কৃষিকেন্দ্রিক জাদু-বিশ্বাস : প্রজনন ও উৎপাদন
কৃষিকাজ মেয়েদের আবিষ্কার, মেয়েলি ব্যাপার। তাই কৃষিকেন্দ্রিক আদিম জাদুবিশ্বাসটির মূল কথা হলো, উর্বরাশক্তির দিক থেকে নারীর সঙ্গে প্রকৃতির নিবিড় ও গভীর যোগাযোগের কল্পনা। মাতৃপ্রধান সংস্কৃতির স্মারকগুলিকে বৈজ্ঞানিকভাবে বোঝবার কাজে এই জাদুবিশ্বাসটিই সবচেয়ে মূল্যবান মূলসূত্র।
পৃথিবীর পিছিয়ে-পড়া মানুষদের চেতনায় আজো এই বিশ্বাসটির স্পষ্ট রূপ দেখতে পাওয়া যায়। তাই তাদের ধ্যানধারণা থেকে শুরু করলে প্রাচীন সংস্কৃতির নানান ভূর্বোধ্য বিষয় বুঝতে পারা যেতে পারে।
আদিম চিন্তা অনুসারে, মেয়েরা যে সার্থকভাবে কৃষিকাজের দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারে তার কারণ মেয়েদের মধ্যে একটি অদ্ভুত শক্তি লুকোনো আছে; এই শক্তির দরুনই মেয়ের সন্তানবতী হয় এবং এই শক্তির প্রভাবে তারা পৃথিবীকেও ফলপ্রসূ করে। আমেরিকায় ওরিনোকো(৪৪৭) বলে রেড-ইণ্ডিয়ানদের মধ্যে দেখা যায়, প্রখর রোদে মেয়েরা ছেলে-কোলে ক্ষেতের কাজ করছে। এই নিয়ে জনৈক খৃস্টান পাত্রী দলের পুরুষদের ভর্ৎসনা করেন। কিন্তু তিনি যে-জবাব পান তা খুবই আশ্চর্য : “এ-সব ব্যাপার আপনি বোঝেন না বলেই অমন বিরক্ত হচ্ছেন। আপনি তো জানেন, একমাত্র মেয়েরাই সন্তানের জন্ম দিতে পারে; আমরা পুরুষেরা তা পারি না। তাই মেয়েরা যখন বীজ বোনে তখন জনার-ক্ষেতের প্রতি ডাঁটায় দুটো—এমন কি তিনটে—করে শিষ গজায়, ম্যানিওক-ক্ষেতে প্রতিটি গাছ থেকে দু’তিন ঝুড়ি করে মূল পাওয়া যায়। কেন? কেননা, মেয়েরা জানে কেমন করে সন্তানের জন্ম দেওয়া যায় এবং সেইভাবেই ওরা ক্ষেতের ফলকেও অনেক বাড়িয়ে দিতে পারে। বীজ বোনবার পর তা থেকে কী করে শস্য-উদ্গম হবে তা শুধু ওরাই জানে। তাই বীজ বোনবার কাজটা ওদের ওপরেই ছেড়ে দেওয়া ভালো। এ-সব ব্যাপার আমাদের চেয়ে ওরা ঢের ভালো জানে।”
ব্যাভেরিয়া আর অস্ট্রিয়ার চাষীরা(৪৪৮) এখনো বিশ্বাস করে যে, অন্তঃসত্ত্বা মেয়েকে গাছের প্রথম ফলটি খাওয়ানো গেলে পরের বছর সেই গাছ থেকে অজস্র বেশি ফল পাওয়া যাবে। স্যর্ জেমস্ ফ্রেসার(৪৪৯) বলছেন, এর থেকেই বোঝা যায়, প্রকৃতিকে ফলপ্রসূ করবার আশায় নারীর ফলপ্রসূতার উপযোগিতায় কতোখানি বিশ্বাস! আবার উগাণ্ডায়(৪৫০) সাধারণের বিশ্বাস, বন্ধ্যা স্ত্রী ক্ষেতের পক্ষে ক্ষতিকর, বহু সন্তানবতী স্ত্রীর দরুন ক্ষেত থেকেও বহুলভাবে ফসল পাওয়া যায়। নিউজিল্যাণ্ড-এ(৪৫১) দেখা যায় অন্তঃসত্ত্বা নারী সম্বন্ধে যে-সব বিধি-নিষেধের ব্যবস্থা