ত ভিকিজ মবকে অনেকদিন ধরেই টুপি পরিয়ে আসছে। আহাম্মক আমি নয়, তুমি। সুধাকর দত্তর আসল পরিচয় তুমি জানো না। সুধাকর ইন্টারপোলের বিগ বস।
ইন্টারপোল! মাই গড!
সুখের কথা, সুধাকর দত্ত ওরফে দাতার মুখোশ খুলে গেছে। ভিকিজ মব ওকে আর তাদের ইউরোপিয়ান শাখার সর্দার বলে মানে না। আমি তাদের হয়েই অপ্রিয় কাজটা করলাম মাত্র। এর জন্য ভাল পয়সা পাওয়া যাবে।
ঈশ্বর! তুমি তা হলে কে লুলু?
একজন নিরীহ ব্যবসায়ী। টাকা আয় করি, ওড়াই। আমি জীবনটা আনন্দের সঙ্গে যাপন করতে ভালবাসি। তোমার মতো আমার কোনও পিছুটান নেই। না পরিবার, না প্রিয়জন। দেওয়ালের দিকে একটু সরে যাও জো। তোমার পিস্তলটা কুড়িয়ে নেওয়া দরকার।
তারপর?
তারপর মানে?
আমাকে নিয়ে কী করতে চাও?
ভয় পেয়ো না জো। তোমাকে নিরস্ত্র করে ছেড়ে দেব। তুমি স্বচ্ছন্দে নিজের জায়গায় ফিরে যাবে। তোমাকে মেরে আমাদের লাভ কী? আর একটা মৃতদেহ নিয়ে বরং সমস্যা বাড়বে। সরে যাও জো।
জো পিছিয়ে গেল। ধীর পায়ে এগিয়ে এল লুলু। পিস্তলটার কাছে এসে থমকে দাঁড়াল। একবার তাকাল মেঝের ওপর কাত হয়ে পড়ে থাকা সুধাকরের দিকে। সামান্য ভ্রু কোঁচকাল তার। দুটো গুলি খেয়েও সুধাকরের কোনও রক্তক্ষরণ হয়নি। অথচ হওয়ার কথা। সে পিস্তলটা কুড়োতে নিচু হল। একটু দ্বিধাগ্রস্ত সে। সুধাকরের রক্তক্ষরণ হয়নি কেন?
লুলু নিচু হয়েছিল বটে, কিন্তু আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারল না। একটা ছোট্ট পিড়িং শব্দ, একটা খুদে পিনের মতো জিনিস বিদ্যুতের গতিতে এসে তার বাঁ দিকের রগে বিধে গেল। কুঁজো অবস্থাতেই বিস্ফারিত হয়ে গেল তার চোখ। তারপর সে ঢলে পড়ল মেঝের ওপর।
সুধাকর কল-টেপা পুতুলের মতো উঠে দাঁড়াল।
জো প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, তুমি মরোনি?
সুধাকর একটু হাসল, একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ক্রাইম অপারেটরের কি লুলুর মতো আনাড়ির হাতে মরা শোভা পায় জো?
কিন্তু ও তো গুলিটা ভালই চালিয়েছিল মনে হল।
তা বটে। শার্প শুটার। তবে টাইম আর স্পেসের কতগুলো হিসেব আছে। সূক্ষ্ম হিসেব। তুমি তো জানো।
জো হাসল, ইউ আর এ গুড সারভাইভার। কিন্তু ভিকিজ মব কি তোমাকে শত্রু ভাবছে? তা হলে এখান থেকে বেরোনো আমাদের কঠিন হবে।
ভয় নেই জো। আমি আসলে কে ভিকি জানে। আমরা হাত ধরাধরি করে কাজ করি। কাটা দিয়েই তো কাটা তুলতে হয়। তাই আমি ক্রিমিনালদের সব সময়ে এলিমিনেট করার পক্ষপাতী নই। তারাও কাজে আসে।
ধন্যবাদ। তোমাকে অজস্র ধন্যবাদ।
পকেট থেকে একটা সেলুলার ফোন বের করে ডায়ালের পর সংক্ষেপে সুধাকর বলল, চলে আসুন।
পাঁচ মিনিট পর গোপীনাথ আর সোনালি সলজ্জ এবং খানিকটা ভীত মুখে ঘরে ঢুকল। শোয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এল মনোজ আর রোজমারি। ঘরে ঢুকল সুব্রত।
রোজমারির দিকে চেয়ে সুধাকর বলল, খুব বোকার মতো কাজ করেছেন ম্যাডাম। লুলুকে বিশ্বাস করা আপনার উচিত হয়নি। আপনার কারখানার সাবোটাজের পেছনে লুলু। আন্তর্জাতিক গুন্ডাদের লেলিয়ে দেওয়ার পেছনে লুলু। জো-কে কন্ট্রাক্ট দেওয়ার পিছনেও লুলু। চমৎকার মাথা, বিচ্ছিরি চরিত্র এই হল লুলু।
আমি দুঃখিত মিস্টার দত্ত।
আপনার স্বামী হয়তো দুর্বল চিত্ত, কিন্তু উনি মস্তিষ্কবান এবং ভাল লোক। আপনার জীবনে লুলুর মতো লোকের ভূমিকা কী?
