৩১তম অধ্যায় – যুধিষ্ঠিরাদির দুর্য্যোধন–অন্বেষণ
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! পাণ্ডবেরা আমার সৈন্যগণকে বিনষ্ট করিলে হতাবশিষ্ট অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য্য, কৃতবর্ম্মা এবং আমার পুত্র মন্দবুদ্ধি দুর্য্যোধন তৎকালে কি করিলেন?”
সঞ্জয় কহিলেন “মহারাজ! ঐ সময় ক্ষত্রিয়-রমণীগণ ধাবমান, ও শিবির শূন্য হইলে আমাদিগের পক্ষীয় সেই তিনজন মহারথ পাণ্ডবগণের জ্যকোলাহল শ্রবণপূর্ব্বক তথায় অবস্থান করিতে একান্ত অসমর্থ হইয়া হ্রদাভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। তখন ধৰ্ম্মপরায়ণ যুধিষ্ঠিরও দুর্য্যোধনকে বিনাশ করিবার বাসনায় হৃষ্টমনে ভ্রাতৃগণসমভিব্যাহারে সমরাঙ্গনে পর্যটন করিয়া পরম যত্নসহকারে কুরুরাজের অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন; কিন্তু কোনক্রমেই তাঁহাকে দেখিতে পাইলেন না। কুরুরাজ ইতিপূৰ্বেই গদাহস্তে রণস্থল হইতে দ্রুতবেগে নিষ্ক্রান্ত হইয়া স্বীয় মায়াপ্রভাবে সলিল স্তম্ভিত করিয়া হ্রদমধ্যে প্রবেশ করিয়াছিলেন। ঐ সময় দুৰ্য্যোধনের অন্বেষণ করিতে করিতে পাণ্ডবগণের বাহনসকল একান্ত পরিশ্রান্ত হইল। তখন তাঁহারা সৈন্যগণসমভিব্যাহারে শিবিরে উপস্থিত হইয়া বিশ্রাম করিতে লাগিলেন।
কৃপাচাৰ্য্যাদির জলমধ্যগত দুৰ্য্যোধনাহ্বান
“এ দিকে মহাবীর কৃপ, অশ্বত্থামা ও কৃতবর্ম্মা মৃদুপদসঞ্চারে সেই হ্রদ-সন্নিধানে গমন করিয়া সলিলমধ্যে নিমগ্ন রাজা দুর্য্যোধনকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! এক্ষণে তুমি হ্রদমধ্য হইতে সমুত্থিত হইয়া আমাদের নিকট আগমনকর এবং আমাদিগের সমভিব্যাহারে যুধিষ্ঠিরের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হই, হয়ে পাণ্ডুনন্দনকে বিনাশপূর্ব্বক পৃথিবী ভোগ কর, না হয় তাহার হস্তে নিহত হইয়া সুরলোক প্রাপ্ত হও। হে দুর্য্যোধন! তুমি পাণ্ডবগণের সৈন্য-সমুদয়কে প্রায় বিনাশ করিয়াছ। যাহারা অবশিষ্ট আছে, তাহারাও তোমার শরনিকরে ক্ষতবিক্ষত হইয়াছে। এক্ষণে আবার আমরা তোমাকে রক্ষা করিতেছি, সুতরাং পাণ্ডবগণ কিছুতেই তোমার বেগ সহ্য করিতে সমর্থ হইবে না।’
“তখন রাজা দুর্য্যোধন তাঁহাদিগের বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “হে মহারথগণ! আমি ভাগ্যবলে এইরূপ ভয়ঙ্কর লোকক্ষয়কর সংগ্রাম হইতে তোমাদিগকে বিমুক্ত দেখিলাম। অতঃপর শ্রমাপনোদনপূর্ব্বক সকলে একত্র হইয়া পাণ্ডবগণকে পরাজিত করিব। এক্ষণে তোমরা সকলেই সাতিশয় পরিশ্রান্ত হইয়াছ এবং আমিও শরনিকরে নিতান্ত ক্ষতবিক্ষত হইয়াছি, বিশেষতঃ পাণ্ডবগণের সৈন্য এখনও অধিক পরিমাণে আছে, সুতরাং এ সময় যুদ্ধ করিতে আমার কোনমতেই অভিরুচি হইতেছে না। তোমরা বীরগণের অগ্রগণ্য; অতএব আমার প্রতি গাঢ়তর অনুরাগ প্রদর্শনপূর্ব্বক যুদ্ধে এইরূপ উৎসাহ প্রদান করা তোমাদের নিতান্ত বিস্ময়কর নহে। আমার মতে এ সময় পরাক্রম প্রকাশ করা নিতান্ত অকর্তব্য। আমি এই রাত্রিটি বিশ্রাম করিয়া কল্য তোমাদিগের সমভিব্যাহারে বিপক্ষগণের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইব, সন্দেহ নাই।
“তখন মহাবীর অশ্বত্থামা রাজা দুর্য্যোধনকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে মহারাজ! তুমি এক্ষণে হ্রদমধ্য হইতে উত্থিত হও। তোমার মঙ্গল হউক, আমরাই তোমার বিপক্ষগণকে বিনাশ করিব। হে বীর! আমি ইষ্টাপূৰ্ত্ত [যাগযজ্ঞাদি ও জলাশযাদি নির্ম্মাণপুণ্য], দান, সত্য ও জয় দ্বারা শপথ করিয়া কহিতেছি, অদ্য নিশ্চয়ই পাণ্ডবগণকে বিনাশ করিব। যদি আমি রজনী প্রভাত না হইতে তোমার শত্রুগণকে বিনাশ করিতে না পারি, তাহা হইলে যেন আমার সজ্জনোচিত যুদ্ধকৃত প্রীতি কদাচ অনুভূত না হয়। আমি নিশ্চয় কহিতেছি যে, পাঞ্চালগণকে বিনষ্ট করিয়া কদাপি কবচ পরিত্যাগ করিব না।’
ব্যাধগণ মুখে ভীমের দুর্য্যোধন সন্ধানলাভ
“হে মহারাজ! তাঁহারা এইরূপ কথোপকথন করিতেছেন, ইত্যবসরে কতকগুলি ব্যাধ মাংসভার-বহন-ক্লেশে একান্ত পরিশ্রান্ত হইয়া জলোপসেবনের নিমিত্ত যদৃচ্ছাক্রমে সেই হ্রদসন্নিধানে আগমন করিল। ব্যাধগণ ভীমের আহারার্থ প্রতিদিন পরম ভক্তিসহকারে মাংস আহরণ করিত। তাহারা সেই হ্রদের কূলে উপবেশনপূর্ব্বক নির্জ্জনে রাজা দুর্য্যোধন ও সেই সমস্ত মহারথগণের কথোপকথন শ্রবণ করিতে লাগিল। ঐ সময় কৃপাচার্য্য প্রভৃতি বীরগণও সমস্পৃহাশূন্য সলিলে নিমগ্ন রাজা দুর্য্যোধনকে যুদ্ধ করিবার নিমিত্ত নিৰ্ব্বন্ধাতিশয় [যুদ্ধাভিলাষহীন] সহকারে অনুরোধ করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন ব্যাধগণ তাঁহাদের পরস্পর কথোপকথন শ্রবণ করিয়া রাজা দুর্য্যোধন যে হ্রদমধ্যে নিমগ্ন হইয়াছেন, ইহা স্পষ্টই বুঝিতে পারিল।
“হে মহারাজ! ইতিপূৰ্ব্বে রাজা যুধিষ্ঠির ঐ ব্যাধগণকে দুৰ্য্যোধনের সংবাদ জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন। এক্ষণে তাহারা যুধিষ্ঠিরের সেই বাক্য স্মরণ করিয়া অপরিস্ফুটরূপে পরস্পর কহিতে লাগিল, ‘দেখ, রাজা দুর্য্যোধন নিশ্চয়ই এই হ্রদমধ্যে অবস্থান করিতেছেন; অতএব চল, আমরা রাজা যুধিষ্ঠিরের নিকট গিয়া এই বৃত্তান্ত প্রকাশ করি, তাহা হইলে অবশ্যই তাহার নিকট বিপুল অর্থ প্রাপ্ত হইব। মহাবীর ভীমসেনও আমাদিগের মুখে এই বৃত্তান্ত শ্রবণ করিলে আমাদিগকে প্রার্থনাধিক অর্থ দান করিলেন। উহাদের দুইজনের নিকট বিপুল ধন প্রাপ্ত হইলে আর প্রতিদিন এইরূপ শুষ্ক মাংস বহন করিতে হইবে না।’ অর্থলোলুপ ব্যাধেরা এইরূপ পরামর্শ করিয়া প্রফুল্লমনে মাংসভার গ্রহণপূর্ব্বক শিবিরাভিমুখে গমন করিতে লাগিল।
এ দিকে পাণ্ডবেরা দুর্য্যোধনকে দেখিতে না পাইয়া কলহের মূলোচ্ছেদ করিবার মানসে তাঁহার অনুসন্ধানে রণস্থলের চতুর্দ্দিকে দূত প্রেরণ করিলেন। দূতেরা বহুক্ষণ অনুসন্ধান করিয়া পরিশেষে যুধিষ্ঠিরের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া নিবেদন করিল, ‘মহারাজ! দুরাত্মা দুৰ্য্যোধনের কোন অনুসন্ধান পাইলাম না; সে পলায়ন করিয়াছে। রাজা যুধিষ্ঠির তাহাদিগের সেই বাক্য শ্রবণ করিয়া চিন্তাকুলিতচিত্তে দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। ঐ সময় ব্যাধগণ হৃষ্টচিত্তে অতি সত্বর দীনভাবাপন্ন পাণ্ডবগণের শিবিরে সমুপস্থিত হইল এবং নিবারিত হইয়াও শিবিরমধ্যে প্রবেশপূর্ব্বক মহাবল-পরাক্রান্ত ভীমসেনের সমীপে গমন করিয়া তাঁহাকে আদ্যোপান্ত সমস্ত বৃত্তান্ত নিবেদন করিল। তখন মহাবীর বৃকোদর তাহাদিগকে প্রভূত ধনদানপূর্ব্বক ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের নিকট গমন করিয়া কহিলেন, “মহারাজ! আপনি যে দুৰ্য্যোধনের নিমিত্ত বৃত্তান্ত অবগত হইলাম। সে জলস্তম্ভ করিয়া হ্রদমধ্যে শয়ান রহিয়াছে।
