বন্দরে জাহাজ লাগাবার পর যা ভয় করেছিলেন হয়েছেও ঠিক তা-ই।
নতুন জয় করা সূর্য কাঁদলে সোনার দেশ থেকে জাহাজ এসে পানামার বন্দরে লাগলে অনেকেই সেখানে গিয়ে হাজির হয়। কেউ যায় পরিচিত বন্ধুবান্ধব আসছে জেনে, কেউ-বা শুধু সে দেশের নতুন খবরাখবর জানবার কৌতূহলে। পানামার রাজসরকার থেকে খাজাঞ্চি কোতোয়াল যায় স্পেনের সম্রাটের জন্যে পাঠানো সোনাদানার দখল নিতে আর আসে ব্যাপারী বা তাদের দালারেরা ভিকুনার পশম কি আলপাকার রেশমি লোমে বোনা কাপড়-চোপড়ের মতো সওদা থেকে কেনাবেচার গোলামের মতো পণ্যের খোঁজে।
ফেলিপিলিও ক্রীতদাস হিসেবে গানাদো আর কয়াকে নিয়ে বন্দরে পা দিতে-না-দিতেই একজন নয়, দু-জন দালালের চোখে পড়েছে।
কয়ার মুখ আর শরীর প্রায় আগাগোড়াই বেটপ নোংরা ময়লা পোশাকে ঢাকা। কিন্তু তা সত্ত্বেও পাশ দিয়ে চলে যেতে গিয়ে একজন থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে হঠাৎ।
তারপর বর্বর তাচ্ছিল্যের সঙ্গে টান দিতে গেছে কয়ার গায়ের কাপড়ে।
ফেলিপিলিও বাধা দিতে গেছে, কিন্তু তার আগেই গানাদো এক ঝটকায় দালালের হাতটা সরিয়ে দিয়ে কয়াকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছেন।
প্রথমে সত্যিই হতভম্ব হয়ে গেছে দালাল। তারপর তার দু-চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরে বেরিয়েছে। একটা ক্রীতদাসের এরকম স্পর্ধা দালালের বুঝি কল্পনারও বাইরে।
দাঁতে দাঁত ঘষে হিংস্র জ্বলন্ত স্বরে সে ফেলিপিলিওকেই প্রথম গালাগাল দিয়ে বলেছেন, তুমি এ গোলামের মালিক! গোলাম হয়ে সে ভদ্রলোকের গায়ে হাত তোলে! ওর ওই হাত দুটো কেটে সমস্ত গায়ের ছাল ছাড়িয়ে নেব আর তোমারও গোলাম কেনাবেচার কারবার কেমন করে চলে তা দেখব! দেখেছেন সেনর এ গোলামের স্পর্ধা?
শেষ কথাটা বলা হয়েছে পাশের আর একটি প্রৌঢ়-গোছের লোককে। এ লোকটিও ওই জায়গা দিয়ে যেতে যেতে প্রথম দালালের ক্রুদ্ধ চিৎকার শুনেই বোধহয় দাঁড়িয়ে পড়েছে।
চেহারায় সৌম্য শান্ত গোছের মনে হলেও এ লোকটিও যে আর-এক দালাল তা বোঝা গেছে দু-একটি কথার পরেই।
প্রথম দালালের প্রশ্নের উত্তরে প্রৌঢ় লোকটি বেশ তিক্ত স্বরেই বলেছে, হ্যাঁ, দেখলাম। দেখেই তো দাঁড়িয়ে পড়েছি।
আমি এখানেই ওর ছাল চামড়া ছাড়িয়ে নিচ্ছি, দেখুন না। গর্জন করে বলেছে প্রথম দালাল।
না। দৃঢ় স্বরে আপত্তি জানিয়েছে প্রৌঢ় লোকটি, ছাল ছাড়াবার সুখটা আমিই করতে চাই।
তার মানে? বিস্ময়ের সঙ্গে বিরক্তিও একটু ফুটে উঠেছে প্রথম দালালের স্বরে।
তার মানে ওর তেজ দেখে আমিই কিনে নেব ঠিক করেছি, জোরালো গলায় জানিয়েছে প্রৌঢ় লোকটি।
আপনি কিনে নেবেন? এবার ব্যঙ্গের হাসি হেসে উঠেছে প্রথম দালাল আপনি কি গোলাম কেনা-বেচার কারবারী নাকি?
না, কারবারি নয়। প্রৌঢ় লোকটি স্বীকার করেছে এবার, আমি আপনারই মতো ব্যাপারীর দালাল।
ও, আপনি দালাল! প্রথম দালালের গায়ের জ্বালাটা এবার প্রকাশ পেয়েছে প্রৌঢ় লোকটির বিরুদ্ধে। কয়া আর গানাদোর দিকে আঙুল দেখিয়ে সে তীব্র অবজ্ঞার স্বরে বলেছে, কিন্তু আমি যে এই দুটোর জন্যে দাদন দিচ্ছি এখুনি।
দাদন দিচ্ছেন!—প্রৌঢ় দ্বিতীয় দালালের মেজাজও এবার চড়তে দেখা গিয়েছে—আর আমি যে পুরো দামে কিনে নিচ্ছি এখানেই এখনই।
বেশ কিনুন দেখি, কত আপনার মুরোদ! উপহাস করে বলেছে প্রথম দালাল, কত দাম এ দুটোর জন্যে দেবেন শুনি?