আছে, ঠিক সেই বিধিনিষেধই রাঙালুর চাষ করবার সময় মেয়েদের উপর প্রযোজ্য হয়। ব্রিফন্ট(৪৫২) দেখাচ্ছেন, এমন কি আজকের ইয়োরোপে চাষীদের মধ্যে এই ধরনের বিশ্বাসের রেশ দেখা যায়। যেমন দক্ষিণ ইতালিতে কৃষকেরা মনে করে, অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় মেয়েরা যদি বীজ বোনে তাহলে গর্ভস্থ ভ্রণের অনুপাতেই গাছটি বড়ো হবে। স্যর্ জেমস্ ফ্রেসার(৪৫৩) এই জাতীয় কয়েকটি দৃষ্টান্তের উল্লেখ করে বলছেন, আদিম মানুষদের ধারণায় প্রকৃতিকে ফলপ্রসূ করবার ব্যাপারে নারীর উর্বরাশক্তির উপযোগিতা যে কতোখানি তা এই থেকেই বুঝতে পারা যায় : সন্তানবতী নারী গাছগাছড়াকেও সুফলা করবে, বন্ধ্যা নারী গাছগাছড়াকেও নিষ্ফল করবে।
ব্রিফন্ট(৪৫৪) বলছেন,
the assimilation of the fruit-bearing soil to the child-bearing woman is universal.
ফলপ্রস্থ পৃথিবীর সঙ্গে সন্তান-প্রসূ নারীর সম্পর্ক-কল্পনা সার্বভৌম।
কিংবা(৪৫৫)
The fecundity of the earth and the fecundity of women are viewed as being one and the same quality.
পৃথিবীর উৎপাদিক-শক্তি এবং নারীর উৎপাদিক-শক্তি উভয়কেই এক এবং অভিন্ন ধরনের মনে করা হয়।
এই বিশ্বাস যে কতো ব্যাপক ও বহুমুখী রবার্ট ব্রিফন্ট-এর রচনা অনুসরণ করে তারই আরো কিছু কিছু পরিচয় পাবার চেষ্টা করা যাক।
ব্ৰেজিলে(৪৫৬) শস্যের উৎপত্তি নিয়ে নিম্নোক্ত কাহিনী প্রচলিত আছে : একটি কুমারী মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিলো এবং সে জন্ম দিলো তুষার-শুভ্ৰ এক শিশুর। শিশুটি ভূমিষ্ঠ হয়েই মারা যায়, তখন তাকে কবর দেওয়া হয়। এই কবরের উপরেই একটি গাছ গজায়। সে-গাছে ফল ফলে। ফল খেয়ে মানুষদের মনে হলো, দেবতা তাদের শরীরে প্রবেশ করছে। এই গাছই পৃথিবীর প্রথম শস্য-গাছ এবং ওই ফলই পৃথিবীর প্রথম ফসল।
শস্য যে নারীদেহ সমুদ্ভূত—এই আদিম বিশ্বাসটিকে গ্ৰীক কৃষকদের(৪৫৭) লোকসংগীতের মধ্যে এখনো টিকে থাকতে দেখা যায় : এক ইহুদি মেয়ে ফসল কাটে, মেয়েটি কখনো থামে কখনো নুয়ে পড়ে গমের শিষের উপর—মেয়েটি প্রসব করলো সোনার শিশু।
আবার, আমরা আগেই দেখেছি, নারী ও প্রকৃতির উর্বর-শক্তির সাদৃশ্য-নির্ভর ওই জাদুবিশ্বাটির বিকাশ উল্টে দিক থেকেও হতে পারে। তাই প্রকৃতির ফলপ্রসূতার সাহায্যেই নারীকেও ফলপ্রসূ করবার আয়োজন দেখা যায়। দৃষ্টান্ত হিসাবে স্তর জেমস্ ফ্রেসার(৪৫৮) বলছেন, দক্ষিণ আমেরিকায় গুয়ারানি বলে রেড্-ইণ্ডিয়ানদের বিশ্বাস, মেয়ের যদি জোড়া-ফল খায় তাহলে যমজ সন্তানের জন্ম হবে। আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলেও ঠিক এই বিশ্বাসেরই নমুনা পাওয়া কঠিন নয়। স্যর্ ফ্রেসার(৪৫৯) আমাদের দেশ থেকেই এই বিশ্বাসের অন্যান্য দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত করছেন। যেমন : উত্তর-ভারতের প্রায় সর্বত্রই মেয়েলি আচার-অনুষ্ঠান এবং পূজা-পার্বণের একটি প্রধান অঙ্গ হলো নারকেল-এর ব্যবহার। নারকেল উর্বর-শক্তিরই প্রতীক বা হয়তো সন্তানের প্রতীক। সন্তান-লাভের কামনা সফল করবার আশাতেই পুরোহিতেরা মেয়েদের নারকেল দেয়।
অন্যান্য লেখকদের রচনা থেকে এই বিশ্বাসেরই অন্যান্য নমুনা উদ্ধৃত করা যায়। যেমন, উইলিয়াম ক্রুক্(৪৬০) বলছেন, প্রাকৃতিক উর্বরতার মূলে রয়েছে জল আর তাই দেখা যায় সন্তানকামনায় বন্ধ্যা নারী জলের সাহায্য চাইছে। খণ্ডদের বিশ্বাস,—বন্ধ্যা নারীকে দুটি স্রোতের সঙ্গমস্থলে স্নান করিয়ে আনলে তার বন্ধ্যাত্ব দূর হবে। পাঞ্জাবের দিকে দেখা যায়, বন্ধ্যা নারীকে চৌকিতে বসিয়ে কুয়োর মধ্যে নামিয়ে দেওয়া হয়, কুয়োর মধ্যে সে নগ্ন হয়ে স্নান করবে আর তারপর জামাকাপড় পরে চৌকিতে বসে উপরে উঠে আসবে। কুয়োর মধ্যে নামানো সম্ভব না হলে পিপুল গাছের তলায় কুয়োর জল এনে এই অনুষ্ঠান সমাধান করতে হবে। মধ্যভারতে জাঠদের বিশ্বাস, তিনটি গ্রামের সীমানায় গিয়ে স্নান করলে বন্ধ্যা নারী সন্তান-লাভ করবে। পাঞ্জাবের নানান জায়গায় মানুষের ধারণা, চৌমাথার মোড়ে পাঁচ-কুয়োর জলে নগ্ন হয়ে স্নান করলে বন্ধ্যা নারী সন্তান-লাভ করবে। রবার্ট ব্রিফণ্ট(৪৬১) দেখাচ্ছেন, আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের মধ্যেও ঠিক একই বিশ্বাসের পরিচয় পাওয়া যায়, কেননা তাদের মধ্যেও দেখা যায় সন্তান-লাভের কামনায় মেয়েরা বৃষ্টিতে ভিজছে।
বন্ধ্যাত্ব-নিরসনের কামনা ছাড়াও বিবাহের একটি অনুষ্ঠান হিসাবে বর বা বধূ বা উভয়ের গায়েই জল ঢালবার প্রথা প্রচলিত আছে—মূল উদ্দেশ্যটা অবশ্যই ওই বন্ধ্যা-নিরসনের মতোই, অর্থাৎ উর্বরতা-মূলক প্রাকৃতিক বিষয়ের সাহায্যে নরনারীকেও ফলপ্রসূ করা। গোগু-রা(৪৬২) বিয়ের সময় বরের গায়ে এমনভাবে জল ঢালে যাতে তা গড়িয়ে বধূর গায়েও পড়ে। হিমালয়অঞ্চলে(৪৬৩) দেখা যায়, বিয়ের সময় মেয়ের বাপ মেয়ে-জামাই-এর হাত এক করে ধরে এবং তার উপর জল ঢালা হয়।
কিংবা, প্রাকৃতিক ফলপ্রসূতার সাহায্যে মানবীয় ফলপ্রসূতার কামনা সফল করবার বিশ্বাসের বিকাশ বিবাহ-অনুষ্ঠান উপলক্ষেই আরো নানানভাবে চোখে পড়তে পারে। থার্স্টন(৪৬৪) বলছেন, দক্ষিণ ভারতে নানা উপজাতির মধ্যে দেখা যায়, বিবাহ অনুষ্ঠানের অঙ্গ হিসেবে বরকে মাটি চষবার বা মাটি-চষা সংক্রান্ত কোনো ক্রিয়ার অনুকরণ করতে হয়। কূর্মীদের(৪৬৫) প্রথা অনুসারে নববধূর আঁচলে শস্যের বীজ বেঁধে দিতে হবে। অন্যত্র(৪৬৬) দেখা যায়, বিবাহ অনুষ্ঠানের একটি অঙ্গ হলো গাছ পোতবার ব্যবস্থা। বম্বে গেজেটিয়ার-এ(৪৬৭) অনুমান করা হয়েছে, মেয়েদের মাথায় সিঁথি কাটবার প্রথাটিতে ক্ষেতের ফাল অনুকরণ করবার আয়োজন—অন্তত সিঁথির সিঁদুর যে ফলপ্রসূ হবার কামনাতেই ব্যবহৃত হয় সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই।
থার্স্টন(৪৬৮) বলছেন, দক্ষিণভারতের স্থানবিশেষে বিবাহ-অনুষ্ঠানের আয়োজন হিসেবেই উইঢিবির উপর ধান এবং ডালের বীজ ছড়িয়ে দেওয়া হয়—বিবাহ-অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে বীজগুলিতে অঙ্কুর উদ্গম হবে, তখন বরবধু মিলে এই অঙ্কুরিত শস্য কুয়োয় বিসর্জন দিয়ে আসবে।
অন্যত্র(৪৬৯) ব্যবস্থা হলে, নবদম্পতী সরার উপর ন’-রকম বীজ বুনবে। কোথাও(৪৭০) আবার প্রথা আছে, বরকে ছুরি দিয়ে একটুখানি জমি কোপাতে হবে—তার উপর নববধূ বীজ বপন করবে, বীজ বপন করে জলসিঞ্চন করবে।
কোথাও(৪৭১) বা প্রথা আছে, বিবাহের সময় নববধূর কোলে একটি শিশুসন্তান বসিয়ে দেওয়া—কিন্তু মানব সন্তানের বদলে গাছের ফলও হতে পারে। উত্তরভারত থেকে শুরু করে দক্ষিণভারত পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে নানা জায়গায় এই প্রথাটি দেখা যায়। গাছের ফল এবং মানুষের ফলকে সমজাতীয় মনে করবার স্পষ্ট দৃষ্টান্ত এই প্রথার মধ্যে রয়েছে।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিবাহের প্রাথমিক অনুষ্ঠান হিসেবে বর বা বধু বা উভয়কেই প্রথমে গাছের সঙ্গে মিলিত হতে হচ্ছে। রিজলি-র(৪৭২) বর্ণনা অনুসারে, বাংলাদেশে বাগদিদের মধ্যে প্রথা হলো, বিয়ের দিন সকাল বেলায় বরের সঙ্গে মহুয়াগাছের বিয়ে হবে : যুবকটি মহুয়া গাছকে আলিঙ্গন করবে, মহুয়াগাছের গায়ে সিঁদুর মাখিয়ে দেবে, তার কব্জিতে সুতো বেঁধে সুতোর অপর প্রান্ত গাছের চার পাশে জড়িয়ে দেওয়া হবে এবং শেষ কালে ওই সুতো দিয়ে বরের কব্জিতে মহুয়া পাতা বেঁধে দেবার পরই সে কনে-বাড়ি গিয়ে বিয়ে করতে পারবে। অন্যত্র, বিয়ের আগে বর ও বধূ উভয়ের সঙ্গেই আমগাছের বিয়ে হয়, আমগাছের বদলে আমের ডালও হতে পারে। কূর্মীদের(৪৭৪) মধ্যে প্রথা হলো, বিয়ের আগে বরের সঙ্গে বিয়ে হবে আমগাছের, বধূর সঙ্গে বিয়ে হবে মহুয়াগাছের।