আমি বিপদের মুখে পড়ে মনোজকে আজ চিনেছি। সে সত্যিই চমৎকার লোক।
.
বছর দেড়েক বাদে এক সন্ধেবেলা সুইডেনের সোলনা শহরের এক প্রান্তে বিশাল ভেনাস ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ সেন্টারের ফটক দিয়ে একটি দামি মার্সিডিজ গাড়ি বেরিয়ে এল। চালকের আসনে গোপীনাথ। মুখে কোনও উদ্বেগ নেই। এই ছোট্ট ছিমছাম সুন্দর শহরটি তার খুব পছন্দ। তার চেয়েও পছন্দ ভেনাস ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ সেন্টারকে। দেড় বছর আগে সে এই কোম্পানিতে যোগ দেয়। কোম্পানি দিয়েছিল প্রভূত বেতন এবং অপার স্বাধীনতা। ভূতের মতো দিনরাত খেটেছিল গোপীনাথ।
এক বছরের মধ্যেই সলিড ফুয়েল তৈরি করা সম্ভব হয়। তবে খরচ পড়েছিল মারাত্মক। পরবর্তী ছ’মাস ধরে চলেছিল বাণিজ্যিক হারে জিনিসটা তৈরির চেষ্টা। দু’মাস আগে সে কাজও সফল হয়েছে অন্তত কুড়িজন বৈজ্ঞানিকের নিরন্তর চেষ্টায়। ভেনাস কিছুদিনের মধ্যেই বহুধা ব্যবহারযোগ্য জ্বালানিটি বাজারে ছাড়বে।
দ্বিতীয়বার বিদেশে এসে সোনালিকে সেই প্রথমবারের মতোই একাকিত্বের জীবন কাটাতে হয়। গোপীনাথ ভয় পেয়ে বলেছিল, তোমার তো আবার একা লাগছে। আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না তো!
সোনালি অবাক হয়ে বলেছিল, একা! না এত একা নই। আমার ভিতরে একটা ছোট্ট তুমি আছে। সে সঙ্গ দেয়।
খুব হেসেছিল তারা। সোনালির একা লাগত হয়তো, কিন্তু গোপীনাথের ভবিষ্যৎ শুধু নয়, পৃথিবীর ভবিষ্যৎ ভেবেও মেনে নিত। দিনের বেলা যেত মার্কেটিং-এ। কখনও পার্ক বা হ্রদের ধারে গিয়ে বসে থাকত। সাত মাস আগে তাদের ছেলে দীপ্যমানের জন্ম হল। ব্যস, সোনালির সব মন-খারাপ ডানা মেলে উড়ে গেল।
দীপ্যমানের জন্মের প্রায় সমসময়েই শেষ হয়েছিল গোপীনাথের পাহাড়প্রমাণ কাজ। তারপর থেকে সে রোজ ল্যাবরেটরি থেকে সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে আসে। শহরটা খুব নির্জন। এই নির্জনতা তাদের ভালই লাগে।
গাড়ি চালাতে চালাতে গত দেড় বছরের কথা ভাবছিল গোপীনাথ। দেড় বছর আগে এক সাংঘাতিক মৃত্যুভয়তাড়িত সময়ে যখন বেঁচে থাকার সবটুকু আশা জলাঞ্জলি দিয়েছিল সে, তখন সোনালি যেন একঝলক হাওয়ার মতো তার বুকে একটা বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষার সঞ্চার ঘটিয়েছিল। ওইভাবেই সোনালির দ্বিতীয় অভিষেক হল তার জীবনে। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, আজকাল কর্মক্লান্ত দিনের শেষে সোনালির কাছেই তার ফিরতে ইচ্ছে করে। আর দীপ্যমান। হ্যাঁ, অবশ্যই দীপ্যমান।
ছবির মতো সুন্দর বাগানে ঘেরা তাদের দোতলা বাড়িটি। কত যে ফুল চারদিকে ফুটে আছে। ধুলো নেই, ময়লা নেই। শুধু সুগন্ধ। এখন গ্রীষ্মকাল। বড় মনোরম আবহাওয়া।
ছোট্ট একটু হর্নের শব্দ করে গাড়ি পার্ক করল গোপীনাথ। তারপর নামল। শ্বেতপাথরের সিঁড়ি বেয়ে যখন দরজায় দাঁড়াল তখন তার মুখে হাসি, বুকটা ভরা। সে কি আজ সুখী? সে কতটা সুখী?