যা আপনি দেবেন তার চেয়ে দশ পেসো দে আরো বেশি! এবার গম্ভীর গলায় বলেছে দ্বিতীয় দালাল।
যা বলেছে করেছেও তা-ই। বন্দরের ওপর মুখরোচক ঝগড়ার গন্ধে গন্ধে তখন চারিদিকে বেশ একটু ভিড় জমে গেছে। তাদের সকলের সামনে প্রথম দালালের চেয়ে সত্যিই দশ পেসো দে অরো বেশি দাম ধরে দিয়েছে দ্বিতীয় দালাল।
পানামার বন্দরে পা দিতে-না-দিতে ফেলিপিলিওর বিমূঢ়-বিহ্বল অসহায় দৃষ্টির সামনে গানাদো কয়ার সঙ্গে বিক্রি হয়ে গেছেন ক্রীতদাসের ব্যাপারীর এক দালালের কাছে।
বিক্রি হয়ে যাবার পর গোরু-ছাগলের মতোই গানাদো আর কয়াকে নতুন মালিকের সঙ্গে বন্দর ছেড়ে যেতে হয়।
পানামা শহর তখন জমজমাট হয়ে উঠেছে শুধু পেরু আবিষ্কারের দৌলতেই।
সেখানকার লুঠ করা ঐশ্বর্য এই পানামা হয়েই স্পেনে চালান যায়, আর সে লুঠের ছিটেফোঁটা বখরাতেই কেঁপে ওঠে পানামা শহর। জমজমাট বলতে অবশ্য রাস্তা বাড়ি-ঘরের ছড়াছড়ি কি শোভা-সৌন্দর্য ভাবলে ভুল হবে। আসলে জংলা জলা বাদার দেশ। সেখানে মানুষের ভিড় বেড়ে শহর ভাল করে ছড়াতে না পেরে ঘিঞ্জিই হয়েছে আরও বেশি।
সেই ঘিঞ্জি ভুঁইফোড় শহরের রাস্তা দিয়ে গোলাম হিসেবে তাঁদের যে কিনেছে সেই ব্যাপারীর দালাল গানাদো আর কয়াকে হাঁটিয়ে নিয়ে যায়।
তার সঙ্গে ঘোড়া আছে। নিজে সে ইচ্ছে করলে তাতে চেপে যেতে পারত। কিন্তু তার বদলে ঘোড়ার লাগাম ধরে সে তার নতুন কেনা ক্রীতদাস-ক্রীতদাসীর সঙ্গে হেঁটেই চলে। নতুন গোলাম আর বাঁদি যাতে পালাতে না পারে সেইজন্যেই কি এই সাবধানতা?
তা হবে বোধহয়! পথে যেতে যেতে যেভাবে ব্যাপারী তাদের দিকে মাঝে মাঝে চেয়ে দেখে তাতে বেশ বড় গোছের দাঁও সে মেরেছে বলেই মনে হয়।
তখন সবে সকাল হয়েছে। পানামার রাস্তায় কিন্তু লোকজনের অভাব নেই। দু-চারজন তার মধ্যে নাম না জানুক, ব্যাপারীর মুখ বোধহয় চেনে। তারা একটু সবিস্ময়েই তার হাতে ধরা দড়িতে বাঁধা গোলাম আর বাঁদিকে লক্ষ করে।
পানামা শহরের রাস্তায় হাতে দড়ি বাঁধা বাঁদি-বান্দাকে নিয়ে যেতে দেখা এমন কিছু অদ্ভুত ব্যাপার নয়! ব্যাপারটা প্রায় নিত্য-নৈমিত্তিক। গানাদো আর কয়ার বেলা এই বিশেষ বিস্মিত কৌতূহল তাই একটু অস্বাভাবিক।
গানাদোকে কেউ কেউ চিনতে পারে বলেই কি এই বিস্মিত কৌতূহল ফুটে ওঠে তাদের মুখে?
না, তা নয়। কয়া এ শহরে সম্পূর্ণ অচেনা তো বটেই, কিছুকাল এ শহরে কাটিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও গানাদোকে চেনবার মতো মানুষও পানামা শহরে তখন নেই বললেই হয়। পানামা তখন তো শেকড় মেলবার শহর নয়, ভেসে যেতে যেতে দু-দণ্ড ঠেকে যাবার আঘাটা মাত্র। পুরনো মহাদেশ থেকে ভাগ্য ফেরাতে কি সেখানকার অপরাধের সাজা এড়াতে যারা এখানে এসে ঠেকে তারা স্রোতের শেওলার মতো। দু-চার দিন কি বড় জোর দু-এক বছরের বেশি কেউ বড় একটা এখানে আটকে থাকে না। নতুন ধান্দায় অথবা হুজুগের ঢেউ-এ অন্য কোথাও ভেসে যায়। পানামা শহরে তখন যারা আছে গোনা-গুনতি দু-একজন বাদে সবাই তারা একেবারে নতুন লোক।
গানাদোকে তারা কেউ চেনে না।
তুচ্ছ অজানা গোলাম বাঁদিকে নয়, অবাক দু-একজন হয় তাদের মালিককে দেখে।
অবাক হল ডন মোরালেসও।
হ্যাঁ, সেই ডন মোরালেস, একদিন যাঁর বাড়িতে পিজারো আর তাঁর বন্ধু আলমাগরোর নিত্য বৈঠক বসেছে সূর্য কাঁদলে সোনার দেশে অভিযানের উপায় ভাবতে।
পানামা শহরের প্রথম পত্তনের সময়কার বাসিন্দাদের মধ্যে তিনিই আর দু-একজনের মতো এখনও পর্যন্ত টিকে আছেন।
কী কাজে ডন মোরালেস সবে বুঝি বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছিলেন।
তাঁর বাড়ির রাস্তায় হাতে দড়ি বাঁধা দু-জন গোলাম বাঁদি আর তাদের মালিককে আসতে দেখে তিনি অবাক হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন।
তার পর বিমূঢ় অবিশ্বাসের স্বরে যা জিজ্ঞেস করেন, পানামা বন্দরে জাহাজ ভেড়াবার পর গানাদো আর কয়া অমন নাটকীয় ভাবে গোলামের কারবারির এক দালালের কাছে বিক্রি হয়ে যাবার রহস্য তাতেই কিছুটা পরিষ্কার হয়ে যায় বোধহয়।
এ কী ব্যাপার, কাপিন!ডন মোরালেস-এর কণ্ঠ বিমূঢ় বিস্ময়ে তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে, আপনি এ দুই গোলাম বাঁদি পেলেন কোথায়?