ব্রিফন্ট(৪৭৫) বলছেন, সারা পৃথিবী জুড়ে দেখতে পাওয়া যায়, বিবাহঅনুষ্ঠানের একটি অঙ্গ হলো, বর-বধুর মাথায় শস্য স্থাপন করা। আমাদের দেশে ধান-দুর্বার ব্যবহার অত্যন্ত ব্যাপক; ব্রিফট-এর রচনা অনুসরণ করলে দেখা যায়, ইয়োরোপের কৃষক মহলেও এই অনুষ্ঠানই হয়তো অল্পবিস্তর রূপান্তরের আড়ালে আজো টিকে রয়েছে।
এই জাতীয় সমস্ত অনুষ্ঠানেরই মূল কথা হলো, প্রাকৃতিক ফলপ্রসূত এবং মানবীয় ফলপ্রসূতা উভয়ের মধ্যে সাদৃশ্য ও যোগাযোগে বিশ্বাস। কৃষি-আবিষ্কারের প্রাথমিক পর্যায়ে এ-বিশ্বাস অনিবাৰ্যভাবেই বসুমাতার আদিরূপটির জন্ম দিয়েছে। কৃষিকাজ মেয়েদের আবিষ্কার। কৃষিভিত্তিক সমাজ মাতৃ-প্রধান। এই স্তরের মানুষদের ধারণায়, প্রজননের মূল রহস্য নারীপ্রকৃতির মধ্যে—পুরুষ অপ্রধান, বীজ অপ্রধান; নারীই প্রধান, ক্ষেত্রই প্রধান। মানবীয় ফলপ্রসূতা বলতে মূলতই নারীর ফলপ্রসূতা, উৎপাদিক-শক্তি। এই স্তরের চেতনায়, পৃথিবী ও জননী এক এবং অদ্বিতীয়। পৃথিবীই আদি-জননী, আদি-জননীই পৃথিবী। রবার্ট ব্রিফন্ট (৪৭৬)বলছেন, মানবসংস্কৃতির আদিম পর্যায়ের বসুমাতাগুলিকে এই বিশ্বাসের বিকাশ হিসেবেই চেনবার চেষ্টা করতে হবে :
পশ্চিম এসিয়া ও ইয়োরোপের ধর্মবিশ্বাসে মহামাতৃকাগুলি যে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছে তার মূলে ছিলো কৃষি-অনুষ্ঠানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক—ফসলের মা, বা, সোনালি ফসলের জন্মদায়িনী বসুমাতা হিসেবেই তারা কল্পিত হয়েছিলো।
ব্রিফন্ট(৪৭৭) দেখাচ্ছেন, নারী ও পৃথিবীর মধ্যে অভেদ-কল্পনার দৃষ্টান্ত এতো অজস্র যে, তা নিয়ে পাতার পর পাতা লিখে যাওয়া যায়। রোমান আইনকর্তাদের মতে জননী ও জমি একই ধরনের। খৃস্টানদের ধর্মপুঁথিতে বলা হয়েছে, মাতৃগর্ভ থেকে আমি নগ্নভাবেই ভূমিষ্ঠ হয়েছি, নগ্ন অবস্থাতেই আমি সেখানে ফিরে যাবো। এস্কাইলাস বলছেন, পৃথিবীই সর্বমাতৃকা—কেননা পৃথিবী থেকেই সবকিছুর জন্ম এবং পৃথিবীতেই সবকিছুর লয়। ভার্জিল বলছেন, বন্দে শস্য-মাতৃকা, বন্দে সর্বমানবমাতৃকা। প্রায় একই ভাষায় অসভ্য জার্মানের গান গাইতে; বন্দে পৃথিবী, মানবমাতৃকা; দেবতার আলিঙ্গনে তুমি মানব কল্যাণে অন্নদায়িনী হয়ে ওঠো। প্রাচীন ইরাণী ধর্মবিশ্বাস অনুসারে পৃথিবী থেকেই মানুষের উদ্ভব হয়েছিলো। মানবার্থক Homo শব্দটি ক্ষেত্রবাচক Humus শব্দ থেকে এসেছে। পৃথিবী থেকেই আদি-মানব আদমের উৎপত্তি; তবুও মানুষ পোকার মতো মাটি থেকে জন্মেছিলো এ-কথা বিশ্বাস করবার জন্যে