দরজাটা খুলে গেল। একটু আনমনা গোপীনাথ ডোরম্যাটে পা মুছে ভিতরে ঢুকতে যাচ্ছিল, দরজার আড়াল থেকে একটা ভারী গলা বলে উঠল, হ্যান্ডস আপ।
গোপীনাথের হৃৎপিণ্ড একটা ডিগবাজি খেল। হাত দুটো ওপরে তুলল সে। আন্দাজ করল, লোকটা তার দু’হাত পিছনে দাঁড়ানো। আচমকা গোপীনাথ সটান উবু হয়ে পিছনের দিকে হাত চালিয়ে লোকটার দুটো পা ধরে হ্যাচকা টান মারল। গোটা ব্যাপারটা ঘটে গেল সেকেন্ডের ভগ্নাংশে। দড়াম করে পড়ে গিয়ে লোকটা বাংলায় বলে উঠল, উঃ, এ তো দেখচি গুরুমারা বিদ্যে।
গোপীনাথ তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে সুধাকরকে মেঝে থেকে তুলে বলল, ইস! লাগেনি তো! ছিঃ ছিঃ, কী কাণ্ড বলুন তো।
সুধাকর হেসে বলল, আই অ্যাম প্লিজড। মাথার কাজ করতে করতে যে রিফ্লেক্স কমে যায়নি তা দেখে খুশি হয়েছি।
কখন এলেন?
ঘন্টা দুই। কফিটফি খেয়েছি। সোনালি আমার জন্য ধোকার ডালনা রান্না করছেন। আর দীপ্যমান আমার নাক কামড়ে দিয়েছে।
খুব হাঃ হাঃ করে হাসল গোপীনাথ। তারপর বলল, আজ থেকে যেতে হবে। অনেক কথা আছে।
সুধাকর মাথা নেড়ে বলল, ডিনারের পরই চলে যাব। কাজ আছে।
এত কী কাজ বলুন তো!
সুধাকর হাসল, দুনিয়ার একটা দিক আপনি দেখতে পান। অন্যান্য দিকগুলি আমাদের মতো লোককে দেখতে হয়। সেখানে দুনিয়ার যত কাদা, নোংরা, যত ক্লেদ।
আবার কবে আসবেন?
চলে আসব। দীপ্যমানকে দেখার পর আমার একটা মায়া জন্মেছে। ইউ আর এ হ্যাপি ম্যান।
কথায়, হাসিতে, খাওয়ায়দাওয়ায় সন্ধেটা চমৎকার কেটে গেল তাদের। পুরনো কথা হল অনেক। রাত আটটায় একটা গাড়ি এল। চলে গেল সুধাকর।
ফাঁকা ঘরে সোনালি আর গোপীনাথ। দীপ্যমান ঘুমোচ্ছে।
সোনালি বলল, বেশ লোকটা, না?
হ্যাঁ, বেশ লোক। ও না বাঁচালে কবে আমি খুন হয়ে যেতাম।
একটু শিউরে উঠে সোনালি তাড়াতাড়ি তার পাশে এসে বসল। গোপীনাথ তাকে এক হাতে বেষ্টন করে বলল, হানিমুনে যাবে? আমরা আজ অবধি যাইনি কিন্তু।
যাঃ, বাচ্চা হওয়ার পর কেউ হানিমুনে যায় বুঝি?
যায় না?
না। তখন হানিমুন ঘরেই করতে হয়।
তাই! বলে অপলক চোখে সোনালির দিকে চেয়ে রইল গোপীনাথ।
তাই। বলে চোখ বুজে ফেলল সোনালি। লজ্জায়।