কোথায় আবার! কাপিতান বলে ডন মোরালেস যাঁকে সম্বোধন করেছেন সেই সৌম্য-দর্শন প্রৌঢ় একটু হেসে বলেন, জাহাজঘাটা থেকে কিনে নিয়ে এলাম!
কিনে নিয়ে এলেন! ডন মোরালেস কথাটা বিশ্বাস করতে পারেন না—আপনি সাত সকালে জাহাজঘাটায় গেছলেন গোলাম বাঁদি কিনতে?
এ কারবারে দাঁও মারতে হলে তা-ই তো যেতে হয়। কাপিন গলায় পরিহাসের সুরটা স্পষ্ট করে তুলে বাহাদুরির ভান করে বলেন, কী রকম সরেস মাল বাগিয়েছি একবার ভাল করে নজর দিয়েই দেখুন না!
ডন মোরালেস তাই দেখেন এবার। আর দেখার সঙ্গে তাঁর দৃষ্টি সত্যিই বিস্ফারিত হয়ে ওঠে।
গানাদোর দিকে চেয়ে তাঁর কণ্ঠে একটা বিস্ময়-ধ্বনিই শুধু শোনা যায়, এ কী! এ তো—
হ্যাঁ, ডন মোরালেস, কাপিন হাসিমুখে তাঁর অসমাপ্ত কথাটা পূরণ করে দিয়ে বলেন, এ ক্রীতদাস আপনার অচেনা নয়। একদিন আপনিই তাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। আজ আপনার কাছেই তাই ওদের নিয়ে এলাম।
পানামার বন্দরে জাহাজ ভিড়বার পর কোনও ক্রীতদাসের ব্যাপারীর হাতে পড়বার ভয় ছিল গানাদোর মনে। যা ভয় করেছিলেন, হয়েছিলও তাই। জাহাজঘাটার জব্বর এক ব্যাপারীর দালালের নজর পড়েছিল তাঁর আর কয়ার ওপর। আগে থাকতে তাক করলেও শেষ পর্যন্ত শিকার অবশ্য তার হাত থেকে ফসূকে গেছে। তার ওপরে টেক্কা দিয়ে আর-এক গোলাম কেনা-বেচার কারবারি গানাদো আর কয়াকে নগদা দামে কিনে নিয়েছে।
গানাদো আর কয়ার পক্ষে এ পরিণামটা তপ্ত খোলা থেকে গনগনে চুলোয় পড়ার শামিল হওয়ারই কথা। কিন্তু তা হয়নি।
না হবার কারণ এই যে জাহাজঘাটায় চড়া নগদ দাম দিয়ে যিনি গোলাম হিসেবে কয়া আর গানাদোকে কিনে নিয়েছেন তিনি আর কেউ নন, গানাদোর বন্ধু ও গুরুজনস্থানীয় পরম হিতৈষী সেই কাপিন সানসেদো।
কাপিন সানসেদো অবশ্য কস্মিনকালে গোলাম বাঁদি কেনাবেচার কারবারি নন। শুধু অবস্থা গতিকে গানাদোকে রক্ষা করবার জন্যে তাঁকে তা-ই সাজতে হয়েছে।
কিন্তু অত সকালে এই বিশেষ দিনটিতে জাহাজঘাটায় তাঁর হাজির হওয়াটাই একটু আশ্চর্য ব্যাপার নয় কি?