ল্যাক্টানটিউস ডিমোক্রিটাসকে ভর্ৎসনা করেছেন। জবাবে লুক্রেটিউস বলছেন, জন্তুজানোয়ার তো আর আকাশ থেকে পড়তে পারে না, পৃথিবীর বাসিন্দারা লোনা জলের হ্রদ থেকেও জন্মাতে পারে না; পৃথিবীকে যে মা বলা হয় তা ঠিকই বলা হয়—কেননা পৃথিবী থেকেই সমস্ত কিছু সৃষ্ট হয়েছে। এই প্রাচীন বিশ্বাসটির আরো অজস্র পরিচয় রবার্ট ব্রিফল্ট-এর(৪৭৮) রচনায় দেখতে পাওয়া যায়। আমরা এখানে আমাদের দেশের কিছু দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত করতে পারি।
মেদিনীকোষ(৪৭৯) অনুসারে, মাতৃ শব্দের অর্থ পৃথিবী। বিশ্বকোষে(৪৮০) বলা হয়েছে : ‘আত্ম-মাতা, গুরুপত্নী, ব্রাহ্মণী, রাজপত্নী, গাভী, ধাত্রী এবং পৃথিবী–এই সাতজনকে মাত কহে। ঋগ্বেদে(৪৮১)আছে, ‘যদূর্ধ্বস্তিষ্ঠা দ্রবিণেহ ধত্তাদ্ যদ্বা ক্ষয়ো মাতুরস্যা উপস্থে’–ব্যাখ্যাকারেরা(৪৮২) বলছেন, এখানে ‘মাতার’ বলতে ‘পৃথিবীর’ বোঝায়—‘মাতুঃ অস্যাঃ পৃথিব্যাঃ’।
সন্তানের জন্ম হওয়াকে আমরা বলি ভূমিষ্ঠ হওয়া। কেন বলি? এর পিছনে ওই আমি বিশ্বাসেরই রেশ খুজে পাওয়া যায় : মানবসন্তান পৃথিবীজাত—তাই ভূমিতে স্থিত বা ভূমিতে পতিত ফলের মতোই তাকে দেখবার চেষ্টা। ব্রিফন্ট(৪৮৩) বলছেন,
জন্মের পরেই শিশুকে মাটিতে শুইয়ে দেবার প্রথা ব্যাপকভাবে চোখে পড়ে। শিশুর সঙ্গে পৃথিবীর সম্পর্কমূলক বিশ্বাস এই প্রথার মধ্যে প্রকাশিত।
সিংহলের অসভ্য আদিবাসীরা(৪৮৪) মনে করে, জন্মের পরই শিশুকে মাটির উপর শুইয়ে দেওয়ার প্রথাটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিফন্ট(৪৮৫) দেখাচ্ছেন, ব্ৰেজিল, গোল্ডকোস্ট ও মধ্য-আফ্রিকার অসভ্য মানুষদের মধ্যে ঠিক একই অনুষ্ঠান প্রচলিত আছে। সিসিলিতে এখনো এই বিশ্বাস টিকে আছে : মেয়েরা মনে করে, সন্তান-জন্মের পরই যদি নবজাতককে ভূমিষ্ঠ করা বা মাটিতে শোয়ানো না হয় তাহলে হাসপাতালেই তার মৃত্যু হবে।
অস্ট্রেলিয়া(৪৮৬) এবং উত্তর-আমেরিকায়(৪৮৭) আদিবাসী মেয়েদের বিশ্বাস, পৃথিবীরই কোনো কোনো গুহা থেকে তারা পেটের ছেলে পেটে পায়। ওরা বলে, গুহাগুলোর আশপাশে মাটির উপর কান দিলে অজাত-শিশুদের কণ্ঠস্বর শুনতে পাওয়া যায়।
আফ্রিকার(৪৮৮) এক আদিবাসী-সর্দারকে চেয়ারে বসতে বলা হয়েছিলো। সে বললো, তার চেয়ে মায়ের কোলে বসা ঢের ভালো। এই বলে সে মাটির উপর বসে পড়লো।
