৩১তম অধ্যায়
সুশর্ম্মার সহিত বিরাটরাজের যুদ্ধ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! পাণ্ডবগণ ছদ্মবেশে মৎস্যদেশে বাস ও মৎস্যরাজ বিরাটের কাৰ্য্যানুষ্ঠান করিয়া নিয়মিত কাল অতিবাহিত করিলেন। দুরাত্মা কীচক নিহত হইলে তাহারাই বিরাটরাজের একমাত্ৰ সহায় হইয়াছিলেন।
এদিকে ত্রিগর্ত্তাধিপতি সুশৰ্মা বলপূর্ব্বক বিরাটরাজ্যের বহুতর গোধন অপহরণ করিলেন। তখন গোপ সত্বর রথারোহণপূর্ব্বক মহাবেগে পুরপ্রবেশ করিল এবং কুণ্ডলাঙ্গদধারী, মহাবলপরাক্রান্ত বহুতর যোধ, মন্ত্রী ও পাণ্ডবগণে পরিবৃত মহারাজ বিরাটকে সভামধ্যে আসীন দেখিয়া সত্বর রথ হইতে অবতরণপূর্ব্বক তাহার সন্নিধানে উপনীত হইয়া প্ৰণতিপূর্ব্বক কহিল, “মহারাজ! ত্রিগর্তেরা আমাদিগকে সবান্ধবে সমরে পরাজয় করিয়া আপনার সহস্ৰ সহস্ৰ গোধন অপহরণ করিয়াছে। এক্ষণে ইহার যথাবিধি প্রতিবিধান করিয়া আপনার গোধন রক্ষা করুন।’
বিরাটরাজ গোপের এই কথা শ্রবণ করিবামাত্র রথমাতঙ্গ সঙ্কুল [রথহস্তিসমাকীর্ণ], অশ্বপদাতিগণ-সমাকীর্ণ, ধ্বজপট [পতাকা]-সুশোভিত। স্বীয় সেনাদিগকে যুদ্ধার্থ প্রস্তুত হইতে আদেশ করিলেন। তখন সমুদয় রাজা ও রাজকুমারগণ বিরাটের আজ্ঞা শ্রবণমাত্র অতিমাত্র ব্যগ্র হইয়া বীরপ্রিয় বিচিত্র কবচ ধারণ করিতে লাগিলেন। বিরাটের প্রিয় ভ্রাতা শতানীক হীরকখণ্ডমণ্ডিত কাঞ্চনময় ও তৎকনিষ্ঠ মন্দিরাক্ষ কল্যাণকর লৌহময় অক্ষয় কবচ ধারণ করিলেন। পরে বিরাটরাজ স্বয়ং শতসূৰ্য্যসম আবর্ত্তশতসম্পন্ন নেত্ৰোপমিত ছিদ্রশতসংযুক্ত নিতান্ত দুর্ভেদ্য বর্ম্মে বিভূষিত হইলেন। রাজা সূৰ্য্যদত্ত সূৰ্য্যসঙ্কাশ নীলোৎপলালঙ্কৃত কবচ ধারণ করিলেন। তৎপরে বিরাটের জ্যেষ্ঠ পুত্ৰ মহাবীর শঙ্খ রজতময় আয়তগর্ভ শতাক্ষিসংযুক্ত শ্বেতবর্ণ বর্ম্ম পরিগ্রহ করিলেন এবং নানাপ্রহরণধারী দেবরূপ মহারথীসকল সংগ্রামার্থ বিবিধ বর্ম্ম ধারণ করিতে লাগিলেন।
অনন্তর উপকরণসম্পন্ন শুভ্রবর্ণ রথে সুবৰ্ণময়-বর্ম্মসংযুক্ত অশ্বগণ যোজিত হইল। মহানুভব মৎস্যরাজ সূৰ্য্যচন্দ্রসদৃশ হিরন্ময় দিব্য রথে ধ্বজ উত্থিত করিয়া দিলেন। পরে অন্যান্য মহাবলপরাক্রান্ত ক্ষত্ৰিয়সকল স্ব স্ব রথে নানাপ্রকার ধ্বজ যোজনা করিতে লাগিলেন। তখন মৎস্যরাজ স্বীয় কনিষ্ঠ ভ্রাতা শতানীককে কহিলেন, “ভ্ৰাতঃ! বোধ হইতেছে মহাবীর কঙ্ক, বল্লব, গোপাল ও দামগ্রন্থি [রজ্জুদ্বারা গোবন্ধনকারী] ইহারাও যুদ্ধ করিবেন, অতএব তুমি ইহাদিগকেও ধ্বজপতাকাসম্পন্ন রথ ও বিবিধ আয়ুধ প্ৰদান কর। ইহারা মৃদু সুদৃঢ় বিচিত্র বর্ম্ম ধারণ করুন।”
গোগ্রহণজনিত যুদ্ধে পাণ্ডবগণের সাহায্য
শতানীক রাজার এই কথা শ্রবণ করিবামাত্র সত্বর পাণ্ডবগণকে রথদানের আদেশ করিলেন। রাজভক্তিসম্পন্ন সারথি তৎক্ষণাৎ যুধিষ্ঠির, ভীম, নকুল ও সহদেবের নিমিত্ত রথ প্রস্তুত করিল। তখন সেই প্রচ্ছন্নরূপী অরতিনিপাতন যুদ্ধবিশারদ মহারথচতুষ্টয় বিরাটনির্দ্দিষ্ট বিচিত্র কবচ ধারণ করিয়া সুবর্ণমণ্ডিত বিচিত্র রথে আরোহণপূর্ব্বক সত্বর রাজধানী হইতে নিৰ্গত হইয়া হৃষ্টচিত্তে মৎস্যরাজের অনুসরণ করিতে লাগিলেন।
সহস্ৰ সহস্ৰ সুশিক্ষিত ষষ্টিবৰ্ষবয়স্ক যোধগণাধিষ্ঠিত মদস্রাবী মত্ত মাতঙ্গ-সকল জঙ্গম পর্ব্বতের ন্যায় তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিল। যুদ্ধবিশারদ উৎসাহশীল প্রধান প্রধান মৎস্য [বিরাটরাজের সৈন্যসমূহ]-গণ বিরাটরাজের অনুগমন করিবার নিমিত্ত অষ্ট সহস্ৰ রথী, সহস্র হস্তী ও ব্যষ্টি সহস্ৰ অশ্ব লইয়া নিৰ্গত হইলেন। তখন সেই হস্ত্যশ্বরথ, সন্ধুল যোদ্ধৃবর্গ-পরিবৃত গোস্থানগমানসমুদ্যত বিরাটসেনা-সমুদয় অলৌকিক শোভা ধারণ করিল।