না, তাও নয়। কারণ পেরু-ফেরতা যে কোনও জাহাজ পানামা বন্দরে ভিড়লেই তা দেখতে যাওয়া কাপিন সানসেদোর অবশ্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে বহুকাল ধরে। পেরুর উপকূল থেকে কোনও জাহাজ ফিরছে জানলে একবার বন্দরটা তিনি ঘুরে যাবেনই।
এ ঘোরাঘুরি যে গানাদোর জন্যে তা বলা বাহুল্য। যে সান্তা মার্তা দ্বীপে পিজারোর পেরু অভিযানের সংকল্পের প্রায় সমাধি হতে চলেছিল, সেখান থেকে কৌশলে। অভিযাত্রীদের সকলকে সরাবার ব্যবস্থা করে গানাদো কাপিন সানসেদোকে নিয়ে মাঝখানের পাহাড় ডিঙিয়ে পানামায় গিয়ে পৌঁছোবার পর সেবারকার মতো পিজারোর অভিযানের আর সঙ্গী হতে পারেননি। পরে ভিন্ন পরিচয় নিয়ে অন্য একটি দলের সঙ্গে পুনা দ্বীপে গিয়ে তিনি পিজারোর বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেন। স্বাস্থ্যে শক্তিতে কুলোবে না বলে প্রৌঢ় কাপিন সানসেদোকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তখন থেকে পানামাতেই থেকে যেতে হয়। গানাদোরই গোপন নির্দেশে কাপিন সানসেদো ইতিমধ্যে ডন মোরালেস-এর সঙ্গে ভাব করে তাঁরই অতিথি হয়ে আছেন। মোরালেস-এরই এক কালের ক্রীতদাস গানাদো সম্বন্ধে সানসেদো অবশ্য কোনও কথা এ পর্যন্ত ভাঙেননি। পেরু-ফেরতা জাহাজের খোঁজ নিতে তাঁর পানামার বন্দরে যাওয়ার বাতিকটাও যথাসম্ভব গোপন রেখেছেন ডন মোরালেস-এর কাছে। এ বাতিক সত্যিই একদিন এতখানি কাজে লাগবে তা সানসেদো নিজেই ভাবতে পারেননি।
এইবার অবশ্য ডন মোরালেসকে সমস্ত কথাই খুলে বলতে হয়।
মোরালেস সত্যিই উদার সহৃদয় মানুষ। এক কালে ক্রীতদাস হিসেবে যাকে দেখেছেন, সত্যকার পরিচয় জানবার পর সেই গানাদোকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে তাঁর বাধে না। গানাদো আর কয়ার আশু আশ্রয়ের সমস্যা সহজেই তাই মিটে যায়। মোরালেস-এর আস্তানায় তাঁরা যতদিন খুশি থাকতে পারেন।
কিন্তু আশ্রয়ের সমস্যা এভাবে মিটিয়ে তো গানাদো খুশি হতে পারেন না। মোরালেস-এর বাড়িতে কয়াকে নিয়ে সসম্মানেই তিনি ঠাঁই পেয়েছেন, কিন্তু এখানে থাকা মানে তো সমস্ত পানামা শহরের কাছে গা ঢাকা দিয়ে চোরের মতো লুকিয়ে থাকা। ক্রীতদাস কেনাবেচার কারবার ফলাও ভাবে শুরু হবার পর থেকে পানামা শহরেও কোতোয়ালদের হুঁশিয়ারি আর আইন কানুনের কড়াকড়ি বেড়ে গিয়েছে। গোলামদের সম্বন্ধে আগেকার সে ঢিলে-ঢালা উদাসীন মনোভাব আর নেই। ফেরারি গোলাম হিসেবে গানাদো এখানকার দাগি আসামি। একবার তিনি এ শহরের পাহারা এড়িয়ে বেমালুম গা-ঢাকা দিতে পেরেছিলেন বটে, কিন্তু এখন আর তা কি সম্ভব? যে ব্যাপারীর দালাল তাঁর সঙ্গে কয়াকে কিনতে চেয়েছিল সে-ও এখন তাঁদের শত্রু। কোতয়ালির লোকজনের তো বটেই, শহরে সে দালালের কড়া নজরে পড়বার সম্ভাবনাও কম নয়। নিজে একা হলে খুব বেশি ভাবনা গানাদোর ছিল না। কিন্তু সঙ্গে কয়া থাকাতেই সমস্যা অত কঠিন হয়ে উঠেছে।
তাঁকে পানামা থেকে কয়াকে নিয়ে হাঁটা পথে জঙ্গল পাহাড় ডিঙিয়ে যোজকের ওপারের কোনও বন্দরে গিয়ে পৌছোতে হবে। নিজে যা পারতেন সেরকম অজানা দুর্গম বিপদসংকুল বিপথে কয়াকে নিয়ে পানামা যোজকের শিরদাঁড়া গোছের পাহাড় পার হওয়ার আত্মঘাতী চেষ্টা করা তাঁর পক্ষে উচিত নয়। পাহাড় ডিঙোবার চালু সহজ রাস্তা না ধরে তাঁদের উপায় নেই। আর সে পথে ক্রীতদাস বলে চিহ্নিত কারও পক্ষে ধরা পড়বার বিপদ পদে পদে।
কী করবেন তাহলে গানাদো? পানামায় মোরালেস-এর বাড়িতে এমন করে লুকিয়ে বসে কতদিন আর কাটাবেন? ভাগ্যে যা থাকে বিপদের সমস্ত ঝুঁকি নিয়ে পাহাড় ডিঙিয়ে আতলান্তিকের তীরের কোনও বন্দরে যাবার সংকল্পই তিনি শেষ পর্যন্ত করেন।
এ সংকল্পে বাধা দেন শুধু ডন মোরালেস।
না, গানাদো! দৃঢ় স্বরে তিনি বলেন, ক্রীতদাস হিসেবে পানামা ছাড়া তোমার চলবে না।
তাহলে মরণ না হওয়া পর্যন্ত তো পানামা ছাড়ার আর কোনও আশা নেই। তিক্ত স্বরে বলেন গানাদো।
কেন আশা নেই! মেরালেস জোর দিয়ে বলেন, সেই স্বার্থপর নীচ পেড্রারিয়স-এর জায়গায় পানামার নতুন গভর্নর এখন ডন পেড্রো দে লস রিয়স। ইনি উঁচুদরের মানুষ বলে শোনা যাচ্ছে। এঁর কাছে তোমার সমস্ত ইতিহাস জানালে উনি নিশ্চয়ই তোমায় স্বাধীন বলে ছাড়পত্র দেবেন বলে আমার বিশ্বাস। পিজারোর এ অভিযান সম্ভব ও সফল করে তোলবার জন্যে যা তুমি করেছ তা কাপিতানের কাছে। সব আমি শুনেছি। আমি নিজেও তার অনেক কিছু এখন জানি। কাপিন সানসেদোর সঙ্গে আমি ডন পেড্রোর কাছে গিয়ে দরবার করে সব জানাব।
সব জানাতে পারবেন না, ডন মোরালেস, দুঃখের হাসি হেসে বলেন গানাদো, আর জানালে স্বাধীনতার ছাড়পত্র দেওয়ার বদলে আমাকে তাঁর গারদে দেওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ পেরু আবিষ্কারের অভিযান সম্ভব করবার জন্যে প্রথমে যদি আমি কিছু করে থাকি সে অভিযান ব্যর্থ করবার জন্যেও শেষকালে কম কিছু করিনি। ভাগ্য বিরূপ না হলে আমার চক্রান্ত সফল হয়ে তাভান্তিন্সুইয়ুর পবিত্র রাজ্যে কোনও এসপানিওলের আর ঠাঁই হত না।
কী বলছ কী তুমি, গানাদো! মোরালেস বিমূঢ়ভাবে গানাদোর দিকে তাকান। কাপিন সানসেদোর চোখেও বিস্মিত জিজ্ঞাসার দৃষ্টি ফুটে ওঠে।
একটু চুপ করে থেকে গভীর অবিশ্বাসের স্বরে মোরালেস আবার বলেন, তুমি স্পেনের শত্রু, একথা আমায় বিশ্বাস করতে বলো?