সংক্ষেপে : আদিম মানুষের বিশ্বাস, মানবীয় ফলপ্রসূতা ও প্রাকৃতিক ফলপ্রসূতা উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক আছে। কৃষিআবিষ্কারের পর্যায়ে স্বভাবতই এই বিশ্বাসটির উপরই বিশেষ গুরুত্ব অর্পিত হয়। কৃষিকাজ মেয়েদের আবিষ্কার। কৃষিকেন্দ্রিক ধ্যানধারণা তাই নারীকেন্দ্রিক—প্রজনন ব্যাপারে পুরুষের ভূমিকা অপ্রধান। মানবীয় উৎপাদন-শক্তি বলতে নারীর ভূমিকাটুকুই, প্রধান। অতএব, এই পর্যায়ের ধ্যানধারণা অনুসারে নারীর উৎপাদিক-শক্তি এবং প্রকৃতির উৎপাদিকা-শক্তি—উভয়ের মধ্যে গভীর ও নিবিড় যোগাযোগ পরিকল্পিত হয়েছে।
অতএব একদিকে দেখা যায়, নারীর উৎপাদিকা-শক্তির উপরই প্রাকৃতিক উর্বরতা নির্ভরশীল : পৃথিবীর আদি-শস্য নারীদেহ-সমুদ্ভূত বলেই কল্পিত, কিংবা প্রজনন-সংক্রান্ত কোনো মেয়েলি ব্যাপারের সাহায্যেই প্রাকৃতিক ফলপ্রসূত আয়ত্বে আনবার কল্পনা।
অপরদিকে দেখা যায়, প্রাকৃতিক উৎপাদিকা-শক্তির উপরই নারীর উৎপাদিকা-শক্তি নির্ভরশীল : পৃথিবীই আদি-জননী, মানবসন্তান পৃথিবী-সমুদ্ভূত, কিংবা প্রাকৃতিক ফলপ্রসূতা সংক্রান্ত কোনো বিষয়ের সাহায্যেই মানবীর সন্তান-কামনা সফল করবার আয়োজন করা হচ্ছে।
সমাজ-বিকাশের পিছন-দিককার পর্যায়ের মামুষেরা—confused the process by which human beings reproduce their kinds with the process by which plants discharge the same function, and fancied that by resorting to the former they were simultaneously forwarding the latter(৪৮৯)—দুটি বিষয়ের মধ্যে তফাত করতে শেখেনি : একটি বিষয় হলো নিজেদের বংশবৃদ্ধি সংক্রান্ত পদ্ধতি, আর একটি বিষয় হলো গাছগাছড়ার বংশবৃদ্ধি সংক্রান্ত পদ্ধতি। অতএব তারা কল্পনা করেছে যে, প্রথমটির সাহায্যেই দ্বিতীয়টিকেও আয়ত্বে আনা সম্ভবপর।
কিন্তু সেই সঙ্গেই মনে রাখা দরকার যে, কৃষিকেন্দ্রিক সমাজে প্রকৃতিকে আয়ত্বে আনবার কল্পনায় এই যে অনুষ্ঠান এরই সঙ্গে নারীপ্রাধান্যের যোগাযোগও অত্যন্ত স্পষ্ট। তার কারণ, কৃষিকাজ মেয়েদের আবিষ্কার, তাই প্রাকৃত পর্যায়ের কৃষিকেন্দ্রিক সমাজ নারীপ্রধান এবং অতএব, কৃষিকেন্দ্রিক এই অনুষ্ঠানটিও নারীপ্রধান। অধ্যাপক জর্জ টম্সন(৪৯০) যেমন বলছেন :
the ritual for fertilising the soil was modelled on the ritual for reproducing the human species, that is the ritual of childbirth. The socialstatus of the women corresponded fo the importance of their part in the economic life. The community was ruled by female chiefs, whose sexual life was treated as a teremonial cycle of mimetic magic. The queen had to conceive in order that the earth might become fruitful.
