[১৯০১ খ্রীঃ ৩১ মার্চ ঢাকায় পগোজ স্কুলের খোলা ময়দানে প্রায় তিন সহস্র শ্রোতার সম্মুখে স্বামীজী ইংরেজীতে বক্তৃতা দেন, নিম্নে তাহার বাঙলায় গৃহীত বিবরণী প্রদত্ত হইলঃ]
প্রাচীনকালে আমাদের দেশে আধ্যাত্মিক ভাবের অতিশয় উন্নতি হইয়াছিল। আমাদিগকে আজ সেই প্রাচীন কাহিনী স্মরণ করিতে হইবে। প্রাচীনকালের গৌরবের চিন্তায় বিপদাশঙ্কা এই যে, আমরা আর নূতন কিছু করিতে চাই না—কেবল সেই প্রাচীন গৌরব স্মরণ ও কীর্তন করিয়া কালাতিপাত করি। প্রাচীনকালে অনেক ঋষি ও মহর্ষি ছিলেন, তাঁহারা সত্য সাক্ষাৎ করিয়াছিলেন। কিন্তু প্রাচীনকাল স্মরণ করিয়া প্রকৃত উপকার লাভ করিতে হইলে আমাদিগকেও তাঁহাদের মত ঋষি হইতে হইবে; শুধু তাই নয়—আমার বিশ্বাস, আমরা আরও মহান্ ঋষি হইব। অতীতকালে আমাদের খুব উন্নতি হইয়াছিল, আমি তাহা স্মরণ করিয়া গৌরব বোধ করি। বর্তমানকালের অবনত অবস্থা দেখিয়া আমি দুঃখিত নই; ভবিষ্যতে যাহা হইবে, তাহা ভাবিয়া আমি আশ্বান্বিত; কারণ আমি জানি, বীজের বীজত্ব নষ্ট হইয়া তবে বৃক্ষ হয়। সেইরূপ বর্তমান অবস্থার অবনত ভাবের ভিতর ভবিষ্যৎ মহত্ত্ব নিহিত রহিয়াছে।
আমাদের জন্মপ্রাপ্ত ধর্মের ভিতর সাধারণ ভাব কি কি? আপাততঃ নানা বিরোধ দেখিতে পাই। মত সম্বন্ধে কেহ অদ্বৈতবাদী, কেহ বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী, কেহ বা দ্বৈতবাদী। কেহ অবতার মানেন—মূর্তিপূজা মানেন, কেহ বা নিরাকারবাদী। আবার আচার সম্বন্ধে তো নানা বিভিন্নতা দেখিতে পাই। জাঠেরা মুসলমান বা খ্রীষ্টান পর্যন্ত বিবাহ করিলেও জাতিচ্যুত হয় না। তাহারা অবাধে সকল দেবমন্দিরে প্রবেশ করিতে পারে। পাঞ্জাবে অনেক গ্রামে যে-হিন্দু শূকর ভক্ষণ না করে, সে মুসলমান বলিয়া বিবেচিত হয়। নেপালে ব্রাহ্মণ চারিবর্ণেই বিবাহ করিতে পারেন, আবার বাঙলা দেশে ব্রাহ্মণের অবান্তর বিভাগের ভিতরেও বিবাহ হইবার জো নাই। এইরূপ নানা বিভিন্নতা দেখিতে পাই। কিন্তু সকল হিন্দুর মধ্যে এই একটি বিষয়ের ঐক্য দেখিতে পাই যে, কোন হিন্দু গোমাংস ভক্ষণ করে না।
এইরূপ আমাদের ধর্মের ভিতরেও এক মহান্ সামঞ্জস্য আছে। প্রথমতঃ শাস্ত্রের কথা লইয়া একটু আলোচনা করা যাক। যে-সকল ধর্মের নিজস্ব এক বা বহু শাস্ত্র ছিল, সেই-সকল ধর্ম দ্রুত উন্নতির পথে অগ্রসর হইয়াছিল এবং নানাবিধ অত্যাচার সত্ত্বেও এতদিন টিকিয়া রহিয়াছে। গ্রীকধর্মের নানাবিধ সৌন্দর্য থাকিলেও শাস্ত্রের অভাবে উহা লোপ পাইয়া গেল, কিন্তু য়াহুদীধর্ম ওল্ড টেস্টামেণ্টের বলে এখনও অক্ষুণ্ণপ্রতাপ। হিন্দুধর্মও সেইরূপ। উহার শাস্ত্র ‘বেদ’ জগতের সর্বপ্রাচীন গ্রন্থ। উহার দুইটি ভাগ—কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড। ভারতের সৌভাগ্যেই হউক অথবা দুর্ভাগ্যেই হউক, কর্মকাণ্ড এখন লোপ পাইয়াছে। দাক্ষিণাত্যে কতকগুলি ব্রাহ্মণ মধ্যে মধ্যে ছাগবধ করিয়া যজ্ঞ করিয়া থাকেন, আর বিবাহ-শ্রাদ্ধাদির মন্ত্রে মধ্যে মধ্যে বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডের আভাস দেখিতে পাওয়া যায়। এখন আর উহাকে পূর্বের মত পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিবার উপায় নাই। কুমারিলভট্ট একবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু অকৃতকার্য হন। তারপর বেদের জ্ঞানকাণ্ড—যাহার নাম উপনিষদ্ বা বেদান্ত, উহাকেই ‘শ্রুতিশির’ বলা হয়। আর্যগণ যেখানে শ্রুতি উদ্ধৃত করিতেছেন, সেখানেই দেখা যায় যে, তাঁহারা এই উপনিষদ্ উদ্ধৃত করিতেছেন। এই বেদান্তের ধর্মই এখন ভারতের ধর্ম। যদি কোন সম্প্রদায় জনগণের মধ্যে নিজ মত দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত দেখিতে ইচ্ছা করে, তবে সেই সম্প্রদায়কে বেদান্তের দোহাই দিতে হয়। কি দ্বৈতবাদী, কি অদ্বৈতবাদী, সকলকেই তাই করিতে হয়। বৈষ্ণবগণ নিজেদের মত প্রমাণ করিতে ‘গোপালতাপিনী উপনিষদ্’ উদ্ধৃত করিয়া থাকেন। নিজের মনোমত রচনাবলী না পাইলে কেহ কেহ নূতন উপনিষদ্ রচনা পর্যন্ত করিয়া লন। এখন বেদ সম্বন্ধে হিন্দুগণের মত এই যে, উহা কোন পুস্তকবিশেষ বা কাহারও রচনা নহে। উহা ঈশ্বরের অনন্ত জ্ঞানরাশি—কখনও ব্যক্ত হয়, কখনও বা অব্যক্ত থাকে। সায়নাচার্য একস্থলে বলিয়াছেন, ‘যো বেদেভ্যোঽখিলং জগৎ নির্মমে’—যিনি বেদজ্ঞানের প্রভাবে সমুদয় জগৎ সৃষ্টি করেন। বেদের রচয়িতা—কেহ কখনও দেখে নাই; সুতরাং উহা কল্পনা করাও অসম্ভব। ঋষিগণ কেবল ঐ-সকল প্রত্যক্ষ করিয়াছেন। ঋষি অর্থাৎ দ্রষ্টা—মন্ত্রদ্রষ্টা, অনাদিকাল হইতে বিদ্যমান বেদ তাঁহারা সাক্ষাৎ করিয়াছিলেন মাত্র।
এই ঋষিগণ কে? বাৎস্যায়ন বলেন, যিনি যথাবিহিত ধর্ম প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করিয়াছেন, তিনি ম্লেচ্ছ হইলেও ঋষি হইতে পারেন। তাই প্রাচীনকালে বেশ্যাপুত্র বশিষ্ঠ, ধীবরতনয় ব্যাস, দাসীপুত্র নারদ প্রভৃতি সকলেই ঋষিপদ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। প্রকৃত উপায়ে এই ধর্মের সাক্ষাৎকার হইলে আর কোন ভেদ থাকে না। পূর্বোক্ত ব্যক্তিগণ যদি ঋষি হইয়া থাকেন, তবে হে আধুনিক কালের কুলীন ব্রাহ্মণগণ, তোমরা আরও কত মহান্ ঋষি হইতে পার! সেই ঋষিত্বলাভের চেষ্টা কর, জগৎ তোমাদের নিকট স্বতঃই নত হইবে। এই বেদই আমাদের একমাত্র প্রমাণ, আর ইহাতে সকলেরই অধিকার। ‘যথেমাং বাচং কল্যাণীমাবদানি জনেভ্যঃ। ব্রহ্মরাজন্যাভ্যাং শূদ্রায় চার্যায় চ স্বায় চারণায়॥’