না, তা বলি না, ডন মোরালেস। গাঢ় গম্ভীর শোনায় এবার গানাদোর গলা, স্পেনের আমি শত্রু নই। অবিচার অন্যায় নীচতা দম্ভ পাশবিকতা লোভ, পৃথিবীর সব সাধারণ মানুষের মতো আমি শত্রু শুধু এই সব কিছুর। নতুন আশ্চর্য এক দেশ আবিষ্কৃত হোক আগ্রহভরে আমি তা চেয়েছিলাম, সে আবিষ্কারের পথ এমন পৈশাচিকতায় নোংরা, রক্তে পিচ্ছিল হবে আমি ভাবতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত যথাসাধ্য তাই এ পাপের অভিযানে বাধা দিতে চেষ্টা করেছি। সে চেষ্টা অবশ্য ব্যর্থই হয়েছে।
গানাদোর কথা শেষ হবার পর খানিকক্ষণ সমস্ত ঘর একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে যায়। কী বলবেন এবার ডন মোরালেস আর কাপিন সানসেদো? যে অকপট স্বীকারোক্তি গানাদো করেছেন তারপর তাঁকে আর ক্ষমা করতে পারবেন কি?
অনেকক্ষণ পর্যন্ত কারও মুখে কোনও কথা শোনা যায় না। মুখের ভাব দেখেও বোঝা যায় না তাঁদের মনের মধ্যে কী দ্বন্দ্ব চলছে।
দ্বন্দ্বটা সত্যিই নেহাত সামান্য তো নয়। একদিকে স্পেন ও স্পেনের সম্রাটের প্রতি আনুগত্য আর-একদিকে সত্য ও ন্যায়ের দাবির সঙ্গে গানাদোর মতো মানুষের প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি।
ডন মোরালেসই প্রথম তাঁর মনের কথাটা প্রকাশ করেন। গম্ভীর ও বেশ একটু বিষণ্ণ মুখে তিনি যা বলেন, তাতে বোঝা যায় যে উদার সহৃদয় হলেও তাঁর কাছে যা দেশদ্রোহিতা গানাদোর সে আচরণ তিনি সম্পূর্ণ ক্ষমা করতে পারেননি।
আমি অত্যন্ত দুঃখিত গানাদো। ধীরে ধীরে গম্ভীর অনুচ্চ কণ্ঠে তিনি বলেন, তোমার সব অভিযোগ মেনে নিয়েও পিজারোর অধীন পেরুর এসপানিওল বাহিনীর বিরুদ্ধে তোমার চক্রান্ত আমি সমর্থন করতে পারছি না। তুমি যা করেছ তা আমার বিচারে গুরুতর অপরাধ। তবু এ অভিযানে তোমার আগেকার ভূমিকার কথা মনে রেখে তোমাকে শাস্তি দেবার কোনও ব্যবস্থা আমি করব না। শুধু যা জেনেছি তার। পর তোমাকে বাড়িতে আশ্রয় দেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। একটি দিন মাত্র তোমায় সময় দিচ্ছি। কাল সকালে উঠে তোমাকে আর আমার বাড়িতে যেন দেখতে না পাই। পেলে সম্রাটের প্রতি কর্তব্য আমি না করে পারব না।
অনেক ধন্যবাদ, ডন মোরালেস!শান্ত স্বরে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে গানাদো আরও কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বলা তাঁর হয় না।
বেশ একটু তিক্ত কণ্ঠে গানাদোকে বাধা দিয়ে কাপিন সানসেদো ডন মোরালেসকে ধিক্কার দিয়ে বলেন, ছি মোরালেস! আপনার মুখে এরকম কথা শোনবার আশা করিনি। ন্যায়, ধর্ম, সত্য এ সব কিছুর দাম আপনার কাছে নেই? গানাদো স্পেনের সম্রাটের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহী বলে আপনি মনে করছেন? মনে করছেন সে স্পেনের সঙ্গে শত্রুতা করেছে? শত্রুতা করেছে, না স্পেনের শুধু নয়, সমস্ত খ্রিস্টান জগতের যারা কলঙ্ক, আবিষ্কারক অভিযাত্রীর সাজে ঐশ্বর্য আর রক্তলোলুপ সেই নরপিশাচদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, স্পেন আর স্পেনের সম্রাটের গৌরব রক্ষা করবারই চেষ্টা করেছে গানাদো?