জননী ও পৃথিবী এক। আদিম Earth-goddesses al Earth-mothers বা বসুমাতাগুলি এই বিশ্বাসেরই বিকাশ।
শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ(৪৯১) অনুমান করছেন, যে-বিশ্বাসটি থেকে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে আদিম বসুমাতা-পরিকল্পনার জন্ম সেই বিশ্বাসটিই আমাদের দেশের শাক্ত মতবাদকে বোঝবার মূলসূত্র। এবং লোকায়তিক ধ্যানধারণার উৎস-সন্ধানে অগ্রসর হয়ে আমরা দেখেছি, লোকায়তিক ধ্যানধারণাকে বোঝবার জন্য শাক্ত মতবাদের আদি-তাৎপর্য বোঝবার প্রয়োজন আছে। অতএব আমাদের পক্ষে ওই আদিম বসুমাতাগুলির কিছুটা পরিচয় পাবার চেষ্টা অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
——————
৪৪৭. R. Briffault 3:54-5.
৪৪৮. J. Frazer GB 28.
৪৪৯. Ibid. 28-9.
৪৫০. R. Briffault op. cit. 3.55.
৪৫১. Ibid.
৪৫২. Ibid.
৪৫৩. J. Frazer op. cit. 29.
৪৫৪. R. Briffault op. cit. 3:59.
৪৫৫. Ibid. 3:55.
৪৫৬. Ibid. 3:54.
৪৫৭. Ibid. 3:55. ৪৫.
৪৫৮. J. Frazer op. cit. 29.
৪৫৯. Ibid. 119.
৪৬০. W. Crooke op, cit. 242.
৪৬১. R. Briffault op. cit. 3:56.
৪৬২. W. Crooke op. cit. 242.
৪৬৩. Ibid.
৪৬৪. E. Thurston CTSI 1:144; 6:20, 355; 3:103; 7.193.
৪৬৫. Ibid. 3:103.
৪৬৬. Ibid. 7:226.
৪৬৭. B G xxiii (1884) 45.
৪৬৮. E. Thurston op, cit. 1:205.
৪৬৯. Ibid. 2:359.
৪৭০. Ibid. 4:364.
৪৭১. BG xii (1880) 117; xx (1884) 132.
৪৭২. H. H. Risley TCB 139.
৪৭৩. Ibid. 2201, 229.
৪৭৪. E. T. Dalton DEB 194; H. H. Risley TCB 2:102.
৪৭৫. R. Briffault op. cit. 3:55.
৪৭৬. Ibid. 3:54.
৪৭৭. Ibid. 3:57.
৪৭৮. Ibid. 3:54ff.
৪৭৯. বিশ্বকোষ ১৪:৫৫০ |
৪৮০. ঐ।
৪৮১. ঐ । ( শুদ্ধিপত্র দ্রষ্টব্য)
৪৮২. ঐ।
৪৮৩. R. Briffault 3:58,
৪৮৪. Ibid.
৪৮৫. Ibid.
৪৮৬. Ibid.
৪৮৭. Ibid.
৪৮৮. Ibid.
৪৮৯. J. Frazer op. cit. 136.
৪৯০. G. Thomson R 10.
৪৯১. R. P. Chanda op. cit. ch. iv.