পাণ্ডবগণের হ্রদসমীপে গমন
“অজাতশত্রু যুধিষ্ঠির ভীমসেনের সেই প্রিয়বাক্য শ্রবণে সোদরগণের সহিত যার পর নাই আহ্লাদিত হইলেন এবং জনার্দনকে পুরোবৰ্ত্তী করিয়া অবিলম্বে হ্রদাভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। ঐ সময় হৃষ্টচিত্ত পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণের ভীষণ সিংহনাদ ও কিলকিলা শব্দ প্রাদুর্ভুত হইল। ক্ষত্রিয়গণ সকলেই অতি সত্বর দ্বৈপায়ন-হ্রদ সমীপে ধাবমান হইলেন। সেমাকগণ মহা আহ্লাদিত হইয়া ‘দুর্য্যোধনকে দেখিয়াছি ও তাহার বিষয় জ্ঞাত হইয়াছি’ বলিয়া চতুর্দ্দিক হইতে বারংবার চীৎকার করিতে লাগিলেন। বেগগামী রথীগণের ঘোরতর শব্দ আকাশমার্গে সমুত্থিত হইল। শ্রান্তবাহন বীরগণ অবিলম্বে যুধিষ্ঠিরের অনুগমন করিলেন। মহারথ অর্জ্জুন, ভীমসেন, নকুল, সহদেব, পাঞ্চালবংশোদ্ভব ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী, উত্তমৌজা, যুধামন্যু, সাত্যকি, দ্রৌপদীর পঞ্চ পুত্র এবং হতাবশিষ্ট পাঞ্চালগণ চতুরঙ্গবল সমভিবাহারে দ্বৈপায়নহ্রদাভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। পরিশেষে প্রবল প্রতাপশালী ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির সেই দুর্য্যোধন সমাশ্রিত দ্বৈপায়ন-হ্রদের সমীপে সমুপস্থিত হইলেন। ঐ হ্রদ দ্বিতীয় সাগরের ন্যায়, উহার জল অতি নিৰ্ম্মল ও সুশীতল। আপনার পুত্র দুর্য্যোধন গদাপাণি হইয়া মায়াভাবে সেই জলরাশি স্তম্ভিত করিয়া অলক্ষিতরূপে তাহার মধ্যে বাস করিতেছিলেন। ঐ সময় পাণ্ডবসৈন্যের সেই মেঘগম্ভীর তুমুল শব্দ তাঁহার কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইল। তখন রাজা যুধিষ্ঠির আপনার পুত্রের বিনাশবাসনায় শঙ্খশব্দ ও রথনির্ঘোষে ভূমণ্ডল কম্পিত করিয়া ভ্রাতৃগণসমভিব্যাহারে সেই হ্রদের উপকূলে উপস্থিত হইলেন। তখন মহারথ কৃপাচার্য্য, কৃতবর্ম্মা ও অশ্বত্থামা পাণ্ডবসৈন্যের সেই তুমুল নিনাদ শ্রবণ করিয়া দুর্য্যোধনকে কহিলেন, “মহারাজ! ঐ সমরবিজয়ী পাণ্ডবগণ মহা আহ্লাদে আগমন করিতেছে। অতএব তুমি অনুমতি প্রদান করিলে আমরা এ স্থান হইতে প্রস্থান করি।’ রাজা দুর্য্যোধন তাঁহাদিগের বাক্যশ্রবণে ‘তথাস্তু’ বলিয়া মায়াপ্রভাবে জলরাশি স্তম্ভিত করিয়া অবস্থান করিতে লাগিলেন। কৃপ প্রভৃতি মহারথগণও শোকার্তচিত্তে বহুদূরে গমনপূর্ব্বক সাতিশ শ্রান্ত হইয়া এক বৃটবৃক্ষমূলে উপবেশন করিলেন। তাঁহারা মহাবল-পরাক্রান্ত দুর্য্যোধন জলরাশি স্তম্ভিত করিয়া শয়ান রহিয়াছেন, পাণ্ডবগণও যুদ্ধার্থ হ্রদসমীপে সমুপস্থিত হইয়াছে, এক্ষণে কিরূপে যুদ্ধ হইবে, পাণ্ডবেরা কিরূপেই বা তাঁহার অনুসন্ধান পাইবে, আর অনুসন্ধান পাইলেই বা রাজ দুর্য্যোধন কিরূপে পরিত্রাণ পাইবেন।’ এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে অশ্বগণকে রথ হইতে বিমুক্ত করিয়া তথায় অবস্থান করিতে লাগিলেন।”