কাপিন সানসেদোর জ্বলন্ত কণ্ঠের ধিক্কার কিন্তু নিষ্ফলই হয়। কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে ডন মোরালেস আগেকার মতোই বিষণ্ণ গম্ভীর গলায় বলেন, আমায় মাপ করবেন, কাপিন, যুক্তিতর্ক বিচারে আমার মনের ভাব বদলাবার নয়। স্পেনের বিজয়-পতাকা সমুদ্র পারে দূরদূরান্তরে যারা মেলে ধরছে আমার চোখে তারা সব বিচারের ঊর্ধ্বে। তাদের উদ্দেশ্যে বাধা দেওয়া আমার কাছে। চরম রাজদ্রোহিতা। গানাদোকে তাই আমি ক্ষমা করতে পারব না। ওকে কাল সূর্যোদয়ের আগে আমার বাড়ি ছেড়ে যেতেই হবে।
আর যে মেয়েটি গানাদোর সঙ্গে এসেছে, তিক্ত শ্লেষ ও ক্ষোভের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করেন কাপিন, তাকেও আর আপনি বাড়িতে স্থান দিতে চান না নিশ্চয়?
না, মোরালেস কাপিতানের আক্রমণে এবার একটু আহত স্বরেই বলেন, ওই অসহায় মেয়েটিকে আশ্রয় দিতে আমার কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু গানাদো চলে যাবার পর ওর এখানে একলা থাকা বোধহয় সম্ভব নয়। ওর আশ্রয়ের সমস্যাটা তাই কঠিন। ও তো আমাদের ভাষাও জানে না।
কিছুটা জানি। তাই বলছি, আমার ভাবনা কাউকে ভাবতে হবে না। কারও ভার আমি হতে চাই না।
ঘরের সবাইকে চমকে দরজার দিকে তাকাতে হয়। সেখানে দাঁড়িয়ে মৃদু ঈষৎ বিকৃত উচ্চারণে হলেও দৃঢ়কণ্ঠে ও কথা যে বলেছে সে কয়া। কখন সে যে ওখানে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ লক্ষ করেননি। সে যে দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়ে তাঁদের। আলোচনা শুনতে পারে ও তা বোঝাবার মতো ক্ষমতা টমবেজ বন্দরে জাহাজে ওঠবার পর থেকে পানামায় এই কয়েক দিন থেকেই আয়ত্ত করে থাকতে পারে তা কল্পনাতেই আসেনি কারও। এমনকী গানাদোরও নয়। অবলা অসহায় একটি মেয়ে হিসেবে তাকে রক্ষা করার দায়িত্বটুকুই শুধু স্মরণ রেখে তার স্বাধীন সত্তার কথা যেন ভুলেই ছিলেন এ কয়দিন। আর যারই হোক, গানাদোর কিন্তু তা ভোলা উচিত হয়নি। পেরুর কুজকো আর সৌসায় সদ্য কৈশোর পার হওয়া যে মেয়েটি একলা সাহস ও বুদ্ধির অতবড় কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আসতে পেরেছে, অজানা বিদেশে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে সে পরগাছা দুর্বল কোনও লতার মতো অক্ষম অসহায় হয়ে যাবে ভাবাই ভুল।
ওই ক্ষীণকায়া একটি মেয়ের সামনে সবাই কেমন একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। সবচেয়ে লজ্জিত হন গানাদো নিজে। লজ্জিত আর দুঃখিতও।
তখনই উঠে পড়ে কয়ার কাছে গিয়ে তিনি দাঁড়ান। দাঁড়িয়ে অপরাধীর মতো বলেন, আমায় তুমি ভুল বুঝেছ, বুঝতে পারছি কয়া। এখান থেকে কেমন করে উদ্ধার পাব সেই দুর্ভাবনায় ক-দিন ধরে এত অস্থির হয়ে কাটাচ্ছি যে তোমার সঙ্গে দুটো কথা বলবারও সময় পাইনি। সেটা অবহেলা নয়, কয়া। তোমাকে শান্তিতে রাখবার জন্যেই আমার দুর্ভাবনার ভাগ তোমাকে দিতে চাইনি। কিন্তু সেইটেই আমার ভুল। নিরুপায় বোঝা হয়ে থাকবার মেয়ে যে তুমি নও সে কথা আমার মনে রাখা উচিত ছিল। জীবনে এ ভুল আর করব না। এখন তৈরি হয়ে নাও। ভাগ্যে যা-ই থাক, আজ রাত্রেই পানামা থেকে আমরা বার হব যোজকের পাহাড় ডিঙিয়ে ওপারের কোনও বন্দরে যাবার জন্যে।