৮১ এই বেদ হইতে এমন কোন প্রমাণ দেখাইতে পার কি যে, ইহাতে সকলের অধিকার নাই? পুরাণ বলিতেছে, বেদের অমুক শাখায় অমুক জাতির অধিকার, অমুক অংশ সত্যযুগের, অমুক অংশ কলিযুগের জন্য। কিন্তু বেদ তো এ-কথা বলিতেছেন না। ভৃত্য কি কখনও প্রভুকে আজ্ঞা করিতে পারে? স্মৃতি, পুরাণ, তন্ত্র—এগুলির ততটুকুই গ্রাহ্য, যতটুকু বেদের সহিত মিলে; না মিলিলে অগ্রাহ্য। কিন্তু এখন আমরা পুরাণকে বেদের অপেক্ষা উচ্চতর আসন দিয়াছি। বেদের চর্চা তো বাঙলাদেশ হইতে লোপই পাইয়াছে। আমি শীঘ্র সেইদিন দেখিতে চাই, যেদিন প্রত্যেক বাটীতে শালগ্রামশিলার সহিত বেদও পূজিত হইবে, আবালবৃদ্ধবনিতা বেদের পূজা করিবে।
বেদ সম্বন্ধে পাশ্চাত্য পণ্ডিতদিগের মতে আমার কোন আস্থা নাই। তাঁহারা বেদের কাল—আজ এই নির্ণয় করিতেছেন, আগামী কাল উহা বদলাইয়া সহস্র বৎসর পিছাইয়া দিতেছেন। যাহা হউক, পূর্বে যেমন বলিয়াছি, পুরাণের যতটুকু বেদের সহিত মিলে, ততটুকুই গ্রাহ্য। পুরাণে অনেক কথা দেখিতে পাই, যেগুলি বেদের সহিত মিলে না। যথা, পুরাণে লিখিত আছে—কেহ দশ সহস্র, কেহ বা বিশ সহস্র বৎসর জীবিত রহিয়াছেন, কিন্তু বেদে দেখিতে পাই, ‘শতায়ুর্বৈ পুরুষঃ’—এখানে বেদের কথাই গ্রাহ্য। তাহা হইলেও পুরাণে যোগ ভক্তি জ্ঞান কর্মের অনেক সুন্দর সুন্দর কথা আছে, সেগুলি অবশ্য লইতে হইবে।
তারপর তন্ত্র। তন্ত্র শব্দের প্রকৃত অর্থ ‘শাস্ত্র’, যেমন ‘কাপিল তন্ত্র’। কিন্তু এখানে তন্ত্র শব্দ আমি উহার বর্তমান প্রচলিত সঙ্কীর্ণ অর্থে ব্যবহার করিতেছি। বৌদ্ধধর্মাবলম্বী রাজগণের শাসনে বৈদিক যাগযজ্ঞসকল লোপ পাইলে কেহ আর রাজভয়ে হিংসা করিতে পারিল না। কিন্তু অবশেষে বৌদ্ধদের ভিতরেই সেই যাগযজ্ঞের ভাল ভাল অংশগুলি গোপনে অনুষ্ঠিত হইতে লাগিল, তাহা হইতেই তন্ত্রের উৎপত্তি। তন্ত্রে বামাচার প্রভৃতি কতকগুলি ঘৃণ্য ব্যাপার বাদ দিলে—লোকে যতটা ভাবে, উহা ততটা খারাপ নহে। বাস্তবিক বেদের ব্রাহ্মণভাগই একটু পরিবর্তিত হইয়া তন্ত্রের মধ্যে বর্তমান। আজকালকার সমুদয় উপাসনা পূজাপদ্ধতি কর্মকাণ্ড তন্ত্রমতেই অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে।
এখন ধর্মমত সম্বন্ধে একটু আলোচনা করা যাক। ধর্মমতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিরোধসত্ত্বেও কতকগুলি ঐক্য আছে। প্রথমতঃ তিনটি বিষয়—তিনটি সত্তা প্রায় সকলেই স্বীকার করেনঃ ঈশ্বর, আত্মা ও জগৎ। ঈশ্বর অর্থাৎ যিনি জগৎকে চিরকাল সৃজন, পালন ও লয় করিতেছেন; সাংখ্যগণ ব্যতীত আর সকলেই ইহা স্বীকার করেন। আত্মা—অসংখ্য জীবাত্মা কর্মফলে বারবার শরীর পরিগ্রহ করিয়া জন্মমৃত্যুচক্রে ভ্রাম্যমান; ইহা ‘সংসারবাদ’—সাধারণতঃ ইহাকে ‘পুনর্জন্মবাদ’ বলে। আর রহিয়াছে এই অনাদি অনন্ত জগৎ। এই তিনকে কেহ একেরই বিভিন্ন অবস্থা, কেহ বা সম্পূর্ণ পৃথক্ তিনটি সত্তা বলিয়া মানিলেও সকলেই এই তিনটিতে বিশ্বাস করেন।
এখানে একটু বক্তব্য এই যে, আত্মাকে হিন্দুরা চিরকাল মন হইতে পৃথক্ বলিয়া জানিতেন। পাশ্চাত্যেরা কিন্তু মনের উপর আর উঠিতে পারেন নাই, পাশ্চাত্যগণ জগৎকে আনন্দপূর্ণ এবং সম্ভোগ করিবার জিনিষ বলিয়া জানেন; আর প্রাচ্যগণের জন্ম হইতে ধারণা—সংসার দুঃখপূর্ণ, উহা কিছুই নয়। এইজন্য পাশ্চাত্যেরা যেমন সঙ্ঘবদ্ধ কর্মে বিশেষ পটু, প্রাচ্যেরা তেমনি অন্তর্জগতের অন্বেষণে অতিশয় সাহসী।
যাহা হউক—এখন হিন্দুধর্মের আর দু-একটা কথা লইয়া আলোচনা করা যাক। হিন্দুদের মধ্যে অবতারবাদ প্রচলিত। বেদে আমরা কেবল মৎস্য-অবতারের কথা দেখিতে পাই। যাহা হউক, এই অবতারবাদের প্রকৃত তাৎপর্য মনুষ্যপূজা—মনুষ্যের ভিতর ঈশ্বর-দর্শনই প্রকৃত ঈশ্বর-সাক্ষাৎকার। হিন্দুগণ প্রকৃতির মধ্য দিয়া প্রকৃতির ঈশ্বরে যান না—মনুষ্যের মধ্যে দিয়া মনুষ্যের ঈশ্বরে গিয়া থাকেন। তারপর মূর্তিপূজা—শাস্ত্রোক্ত পঞ্চ উপাস্যদেবতা ব্যতীত সকল দেবতাই এক-একটি পদের নাম, কিন্তু এই পঞ্চদেবতা সেই এক ভগবানের নামমাত্র। এই মূর্তিপূজা আমাদের সকল শাস্ত্রেই অধমাধম বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে, কিন্তু তাই বলিয়া উহা অন্যায় কার্য নহে। এই মূর্তিপূজার ভিতরে নানাবিধ কুৎসিত ভাব প্রবেশ করিয়া থাকিলেও আমি উহার নিন্দা করি না। সেই মূর্তিপূজক ব্রাহ্মণের পদধূলি যদি আমি না পাইতাম, তবে কোথায় থাকিতাম! যে-সকল সংস্কারক মূর্তিপূজার নিন্দা করিয়া থাকেন, তাঁহাদিগকে আমি বলি—ভাই, তুমি যদি নিরাকার-উপাসনার যোগ্য হইয়া থাক, তাহা কর; কিন্তু অপরকে গালি দাও কেন?
সংস্কার কেবল পুরাতন বাটীর জীর্ণসংস্কারমাত্র। সেটুকু হইয়া গেলে সংস্কারের আর প্রয়োজন কি? কিন্তু সংস্কারকদল এক স্বতন্ত্র সম্প্রদায় গঠন করিতে চান। তাঁহারা মহৎ কার্য করিয়াছেন। তাঁহাদের উপর ভগবানের আশীর্বাদ বর্ষিত হউক। কিন্তু তোমরা নিজদিগকে পৃথক্ করিতে চাও কেন? হিন্দু নাম লইতে লজ্জিত হও কেন? আমাদের জাতীয় অর্ণবষানে আমরা সকলে আরোহণ করিয়াছি—হয়তো উহাতে একটু ছিদ্র হইয়াছে। এস, সকলে মিলিয়া উহা বন্ধ করিতে চেষ্টা করি, না পারি একসঙ্গে ডুবিয়া মরি।
আর ব্রাহ্মণগণকেও বলিঃ তোমরা আর বৃথা অভিমান রাখিও না, শাস্ত্রমতে তোমাদের ব্রাহ্মণত্ব আর নাই; কারণ তোমরা এতকাল ম্লেচ্ছরাজ্যে বাস করিতেছ। যদি তোমরা নিজেদের কথায় নিজেরা বিশ্বাস কর, তবে সেই প্রাচীন কুমারিলভট্ট যেমন বৌদ্ধগণকে সংহার করিবার অভিপ্রায়ে প্রথমে বৌদ্ধদের শিষ্য হইয়া শেষে তাহাদিগকে তর্কে পরাজিত করিয়া অনেকের মৃত্যুর কারণ হন এবং প্রায়শ্চিত্ত-স্বরূপ তুষানলে প্রবেশ করেন, সেইরূপ তোমরা সকলে মিলিয়া তুষানলে প্রবেশ কর; যদি তাহা করিবার সাহস না থাকে, নিজেদের দুর্বলতা স্বীকার করিয়া সর্বসাধারণকে সাহায্য কর, তাহাদের নিকট জ্ঞানের দ্বার উন্মুক্ত কর এবং পদদলিতদের আবার ন্যায্য ও প্রকৃত অধিকার দাও।