তাহলে আমিও তোমাদের সঙ্গী হচ্ছি, জেনে রাখো। কাপিন সানসেদো দাঁড়িয়ে উঠে দৃঢ়স্বরে জানান, পথে যদি মারাও পড়ি, তাতে আমার দুঃখ নেই। এই পানামা আমার কবর যেন না হয়, এখন এই আমার একমাত্র কামনা।
কথাগুলো বলে ডন মোরালেস-এর বাড়িটাই যেন গোটা পানামা শহর এমনই ঘৃণাভরে সেদিকে তাকিয়ে সানসেদো বার হয়ে যাচ্ছিলেন। গানাদো তাঁকে ডেকে থামিয়ে বলেন, আজ রাত্রেই যখন আমরা রওনা হচ্ছি তখন শহরে ফেলিপিলিওর একটু খোঁজ করে আসবেন। এখান থেকে যাবার আগে তাকে একটু জানাতে চাই। ইচ্ছে করলে সে-ও আমাদের সঙ্গী হতে পারে। জাহাজঘাটায় আপনার কাছে অমনভাবে বিক্রি হয়ে যাবার পর আমাদের পরিণাম না জানতে পেরে সে অস্থির হয়ে আছে। তাকে পেতে খুব অসুবিধে বোধহয় হবে না। আমাদের খোঁজে বাজারের রাস্তাতেই সে ঘোরাঘুরি করবে বলে মনে হয়।
গানাদোর অনুমান ঠিক। কাপিন সানসেদো বাজারের রাস্তাতেই ফেলিপিলিওকে পেয়ে যান। কিন্তু তার পরে এমন আর-একজনের দেখা পান যাকে পানামা শহরে দেখবার কথা তাঁর কল্পনার বাইরে।
সানসেদো ফেলিপিলিওকে জাহাজঘাটায় মাত্র খানিকক্ষণের জন্য দেখেছিলেন। তার বিশেষ চেহারা পোশাকের জন্যে ছবিটা একটু যেন মনে ছিল। ফেলিপিলিও নিজেই তাঁকে ডেকে না কথা বললে শুধু তারই জোরে পানামা শহরে বাজারের ভিড়ে ফেলিপিলিওকে তিনি অবশ্য খুঁজে নিতে হয়তো পারতেন না।
ফেলিপিলিও সত্যিই কদিন ধরে অত্যন্ত যন্ত্রণার মধ্যে দিশাহারা হয়ে কাটিয়েছে। জাহাজঘাটায় গানাদো আর কয়াকে অজানা এক ব্যাপারী কিনে নেবার পর সে চোখে একেবারে আঁধার দেখেছে। বিক্রির ভান করতে বাধ্য হলেও কেনাবেচার পর ব্যাপারী কোথায় গানাদো আর কয়াকে নিয়ে যায় পিছু পিছু গিয়ে একবার দেখে আসার ইচ্ছে তার হয়েছিল। কিন্তু মুখের গ্রাস ফসকে যাবার দরুন অন্য যে দালাল তখনও জাহাজঘাটায় দাঁড়িয়ে গজরাচ্ছে তারই কড়া নজরের সামনে সে অনুসরণ আর সম্ভব হয়নি।
পানামা শহরে কী সে এর পর করবে তাই ঠিক করা তার পক্ষে কঠিন হয়ে উঠেছে। একটা সুবিধের কথা এই যে গানাদো আর কয়ার দাম হিসেবে বেশ কিছু নগদ পেসো দে অরো সে হাতে পেয়েছে। শেষ পর্যন্ত তারই জোরে পানামার বাজারের মধ্যে দেশি মানুষের পাড়ায় একটা আস্তানা জোগাড় করে নিতে তার অসুবিধে হয় না। মুশকিল হয় শুধু কোনও হদিস না জানা থাকায় গানাদো আর কয়ার খোঁজ করা। সত্যিকার গোলামের ব্যাপারীর কাছে তাঁরা যে বিক্রি হননি তা আর ফেলিপিলিও কোথা থেকে জানবে! ক্রীতদাস হিসেবে বাজারের রাস্তাতেই তাদের কোনও সময়ে আসা সম্ভব মনে করে সেইখানেই সে ব্যাকুলভাবে প্রতিদিন যতক্ষণ সম্ভব টহল দিয়ে বেড়ায়।
গানাদো বা কয়াকে নয়, সেই টহলের মধ্যে হঠাৎ সেদিন কাপিন সানসেদোকে দেখে সে চিনতে পারে। চিনতে পেরে কী যে করবে তাই প্রথমটা স্থির করে উঠতে পারে না। সে মনে রাখলেও গোেলামের ব্যাপারীর দালাল যে তাকে মনে রেখেছে তার ঠিক কী! মনে রাখবার কোনও গরজই তার নেই। ডেকে কথা বলার চেষ্টা করলে হয়তো চিনতেই পারবে না। আর চিনুক না চিনুক, তার সঙ্গে ফেলিপিলিও কী বলে প্রথম আলাপই বা করতে পারে! জাহাজঘাটায় সেদিন যাদের কিনেছে তাদের সম্বন্ধে হঠাৎ অমন খোঁজ নিতে গেলে ব্যাপারটা সন্দেহজনক হবে না? তাতে হিতে বিপরীতও তো হতে পারে। সমস্যা কঠিন হলেও ফেলিপিলিও শেষ পর্যন্ত মরিয়া হয়ে কাপিতানকে পেছন থেকে ডেকে থামায়। তারপর বিনীতভাবে বলে, মাপ করবেন সেনর, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে পারি?
প্রথমটা চমকে বেশ একটু বিরক্তির সঙ্গে ফিরে দাঁড়ালেও কাপিন সানসেদো একটু লক্ষ করেই ফেলিপিলিওকে চিনতে পারেন। চিনে রীতিমতো অবাকই হন, যাকে তিনি খুঁজছেন সে-ই নিজে থেকে তাঁকে ডেকে থামিয়েছে দেখে। বিস্ময়টা গোপন করে তিনি ফেলিপিলিওকে বিমূঢ় করে দিয়ে গম্ভীর স্বরে বলেন, হ্যাঁ, তোমার নাম যদি ফেলিপিলিও হয় তাহলে পারো।
আমার নাম যে ফেলিপিলিও তা—বিস্ময়ে ফেলিপিলিও ওর বেশি কিছু বলতে পারে না।
কেমন করে আমি জানলাম ভাবছ তো? এবার হেসে বলেন সানসেদো, আমার সঙ্গে এলেই জানতে পারবে।
ফেলিপিলিওকে পথে যেতে যেতে সানসেদো এবার সমস্ত বিবরণ শুনিয়ে তাঁদের সেইদিনই পানামা ছেড়ে যাবার ব্যবস্থার কথাও জানান।
কিন্তু এখন আর তা যাওয়া তো সম্ভব নয়। এতক্ষণ নীরবে সব শোনবার পর ফেলিপিলিও বিষণ্ণভাবে মাথা নেড়ে জানায়।
কেন নয়? সানসেদো একটু উষ্ণস্বরেই বলেন, ধরা পড়ার বিপদের কথা যদি বলো তাহলে তা তো বরাবরই আছে ও থাকবে। আজ হঠাৎ সে বিপদ তো নতুন করে দেখা দেয়নি।
তা দেয়নি, ফেলিপিলিও বিনীতভাবে জানায়, কিন্তু সে বিপদ আর কারও পক্ষে না হোক, গানাদোর পক্ষে এখন গুরুতর।
বিপদ গুরুতর বেছে বেছে শুধু গানাদোর পক্ষেই?সানসেদোর কণ্ঠে অবিশ্বাসের সঙ্গে বিরক্তিই ফুটে ওঠে, পানামা শহর গোলাম বলতে শুধু গানাদোকেই জানে? আর যত আক্রোশ শুধু তার ওপর!
আক্রোশ কি না জানি না! ফেলিপিলিও এবার তার বক্তব্যটা বিশদ করবার চেষ্টা করে, কিন্তু দু-চারদিন ধরে পানামা শহরের সমস্ত আসা-যাওয়ার রাস্তায় গানাদোর মতো একজন গোলামের খোঁজে সজাগ কড়া পাহারার ব্যবস্থা যে হয়েছে এটুকু নির্ভুলভাবে আপনাকে বলতে পারি।
পানামার বাজারের মধ্যে বাস করে গত কয়েকদিন যা সে জেনেছে, ফেলিপিলিও তারপর সানসেদোকে শুনিয়ে দেয়। কোতোয়ালির সিপাই সান্ত্রীদের তো বটেই, বাজারের সাধারণ লোকেদের মধ্যেও গানাদোর চেহারা চরিত্রের বর্ণনা কয়েকদিন। আগে তেঁড়া পিটে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে ঘোষণা হয়েছে যে এই চেহারার মানুষের হদিস দিলে প্রচুর পুরস্কার মিলবে।
পুরস্কার দেবে বলে ঘোষণা করেছে? সব কথা শুনে সানসেদো বেশ একটু বিস্মিত সংশয়ের সুরে বলেন, কোনও ফেরারি গোলামের খোঁজ দেবার জন্যে সরকারি দপ্তর বা কোতোয়ালি থেকে পুরস্কার দিতে চায় এমন কথা তো কখনও শুনিনি। ফেরারি গোলাম হিসেবে গানাদোর দাম হঠাৎ এত বেড়ে গেল কী করে? জাহাজ থেকে তোমরা যেদিন নামো সেদিনও তো তার জন্যে এ খোঁজাখুঁজি ছিল না। পেরু থেকে এর মধ্যে আর কোনও জাহাজও আসেনি যে গানাদোর সেখানকার কীর্তি এখানে জানাজানি হয়ে তার খোঁজ এত জরুরি হয়ে পড়েছে। গানাদোর জন্যে পানামার সরকারের হঠাৎ এ পুরস্কার ঘোষণার মানেটা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
আমি বাজারের নানা লোকের সঙ্গে আলাপ করে যা বুঝেছি, ফেলিপিলিও জানায়, তাতে পুরস্কারটা পানামার সরকারি দপ্তর কি কোতোয়ালি থেকে দেওয়া হচ্ছে বলে মনে হয় না। কোতোয়ালির মারফত ঘোষণাটা করা হলেও পুরস্কারটা দিতে চেয়েছে অন্য কেউ। শুনছি, মাত্র কদিন আগে স্পেন থেকে এখানে এসে কেউ একজন হন্যে হয়ে ঠিক গানাদোর মতো একজন গোলামকে খুঁজছে।
স্পেন থেকে এসে হন্যে হয়ে গানাদোকে খুঁজছে! সানসেদো নিজের মনেই যেন সরবে চিন্তা করেন—গানাদোর বিরুদ্ধে আক্রোশের যার সীমা নেই সে সোরাবিয়া তো এখনও পেরুতে। স্পেন থেকে গানাদোর এত বড় শত্রু আর কে আসতে পারে!
কথা বলতে বলতে বাজারের রাস্তা যেখানে বন্দরের দিকে মোড় নিয়েছে। সানসেদো আর ফেলিপিলিও সেখানে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ সে পথে একজনকে আসতে দেখে সানসেদো চমকে ওঠেন।